দ্বিধাবিভক্ত আমি-২

আমার আগের এই নামের কবিতার সাথে এই কবিতার একমাত্র মিল হল উভয় ক্ষেত্রেই আমি দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম।

শ্রেণী বৈষম্যের আলোকে সমাজকে দেখেছিলেন
মার্ক্স, কার্ল মার্ক্স।
সভ্যতার উত্তরণ, এগিয়ে চলার পথ আর আইনকে
তিনি দেখেছিলেন অর্থনৈতিক ভিত্তিতে।
সেই আইন, প্রলেতারিয়েতদের ওপর যা চাপিয়ে দেয়
বুর্জোয়াদের ইচ্ছার প্রতিফলিত ফলাফল।
একেই আইন বলে, শ্রমজীবী শ্রেণীকে যা দমন করার
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মার্ক্সের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা
আয়োজন করি সেমিনার, আলোচনা ও বিজ্ঞ বিতর্কের।
জ্ঞানী আলোচক, বিজ্ঞ বিশ্লেষক, সম্মানিত শিক্ষকেরা
আসেন আমাদের জ্ঞান দানের উদ্দেশ্যে।
তাদের নামের আগে বিজ্ঞতার পরিচায়ক “ডঃ” বসানো,
আমরা নগণ্য কয় শ্রোতা হা করে তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে।
নিজের জ্ঞানহীনতার স্বরূপ আরো একবার অনুভূত হল।
অনেক অনেক কথা তারা বললেন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে।

হঠাৎ জানতে পাই, তারা হয় পুঁজিবাদের সূতিকাগার
বিলাত থেকে, নয় আমেরিকা থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করা।
আবার একজন অত্যধিক জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পাই যে
তিনি প্রচণ্ড জ্ঞানী। ১৮ বছর ডলার পিপাসু সাদা চামড়ার ছাত্রদের
শিক্ষকতা করার মত অপার্থিব যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন।
১৮ বছর ডলারে কামাই করার পর দেশে ফিরলেন তিনি,
তার বিলাসিতার নতুন রূপান্তর ঘটেছে মার্ক্সের প্রতি তার মনোযোগ
প্রতিষ্ঠাপনের মাধ্যমে। মার্ক্স কত সৌভাগ্যবান্‌ ভাবতে পারেন?
তিনি সত্যিকার অর্থে মার্ক্সের আদর্শে উদ্ভাসিত একজন মহাপ্রাণ,
তার কথার বুলেটে তিনি ঝাঁঝরা করে ফেলেন পুঁজিবাদীদের।
তো কি হয়েছে যে তিনি পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ লাভকারী,
বিশ্ব শ্রেণী ব্যবস্থার সর্বোচ্চে থাকা আমেরিকা থেকে ডিগ্রী নিয়েছেন?
তো কি হয়েছে যে তিনি চলা ফেরায় কষ্ট যাতে না হয় তাই একটা টয়োটা
করলা জিএলআই কিনেছেন, আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন?
একেই বোধহয় বলে হিপোক্রেসি, হায় সেলুকাস, কী বিচিত্র এই পৃথিবী।
আর তদাপেক্ষা বিচিত্র, অদ্ভুত এই তথাকথিত মার্ক্সবাদীরা।

কেউ কেউ নিজের মাহাত্ম্য বাড়াতে নামের আগে মার্ক্সবাদী আদর্শে,
মার্ক্সিয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশেষণসমূহ লাগাতে পছন্দ করেন।
আর আমাদের মত যারা সেমিনারে যায়, তারা মস্তিষ্কে আর হৃদয়ে
ঝড়, বিজ্ঞানের ভাষায় রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরি।
রোমকাঁটা দিয়ে ওঠার মত হৃদয়স্পর্শী কথা শুনি সেমিনারে গিয়ে,
শুনি নিপীড়িত মানুষের গল্প আর ফেলি ফুসফুস হতে আসা দীর্ঘশ্বাস।
মুষ্টিবদ্ধ সংকল্পে দৃঢ় মনা হই, কাজী নজরুলের কবিতা হতে প্রেরণা নেই
হই বিদ্রোহী, হই মার্ক্সের স্বপ্নাদর্শে বলীয়ান্‌। শ্রেনীবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার
দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি, আর বলি, “আগে বদ্‌লাতে হবে নিজেকে”।
কিন্তু অতঃপর যখন ক্লাসে বসে এসির বাতাস খেতে থাকি,
কোথায় থাকে প্রলেতারিয়েত, আর কোথায় আমি? আমার টেবিল চাপড়ানো
তর্কের একটা বিষয়ের মধ্যেই শ্রেনীবৈষম্যের সূচনা হয় আর সেখানেই তার সমাপ্তি।
আমার মধ্যে তখন জাজ্বল্যমান থাকে আদর্শ পুঁজিবাদী সমাজের একজন বুর্জোয়া।
বাস্তব বড় কঠিন, নিষ্ঠুর, বলে নিজেকে বাঁচাতে চাই আমি সকল নিপীড়িত প্রলেতারিয়েতদের
অশ্রুসজল দৃষ্টি থেকে, বিবেকটা বুড়িগঙ্গার পানির চেয়েও
বেশি কলুষিত, পঙ্কিল, পূঁতিগন্ধময় হয়ে গেছে, যেন নিজেতে আমি পচন দেখতে পাই।
চাই পুঁজিবাদী সমাজেরই একজন আদর্শ বুর্জোয়া হয়ে সকল প্রলেতারিয়েতদের
যত অধিকার আছে, নিজ পদতলে তা পৃষ্ঠ করে ওদের দমন করতে, তাদের
দেহের স্তুপের উপরই আমি আমার রাজপ্রাসাদ গড়ে সুখনিদ্রায় শায়িত হব।

অসীম ক্ষমতাধর একজন আমাদের প্রতিপালন করছেন এই পৃথিবীতে,
ভাবতে ভালোই লাগে। তাঁর নিকট প্রার্থনা, এভাবে যেন না বাঁচি,
বেঁচে থাকা নতুন অর্থ খুঁজে পেতে চাই আমি নতুন কিছু করার চেষ্টায়।
চাই দুর্বলের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে, তাদের প্রাপ্য পৌঁছে দেয়ার প্রয়াস,
তাদের বাঁচতে দেয়ার উদ্যোগ। তবে জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাবো।
দ্বিধাবিভক্তের মত অন্য কাউকে দোষারোপ না করে নিজের পথ
বদ্‌লানোর চেষ্টা করতে চাই। শতভাগ সমতা আনা বাস্তবিকভাবে হয়তো
সম্ভব নয়, তথাপিও যার যতটুকু পাওয়ার অধিকার তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে
একজীবন পার করে দেয়া তেমন একটা কঠিন কাজ হবে না বোধহয়,
তাই না?

পুনশ্চঃ এই কবিতার কোন চরিত্রের সাথে বাস্তব চরিত্রের মিল পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণই কাকতালীয়।

৩,৭২২ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “দ্বিধাবিভক্ত আমি-২”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    সবতো শুরু জীবনের, টের পাইবা "আরও কত কাহিনী" পরে ভুইল্লা যাইবা কই থাইকা শুরু করছিলা।

    ব্যাপার না, টেনশন নিও না............।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    কোনকিছুইতো দুনিয়ায় পারফেক্ট না, তাই না 🙂
    আর বাইচা থাকনের লাইগা এসব থাকবেই, সো লেস টেনশন 🙂
    লেখাটা সেরকম হইছে শার্লী :clap: :clap:
    :thumbup: :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. সামি হক (৯০-৯৬)
    নীতি ঠিক রাখতে গিয়ে নীতি বিবর্জিত কাজ না করলেই হল। আর সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা, দেশের কাছে, পরিবারের কাছে এবং সমাজের কাছে একদম পয়লা কাতারে। বাকি যে কোন কিছুই চেঞ্জ হতে পারে।

    একমত কথাগুলোর সাথে।

    @ শার্লী লিখাটা ভালো হয়েছে, আমার মনে হয় মন যা ভালো বলে তাই ঠিক সবসময় তাতে দ্বিধান্বিত থেকো না।

    জবাব দিন
      • সুব্রত (৯৪-০০)

        শার্লি,লেখাতে যা লিখেছ তা আমার হৃদয় নিংরানো কথা।আমি খুব করে ফীল করতে পারছি তোমার মনের অবস্থা।ঢাকায় অনেক বড় বড় আইন বিশেষজ্ঞ আছেন যারা রাসিয়া থেকে আইন পড়ে এসে দেসে মারক্সের থিওরি কপচে বেরাচ্ছে।অথচ খোজ নিয়ে দেখ তারই হয়ত ঢাকায় তিনটে ফ্লাট বারি আছে।আমি পজিটিভ ল তে বিস্বাস করি।চোখের সামনে যা দেখি তাই আইন হিসেবে নিতে পছন্দ করি,কিম্বা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাবস্থা গ্রহনে বিস্বাস করি। আমি যেটা পড়ব সেটার উপর আগে আস্থা স্থাপন করব।এইসব তথাকথিত মানুসের কথা সুনে কনফিউজড হয়ে যেও না।"ল" তে হল সবার আগে টেক্সট বই তারপর তোমার টিচার।তুমি টেক্সট পড়ে এসব মানুষের ডূয়াল ফেস উন্মোচন করতে পারবে।

        জবাব দিন
        • সুব্রত (৯৪-০০)

          আমি প্রথম প্রথম টেক্সট না পড়ে এদের কথা সুনে ঘাব্রে যেতাম।যখন থেকে থরলি টেক্সট পরতে সুরু করেছি তখন থেকে আমি মানতে সুরু করেছি "ল"একটি স্পেসিফাইড সাব্জেক্ট।সবসময় মনে রাখবা যেসব টিচার তোমাকে ল এর কোনো ধারনা কে সংগায়িত করতে পারবে না,কিম্বা তোমাকে সুক্ষভাবে সেসব জটিল ব্যাপারগুল বোঝাতে পারছে না তখন বুঝে নিবা সেই টিচারের ঘাটতি আছে।আইনে চাই বুদ্ধি ও মেধা।এসব তথাকথিত ডীগ্রিধারি অনেক আছে ঢাকায় যারা এখনও চুক্তি আইনের সাধারন সঙ্গা দিতে পারবে না। অথচ যদি মফস্বলের অনেক ঘাগু এডভকেট পাবা যারা এসব গুলে খেয়েছে।তাই বলছি সাহস রেখে,বুকে বল এনে এসব মুখোসধারীদের সামনাসামনি হও।দেখবা সাধনা তোমায় ফল এনে দেবে।

          জবাব দিন
          • সুব্রত (৯৪-০০)

            আরেক্টা কথা না বললেই নয়।সমাজের অবহেলিত শ্রেনি হল সমাজের সফট করনার যেখানে আঘাত করলে সব মানুসের সমিহ আদায় করা সম্ভব।আমাদের পলেসি মেকাররা এই কাজ টা খুব ভাল পারে।বড় বড় টিচার যারা তোমাদের পড়ান এটা তাদের একটা কৌশল ছাত্রদের সমিহ আদায় করার জন্য।কিন্তু তারা স্বারথপরের মত ভুলে যান যে এসব কোমলমতি ছাত্র যাদের তারা আইন পরাচ্ছেন তারা সমিহ করার জন্য আইন সিখছে না।শিখছে লড়াই করার জন্য।সমিহ করে আইন সেখার দিন শেষ।এখন লড়াই করে আইন সিখতে হবে।

            জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।