০.
আর কিছুদিন যাক না এমন আরো একটু আশা
এই পৃথিবীর মানুষগুলো বুঝবে আমার ভাষা।
এমন একটা গান আছে।
১.
মাঝে মাঝে কাকতালীয় ঘটনা ঘটে আমাদের জীবনে। কেন ঘটে সেটা আমরা বুঝতে পারি না বলেই হয়তো সেগুলো কাকতালীয়। আমার বিশ্বাস, সবকিছুই একটা বৃহত্তর নকশার অংশ। এখানে ‘বিশ্বাস’ কথাটা বলার কারণ এই যে এটা আমি প্রমাণ দেখাতে পারবো না। অসংখ্য ঘটনা তুলে আনতে পারি যেগুলো কাকতালীয় ঘটনার পেছনে কারণটাকে ব্যাখ্যা করবে। এবং এটা বুঝিয়ে দিবে যে এগুলো ঘটেছে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্যসাধনে। তবে তাতে পুরোপুরি বিষয়টা প্রমাণ হয় না। কেবল একটা কুযুক্তির উদাহরণ হয়ে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে।
আমি প্রায়ই আজে বাজে উপমা ব্যবহার করি। এটা নিয়ে আমাকে অনেক কথা আর প্রশ্ন শুনতে হয়। এরকম উদ্ভট উপমা কেনো খাপ-না-খাওয়া চেহারা নিয়ে ঝুলতে থাকবে। বেশিরভাগ সময়েই আমি নিজের কাজকর্মের ব্যাখ্যা দিতে পারি না, লেখার তো আরও পারি না। তবে উপমার ব্যাপারে আমরা একজন বেখাপ্পা কবিকে চিনি যিনি অনায়াসেই আমাদের কাছে অনুমতি পেয়ে যান বিদঘুটে উপমা যথেচ্ছা বসিয়ে দেবার…
তার সাথে আমার পরিচয়ের শুরুতে আমি তাকে খুব বেশি পছন্দ করি নি। শৈশবের অভ্যাস মানুষ সহজে ছাড়তে পারে না, সেটা পাঠের অভ্যাসের বেলায় আরো বেশি খাটে। ছড়াটে ছন্দ আর মাপা মাপা মাত্রা মাথায় কাঁথার মত সেলাই হয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি পড়তো তখন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ এভাবেই ভাবতাম আমি। গ্রামে বেড়াতে গেলে নদীর পারে বসে “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে” ভুস করে শুশুকের মতো ভেসে উঠতো। তারপরে আমি বাংলা মাস হিসেব করে মেলানোর চেষ্টা করতাম– এখন আসলে বৈশাখ, তাই নদীতে হাঁটু জল। তারপরে আরেক কবি এসে বললেন, সবাই বেশ সমান, নর এবং নারী। আমি ছোট ছোট কিশোর চোখে বোঝার চেষ্টা করি, কেন আমার পাতে বড়ো মুড়োটা পড়ে আর বোনের পাতে লেজ! এভাবে আমি অভিযোজিত হই, আমার সামাজিকীকরণ ঘটে।
এই পর্যায়ে আমার সাথে সেই বেখাপ্পা কবির পরিচয় হয়। তিনি বেশ মৃদুমন্দ, মোটেও সুরেলা নন। আর নিদারুণ দারুণ কাঠখোট্টা। তার নদীটার নাম ধানসিঁড়ি, তার পাখিটি হলো কালো শালিখ! আর বিদঘুটে উপমায় তার জুড়ি নেই- মাঠের ঘাসের মাঝে তার প্রেমিকার চুল আর ঘাম মিশে থাকে, প্যাঁচার ডাকের ভেতরে জীবন (নাকি মরণ) থরে থরে জমে আছে নাকি! এতোটা বিক্ষুব্ধ রচনায় স্বভাবতই মন বসেনি, হাতে পেতে দুয়েকটা যা কবিতা পড়লাম, ছন্দ মেলে না ঠিকঠাক। তারপরে দেখি মাত্রার নাম সনেট (এ কি বিদেশি গোলোযোগ!)। দূরে সরে গেলেন ম্রিয়মাণ কবি চুপিচুপি। দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এলেন ছাড়পত্র নিয়ে অভিযাত্রিক কবিগণ। তার সাথে আমার ফের দেখা আরো অনেক বছর পরে। … কাকতালীয় নিয়ে বলছিলাম, আসলেই সবকিছু একটা নির্দিষ্ট ছকেই ঘটে বুঝি। তিনি যখন আবার ফিরে এলেন, তার সাথে পরিচয়ের উদ্ভাসে আমিই ভেসে গেলাম। চোখের ওপরে যেন রঙিন কাচ আটকে ছিল, যা দেখছিলাম সব সেপিয়া-পয়েন্টে ঈষৎ বাদামি হয়ে ছিলো। তিনি এসে সেই কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন।
এই কাজটি তিনি খুব সুচারুভাবেই করেছেন, বেশ “সহজ” উপায়ে। আসলেই কাজটি সোজাসরল– আমি বুঝলাম।
“আমার এ গান
কোনোদিন শুনবে না তুমি এসে-
আজ রাত্রে আমার আহবান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে-
তবুও হৃদয়ে গান আসে!”
বয়ঃসন্ধি কেটে গেলে যেভাবে ঘুম ভেঙে যায়, দুই বেণি ছেড়ে ক্লাসের শীর্ণ মেয়েটি যখন একটা বেণি করে আসলো প্রথম সেটা আমার নজর এড়ায়নি। চোখ খোলাই ছিল, সেখানে মেয়েটির ওড়নার প্রান্ত হু হু করে মগজে সেঁধিয়ে গেলো। সেসময় কানের পাশে তিনি মৃদুস্বরে বললেন এই মেয়েটি তোমার গান কোনোদিনই শুনবে না। তবু তুমি পৃথিবীর কানে, নক্ষত্রের কানে কানে গান গাইবে। এ যেন এক মহান নিরুপায় শাস্তি– তোমাকে এই গান গাইতেই হবে। সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না, তিনি বড়ো জ্বালালেন। দু’চোখে মণিমুক্তোর মতো দৃশ্যগুলো ভরে দিতে লাগলেন। দেখলাম পঁচিশ বছর পরে আমাদের আবার দেখা হয়েছে। মেয়েটি মধ্য চল্লিশের ভারি শরীর, পাতলা হয়ে আসা চুল নিয়ে সেদিন সামনে দাঁড়ালো। আমিও বুড়িয়ে গেছি, হাতের উল্টোপিঠের দাগগুলো মুখের ভাঁজে ভাঁজে, চোখের কোনায় কোনায় উঠে এসেছে। আমাদের মাঝে কোনো ভণিতা নেই- কৈশোরের নির্মলতা হারালে মানুষ কেমন অথর্ব আর ক্ষয়াটে হয় যায় সেই চেহারা নিয়ে কবি দাঁড়ালেন সামনে, আমাদের মাঝখানে। হলদে তৃণ আর কুয়াশা ভরা মাঠের মাঝে আমি মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ালাম। কবির চোখে দিব্যি দেখলাম, ম্রিয়মাণ মুখে কী তীব্র জ্বলজ্বলে আলো!
২.
এই কবির জীবন এবং কবিতা নিয়ে বহু বহু কথা হয়েছে। গত সত্তুর বছরে কবি বুড়িয়ে গেছেন, মরেও গেছেন অন্যমনস্ক হাঁটতে হাঁটতে। তার কবিতাগুলো বার বার বইয়ে বাঁধাই হয়ে সকলের বাসার শেলফে জায়গা করে নিয়েছে। তার কবিতার সবচেয়ে বেশি ব্যবচ্ছেদ হয়েছে, খাতায়, পাতায়, পত্র-পত্রিকায়, আড্ডায়, আলোচনায়, ভাষণে। কবি বেঁচে থাকলে কী করতেন? অথবা তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, তখন কী ভাবতেন তিনি মরে গেলে তাঁকে নিয়ে এমন মেতে উঠবে একটা জনপদ? তার জন্যে কাতর রাত নির্ঘুম কাটবে কোনো কিশোরের। মধ্যবয়েসী একজন কেউ প্রবল হতাশ রাতে ঘরের বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবে, আর সেই গনগনে ফুলকিতে দেখবে একটা প্যাঁচা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে! তখন তার মনে পড়বে একজন কবি ছিলেন যার কাছে এই প্যাঁচা কত অবলীলায় উপমা হয়ে গেছে মানুষের। আমার সাথে তার পরিচয়ের পর থেকে বারবারই আমার মনে হয়েছে এই কথাগুলো তিনি ভাবেন নি। এমন অসীম কল্পনাপ্রবণ মানুষটি হয়তো কখনোই ভাবেন নি যে তিনি কতজনের মনের কান্না আর চোখের হাসির ঝিলিকগুলো হুট করেই বাইরে নিয়ে আসতে পারবেন তার লেখা কবিতাগুলো দিয়ে। কবিতাগুলো নিরীহ এবং আড়ম্বরহীন সাজ নিয়ে অনেকদিন কাউকে নাড়া দেয় নি সেভাবে। অনেকেই বোঝেন নি হয়তো, এরকম নিভৃতে বসে এমন কবিতাও লেখা যায়।
মৃত্যু খুব প্রিয় বিষয় ছিলো কবির। ঘুরে ফিরে বারবার তার লেখায় চলে এসেছে গহীন কালো শীতল মৃত্যু। এবং তিনি কাতর হন নি। তিনি কখনই বলেন নি, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে। আবার মৃত্যুকে আহ্বানও করেন নি। তারপরেও মৃত্যু তার কাছে প্রিয় ছিলো। এবং প্রিয় জিনিসের ব্যাপারে আমাদের একটা বাই-ডিফল্ট আবেগ কাজ করে। অনেক ভীড়ের মাঝে খুঁজলে আমরা যেমন হুট করেই আপনজনের চেহারা খুঁজে পাই, তেমনি তার কবিতায় খুঁজলে তিনি কেবল মৃত্যুর চেহারাই দেখতেন। একটা বিষয় খুব বেশি ঘনঘন আমাদের জীবনে ঘটতে থাকলে সেটার অসাধারণত্ব মিইয়ে যায়। আটপৌরে হয়ে পড়ে বার বার তার আসা-যাওয়া। অতিথিকে আমরা যেভাবে আদর-আপ্যায়ন করি, সে বসার ঘরে খাটিয়া পেতে ঘুমুতে শুরু করলে সেটা অচিরেই ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। সে কারণেই মৃত্যুর মত বিশাল বিলোপকারী চিন্তা এবং ঘটনা তিনি ভেঙে চুরে কাঁথা-বালিশ বানিয়ে ফেললেন। ঘাস, পাতা, জানালা, দেয়াল, শিশির, জোছনা, এমন হাজারো অসংখ্য উপাদানের মাঝে টুকরো টুকরো করে মৃত্যু মিশিয়ে দিলেন। আমরা পড়ার সময়ে খেয়ালও করি না, সরসরে ময়াল সাপের মতো মৃত্যুছায়া পুরো পঙ্ক্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এভাবে মৃত্যুকে টেবিল চেয়ার বানিয়ে ফেলার আরেকটা সুবিধা আছে। অপার্থিব অনুভূতিগুলো খুব সহজেই এই সব উপাদানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মনে হয় সবাই মিলে একটা স্ট্র দিয়ে মিষ্টি জুসের মতো মৃত্যুকে শুষে খেয়ে ফেলছে! কী অদ্ভুত কল্পনা, তাই না? জীবনের সকল উপাদান যখন তুচ্ছ হয়ে যাবে, আমাদের দপদপিয়ে দৌড়ে চলা কণিকা যখন ক্লান্ত হয়ে গতি থামিয়ে দিবে, ধুকপুকে হৃৎপিণ্ড অতি ধীরে স্তব্ধ হবে আর শৈত্যের প্রবল থাবা এগিয়ে আসবে, তখন হুট করেই আমার কবিকে মনে পড়বে। মৃত্যু খুব কঠিন কিছু তো নয়! জন্মানোর পরমুহূর্তেই হেঁচকি তুলে চিৎকার করে ওঠার চাইতেও সহজ শ্লথগতিতে চোকেহর তারার আলো ফুরিয়ে যাওয়া। এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে হুট করেই ট্রামের সাথে ধাক্কা খাওয়া। এভাবেই মৃত্যু আসে। আমাদের স্তব্ধ করে দিতে, আমাদের জীবনের সবটুকু আলো নিভিয়ে দিতে।
কবির সাথে প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছিলো তিনি বেশ ম্রিয়মাণ। এই চিন্তাটা কতটা অপরিপক্ক ছিলো, তা এখন মনে পড়লে হাসি পায়। আমি একটা নতুন তথ্য জেনেছিঃ অনেক সময় খুব মৃদু স্বরে বলা কথাগুলো সবচেয়ে জোরালো শোনায়, আর উচ্চকিত স্লোগানের চাইতেই তীব্র অনুরণন তৈরি করতে পারে। কবিতায় যতো নিয়ম কানুন বানানোর চেষ্টা হয়েছে, এই কবির লেখার পরে সেগুলো মোটামুটি হাস্যকর প্রস্তাবনা হয়ে গেছে। সবারই মনে হয়েছে এভাবেও কবিতা লেখা যায়। চমক কাটতে সময় লাগেনি, তারপরের সময়টুকু কেবল এই কবির জন্যেই স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। পরে জানলাম এই অনুভূতিটার নাম- আধুনিকতা। প্রথা, সংস্কার এবং জোয়ালের মতো চেপে বসা সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত যেভাবে ক্ষয়ে যাই, যেভাবে আমাদের ভেতর থেকে মৃত্যুর চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে জীবন চুরি হয়ে যায়, সেখানে এই কবিই পথ দেখালেন। তার কথাগুলো আমার কাছে নতুন সত্যের মতো ধরা দিলো। অন্ধকার প্রবল হলেও আমার মনে হয়, সেখানে তিনি পাশেই আছেন। আমার কানের কাছে মৃদুস্বরে বলছেনঃ
“আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।
…ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস –
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।”
কবি মারা গেলেন চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবর। আজকে থেকে ঠিক পঞ্চান্ন বছর আগে। ট্রামের চাকার সাথে যেই চিত্রকল্পগুলো হারিয়ে গেলো, যে পঙ্ক্তিগুলো নির্বাসনের নির্দেশ পেলো, সেগুলোর জন্যে আমার অনেক রাতেই মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরে অন্ধকারেই কল্পনা করি, কবির হাত মৃদু আমার কাঁধে এসে বন্ধুর মতো ছড়িয়ে আছে। তার মুখ অস্পষ্ট এবং ঘোলা। আমার চোখে অশ্রু। আমার মুখে একচিলতে হাসি। কেউ দেখছে না, কারণ ঘর অন্ধকার।
***
২২.১০.৯
তাইলে কি আমি?
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
এতো রাতে আছেই দেখলাম আমি আর তুমি ছাড়া দুইজন। তাও এতো কনফিউজ কেন হে? 🙂
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।
কবি মনে হয় চলে যাননি; বারে বারে ফিরে আসেন। হয়তো পাখিদের রূপে মানবের প্রগাঢ় চিত্ত নিয়ে।
দারুণ লিখেছেন আন্দালিব ভাই।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সেটাই বললাম, জনরোলের ভেতর তিনি ধরা দেন না। আমার কাছে নিভৃত ক্ষণেই তার উপস্থিতি। সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে ভালো সময়ে তিনি হাজির! অদ্ভুত ভাবেই মিশে গেছেন...
জীবনানন্দ দাশ। তার মতো আর কেউ নয়।
ভীষন প্রিয় কবি। সবচেয়ে প্রিয়।
প্রয়াণ দিবসে কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
গতকাল থেকেই মন কেমন হয়ে আছে কামরুল ভাই...
গতকাল থেকে আমার বাসায়ই সবকিছু এলোমেলো। সারা রাত ঘুম হয়নি। অর্থহীন বসেছিলাম।
সেই নির্জনতায় আমার পাশে কেউই ছিলো না। পাতার পর পাতা জীবনানন্দ সাথে ছিলেন কেবল! এটা যে কেমন অনুভূতি আমি প্রকাশ করতেই পারবো না!
কবিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর তোমাকে ধন্যবাদ- এই অদ্ভুত সুন্দর লেখাটার জন্য... :thumbup:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
অনেক ধন্যবাদ কবীর ভাই। যাঁরে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই, তাঁর জন্যে এসব লেখা কিছু না। কিছু না।
:hatsoff: :hatsoff:
টাইটেলে চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবর আর কবি দেখেই বুঝে নিতে পেরেছিলাম কি নিয়ে হতে যাচ্ছে পোস্ট। জীবনানন্দের সাথে আমার প্রথম পরিচয় সম্ভবত ৯৯% বাঙ্গালীর মতোই বনলতা সেন দিয়ে। খুব ছোট যখন ছিলাম আমার মা জোড়ে জোড়ে কবিতা পড়তো। সেই সময়ই শুনে শুনে অনেকগুলো কবিতা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো যা আমি তোতাপাখির মতো বলতে পারতাম। সব পাখি ঘরে ফেরে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন// থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।// এবং এরপর ক্লাস সেভেন কি এইটে হাঁস- মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণীমা সন্যালের মুখ// উড়ুক উড়ুক তারা পৌষের জোছনার নিভৃত্তে (!) উড়ুক// কল্পনার হাঁস সব পৃথিবীর সব ধনী সব রঙ মুছে গেলে পর// উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভেতর।// কিন্তু, একে তো আর পরিচয় বলে না, পরিচয় মোটামুটি হয়েছে আরও পরে যখন আমার বয়স উনিশ। তাঁর লেখা খুবই ছোট একটা কবিতা পড়ে আমি পুলকিত হয়ে উঠেছিলাম মনে আছে, এইভাবেই কবিতা লিখতে হয়! কবিতাটি ছিলো সেইসব শেয়ালেরা।
সেইসব শেয়ালেরা
জন্ম জন্ম শিকারের তরে
দিনের নিভৃত্ত আলো নিভে গেলে
পাহাড়ের বনের ভিতরে প্রবেস করে, বের হয়
চেয়ে দেখে বরফের রাশি পড়ে আছে জোছনায়
উঠিতে পারিতো যদি সহসা প্রকাশি
সেইসব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায়
তাহলে তাদের মনে যেই বিকীর্ণ বিষ্ময় জম্ন নিতো
সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পাড়ে
আমারো নিরভিসন্ধি কেঁপে উঠে স্নায়ুর আধারে।
এতো কথায় কবিতা লিখে ফেলার নজির আমি আর দেখিনি। এটা সম্ভবত আমার পড়া সেরা পাঁচটি কবিতার একটি হবে। তাঁর আরো একটি কবিতা আমার খুবই প্রিয়। কবিতাটি সার্কাস্টিক। জীবনানন্দ যে সার্কাজমও জানে এই কবিতাটি না পড়লে হয়তো আমি কখোনই বুঝতাম না। এটা মনে হয়না কোন আউট্রেইজাস ক্লেইম হবে যদি বলি, শেলীও এতো ভালো সার্কাজম জানতো না।
আমাদের এযুগের জন্ম হয়েছিলো বটে শূকরের পেটে
তাই কলম ছেড়েছি অসূ্যায়
কেননা খড়গের সাথে এটে এখন কলম কাঁত রবে বহুদিন
তারপর যখন সে মনিষীর হাতে ধরা দেবে পুনরায়
ততোদিনে ঢের দিন কেটে গেছে বলে
বেবুন ছাড়া কে আর উঠেছে মনিষীর জাতে।
তোমার মায়ের জন্যে আমার অনেক শ্রদ্ধা জন্মে গেলো অর্ণব! :hatsoff:
আমি বিশ্বাস করি, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আচরণগুলো খুব কোমল হয়। দেখি যে স্বভাবগুলো আমি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, সেগুলো এই বাস্তবতায় আমাকে 'মানুষ' থাকতে খুব সাহায্য করে। অনেক ছেলেরা খুব 'মা-ঘেঁষা' হলে তাদের মাঝেও এই কোমলতাগুলো দেখি যেগুলো দারুণ মানবিক!
তোমার মতো চমৎকারভাবে আমার জীবনানন্দের সাথে পরিচয় হলে, এমন অসাধারণ লাইনগুলো হয়তো আমার লেখাতেও উঠে আসতো।
কিন্তু কৈশোরের বিক্ষুব্ধ সময়ে তাঁকে চিনেছি, নিজে নিজেই। এই জন্যে তূলনামূলক কম পঠিত কবিতায় তাকে বেশি খুঁজি। মনে হয় সবার সামনে বলা কথাগুলো সম্পূর্ণ নয়। তিনি নিশ্চয়ই তার গোপন আর গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো অন্য কোথাও বলে রেখেছেন। একটা প্রাচীন রহস্য অনুসন্ধানের মতো (সেই বয়সে সেসব গল্প কী নাড়া দিত!) তাঁর মানবিক রূপটাকে খুঁজি আমি!
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যটার জন্যে অর্ণব!
অর্ণব,
তোমার দারুণ মন্তব্য পড়ে মুগ্ধ হলাম।
তবে "যেইসব শেয়ালেরা" কবিতাটার উদ্ধৃতিতে কিছু ভুল রয়েছে।
বহুদিন পর এই কবিতাটা দেখলাম, আমার মনে হচ্ছে
আরো কিছু ভুল রয়ে গেছে। এই কবিতাটা আমার অসম্ভব আসম্ভব
প্রিয়। পরে পুরো কবিতাটা আবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করবো এখানে।
ভালো থেকো।
সেইসব শেয়ালেরা : কবিতাটার নাম মনে হয় যেইসব শেয়ালেরা
নিভৃত্ত হবে বিশ্রুত
* এইখানে নীরবে হবে।
বের না, বার
বিকীর্ণ না, বিদীর্ণ হবে
পাড়ে না, পারে হবে
আধারে। না, আঁধারে হবে
জীবনানন্দ সমগ্রটা সাথে নেই তাই দেখে লিখতে পারিনি মুখস্ত লিখতে হয়েছিলো, নিজেই বুঝেছি কনফিউশনে থাকা অনেক শব্দ কেয়ারলেসভাবে গুজামিল বসিয়ে দিয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ভালো লাগলো অনেকদিন পর আপনাকে সিসিবিতে দেখে। লেখা শুরু করবেন আশা করি তারাতারিই।
এই লেখাটা পড়তে এত ভাল লাগলো যে কিছু না লিখে পারলাম না।
সব বাঙালী কিশোরই জেনে বা না জেনে জীবনের কোন একটা মুহুর্তে জীবনানন্দ হয়ে ওঠে, খুব অল্প সময়ের জন্যে কেউ কেউ, আর কারও কারও মাথায় তিনি বসে যান চিরকালের মত।
জীবনানন্দের লেখা আমার প্রিয়তম লাইন হলো-
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথায় পেতে, অলস গেয়োঁর মত এইখানে, কার্তিকের ক্ষেতে-
এই লাইনটা আমার জন্যে চিরকাল একটা বিস্ময় নিয়ে আসে, ঠিক কেমন করে, কোন ভাবনায় পৌঁছালে যে কেউ এমনটা লিখতে পারে!
কবির প্রতি শ্রদ্ধা, আর আন্দালিবকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। জীবনানন্দকে নিয়ে কোন লেখা দেখলেই এখন খানিকটা আতংকে থাকি, আনিসুল হক নামের এক শিক্ষিত ছাগল এই কবিকে নিয়ে একটা জঘন্য বই লিখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে, ভয় হয়, আরও কেউ বুঝি সে ছাগলের অনুগামী হয়ে পড়ে!
www.tareqnurulhasan.com
আপনি যে লাইনটা বললেন তারেক ভাই, এমন অনুভূতি আমার অনেক আপাত-সহজ লাইন নিয়েও হয়!
আরেকটা বিস্ময়, মিশরে না গিয়ে কেউ মিশরের এমন অদ্ভুত বর্ণনা কী করে দেয়?
===
আনিসুল হক যে ক্ষতিটা করেছেন সেটা আমি এভাবে দেখি-- আমরা যারা সরাসরি জীবনানন্দ পড়েছি, তারা বেঁচে গেছি এমন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী লেখকদের হাত থেকে। চিন্তা করেন যে ছেলেটি আনিসুল হকের লেখাতে প্রথম জীবনানন্দকে চিনবে তার কপালে কী দুর্ভোগ লেখা আছে! সেই ছেলেটি যে মূল জীবনানন্দে আর কোনো মজা কখনই পাবে না সেটার দায়ভার আনিসুল হকের মৃদু কাঁধে ফেলে দেয়া উচিত। ~x( :gulli:
কোন আনিসুল হককে নিয়ে কথা হচ্ছে? রংপুইরা আনিসুল হক? ও হয়ে থাকলে বলা যায় ও তো হচ্ছে নাঙ্গলের বলদ! :)) (কপিরাইটঃ মোস্তাফিজ স্যার, ইংরেজী।)
নাঙ্গলের বলদ আসলেই তার রূপ দেখিয়েছে। জীবনানন্দের জীবনী লিখতে গিয়ে বনলতা সেনের চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছে ভাব-সম্প্রসারণ করে। কবিতার সৌন্দর্য আর রহস্যময়তা এই বইলেখকদের হাতে পড়ে রীতিমত লাঞ্ছিত হয়!
কি ভাব-সম্প্রসারণ করেছিলো? সারমর্মটা বলে ফেলুন একটু হাসাহাসি করি।
অসাধারণ দোস্ত। একটু থেমে থেমে লেখাটা পড়লাম।
গতকালকে কবির মৃত্যু বার্ষিকী ছিল আর খুব সম্ভবত আগামী কাল শামসুর রাহমানের জন্ম বার্ষিকী।
অর্ণবের মত আমারও তার সাথে পরিচয় ঘটেছিল মায়ের হাত ধরে। আমার কথা বলা শুরু যখন কিংবা বোধের শুরু যখন তকন আমার মা ঢাকা ভার্সিটির বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। তার কাছে থেকে শুনে শুনে আমার মুখে মুখে চলে আসে জীবন বাবু যদিও কবিতার ক ও আমার অন্তকরণে ঢুকত না। প্রথম আমি আমার মায়ের সাথে ঢাকা ভার্সিটির পিকনিকে গিয়ে আবৃত্তি করে ফেলি "হায় ছিল"। যে বয়সে একটা ছেলের ঐ দেখা যায় তালগাছ বলার কথা তারা হায় চিল বলা দেখেই কিনা কোন এক স্যার (নামটি বলতে পারছি না সম্ভবত সৈয়দ আকরাম হোসেন) আমাকে বলেছিলেন বাবু যখন পড়তে শিখবে বুঝে কবিতাটি পড়বে। তারপরে ও ছিলেন ।
মজার ঘটনাটা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রিয় লাইন নির্দিষ্ট করে বলতে পাছি না। " উটের গ্রীবার মত কোন এক নিঃস্তব্ধতা এই লাইনটা খুব মনে পড়ছে।
"নক্ষত্র সরিয়া যায়" এই লাইনটা ও তার পরের লাইংুলো কিংবা আমি যদি হতাম বুনো রাজ হংস এগুলোও মনে পরছে।
পরে আবার কমেন্টামুনে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ তোকে এমন চমৎকার একটা মন্তব্যের জন্য। তোর আর অর্ণবের কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ের পরে বউকে বেশি বেশি করে জীবনানন্দ পড়াতে হবে। যাতে করে আমার ছেলেমেয়েও এরকম একটা জীবনানন্দঘন পরিবেশে বেড়ে ওঠে। মুখে মুখেই কবি বেঁচে ওঠেন!
তোর আবৃত্তি করা কবিতাটা এখানে তুলে দিচ্ছিঃ
হায় চিল
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটি পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যার মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভেজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
(কাব্যগ্রন্থঃ বনলতা সেন)
এই কবিতাটি নিয়ে গান লেখা হয়েছে। অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে গানটি পাওয়া যাবে এখানে
***
"উটের গ্রীবার মতো নিঃস্তব্ধতা"-- এরকম উপমা বাংলা কবিতায় খুব বেশি নাই। আরো মন্তব্যে এই কবিতাটাও তুলে দিবো! 🙂
আন্দালিব,
খুব বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছি জানো।
তোমার লেখা চোখে পড়ে কিন্তু মন দিয়ে পড়তে পারিনা।
আসলে কাঠখোট্টা কাজ করি তো খুব ঝামেলা হয়
ভেতর-বার ভেতর-বার করতে।
আশা করছি এটা কেটে যাবে।
দায়সারা মন্তব্য করতে পারিনা বলে চুপ করে আছি।
জীবনানন্দ আমার কাছে অবসেশনের মতো।
তাঁকে নিয়ে যখন লেখো তখন আর চুপ করে থাকতে পারিনা।
একদিন সারাদিন সময় নিয়ে তোমার লেখাগুলো পড়বো
আর মন্তব্য লিখবো জমিয়ে।
ভালো থেকো।
নূপুর ভাই, জীবনানন্দ আমাদের সবার জন্যেই একটা অবসেশন। তাঁকে বাদ দিয়ে কোন কবি এখনও পর্যন্ত নতুন কবিতা লিখতে পারেন না। কারণ তিনিই উদাহরণ তৈরি করে গেছেন, সেই রবীন্দ্র-আক্রান্ত যুগে, কীভাবে "নতুন" কবিতা লিখতে হয়!
আপনি সময় নিয়ে মন্তব্য করবেন। আমার খুবই ভালো লাগবে, ভাই। :hatsoff:
লেখাটা খুব ভাল লাগল। জীবনান্দের সাথে আমার পরিচয় খুব কম। তার কবিতা খুব বেশি পড়া হয় নি। তবে ভবিষ্যতে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা অবশ্যই আছে। এই লেখাটা তাই খুব কাজে লাগবে।
মুহাম্মদ, পরিচয় কম হলেও এখন সেই যোগাযোগ তৈরি করো। জীবনানন্দের কবিতা পড়ার একটাই সমস্যা। তিনি অনেক বেশি লিখে গেছেন। সব কবিতা আমার এখনও একবার করেও পড়া হয় নি। এবং কাব্যগ্রন্থে যা ছিলো, তাঁর মৃত্যুর পরে অপ্রকাশিতও পাওয়া গেছে মোটামুটি সমান পরিমাণ। সেসব কবিতা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনার দারুণ একটা অংশ গত পঞ্চাশ বছরে গড়ে উঠেছে!
বিশেষ করে তোমাকে যা আগ্রহী করবে সেটা হলো তার কবিতায় আধুনিকতা। তৎকালীন সমাজে বড়ো হয়ে, বসবাস করে, সমাজের প্রথাগুলোকে তিনি হাঁসের গায়ে পানির মতো ঝেড়ে ফেলেছেন কবিতায়। এমনকি কখনও কখনও তীব্র পরিহাসও করেছেন (নিচে অর্ণব একটা উদাহরণও দিয়েছে)।
আর একটা বিষয়, তা হলো তার "সেন্স অফ রিয়েলিজম"। এটাকে তিনি সবসময়েই তুলে এনেছেন খুব অদ্ভুত সুররিয়্যাল কিছু কিছু দৃশ্য দিয়ে!
জীবনানন্দ নিয়ে কথা বললে আসলে থামা মুশকিল। বরং তুমি পড়া শুরু করে দাও! 🙂
@ মুহাম্মদ, পড়ে দেখতে পারো, ইন্টারেস্টিং। একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে কিছু লিটারেচার জানা তো অবশ্যই প্রয়োজনীয়, তাই নয় কি? জীবনানন্দ পড়ে আগ্রহী হয়নি বাংলা ভাষা সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান রাখা এরকম কাউকে আমি পাইনি। এবং এরকম শিক্ষিত বাঙ্গালীর সংখ্যাও বোধহয় খুবই কম জিবনের একটা সময় অন্তত যে কিনা জিবনানন্দের ভক্ত হয়ে পার করেনি। ব্যক্তিগতভাবে কবিতা যে একটি মজার জিনিষ জীবনানন্দ পড়েই আমি বুঝতে পেরেছি। জীবনানন্দ আমার পড়া প্রথম কবি যার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে না কবিতা বুঝতে হবে। আমাদের দেশ কবিতার ক্ষেত্রে একটি সুপার্ব রিটার্ডেন্ট এটা বোধহয় চোখ বন্ধ করেই আমরা বলতে পারি। আমাদের দেশে কয়জনের লেখা কবিতা হতে পেরেছে হাতে গুনে বলা যায়। কিন্তু, টেক্সট বইগুলো হরেক রকম কবিদের কবিতায় ঠাঁসা যাদের মধ্যে অবশ্যই আছে কায়কোবাদ, বন্দে আলী মিঁয়ার মতো নুইসেন্স কবি। এদের লেখাকে কবিতা বলে চালিয়ে দেওয়ায় যেটা হয়েছে কবিতা শেখার বদলে আমরা শিখেছি কবিতাকে আন্ডারেস্টিমেট করা। এটাতো ওভারকাম করতে হবে।
হুম, নেক্সট মিশন জীবনানন্দ। কবিতার উপরে কিছু নেই। কবিদেরকে সবসময়ই অনেক উপরে স্থান দেই। কিন্তু অনেকের কবিতাই খুব একটা পড়া হয় নি। শুরু করতে হবে।
মুহাম্মদ, এই লিঙ্কে অনেকখানি জীবনানন্দের কবিতা পাবে।
যেইসব শেয়ালেরা
যেইসব শেয়ালেরা - জন্ম জন্ম শিকারের তরে
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে, বার হয়, - চেয়ে দেখে বরফের রাশি
জ্যোৎস্নায় প'ড়ে আছে; - উঠিতে পারিতো যদি সহসা প্রকাশি
সেইসব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায় :
তাহ'লে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়
জন্ম নিতো ; - সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে
আমারো নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।
কবিতাটা তুলে দিলাম আব্দুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত কবিতাসমগ্র, জীবনানন্দ দাশ থেকে। জানিনা আর কোন পাঠ আছে কি না এই কবিতাটার। সবার মন্তব্য পেলে ভালো লাগবে।
আন্দালিব আর অর্ণবকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এই বইটাই আমার কাছে আছে নূপুর ভাই। অনেক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য! 🙂
[আমি যদ্দুর জানি আবদুল মান্নান সৈয়দের বইটাই কবিতাগুলোর মান-সংকলন। ]
কবির প্রেমে মজে ছিলাম অনেকদিন, মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সময়টাই সুখের ছিলো। লিখাটা খুব ভালো লাগলো। পছন্দের একটা কবিতা তুলে দিলাম...
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ
বধু শুয়ে ছিলো পাশে, শিশুটিও ছিলো
প্রেম ছিল, আশা ছিল, জোছনায়
তবু সে দেখিলো কোন ভূত
ঘুম কেন ভেঙ্গে গেলো তার।
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার...
🙂 আট বছর আগের একদিন! মখস্থ আছে কবিতাটা। বাকীটুকু বলে ফেলার লোভ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে, তবে ভুল কবিতা বলে উপরে নুপুর ভাইয়ের হাতে একবার ধরা খেয়েছি- তাই দমে গেলাম। "যে জীবন দোয়েলের শালিকের মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।"
আমি নিশ্চিত এই পোস্টের কমেন্ট গুলোয় সুন্দর কিছু কবিতা আসবে, আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি...
এ্যাই ছেলে!
দমে যাবার কি হলো?
পুরো কবিতাটা বলে ফেলো এবারে!
তুমি একটু ভুল লিখলে বলেই না
আমি এ্যাদ্দিন পর এটা নিয়ে আবার
বুঁদ হতে পারলাম।
রেশাদ ভাই, কবিতাটা আমারও অসম্ভব প্রিয়। আবৃত্তির জন্য খুব চমৎকার একটি কবিতা। আর নিজস্ব বিচারে, মৃত্যু এবং আত্মহত্যা নিয়ে এমন চমৎকার জীবনবোধে মাখা কবিতা আর লেখা হয় নি। অনেক ধন্যবাদ কবিতাটা উল্লেখের জন্য।
***
অর্ণব, এই দীর্ঘ কবিতা তোমার মুখস্থ! এটাই বিরাট কৃতিত্ব! আমার মুখস্থ-ক্ষমতার অবস্থা করুণ বলেই কোনোমতেই এই কবিতাগুলো মনে রাখতে পারি না।
***
কবিতাটি আগ্রহীদের জন্যে তুলে দিচ্ছিঃ
আট বছর আগের একদিন
শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিলো পাশে - শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো - জোৎস্নায়, - তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি !
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
'কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম - অবিরাম ভার
সহিবে না আর - '
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো-এক নিস্তব্ধতা এসে।
তবুও তো প্যাঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
দূরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে
বলেনি কি : 'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! -
ধরা যাক দু -একটা ইঁদুর এবার!'
জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের -
তোমার অসহ্য বোধ হলো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; - কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যার্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোন খাদ,
সময়ের উর্ধ্বতনে উঠে এসে বধূ
মধু - আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ' পরে।
জানি - তবু জানি
নারীর হৃদয় - প্রেম - শিশু - গৃহ - নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বথের ডালে বসে এসে,
চোখ পালটায়ে কয় : 'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার !
ধরা যাক দু - একটা ইঁদুর এবার -'
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব
কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
***
কবিতাটি নিয়ে একটা দারুণ আলোচনা আছে আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা।
আসলে ঠিক একেবারে একশোভাগ মুখস্থ যে তা না। মাঝে মাঝে অনেকগুলো শব্দ ভুলে গিয়ে নিজের মনের মতো গুজামিল বসিয়ে দেই। আর মুখস্থ কারণ কবিতাটা আমি বোধহয় এক হাজার বারের উপরে পড়েছি। অনেকদিন জীবনানন্দ পড়া হয়না। জীবনানন্দ খুলেই আমি যেই কয়েকটা কবিতা প্রথম পড়ে নেই তার মধ্যে আছে এই আট বছর আগের একদিন, গভীর হাওয়ার রাত, শ্যামলী, বনলতা সেনেরঈ হরীণ বিষয়ক একটা কবিতা, মহিনের ঘোড়াগুলি, আকাশলীনা, মহিলা বিষয়ক একটা কবিতা (এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হয়ে এলে মনে করে নিতে গিয়ে আরেক পৃথিবীর নাম// মহিলার ক্রমেই জাগছে মনোষ্কাম), বুনোহাঁস, লোকেন বোসের জার্নাল, যেইসব শেয়ালেরা এইরকম আরো কয়েকটা। এদের প্রায় সবকটিরই অন্তত ৫০% করে মনে আছে।
তোমার কবিতার পছন্দ দেখে খুবই আনন্দ হচ্ছে। আমারও এর বেশিরভাগ কবিতাই অনেক প্রিয়। এখানে একটা কবিতা রাখছিঃ
হরিণেরা
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি- ফাল্গুনের জোছনার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা; রুপালি চাঁদের হাত শিশিরের পাতায়;
বাতাস ঝাড়িছে ফাঁকে- বনে বনে - হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।
হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে-
বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা আহা;
ফাল্গুনের জোছনায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।
বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে-
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।
জীবনানন্দের একটা কবিতা আছে বিষয়বস্তু শিমগাছ আর নিজের মেয়ে। কয়েকটা লাইন এরকম (বেলা শেষ হলে// শুনলাম ডুবে গেছে পুকুরের জলে), (চিনেছো বললে রাতের লক্ষীপাখি।) কেউ কি জানেন কবিতাটির নাম এবং কোন বইয়ে আছে?
অর্ণব, এই মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না। বিশাল খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার অনুভূতি হলো (বইয়ের সাথে যদি একটা গুগল থাকতো কী চমৎকারই না হতো)। আমি খুঁজে পেলে তোমার ব্লগে আর এখানে পোস্ট করবো... 🙂
জীবনানন্দের একটা জিনিষ আমার খুবই ভালো লাগে, তাঁর descriptive simile যা নিয়ে জীবনানন্দ কাজ শুরু করে বনলতা সেন থেকেই। বনলতা সেন কবিতাটির সেকেন্ড প্যারাতেই আছে এরকম বিশাল একটা descriptive simile যেটার সফলতা একটি সফল সিমিল হওয়ার মধ্যে নয় বরং একটি সফল ইমেইজারি হওয়ার মধ্যে (বহুদুর সুমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা// সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর// তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে।)। কিভাবে বনলতা সেনকে সে দেখলো বর্ণনা করতে গিয়ে সে সুমুদ্র, জাহাজডুবি, অজানা একটি দ্বীপে নাবিকের জ্ঞান ফিরে পাওয়া ইত্যাদি হাজারো কাহিনীর মধ্য দিয়ে পাঠককে সে এমনভাবে নিয়ে গেল যে পাঠক কিন্তু আর বনলতা সেনের চুল আর মুখশ্রীর রূপের মধ্যে নেই যেখান থেকে সে কিনা শুরু করেছিলো, পাঠক ততক্ষণে সিংহল সুমুদ্রে। এবং একই কাজ সে করেছে, ওই বনলতা সেনের চুল আর মুখশ্রীর রূপ বর্ণনা করতে গিয়েও। (চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা// মুখ তার সাবস্ত্রীর (!) কারুকার্য।)। যখন যে চুল আর মুখশ্রীর রূপ বর্ণনার ব্যাস্ত, পাঠক ততক্ষনে প্রত্নতত্বে, বিলুপ্ত এক পুরাতন শহরে। এখানে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, "চুল এবং পুরাতত্ব" ও "বনলতার সাথে দেখা ও সিংহল সুমুদ্রে জাহাজডুবি" ঘটনাগুলির মধ্যকার দুরত্বে। এই দুরত্ব এতটাই বিশাল যে সচেতনভাবে পাঠকের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না কি তুলনা করা হচ্ছে সেই বিষয়ে ফোকাসড্ থাকা। নিজের অজান্তেই পাঠক হারিয়ে যাচ্ছে, কার সাথে তুলনা করা হচ্ছে তাতে। ফলে, সিমিল আর সিমিল থাকছে না হয়ে যাচ্ছে ইমেইজারি। এই ফেনোমেনার একটা উতকৃষ্ট উদাহারণ আছে খুবই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি কবিতায়- তা হলো কীটসের ওড টু নাইটিঙ্গেল, যেখানে প্যারাতে প্যারাতে এক একটা ভুখন্ড ভ্রমনের স্বাদ মিলে। আমার মনে হয় ইংরেজীর ছাত্র হয়ে জীবনানন্দ এখানেই একটা বিশাল জেতা জিতে গেলেন। বাংলা ভাষার প্রায় সব কবিই মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ, আমিয়, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব ছিলেন ইংরেজীর ছাত্র as long as গোলাম মোস্তফা, কায়কোবাদ এদেরকে আমরা কবির তালিকায় না ধরি। কীটসের কাজটা ফর্মগতভাবে যতটা স্ট্রাকচার্ড ছিলো বনলতা সেন হয়তো ততোটা না, কেননা বনলতা সেন রোমান্টিক কবিতা নয়, আধুনিক কবিতা ফর্মকে স্ট্রাকচার্ড রাখার চেয়ে অন্যান্য আরো গুরুত্বপুর্ণ কাজের দিকে বেশী মনোযোগ দেয়- ফর্মকে স্ট্রাকচার্ড রাখতে গিয়ে টেকনিক্যাল এবং ইমোশনাল রিচনেস কোনভাবে বিসর্জন দিবো না পাউন্ড, ইয়েটস আর এলিয়টের এই মতাদর্শ কঠোরভাবে অনুসরণ করে জীবনানন্দ খেয়ালী, ক্যাজুয়াল ইত্যাদি দুর্নাম কামিয়েছেন। তার সাথে এমবেডেড এই বিশেষণগুলোর বিরোধীতা কিন্তু তিনি নিজেই করেছেন। আমিও ঠিক তাই মনে করি, জীবনানন্দের কবিতা হচ্ছে আত্নবিশ্বাসের কবিতা। আত্নবিশ্বাস যে কোন লেখা কবিতা হয়ে উঠার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। যেই লেখা পাঠক মনে ইতস্তত ভাবের সৃষ্টি করে খুব কম সময়ই তা কবিতা হয়ে উঠতে সফল হয়। অবশ্যই আমি অবগত আছি লোকেন বোসের জার্নাল, আকাশলীনা ও অন্যান্য অনেক কবিতায় যেই ইতস্তত ভাব জীবনানন্দ সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিলো ইচ্ছাকৃত। এই ইচ্ছাকৃত ম্যানিপুলেইশনও কিন্তু তিনি সফলভাবে করতে পেরেছেন কনফিডেন্সের সাহায্যেই, ক্যাটেগরিকালি ইতস্তত সেটা ছিলো না। কিছু কিছু কবিতা হয়তো অন্যান্য কবিতা থেকে কম বা বেশী কনফিডেন্ট ছিলো- তবে, বনলতা সেন থেকেই জীবনানন্দের কবিতাকে কনফিডেন্ট কবিতা ছাড়া আমি মনে করিনা অন্য কিছু বলার আছে।
অসাধারণ মন্তব্য, আলাদা করে পোস্ট দেয়ার মতো লিখেছো। এর সাথে বেশি কিছু যোগ করতে পারবো না। তুমি কবিতার এই বিষয়গুলো নিয়ে একটা পোস্ট দিতে পারো কিন্তু!
সুরঞ্জনা,
ঐ খানে যেও নাকো তুমি,
বলো নাকো কথা ঐ যুবকের সাথে
কিংবা
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ,
মরিবার হলো তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল ..।..।..।...।।
মনে নাইরে ভাই আর। কবিতার মধ্যে যে ভালো লাগাটা তৈরী হয়েছে, তার ৯০ ভাগ জুড়ে আছে রবিন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ বাকী দশভাগে গাদাগাদি করে অন্যরা।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
পরের কবিতাটা দিকে মন্তব্যে লিখেছো 🙂
দেখি আগেরটার আরও কিছু লাইন
নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে
দূর থেকে দূরে, আরও দূরে.....।...।
যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর।
কি কথা তাহার সাথে? তার?
সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস,
আকাশের ওপারে আকাশ
বাতাসের ওপারে বাতাস।
১০ এর মধ্যে ৫ তো পাব নাকি
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আকাশলীনা
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে -- আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? --তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরন্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাসঃ
বাতাসের ওপারে বাতাস--
আকাশের ওপারে আকাশ।
***
(কাব্যগ্রন্থঃ সাতটি তারার তিমির)
***
ফয়েজ ভাই, আপনি ১০ এ ৮ বা ৯ পাইছেন! সাবাশ বস! :boss: :hatsoff:
ফয়েজ ভাই, জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতার নাম রবীন্দ্রনাথ। সেটা আপনার জন্য তুলে দিচ্ছিঃ
আজ এই পৃথিবীতে অনেকেই কথা ভাবে।
তবুও অনেক বেশি লোক আজ শতাব্দীর-সন্ধির অসময়ে
পাপী ও তাপীর শববহনের কাজে উচাটন
হয়ে অমৃত হবে সাগরের বালি, পাতালের কালি ক্ষয়ে?
কোথাও প্রান্তরে পথে ফুল পাখি ঘাসের ভিতরে
সময় নিজেকে ফাঁকি না দিয়ে হয়তো নিখিল চালাতেছে;
আড়াই চালের মতো রক্তের চঞ্চল তাল
সেখানে দু-এক মোড় খুলে, স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
নিমিষে আহ্নিকগতি উতরোল হয়ে উঠে ম্যামথের পরে--মানুষের।
কবি ও নিকট লোকের মতো, বড় এক প্রিয়--
অন্ধ মরুতে কবে ফা হিয়ান সূর্যের সোনা দেখেছিল--
বিশদ প্রসঙ্গে আজ ততোধিকভাবে স্মরণীয়।
ধন্যবাদ।
খুব নরম একটা অনুভূতি হলো তোমার এই পোস্টে এসে। 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
কবির নাবিক কবিতাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, এইখানেই আগাম ঘোষণা হয়েছে নতুন লেখনীর কথা। আগে একবার দিয়েছিলাম অন্য একটি লিখায়, আবারো দিলাম...
এতদিন, শুনেছো যে সুর
পুরনো তা, কোনো এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন।
তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন
আর নাই কেহ
আমার পায়ের শব্দ শোনো
নতুন এ, আর সব, হারান-ফুরোনো।
(যতিচিহ্নে ভুল আছে, স্মৃতি তেহেক লিখলাম)
একটা গান আছে কবির কবিতা থেকে নেয়াঃ
একদিন, জলসিড়ি নদিটির পাড়ে
এই বাংলার মাঠে, বিশীর্ণ বটের মত শুয়ে রবো,
... মতো লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে, বাকাঁ চাঁদেজেগে রবে
নদিটির জল।
কেউ কি পুরো কবিতা আর গানটা দিতে পারবেন?
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রবো; পশমের মতো লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে,- বাঁকা চাঁদ জেগে র’বে- নদীটির জল
বাঙালি মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে- তারপর যেই ভাঙা ঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো, পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল
কাঁদিবে সে সারা রাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে
সাজায়ে রেখেছে চিতা; বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্ণীর গল্প- ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে
ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;- চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস-
***
(একদিন জলসিড়ি নদীটির/রূপসী বাংলা)
***
গানটা শোনা হয়নি রেশাদ ভাই। কেউ শুনে থাকলে এখানে লিঙ্ক দিয়ে যাবেন।
এই সুযোগে আমার একটি প্রিয় কবিতা দিয়ে দিলাম এখানে
হাজার বর্ষ আগে
সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ'লো না :
কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো
আমি বুঝলাম
চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে
কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন - সপ্রতিভ হয়ে
সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন
সপ্রতিভ হয়ে -- সপ্রতিভ হয়ে
সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে
অপেক্ষা করে -- অপেক্ষা ক'রে
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ'লো না
কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ'ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
গাঙশালিখের মতো আমরা দু'টিতে
আমি কোন এক এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
এই লোকের প্রশংসা করতে থাকলে আর দিনদুনিয়ার কোনো কাজ করা হবে না! 😕
দারুণ, অসাধারণ একটা লেখা৷
ধন্যবাদ মহিব! 🙂
:clap:
আচ্ছা জীবনবাবু কি জানেন উনি আমাদের সবার মনেই একজন করে জীবনানন্দের জন্ম দিয়ে গেছেন...................
মনে হয় জানতেন না। অথবা জানতেও পারেন! কি জানি! 😕