ছোটগল্প: আলো অন্ধকারে যাই

[এই গল্পটি মাস তিনেক লিখেছিলাম ব্লগ সূত্রে পরিচয় হওয়া (সিসিবি না) এক বন্ধুর প্রয়ান দিবসে। সেটাকে একপাশে সরিয়ে আলাদা গল্প হিসাবেও এটাকে পড়া যায়। সত্যিকার অর্থে গল্পটা লিখার জন্য আরও সময় আর মনযোগ দাবি করে। অনেককাল ধরে কিছু লিখি না বলে সবটুকু দেয়া গেল কিনা বলা মুশকিল। ভাবলাম গল্পটি আমার সিসিবির পাতায়ও থাক। সময় পেলে আবার এডিট কোরা যাবে। গল্পটিতে সময়ক্রম ইচ্ছা করেই ডিসরিগার্ড করা হয়েছে।]

বরফের কৃষ্ণচূড়া

আরেকটু উঠলেই চূড়ায় পৌঁছে যাব আমরা। আসলেই কি তাই! হোক বা না হোক সেটা, অদেখার সন্ধানে চূড়ার দিকে ছুটে চলাই আমাদের নিয়তি। আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু অনুভব করতে পারছি নিজেদের উপস্থিতি। অথচ এই টানকে অগ্রাহ্য করে আমরা ছুটে চলেছি ক্রমাগত। আরেকটু এগুলেই হয়ত নতুন কিছু দেখব। এমন সময়, হঠাৎ করেই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল ঝুমঝুম অন্ধকার ভেদ করা মৃদু আলোর ঝলসানিতে। আমাদের বিপরীতের উঁচু পাহাড়ের উপরের বরফ সূর্যের আলোর ঝলকে কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটেছে যেন। আমরা দুজনেই তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। যাকে ভালোবাসি, বন্ধুর পথ তাকে নিয়ে হাঁটা যায়, চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য তাকে নিয়ে দেখা যায়। আমি আমার পাশের জনকে নিজের মত সাজিয়ে নিলাম, কিন্তু পাশের জন তার মত করে আমাকে বদলে অন্য মানুষকে বসিয়ে দিল কি?

স্বপ্ন অথবা বিভ্রম

বৃষ্টির দিনে আলো আঁধারি থাকে। কিছুটা বৃষ্টি হয়ে যাবার পরে আকাশ এক ধরণের ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। এই আলোকে মিলির কাছে স্বর্গীয় মনে হয়। এই আলো তার মাঝেকার অনেকগুলো আবরণকে উম্মুক্ত করে দেয়। এই সময়টায় সে নিজেকে দাঁড় করায় নিজের সামনে। ছোটবেলায় কারণে অকারণে বৃষ্টিতে ভেজা ছিল তার স্বভাব। তার ছোট বোন এটার নাম দিয়েছিল হুমায়ুন প্রভাবিত ফ্যান্টাসি। কথার মাঝে যে সত্যতা নেই সেটাও নয়। তবে এই আদিখ্যেতাই তাকে খোঁজ দিয়েছে সেই বিষণ্ণ সুন্দর আলোর। পরে অনুভব করে এই আলোর সুরভি আসলে মধ্যরাতের সূর্যের আলোর মত। বৃষ্টির পরিবর্তে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সে আবিষ্কার করে মেরুর কাছের কোন পাহাড়ের উপরে, যেখানে তার চারপাশ মধ্যরাতের সূর্যের আলোকচ্ছটায় ভেসে যায়। এই আলো মোলায়েম স্নিগ্ধ রহস্যময়। এই আলোয় মনের ভেতরকার আবেগ গুলো জোয়ারের সময়কার সাগরের মত ফেপে উঠে। তার একজন অজানা বন্ধুর কাছে সে নিজের আবেগ প্রকাশ করে। সেই বনধুর অবয়ব অনুভূত হলেও, চেহারায় জায়গা নিয়ে দ্বিধা কাজ করে। সময়ের সাথে সাথে চেহারাগুলো বদলে যায়। মাঝে মাঝে সেই চেহারা দেখে নিজেই গভীরভাবে চমকে উঠে। নিজের প্রিয় মানুষের হাত ধরে একদিন এই আলোতে ভিজবে এমন ভাবনায় সে একই সাথে স্বপ্নাতুর ভাবালু বিষণ্ণ ও আবেগী হয়ে উঠে। তার সঙ্গীর অবয়বে থাকা মানুষটির মুখছবি আবছা হতে ক্রমশ স্পষ্ট হয় তার কাছে। মধ্যরাতের আলোতে সেই মানুষটির সাথে আত্মার যোগাযোগ তার বাড়তে থেকে প্রতিনিয়ত।

কোন বৃষ্টিভেজা দুপুরের স্মৃতি তার ভাবনাকে আঁটকে ফেলে। পরিকল্পনা ছাড়াই কাকভেজা হয়ে যায় সেদিন। তবে সেদিন তার সাথে আরেকজন মানুষও এটে গিয়েছিল নিয়তির ফাঁদে। অনির্ধারিত বৃষ্টিভেজার সঙ্গীটির সাথে চা খাবার সময়েই আকাশ হতে নিশি-আলোয় সেই অবয়বকে দেখে সে চলে যায় তার কল্পনা ও বাস্তবের সীমারেখায়।

সেই স্মৃতি মনে করতে করতে নিজের অজান্তেই বলে উঠে মিলি, “তাকে ভালোবাসার কথা এমন আলোতে মধ্যরাতে জানাব।”

অতৃপ্তি অথবা আক্ষেপ

জীর্ণ হয়ে যাওয়া ঘরটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে আধা ভাঙা অবয়বে মলিন চেহারা নিয়ে। তার সামনে বসে থাকা সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলেটি তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। নাহ, কারো কোন সাড়া শব্দ নাই। অথচ এক সময় এই জায়গাতেই বিকেলটা জমে উঠত তার বন্ধুদের আনাগোনায়। সেই সময়টার স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে আপাতত ধ্বংসস্তুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই টং দোকানটি। লাটু আর বল একই সাথে তার চিন্তায় চলে আসে অবধারিত ভাবে। সেই প্রতিবার দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় তার শিশু মন লাটুর জন্য আক্ষেপ করত। ব্যাপারটা এখন তার কাছে কিছুটা কৌতুককর মনে হলেও সেই সময়ের বাস্তবতায় লাটুর জন্য আক্ষেপ আর বলের প্রতি অতৃপ্তি হয়তবা ভুল ছিল না। বলের নিয়ে খেলতে গিয়ে তার পিছে ছুটে ছুটে সে ক্লান্ত হোয়ে উঠেছিল। লাটু থাকলে তার পাশে বৃত্তায়িত হত এমন ভাবনা স্বার্থপরের মত ঠেকলেও তার প্রয়োজন সে বোধ করছিল সময়ে অসময়ে। দোকানের সামনে দোলনায় বসে তার চোখে সেদিনগুলো ভেসে উঠে। বলটিকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সে দোকানে অবিক্রিত লাটুর দিকে তাকিয়ে থাকত। প্রতিদিন অল্প অল্প করে সে বলের পরিবর্তে লাটু চাইছিল। অথচ বৃত্তায়িত লাটুকে একঘেয়ে ভেবেই সে একদিন বলটাকে কিনে নিয়েছিল বিজয়ের আনন্দে।

আলো ঝরা সায়াহ্ন

পথ চলতে চলতে আমরা এখানে এসে থামব সেটা ভাবি নি। অদ্ভুত এক আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন। একটা ছোট টিলার মত জায়গা। তার উপরের গাছেরা আলোকে ছেকে বিশুদ্ধ করে ছড়িয়ে দিয়েছে আমাদের চারপাশে। তার হাত ধরে হাঁটা যায় এমন আলোর নিচে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে নিচে এসে দাঁড়াই। টলটলে পানি নিয়ে চুপ হয়ে বসে আছে একটি হ্রদ। কোন তাড়াহুড়া নেই কোথাও। আশেপাশে মানুষ নেই, লোকালয় নেই, তবুও হুট করেও গির্জায় বারোবার ঘন্টা বেজে উঠে।

অভিসারী আলোকবর্তিকা

ঠান্ডা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই শহরে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে বেশ আগেই। লোকজন কমে গেছে। এইদেশে ছিন্নমূল মানুষ নেই। থাকলে বিপদ হত বেশ। অন্ধকার ঠান্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে তুষার নামল। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। হেঁটে চলে মিলি। তার কেমন মুক্তি বোধ হচ্ছে। একদিন সে এইদেশে এসেছিল নিশিরোদ দেখতে, তার পরিবর্তে সে আর আটকে গেছে পোলার নাইটে। অন্ধকারের ও গন্ধ রূপ রস আছে। আলোর অপর পিঠ অন্ধকার। পোলার নাইট মিডনাইট সান বিপরীত হয়েছে কোথাও সংযুক্ত। সেই সংযুক্তির দিকে এগিয়ে চলেছে যেন সে। তুষার ক্রমশ বাড়ছে। এই দিন গুলোতে পরাবাস্তবতার ঝলক দিয়ে নর্দার্ন লাইট আসে। অন্ধকার বরফ ঠান্ডা সব উপেক্ষা করে মিলি তাকিয়ে থাকে অতিপ্রাকৃত আলোর দিকে। সেই আলো মুক্তির আলো, শান্তির আলো, ভালোবাসার আলো।

অপসৃয়মান অসমতা

দুজনের পথচলা কেবল নিজেদের মাঝেকার অসমতাকে কমাবার প্রচেষ্টায়। অথচ সেই চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে ফেলি আরেকজনের ভালো লাগা আমার আমি কে। পথচলা বন্ধুর হওয়া কষ্টের নয়, ক্লান্তিকর হওয়াটা বিপজ্জনক। সেটা ক্রমশ আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় নিজেদের সামনে। নিজেদের ভুলগুলোকে আমরা তীব্রভাবেই প্রত্যাখ্যান কোরি। এভাবেই আমরা পথচলতে থাকি কেবল দায়িত্বের নিমিত্তে। এভাবে আমরা হারিয়ে যাই, ভালোবাসা হারিয়ে যায়। অথবা আমরা বুঝতে পারি আসলে ভালোবাসা ছিল না কখনও আমাদের। দুজনের পথ অপসারী হতে চাইলে আমরা প্রাণপণে টেনে ধরি। এইটুকু বাদ দিয়ে ভালোবাসার খোঁজ টুকু কি জরুরি না।

দীপা আজ মন খারাপ। তার আজ খুব করে মন চাইছে নিশি-রোদ দেখবার। সেই অপার্থিব আলো যা ছবিতে ভিডিওতে দেখেছে।

‘চা চলবে?’ — অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকায় দীপা।

আপাত সুখী ক্লান্তিকর দিনের মাঝেও এমন মুগ্ধতার জন্যই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

তারও কিছু পরে, দুজন মানব মানবীকে বাচ্চাদের মত কাঁদতে দেখা যায় অন্য আরেকজনের অপ্রতিভ স্বরের কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড শুনে।

আকর্ষণ অথবা অবহেলা

লাটু অথবা বল? সিদ্ধান্তটা কঠিন মনে হয় তার কাছে। অথচ এমন প্রশ্ন শুনলে তার বয়সী সবারই ভ্রু কুচকে উঠার কথা। বল খেলার আনন্দের সাথে লাটুর তুলনা কোথায়? বল খেলাটা তার খারাপ লাগে না। তবে সেটা যতটা স্বতঃস্ফুর্ত তার চেয়ে অনেক বেশি আরোপিত। তুলনায় লাটু কে তার কাছে রহস্যময় মনে হয়। ভালো লাগার জিনিসকে জয় করবে নাকি সবচেয়ে ভালো জিনিসকে জয় করবে? লাটু দিয়ে খেলাটা সবাই পারে না অথবা পারার দরকার মনে করে না। বেশিরভাগের কাছেই অনাকর্ষণীয় লাটুকে বেছে নিলে তার বন্ধুরা হতাশ হবে। তারা সবাই চায় বাবলু উপহার হিসাবে বল নিক। পড়ন্ত বিকেলে জয়ের সাথে পাশাপাশি দোলনায় দুলতে দুলতে বাবলু তার লাটুর প্রতি সাময়িক আগ্রহের কথা জানায়। জয়ের দৃষ্টিতে হতাশার চাইতে বেশি ছিল বিস্ময়। পাশের দোলনার দিকে তাকিয়ে সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে। লাটু বল বিষয়ক দ্বিধা চোলে গিয়েছিল সেদিনই। মিডিওক্রিটি কে অতিক্রম করবার দুর্নিবার আকর্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তারও অনেক পরে, তাদের খেলাঘরের পাশে পুরনো পাচিলের আঁধারে হারিয়ে যাওয়া বল খুঁজতে গিয়ে হাপিয়ে উঠে বাবলু। অন্ধকার থেকে উপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বিভ্রম হয় বাবলুর। আকাশের রহস্যময় আলো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আলোর তীব্রতা ভেদে সেখানে অজানা অনেক অবয়ব ধরা পড়ে তার চোখে। পাচিলের ধাঁধাঁতে জ্ঞান হারাবার আগে আকাশের বুকে অন্যান্য অবয়বের মাঝে লাটু আর বলকেও আর চোখে পড়ে তার।

বিষণ্ণতা

‘আমি তোমার দূরে থাকি কাছে আসব বলে,
আমি তোমার কাছে আসি না, দূরে যেতে হবে বলে’

গানটা আমি প্রতিদিন শুনি। তারপরে আমার এই স্বপ্নমঞ্চে ঢুকে যাই। আট ফুট বাই আঠার ফুটের এই ঘরটি স্টোর হিসাবেই বেশি উপযোগি। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে সিলিংয়ে বাইরের আলোকে গল্প লিখি। আমি প্রতিদিন একটা গল্পকেই নানাভাবে নানা ঢঙে বলি। গল্পটা এক জায়গায় এসে আটকে যায়। কিছু অনুভূতি আমাকে বিষণ্ণ কোরে। তারপরে নানাভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে স্বপ্ন আঁকি সিলিংয়ে। তখনই আমি বুঝি আমার এই শব্দ অপচয় কোরবার মানে নেই। আমার মাথায় ঘোরে

“স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!”

অন্ধকার আলো হাত ধরে চলে। অন্ধকারের মাঝেও এক ধরণের নেশা আছে। অন্ধকার একটু তরল হলে ধূসর হয়। ধূসর রঙের মাঝে রহস্যময়তা আছে। ধূসর আর রূপালি আসলে একই অনুভূতির দুই রূপ। অথবা রূপালিকে ভালবেসেও ধূসরকে অগ্রাহ্য করা যায়। রূপালি শুনলেই তার চেহারা ছবি ভেসে উঠে। প্রেম নয় মোহ নয় অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে। আধো অন্ধকারেই রান্না ঘর থেকে চায়ের কাপ টেনে নেই। চায়ের ধোয়া উঠা ঘ্রাণ আমার নাকে মুখে চলে যায়। চায়ের গন্ধ কোন এক মানুষের স্পর্শ গন্ধের কথা ফিরিয়ে আনে। বাইরের আকাশের দিকে তাকাবার চেষ্টা করি। বিদঘুটে একটা রঙ হয়ে আছে। চা চুমুক দেবার পরেও মাথা টনটন করছে। দিনের পর দিন এইভাবে কেটে যায়।

দ্বিধা অথবা ত্যাগ

— গুড মর্নিং। তোর চা।

মিলির ডাকে আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসে দীপা।

প্রতি ছুটির সকালেই মিলি তাকে চা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। দীপা চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিলির দিকে তাকায়। মিলির চেহায়ার ক্লান্তির চাপ স্পষ্ট। নির্ঘুম রাত যাপনের চাইতে ক্লান্তির কারণ সম্ভবত ভিন্ন। গতকাল রাতে তারা দুজনে বারান্দায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে। কাজ, ক্যারিয়ার পার হয়ে অন্য কোন বিষয়ে ঠিক কী কথা হল সেটা এই গল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ন না হলেও মিলি জেনেছিল তাদের সম্পর্ক বদলে গেল চিরকালের মতই। মিলি তার নরওয়ে যাবার গল্প বলেছিল। দীপা জানিয়েছিল তার ভালোবাসার মানুষ গমগমে গলার আবৃত্তিকার ছেলেটার কথা। মিলির মাথায় সাথে সাথে বাজতে থাকে ছেলেটির কন্ঠের আবৃত্তি

“সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ ?
আমার পথেই শুধু বাধা?”

আপন মনেই ভাবে, কথাটা কি তার জন্যও প্রযোজ্য। হয়তো প্রকাশ করবার দরকার ছিল অনেক কিছুই। দীপার জন্য খুশি হওয়ার কথা ছিল তার। অথচ কী কারণে আনন্দের প্রকাশটা স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে উঠে না। দীপার সাথে তার সম্পর্ক বেস্ট ফ্রেন্ডের চাইতেও বেশিই ছিল। নিজেদের মাঝে আড়াল ছিল না, গোপনীয়তা ছিল না। তার অন্তর্মুখী রহস্যময়তার সাথে দীপার সাবলীল প্রানোচ্ছলতার রসায়নে তারা খুব দ্রুতই নিজেদের কাছে এসেছিল। রায়হানের তাদের দুজনের জীবনে আসবার পরেই কি তবে সম্পর্কের দেয়াল তৈরি হতে থাকল ধীরে ধীরে। অথচ রহস্যময় ভাবেই দীপাকে মিলি জানিয়েছিল, তার নিশিরোদ প্রীতি আর পছন্দের মানুষের সাথে নিশিরোদে হাত ধরে হেঁটে বেড়ানোর স্বপ্নের কথা। রোদ কবিতা ভালোলাগা, আর ছন্দবদ্ধ শব্দ কারও প্রতি তার দুর্বলতার গল্প হেঁয়ালি হয়ে আটকে যায় যোগাযোগের স্বল্পতায়।

কী হলো? কী ভাবিস?

দীপার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে মিলি। দীপার সারল্য মাখা আনন্দ কিছুক্ষণের জন্য তাকে তার ব্যাক্তিগত বিষাদগ্রস্ততাকে ঢেকে দেয়। হাসতে হাসতে বলে, নরওয়েতে রাতের আকাশে সূর্য হাসে। তোর ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সেটা দেখতে আসার আমন্ত্রণ রইল।

হতাশা

প্রতিদিন অল্প অল্প করে মরে যায় রায়হান। মানুষের মৃত্যু সম্ভবত তার ভালোলাগার সম্পর্কের ইতিতেই ঘটে। অথবা ব্যাপারটা শুধু সম্পর্ক নয়; যখন একসাথে যাপিত জীবনের গুরুত্বের অসমতা তৈরি হয়। একই পথে দুজন চলবার পরে নিজের পছন্দের পথটা যদি অপরের কাছে বিস্মৃত হয় তুচ্ছতার জন্য। শারীরিক মৃত্যুর অনেক আগেই আসলে আমরা মারা যাই সম্পর্কের মৃত্যুতে। প্রতিদিন নিজেকে অন্যের কাছে মেরে ফেলি, অন্যরা আমাকে মেরে ফেলে। আমরা নিজেদের খাই, সময় সময়কে খায়। এসব কথা অজান্তেই ই বিরবির করতে করতে সিগারেট ধরায় বাবলু। ভালোবাসার মৃত্যুতে কষ্ট বোধ হয়। একসময় যে পাশে দাড়িয়ে থাকলে মাথার ভেতরে আরামদায়ক ঠান্ডা অনুভূতি হত, আজ তার উপস্থিতি কাচের উপর ছুরি ঘরার শব্দের মত অসহ্য মোনে হয়। দূরে কোথাও পাতা খসার শব্দ হয়। ঝরা পাতার দিকে তাকিয়ে এক ধরণের শূন্যতার অনুভূতি হয় রায়হানের। চিরকাল নিজের মিডিওক্রিটিকে অস্বীকার করে সেরা হয়ে উঠবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার অসাড়তা তার কাছে ধরা পড়ে। বাবলু থেকে রায়হান চৌধুরি হতে গিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে গেছে এতটি বছর। এতটা বছর পরে আজ সে কতটা রায়হান কতটা বাবলু সে নিজেও জানে না। হাতের সামনে থাকা মোমবাতির আলোর দিকে তাকিয়ে সিগারেটের একরাশ ধোয়া ছাড়ে। দীপার দীপ্তিতে দীপ্যমান হওয়া কী আসলেই তার নিয়তি ছিল? রায়হান না হয়ে বাবলু থাকলে সে হয়তো বা একদিন তার পাশে বৃত্তায়িত হওয়া মানুষের সান্নিধ্যে মিডিওকার অথচ তৃপ্ত হতে পারত।

গৃহত্যাগী কুয়াশা

ভালোলাগার মানুষের হাত ধরে বন্ধুর পথে হাঁটা যায় অবলীলায়। রাত আর দিন মিলে যায় রহস্যময় ধূসর অথবা রূপালি সময়ে। বাইরের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকে মিলি। বিদ্যুত না থাকায় তা হয়ে উঠেছে আরো বেশি রহস্যময়। হাতের লেখা চিঠিটা সাথে নিল। এই যুগে কেউ চিঠি লিখে না। ইমেইলে কাজ চালানো যেত। কিন্তু এই চিঠিটা বিশেষ বলেই নিজের ছোঁয়া গন্ধের সবটুকু দিয়ে দিয়েছে এখানে। তার মাথায় বেজে চলে কিছুক্ষণ রেকর্ড করা নিজের আবৃত্তির লাইনগুলো:

“সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,-পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা – প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয় !”

কুয়াশার বুকে এগিয়ে চলে মিলি চিঠিটা ডাকে ফেলে হাঁটতে থাকে পথ। গল্পের শেষ অথবা নতুন গল্পের শুরু এখানেই।

১০২ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।