বিজয়ের দিনে বিজয়ীর কথাঃ বিস্মৃত এক সুপারহিরোর গল্প

………………………রাআদ রহমান এবং মাসরুফ হোসেন

শুরুর কথাঃ

“What is it that makes these boys have no fear”???

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ভারতীয় একটি মুভিতে এই সংলাপটি শুনে কেন জানি বিশাল একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং এবং তাঁর সংগীসাথীরা যখন ফাঁসির মঞ্চে হেঁটে যাচ্ছেন-তাঁদের দৃপ্ত পদচারণা দেখে ব্রিটিশ জেলার মিস্টার ম্যাককিনলে বিড়বিড় করে নিজেকেই এ প্রশ্নটি করছিলেন । এটা দেখে আমার মাথাতেও একই প্রশ্নই খেলছিলঃ এই যে যাঁরা যুদ্ধে প্রাণ দেয়, এরাও তো আমাদের মত মানুষ। এরা আমাদের মতই ঝঞ্ঝাটহীন জীবনের স্বপ্ন দেখেছে কোন এক সময়ে, আনন্দের সাথে জীবন কাটিয়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধকালে মরতে চেয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অসামান্য একটা জিনিস দেখতে পাইঃ কিছু কিছু মানুষ সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সম্ভাব্য পরিণতির কথা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার পরেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মৃত্যুর হাতছানিতে সাড়া দেবার। এঁরা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, স্কটিশ বীর উইলিয়াম ওয়ালেসের মত কারো কারো শরীর চার খন্ড করে দেশের চার প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে- ক্ষুদিরামের মত ১৬ বছর বয়েসে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে কাউকে কাউকে। আর এর বিনিময়ে আমাদের মত মানুষেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিরাপদ জীবনের দ্রাক্ষারস ভোগ করে চলেছি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোহিমা এলায়েড সিমেট্রিতে নাম না জানা সৈনিকদের এপিটাফে লেখা দুটি বিখ্যাত লাইন এখানে খুব প্রাসংগিকঃ

When you go home, tell them of us and say,
For your tomorrows these gave their today.

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচাইতে গৌরবদীপ্ত ঘটনা- বাংলাদেশের নাগরিকমাত্রই এটি নিয়ে দ্বিমত করার কেউ থাকার কথা না। কিন্তু দুঃখ, ক্ষোভ আর লজ্জার সাথে দেখি, আমাদের দেশে এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধুমাত্র উদাসীনই নয়, এদের কেউ কেউ পাকিস্তানি বরাহশাবকদের প্রেতাত্মাকে লালন পর্যন্ত করে। এই রাগ থেকেই সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযোদ্ধাদের কথা লিখব-অন্ততঃ নিজের জন্যে হলেও। ভুলভ্রান্তি, অযোগ্যতা , ভাষার ত্রুটি , সামরিক জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা- এগুলো মাথায় রেখেই লিখবো। অনেকটা রবিঠাকুরের কবিতার মাটির প্রদীপের মতঃই

কে লহিবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি
সমগ্র জগৎ রহে নিরূত্তর ছবি
মাটির প্রদীপ ছিল , সে কহিল স্বামী
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি

“জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” বইটির লেখক মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া স্যারের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে ইতোপূর্বে লেখা একটি ব্লগে বলেছিলাম ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা ফতে আলী চৌধুরীকে নিয়ে একটি লেখা দেবার কথা। সেটা ছিল সেই ২০০৯ সালে- এই পাঁচ বছরে নানা কারণে লেখাটি দাঁড় করানো হয়ে ওঠেনি। ২০১৪ সালে এসে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম জাপানে, এবং সেই সাথে পরিচয় হল এমন একজনের সাথে যে কিনা এই দায়িত্বটি আমার চাইতে অনেক ভালোভাবে পালন করতে পারবে। “রাআদ রহমান” বললে আপনারা হয়তো চিনবেন না, কিন্তু “ডন মাইকেল করলিয়নে” ছদ্মনামে ফেসবুক গ্রুপ ক্রিকেটখোরের অসাধারণ সব পোস্টের লেখককে আপনারা অনেকেই চেনেন। আমরা দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম বিজয় দিবসে আমাদের সুপারহিরোদের অন্ততঃ একজনকে নিয়ে যৌথভাবে কিছু লেখার, যার ফলশ্রুতি হচ্ছে এই ব্লগ। এ লেখাটির ৯৫% কৃতিত্ব রাআদের, প্রথম থেকে সপ্তম পর্ব আমাকে করা ওর ইমেইল থেকে সরাসরি তুলে দিচ্ছিঃ

প্রথম পর্বঃ

বনেদী ঘরের ছেলে ছিল ফতেহ আলী চৌধুরী, বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ডিসট্রিক্ট জাজ। একটা আলাদা লেভেলে চলাফেরা ছিল ওর, অভিজাত বংশের কুল ডুড বলতে যা বোঝায়। রংচঙে হালফ্যাশনের জামাকাপড়, চোখে ব্যান্ড লাগানো চশমা(এই ধরণের চশমা পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছে- শস্তা, চোখের সাথে সেঁটে থাকত আর খুব মজবুত),মাঝে মাঝে বাবার সরকারী গাড়িতে করে ভার্সিটিতে যাওয়া-ইত্যাদি ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন। একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতো, নাম গুড়িয়া। অবাঙ্গালী। থাকতো হাটখোলাতেই, ফতেহদের বাড়ির তিনচার বাড়ি পর। প্রতিদিন একবার করে গুড়িয়াকে না দেখলে দিনটাই মাটি হয়ে যেত ওর।পড়াশোনাতেও বেশ চৌকষ ছিল ফতেহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সময়ের অন্যতম হাইপ্রোফাইল সাবজেক্ট ইংলিশে পড়ত , ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিল ও। খেলাধুলাতেও ছিল সমান দক্ষ। বাস্কেটবলটা সবচেয়ে ভালো খেলতো, প্রিয় বন্ধু কাজী কামালউদ্দিনের সাথে পরিচয় বাস্কেটবল খেলতে গিয়েই। কাজী কামালউদ্দিন ততদিনে তুমুল শোরগোল ফেলে দিয়েছে অসাধারন পারফর্ম করে, পাকিস্তান ন্যাশনাল বাস্কেটবল টিমে জায়গা পাবার দাবীটা বেশ জোরালো করে তুলেছে। তবে ফতেহ ছিল সব্যসাচী। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে কেবল বাস্কেটবলই খেলতো না, ক্রিকেটটাও চালিয়ে যেত সমানতালে।ঢাকা কলেজে পড়বার সময় রানা ভাইকে যেদিন এসে বলল ও ক্রিকেটটাও ভালো খেলে, তখন রানা ভাই ভুরু কুঁচকে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন, কোনটা ভালো পারো হে? ব্যাটিং, বোলিং না ফিল্ডিং? সদারসিক ফতেহ রহস্য করে জবাব দিল, ভাই, কোনটাই তো ভালো পারি না, আবার সবটাই পারি। আমি হইলাম অলরাউন্ডার। শুনে তো রানা ভাই গেল ক্ষেপে, মানে কী? টেস্ট নেওয়া হল ফতেহর, একটা ম্যাচে নামিয়েও দেওয়া হল। এইবার রানা ভাইয়ের অবাক হওয়ার পালা, সুন্দর অফ স্পিন করে ফতে, ব্যাটিংয়ে ধুমধাম মেরে কিছু রান করে আসছে, ফিল্ডিংটাও চমৎকার,নিজেই চেয়ে নিল কিপিং করবে, দেখা গেল উইকেটকিপিংও পারে। তব্দা খেয়ে রানা ভাই বলে, কাহিনী কিরে? কাঁচুমাচু স্বরে ফতেহ জবাব দিল, আমিও বুঝতেছি না। মনে হইতেছে কিপিংটাই ভালো পারি, বাকিগুলা অপশোনাল…

এই ছিল ফতেহ, সমাজ-সংসার-দেশ-রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক মানুষ, ঘুরছে, ফিরছে, আড্ডা দিচ্ছে, মজা করছে আর তখনকার ফ্যাশান থিউরি কপচাচ্ছে, বিপ্লবের থিউরি। সবসময় পকেটে ঘুছে মাউ সে তুং এর দ্যা রেডবুক- কমিউনিজমের হটকেক। ভার্সিটির ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের বিপ্লবের মতবাদ শুনে শুনে মার্ক্সবাদী থিউরি বুঝতে নাছোড়বান্দার মত লেগেছে তখন ফতেহ, যেখানে যা পাচ্ছে সব পড়ে ফেলছে এক নিমিষে। রেভলিউশনের মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকা ফতেহ তখনো কল্পনাও করতে পারেনি কি ভয়ংকর এক বাস্তবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। ২২ বছর বয়সী ফতেহর চারপাশে ঘিরে থাকা বিচিত্র সেই জগতের ঠিক বাইরেই তখন চলছিল এক সত্যিকারের বিপ্লব, যে বিপ্লবের ফাউন্ডেশন ছিল ২৪ বছরের দীর্ঘ নিষ্পেষণ, অকথ্য নির্যাতন আর শোষণ, বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝের সরলরেখাটা খুব ক্ষীণ ছিল যে বিপ্লবে, যে বিপ্লবে থিউরির কোন স্থান ছিল না, সবই ছিল নির্মম প্রাকটিক্যাল, যে বিপ্লবটা হয়েছিল একাত্তরে, সময়টা তখন মার্চ, একাত্তরের অগ্নিগর্ভ মার্চ…

দ্বিতীয় পর্বঃ

মার্চের ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় কে যেন হঠাৎ এসে বলল, আজকে রাতে ক্র্যাক ডাউন হবে। ফতেহ তেমন গুরুত্ব দিল না। এ আর এমন কি ? ডেইলিই তো হচ্ছে। আর্মি নামছে রাস্তায়, বিক্ষোভ ঠেকাতে, ঠা ঠা করে গুলি করছে, কিছু মানুষ হুট করে মৃত লাশে পরিনত হচ্ছে, এ তো প্রতিদিনের ঘটনা। সত্যি বলতে কি, রাজনীতি কিংবা জনগনের দাবী সম্পর্কে কখনই তেমন আগ্রহ ছিল না ফতেহর, তাই ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আসন্ন ক্র্যাক ডাউনের খবর পেয়েও তার তেমন ভাবান্তর ঘটল না। সে বরং বেরিয়ে গেল হকিস্টিক নিয়ে, তাদের পাড়াটায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আজিম ভাই( বিখ্যাত চিত্রনায়ক আজিম) এগুলো কিনে দিয়েছেন তাদের। সে রাতে অবশ্য খুব বিচিত্র এক কাজ করল ফতেহ আর তার পাড়ার ছেলেগুলো, তাদের হাটখোলা বড় রাস্তাটায় গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে এল। পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় সবাই বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিচ্ছে, তাদের পাড়া কেন পিছিয়ে থাকবে? কোন আদর্শগত বা স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, স্রেফ পাড়ার ইগো বজায় রাখতেই তারা রাস্তা-ঘাট আটকে দিল। কি উত্তেজনা… শেষ পর্যন্ত ঘুমাতে যেতে বেশ দেরী হয়ে গেল ওদের, এবং ঘুমোবার কিছুক্ষনের মধ্যে হঠাৎ মর্টার শেলিং আর মেশিনগানের ঠা ঠা শব্দে লাফ দিয়ে উঠে বসলো সবাই। বাইরের আকাশ তখন অত্যাধুনিক ট্রেসার বুলেটের ফুলকি আর ফ্লেয়ারের আলোয় আলোকিত, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে আর্তনাদ আর আর্তচিৎকারে। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম এক আঁধার রাতের শুরু ছিল সেটা, যে অমানিশার গালভরা নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। পরদিন বাইরে বেরিয়েছে ফতেহ, হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ভিসতিওয়ালার উপর, (ভিসতিওয়ালা –যারা বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করতেন) ওদের বাড়ির সামনে মানুষটা মরে পড়ে আছে, গুলিতে গুলিতে বুকটা ঝাঁঝরা। সকালে বোধহয় পানি দিতে বেরিয়েছিল, পাকিস্তানী সেনারা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে ওকে, চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছাপটা তখনো স্পষ্ট, যেন এভাবে বিনা কারনে মরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। স্থির হয়ে যায় ফতেহ, হঠাৎ মনে পড়ে যায় একটা মুভির কথা, দ্যা ট্রেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সালটা ১৯৪৪। ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়ামের বিশ্বখ্যাত সব চিত্রকর্ম জার্মান সেনারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক হল, ওদের ট্রেনে হামলা চালানো হবে। ফ্রেঞ্চ গেরিলাদের একটা বাহিনী ওঁত পেতে থাকলো, ট্রেনের যাত্রাপথের সব ষ্টেশনের নাম চেঞ্জ করে ফেলা হল, ট্রেনটাকে নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো রং ডিরেকশনে। রেঞ্জের মধ্যে আসতেই হামলা করল ফেঞ্চ গেরিলারা, প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে কেবল জার্মান সেনাদের কমান্ডার কর্নেল ভ্যান ওয়াইল্ডহাম আর গেরিলা ল্যাভিশে বেঁচে রইল। তাচ্ছিল্যের স্বরে জার্মান কর্নেল বলতে লাগলো, ইউ আর নাথিং ল্যাভিশে, নাথিং বাট আ লিম্প অফ ফ্লেশ। বিউটি বিলংস টু দোজ হু ক্যান এপ্রিশিয়েট ইট, ইউ পিপল নট ইভেন ডিজার্ভ ইট। হঠাৎ ল্যাভিশের চোখ পড়ল কিছু ফ্রেঞ্চের উপর, তার মধ্যে একটা ফুটফুটে মেয়ে, ১৫-১৬ বছর বয়সী, মরে পড়ে আছে। চেহারায় তখনো অসহায় আকুতি। মাথায় আগুন ধরে গেল ল্যাভিশের, পলকের মধ্যে মেশিনগান তুলে গুলি করলো কর্নেলকে। পিকাসো কিংবা ভিঞ্চির অসামান্য চিত্রকর্ম না, তাকে ধাক্কা দিয়েছিল মিষ্টি কিশোরীর নিষ্পাপ মুখটা। ভিস্তিওয়ালার নিষ্প্রাণ অসহায় চেহারাটা দেখতে দেখতে আচমকা সেই ১৫-১৬ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ মেয়েটার মিষ্টি চেহারাটা ভেসে উঠলো ফতেহ’র সামনে, কোন পার্থক্য খুঁজে পেল না সে ভিসতিওয়ালার সাথে। চোয়ালটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল ফতেহর, একটা অস্ত্রের বড্ড দরকার…

তৃতীয় পর্বঃ

শাহাদাৎ চৌধুরী ছিল ফতেহর বড় ভাই, পাঁচ বছরের বড়। অসাধারন ব্যক্তিত্ব, চমৎকার চেহারার এই মানুষটি খুব ভালো প্ল্যান করতে পারতেন। একাত্তরের ২৬শে মার্চ সকালে কেবল প্রতিশোধের প্ল্যান ঘুরছিল তার মাথায়। কিছুক্ষন পর হাজির হল দুধওয়ালা, তারা বেঁচে আছে দেখে খুব অবাক হল। আসতে আসতে রাস্তায় যে বিচিত্র মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ দেখছে সে, সেটা বর্ণনা করতে শুরু করল। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আপনারা আমার বাড়ি চলেন, ত্রিমোহনী এখনো নিরাপদ। কেউ একজন বললো জিঞ্জিরার দিকে যেতে, কিন্তু ফতেহর বাবা জাজ সাহেবের সিক্সথ সেন্স বললো, জিঞ্জিরায় গেলে মহাবিপদ হতে পারে( তার এই আশংকা বড় বিস্ময়ভাবে সত্য হয়ে যায়, জিঞ্জিরায় প্রানভয়ে আশ্রয় নেওয়া মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা, যেটা জিঞ্জিরা ম্যাসাকার নামে পরিচিত।কবি নির্মলেন্দু গুণ এটার কথা তাঁর “আত্মকথা ১৯৭১” এ বলেছেন) ।সুতরাং দুধওয়ালার সাথে চলে যাওয়াটাই বেটার অপশন। তিন বোন, মা আর বড় ভাইকে নিয়ে ত্রিমোহনী চলে এল ফতেহ। স্থির হয়ে বসতে না বসতেই শাচৌ গায়েব, একটু পর তাকে দেখা গেল ফিরে আসতে। ফতেহকে ডাকলেন, এদিক আয়। গোপন শলাপরামর্শ করছেন এমন ভঙ্গিতে ফতেহকে বললেন, কিছু পুলিশ আছে এইখানে, রাজারবাগ থেকে পালায়ে আসছে। গতকাল রাতে তো পাকিস্তানীগুলার সাথে বিশাল ফাইট দিছে পুলিশগুলা, শেষে যখন ভারী এমজি(মেশিনগান) দিয়া ফায়ার শুরু করছে, তখন আর পারে নাই। বেশিরভাগই মারা গেছে, কয়েকজন পলায়ে আসছে এইখানে, এক বাড়িতে আশ্রয় নিছে। চল দেইখা আসি।

পুলিশদের এই বীরত্বগাঁথা শুনে ফতেহ যেন পাল্টে গেল। পুলিশদের সাথে জনগণের সম্পর্ক এখনের মত তখনও ভালো ছিলো না- ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি তখনো টাটকা। “পুলিশ তুমি যতই মারো, বেতন তোমার একশ বারো”– যে পুলিশকে নিয়ে ছাত্ররা টিটকারী করত সরকারের পক্ষে কাজ করার কারণে- সেই হাবাগোবা পুলিশ যদি এভাবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কয়েকটা খেলনা অস্ত্র(পাকিস্তানি আর্মির অস্ত্রের তুলনায় বাঙ্গালী পুলিশের অস্ত্র খেলনাই ছিল)নিয়ে ফাইট করতে পারে মেশিনগান আর ট্যাংকের বিরূদ্ধে, তাহলে আমি কেন বসে আছি?! যুদ্ধে করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফতেহ পুলিশগুলোকে দেখতে গেল ভাইয়ের সাথে। কিন্তু তাদের হতাশ হতে হল। দুধওয়ালা বুঝিয়ে বলল, এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। সারারাত যুদ্ধ করে ভয়ংকর ক্লান্ত মানুষগুলা, বিশ্রাম নিচ্ছে আপাতত, পরে আসেন। মনঃক্ষুণ্ণ এবং কিঞ্চিৎ অপমানিত হয়ে ফিরে আসবার সময় হঠাৎ নদীর পাড়ে নৌকা থেকে কেউ একজন ডাকলো ওদের।কাছে যেয়ে দেখল , নানা বয়সের অনেকগুলা মানুষ, বাক্স-পেঁটরা নিয়ে পালাচ্ছে ওরা। যে ডেকেছিল, সে বাষ্পারুদ্ধ গলায় বলল, ভাই দেখেন তো, রেডিওতে কোন মেজর জিয়া না কে যেন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়া কি বলল… আপনারা কিছু শুনছেন নাকি? আশে পাশে আরও কয়েকজন দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ একজন বলল, হ আমি শুনছি। মেজর জিয়া নামে একজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিছে, একটু আগেই শুনছি। ততক্ষনে আরেকজন এসে বলল, খালেদ মোশাররফের ফোরথ বেঙ্গল রেজিমেন্ট , সফিউল্লাহর সেকেন্ড বেঙ্গল, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ সবাই বিদ্রোহ করছে, যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।

কথাটা শেষ হবার আগেই ফতেহর হাত ধরে শাচৌ বলল, চল, খবরটা পুলিশগোরে দিয়া আসি। এইবার নক করতেই দুধওয়ালা ভিতর থেকে একটু বিরক্তস্বরে বলল, আবার কি ভাই? শাচৌ বলল, জরুরি খবর দিতে হবে, গেটটা খুলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভিতরে নিয়ে গেল দুধওয়ালা, মানুষ দেখেই চমকে উঠলেন এক পুলিশ সার্জেন্ট, শাচৌর পরিচয় দেওয়ার পর ধমক দিয়ে বললেন, কি চাই এইখানে? সমান তেজে জবাব দিল শাহাদাৎ চৌধুরী, কিচ্ছু না, খালি একটা কথা জানাইতে আসছি। ফোরথ বেঙ্গলের কর্নেল খিজির হায়াত খানকে বন্দী করা হইছে, মেজর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহ করছে সেইখানে, সেকেন্ড বেঙ্গলে শফীউল্লাহ, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ বিদ্রোহ করছে, একটু আগে মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছে, ওয়ার ইজ অন—চিৎকার করে কথাগুলা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল শাচৌ। অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো ফতেহ, তার জীবনে এতো পড়াশোনা করা মানুষ সে আর দেখে নাই, শান্ত চেহারার সৌম্য দর্শন ঠাণ্ডা প্রকৃতির এই মানুষটার ভিতরে যে এমন লাভাস্রোত লুকিয়ে ছিল, সেটা কে জানতো?

চতুর্থ পর্বঃ

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির আশফাকুস সামাদ আশফি, বড় ভাইকে তখন হাত পা নেড়ে নেড়ে তারাবো পর্যন্ত চলে আসা দুই ট্রাক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যের খবর দিচ্ছে ফতেহ। শান্ত শিষ্ট ভদ্র ছেলে একটা ছেলে আশফি, কিন্তু তখন সেই মুহূর্তে ফতেহ ওকে চিনতে পারে না। ‘পাঞ্জাবীগুলা এইভাবে মানুষ মারলো? বিনা কারনে,বিনা অপরাধে এতগুলা মানুষ এইভাবে মারা গেল? নো, আই কান্ট টেক ইট এনিমোর, লেট’স ফাইট ব্যাক”। যুদ্ধে যেতে উন্মুখ হয়ে আছে ফতেহও, কিন্তু কিভাবে কোথায় যাবে, পরিচিত কেউ যাচ্ছে কিনা, জিজ্ঞাসা করছিল সে। চিবিয়ে চিবিয়ে আশফি বললো, “বদি, বাদল, বকুল, বাচ্চু সবাই বের হয়ে যাইতেছে যুদ্ধে, আর তুই অখনো বইসা বইসা *** করতাছোস? আরে শালা, বাইর না হইলে ক্যামনে বুঝবি কই যাইতে হইব? আগে বাইর হ”। আশফির চোখ দিয়ে রীতিমত আগুন ঝরছে।( লেঃ আশফি পরবর্তীতে জয়পুরহাটের ভুরুঙ্গামারীতে যুদ্ধে অসমসাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন)

কথাটার ভিতর বোধহয় বারুদ মেশানো ছিল, তাই কয়েকদিন পরেই ফতেহ, মায়া(মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম) গাজি(গাজি গোলাম দস্তগীর বীর বিক্রম) , সিরাজ সহ ছয়সাতজন রওনা দেয়। তাদের সাথে আরও একজনের যোগ দেওয়ার কথা। তার নাম কাজী কামাল(কাজি কামালউদ্দিন) , কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন তার দেখা পাওয়া গেল না, তখন ওকে ফেলেই চলে গেল সবাই। ওরা যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে কাজী কামাল। শাহাদাৎ চৌধুরী আফসোস করে , “আইলা যখন, আরেকটু আগে আইতে পারলা না? ওরা তো ওয়েট করতে করতে চইলা গেল। তাড়াতাড়ি সদরঘাট যাও, মতলবের লঞ্চে খুজবা, দেখো পাইলেও পাইতে পারো।টর্নেডোর বেগে বের হয়ে যায় কামাল, খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত পেয়ে যায় ওদের। ফতেহ বলে, আসছস, ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিজনের টাকা লাগবো ১৭০ কইরা, আনছস ওইটা? কামাল থমকে যায়। যুদ্ধে যেতে যে টাকা লাগতে পারে, সেটা তো তার মাথায় আসেনি। দাঁড়া , আসতেছি, বলেই সে নেমে যায়, হারিয়ে যায় জনারণ্যে।

হুট করে টেনশনে পড়ে ফতে, কই গেল পোলাটা? এখন যদি লঞ্চ ছাইড়া দেয়? মেজাজ খারাপ হতে শুরু হয়েছে কেবল, তখনই হাসিমুখে উদয় হল কামাল। হাতে টাকা। ফতে অবাক, টাকা পাইলি কই? কামাল বাম হাত তুলে দেখায়, ঘড়ির জায়গাটা খালি। এইবার অবাক হয় ফতেহ, এইটা না তোর প্রিয় ঘড়ি ছিল? “’ তাতে কি হইছে?” নিজেকে ডিফেন্ড দেয় কামাল। “টাকা দরকার, বেইচা দিলাম। দেশ স্বাধীন হইলে আবার কেনা যাইব”। অবাক ফতেহ তাকিয়ে থাকে, মুখে কথা যোগায় না।

২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ওঠার পরেই বের হয়ে গিয়েছিল বদিউল আলম, শহিদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ আশফি আর মাসুদ ওমর।নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রথমে পায়ে হেটে যায় কুমিল্লা, সেখানে খবর পায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে মিরেরসরাই, পায়ে হেঁটেই চলে যায় চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে। অবশেষে ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পের খবর পেয়ে আগরতলা হয়ে চলে যায় মতিনগর। তাদের সাথে যোগ দেয় বকুল (মুস্তফা কামাল বকুল) বন্ধুমহলে যাকে বডিবিল্ডার হিসেবে সবাই এক নামে চিনত।ফতেহকে সে হাসতে হাসতে বলেছিল, খায়াদায়া তো বিশাল শরীর বানাইলাম, যাই কয়েকটা পাকি মাইরা আসি দোস্ত। আরও হাজির হয় মানিক, মাহবুব, আসাদ( রাইসুল ইসলাম আসাদ, অভিনেতা) । এপ্রিলের শুরুর দিকে চলে আসে জিয়া( জিয়াউদ্দিন আলী আহমেদ, বীর বিক্রম) , হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, দুই জমজ ভাই মুনির আর মিজান, শ্যামল, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণ এবং মেজর কাইয়ুম। তারপর শেষমেষ হাজির হয় ফতেহরা, মায়াকে মতলব থেকে তুলে নিয়ে সোনামুড়া বন্দর হয়ে আগরতলা হাজির হয় ফতেহ, কাজী কামাল, গাজি, সিরাজ, জুয়েল( আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম) । আগরতলা থেকে ভাগ্যচক্রে মেজর ডাঃ আখতার বীর প্রতীককে পেয়ে যায় ওরা, উনার সাহায্যে চলে আসে মতিনগর। জুনের প্রথম সপ্তাহে ক্যাম্প আরও ১০ মাইল দূরে মেলাঘরে সরিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত মতিনগরেই ছিল গেরিলাদের ট্রেনিং ক্যাম্প।

ফতেহ’র আজো স্পষ্ট মনে পড়ে খালেদ মোশাররফকে, বর্ডারের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের নিচে অ্যাটেনশন হয়ে দাড়িয়ে ছিল ওরা, হঠাৎ নেমে এলেন তিনি, পাথুরে শান্ত চেহারা, সৌম্য দৃষ্টি, তবে একটু ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারা যায় চোখটা আসলে তপ্ত ভাটার মতো জ্বলছে । নেমে কিছু কথা বললেন তিনি, কথাগুলোর ভেতরে বোধহয় বারুদ লুকানো ছিল, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি হল সবার। শেষে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন জনৈক মেজর হায়দারের সাথে, বা হাত ভাঙ্গা, স্লিঙ্গে ঝুলছে। বিকালের মরে আসা নরম আলোয় শক্ত চেহারার ভাবলেশহীন এ মেজরকে ফতেহর হঠাৎ কোন গ্রীক দেবতার স্কাল্পচার বলে মনে হল। পাকিস্তান আর্মির স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের ডাকসাইটে কমান্ডো ছিলেন এই মেজর, তিনিই ঢাকা এরিয়ার কমান্ডার হবেন, তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন হাবিলদার, সুবেদার মেজররা গেরিলাদের ট্রেনিং দেবেন।ফতেহ আলী চৌধুরীর এক ভিন্ন জীবন শুরু হল। মেজর হায়দার নামের এই মানুষটা যে কতটা অসামান্য একজন ইন্সট্রাকটর এবং লিডার ছিলেন, সেটা আরবান গেরিলাদের এই দলটা খুব দ্রুতই বুঝে গেল।

একেবারে বিজন পাহাড়ে জঙ্গল কাটা, তাবু তৈরি, খাওয়া দাওয়ার কষ্টকর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে হাড়ভাঙ্গা ট্রেনিং– সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন মেজর হায়দার। ব্যক্তিত্বের পারফেকশনে কড়া শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের সময় বাঘের মতো ভয় পেত সবাই, কিন্তু যখন কেউ হঠাৎ করেই কিছু একটা শিখে ফেলতো, করে দেখাত নিখুঁত ভাবে, তখন তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠত তাঁর মুখে, পিঠ চাপড়ে বলতেন, ওয়েল ডান, বয়,ওয়েল ডান। ব্যস, সব রাগ-অভিমান ভ্যানিশ।ফতেহ আলী চৌধুরী মানুষ হিসেবে ছিল সদারসিক, কারোর কোন কথা মাটিতে পড়তে দেবে না, জবাব রেডিই আছে। এমন একটা কথা বলবে যাতে মানুষটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও হেসে ফেলতে বাধ্য। মেজর হায়দারের খুব প্রিয় সোলজার ছিল ফতেহ, যেকোনো গুমোট পরিস্থিতি খুব সহজে হালকা করে ফেলতে পারত ছেলেটা। একবার এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং চলার সময় একটা গাছে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে বললেন হায়দার। লাগিয়েই সবাইকে সরে যেতে বললেন, সবাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সরে গেল। সবাই, কেবল ফতেহ আলী ছাড়া। বিকট বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল, তার মধ্যেই হায়দার খেপে গিয়ে ফতেহকে জিজ্ঞেস করলেন, সরে যেতে বললাম না? খাম্বার মতো দাঁড়ায়া ছিলা কেন? চটপটে ফতেহর উত্তর, আপনি তো স্যার যান নাই, আমি কেবল আপনারেই ফলো করছি মাত্র। মরতাম না এদ্দুর সিউর ছিলাম। জবাব শুনে ফতেহকে এই মারেন তো সেই মারেন হায়দার, ফাজিল পোলা, মাইর না খাইলে সিধা হইবা না…

পঞ্চম পর্বঃ

জুনের প্রথম সপ্তাহে মুভমেন্ট অর্ডার আসলো, মতিনগর থেকে আরও ১০ মাইল ভিতরে ঘন জঙ্গল মেলাঘরে ক্যাম্প তৈরি করা হল। প্রথম পর্বের যারা এসেছিল, তাদের ট্রেনিং শেষ। এবার ২য় পর্বে নতুন ছেলেরা আসবে, তাদের ট্রেনিং হবে। প্রথম পর্বের মাঝামাঝি এসে যোগ দিয়েছিল রুমি, সেকান্দার হায়াত, হাফিজ প্রমুখ। বারুদের টুকরো একেকটা, কর্নেল হায়দারের মতো অসাধারন ট্রেনারের ছোঁয়া পেয়ে জ্বলে উঠেছিল দাবানলের মতো, পরবর্তীতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানীদের অন্তরাত্মা। এদের মধ্যে কাজী কামালকে দেখে অবাক হয়েছিল সবাই, প্রভিন্সিয়াল বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন কামাল ডাক পেয়েছিল পাকিস্তান জাতীয় বাস্কেটবল টিমের প্রাথমিক দলেও। যা প্রতিভা ছিল, তাতে যে বাস্কেটবলে এক অসাধারন ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছিল ওর জন্য, তাতে কোন সন্দেহ নাই। ফেলে চলে আসলো সব, খ্যাতি, অর্থ, ক্যারিয়ার কোনকিছুর পরোয়া না করে।

বিদায়ের বাঁশি বাজলো। দুটো মাস একসাথে ট্রেনিং নিতে এবং করাতে যেয়ে এমন এক বাধনে বাঁধা পড়েছিলেন মেজর হায়দার আর গেরিলারা যে সেটা কাটাতে কষ্ট হল খুব। খালেদ মোশাররফের অমিত ব্যক্তিত্বের কারনে তাঁকে সবাই দূর থেকে সম্মান করতো, ভালোবাসতো, আইডল হিসেবে স্যালুট করতো। কিন্তু মেজর হায়দার ছিলেন তাদের খুব আপনজন, খালেদের মতো একই ছাঁচে রাশভারী ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও ট্রেনিংয়ের মাঝে কখন যেন ছেলেদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন মানুষটা। তাই যে রাতে ওদের ঢাকায় অপারেশনে চলে যাবার কথা, সেরাতে এক অদ্ভুত বিষাদ গ্রাস করেছিল মেজর হায়দারকে, শক্ত বহিরাবরণ ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলো বিষণ্ণতার ধূসর চেহারা।
মুক্তিবাহিনীর মাত্র এই ১৭ জন গেরিলাই কাঁপিয়ে দেয় পুরো ঢাকা শহর।এশিয়ার সেরা যুদ্ধবাজের দাবীদার এবং হাজার হাজার প্রশিক্ষিত আধুনিক সোলজার নিয়ে গড়া হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ উড়ে আসা গ্রেনেড আর আঁতকা অ্যামবুশে পড়বার ভয়ে ইঁদুরের বাচ্চায় পরিনত হয়। বিশেষ করে পুরো জুলাই জুড়ে চালানো বেশ কয়েকটা ভয়ংকর অপারেশনের পর এক পর্যায়ে ভয়ের চোটে সন্ধ্যার পর পাকিস্তানীদের নিয়মিত টহলে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। সবসময় এক ভয়ংকর আতংক পিছু তাড়া করে বেড়াত তাদের, একযোগে ঢাকার সবকটা অঞ্চলে অপারেশন চালানোয় প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে ওরা ভাবতো, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বোধহয় ওদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ভয়ে আরও আতংকিত হত ওরা। এই অসামান্য বীরত্বগাঁথা চলতেই থাকে, এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদের থামাতে দ্বারস্থ হয় তাদের এ দেশীয় পোষা বরাহকূলের, যাদের নাম আলবদর।

ষষ্ঠ পর্বঃ

একাত্তরের ২৯শে আগস্ট। আলবদরের কর্মীদের তথ্য মতো সকাল ১১ টায় বদিউল আলম ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিনের বাসা থেকে, শুরু হয় এক যন্ত্রণাময় করুণ অধ্যায়ের। বিকাল চারটার সময় ধরা পড়ে আব্দুস সামাদ, অকল্পনীয় টর্চারের মুখে সে আলতাফ মাহমুদের ঠিকানা বলে দিতে বাধ্য হয়। বদি আর সামাদের ধরা পড়বার খবর পেয়ে ইশ্তিয়াক আজিজ উলফাত ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়, বেবিট্যাক্সিতে চড়ে চলে যায় ৩০ নম্বর হাটখোলা, ফতেহ আলী চৌধুরী আর শাহাদাৎ চৌধুরীর বাসায়। গেটের সামনেই পেয়ে যায় ফতেহকে, জানায় রেইড আসন্ন। শাচৌ তখন মেলাঘরে, কিন্তু রিস্ক তারপরও ছিল। বাবা ডিসট্রিক্ট জাজ আবদুল হক চৌধুরী, মা, তিনটা বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা- প্রত্যেকেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র গোলাবারুদ লুকায়ে রাখা, সেই গুলা পরিচর্যা করা, যত্ন নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, আপনজনের মতো দেখভাল– সব কিছুই করতো এরা অদ্ভুত নিষ্ঠার সাথে… তাই খবরটা পাওয়া মাত্র তিন বোনকে উলফাতের বেবিট্যাক্সি করতেই আরেক বোনের বাসায় নিয়ে যায় ফতেহ। তারপর সেইখান থেকে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোড, জাহানারা ইমামের বাসা খুঁজতে। কিন্তু বহু খুজেও প্রিয় সহযোদ্ধা রুমির বাসাটা খুঁজে পায় না ও। ভয়ংকর দুর্ভাবনায় বিফল মনোরথে ফিরে যায় ফতে, আর সেইদিনই রাত ২ টার ধানমণ্ডির কনিকা থেকে জামি, রুমি, শরীফ ইমাম, মাসুম, হাফিজ এই পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা। একই সময়ে আরও রেইড হয় শাচৌ-ফতেহর হাটখোলার বাসায়, দুই গেরিলাকে না পেয়ে সেনারা বাড়ির জামাই বেলায়েত হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। বড় মগবাজারে আজাদের বাসা থেকে ধরে নেয়া হয় আজাদ, জুয়েল,বাশারসহ চার-পাঁচজনকে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে পেটে গুলি করা হয় আজাদের খালাতো ভাই টগরকে। ১৭ জন বঙ্গশার্দূলের মধ্যে ধরা পড়ে ১৫ জন।

সপ্তম পর্বঃ

মেলাঘর। দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়াটার। খালেদ মোশাররফ আর এটিএম হায়দারকে ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেপুলের দুর্ধর্ষ সব অপারেশনের গল্প বলছেন শাহাদাৎ চৌধুরী। শুনছেন আর প্রচণ্ড খুশিতে চোখ-মুখ ঝলমল করছে দুই সেনানায়কের, শহিদুল্লাহ খান বাদল প্ল্যান করছেন ভারী অস্ত্র আর আরও বেশি গোলাবারুদ কবে পাঠানো যায় সেটা নিয়ে। নতুন আর্মসগুলো নিয়ে ৬ই সেপ্টেম্বরের আগেই পৌছাতে হবে , এটা ভাবতে ভাবতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন শাচৌ। ধোঁয়াটা ছাড়তেই হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড় থেকে ঝড়ের বেগে কেউ একজন নেমে আসছে। একটু সামনে আসতেই চেনা যায় মানুষটাকে, ফতেহ আলী চৌধুরী। রেগে যান শাচৌ, ঢাকার অপারেশন ফালায়া এইখানে কি তোর? ফতেহ সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষনে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে বাকিরা। ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সবগুলো অপারেশনে অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা ফতেহ আলীর চেহারাটা বিধ্বস্ত দেখায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সে ধীরে বলে যায়, সব শেষ হয়ে গেছে স্যার। সব শেষ হয়ে গেছে। রেইড হইছিল, ওরা সবাই ধরা পড়ছে।
উপস্থিত মানুষগুলার উপর যেন হুট করে বজ্রপাত হয়। মেজর হায়দার হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যায়, বাকিরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ভয়ংকর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যন্ত্রণাটুকুও বোধহয় তাদের স্পর্শ করতে দ্বিধায় পড়ে যায়। অসামান্য দৃঢ় ভাবলেশহীন পাথর মেজর হায়দারকে পাওয়া যায় তাঁর তাবুতে, বালিশটা তুলে তাতে মুখ গুঁজে শিশুদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি, গুমরে গুমরে কান্নার শব্দের সাথে সাথে অস্ফূট শব্দ শুনতে পায় তাঁবুর বাইরের কেউ কেউ- মাই বয়েজ… মাই বয়েজ…
সেপ্টেম্বরে আবার প্রস্তুত হল গেরিলারা। ক্র্যাক প্লাটুনের ২য় পর্বের বিশাল দলটাকে পাঠানো হবে ঢাকার আশেপাশের থানাগুলোতে, আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ, ত্রিমোহনী। তিনটা সেকশনে বিভক্ত করে তিন জন কমান্ডার চূড়ান্ত করা হল। মায়া, গাজি আর ফতেহ আলী। মেজর হায়দার তাদের ইন্সট্রাক্ট করতে বর্ডার চলে এলেন। অস্বাভাবিক গম্ভীর আর বিষণ্ণ হায়দার, ডাকলেন, ” ফতেহ , কাছে এসো”। ফতেহ সামনে এগিয়ে গেল, পিঠে হাট রেখে বিষাদে ঢাকা গলায় হায়দার বললেন, তোমার মনে আছে, একদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি সবচেয়ে ভালবাসো কাকে? ফতেহ বলল, জি স্যার, মনে আছে। হায়দার বলে চলেন, “তখন তুমি বললে, নিজের জীবনকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো। কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল, কেউ তো এভাবে সরাসরি বলে না। বললাম, তাহলে যুদ্ধে এলে কেন? তুমি বলছিলা, সেইটা বাংলাদেশকে দিতে”। বলতে বলতে বুকে টেনে নিলেন ফতেহকে, শক্ত করে চেপে ধরলেন। ভারী গলায় হুকুম দিলেন, “জাস্ট ডোন্ট ডাই, দ্যাটস মাই অর্ডার”। বাধ্য সোলজারের মতো ফতেহ বলল, ইয়েস স্যার…

অষ্টম পর্বঃ

বিজয়ের আগ পর্যন্ত ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা ঢাকার আশেপাশে পাকিস্তানী সেনাদের উপর প্রবল প্রতাপে আক্রমন চালিয়ে গেল। মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনীর আক্রমন, ইন্ডিয়ান এয়ারস্ট্রাইক, গেরিলাদের মুহুর্মুহু অ্যামবুশ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী টিকতে পারল না, পালিয়ে গেল ঢাকা শহরের ভেতর।

অবশেষে এল ১৬ই ডিসেম্বর, মেজর হায়দার আত্মসমর্পণের সময় থাকবেন শুনে ফতেহ আলী চৌধুরী তার যোদ্ধাদের নিয়ে কাদা জল, ঝোপ জঙ্গল ভেঙ্গে চলে এল ঢাকায়, স্যারের পাশে থাকবে। ১৭ই ডিসেম্বর সকালে রেডিও অফিসে চলে গেল আলম আর ফতেহ, সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটে পাক বেতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বেতারের যাত্রা শুরু হল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ ঘোষণা পাঠ করলেন মেজর হায়দার। হায়দারের নির্দেশে আলম আর জিয়া সেন্ট্রাল জেল খুলে বন্দীদের মুক্ত করে দিল। তারপর সন্ধ্যায় একযোগে সবাই মিলে ঘেরাও করল ডিআইটি ভবন। ভবনে অবস্থিত টেলিভিশন সেন্টার দখলে নেবার পর প্রথমে পর্দার পর্দায় বড় করে লেখা উঠলো বাংলাদেশ টেলিভিশন। তারপর গেরিলা বাহিনীর প্রতি মেজর হায়দারের নির্দেশ ডিসপ্লে আকারে প্রদর্শিত হতে থাকলো স্ক্রিনে। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল ফতেহ আলী চৌধুরীকে। ফতেহ আলী বিশেষ ঘোষণা পাঠ করবার পর বিশেষ নির্দেশাবলী ও ঘোষণা পাঠ করলেন মেজর হায়দার,তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। এই ইতিহাসের এক অন্যতম অংশ ফতেহ আলি চৌধুরী এরপর হঠাৎ হারিয়ে গেল, চলে গেল আড়ালে।

১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের পর ফতেহ আলি চৌধুরীকে আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়নি। অনেক টেলিভিশন চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছে, পত্রিকা তাকে নিয়ে করতে চেয়েছে রিপোর্ট, কিন্তু ফতেহ আলি রাজি হননি। অডিও কিংবা ভিডিও সাক্ষাতকারের জন্য অনুরোধ করলে রেগে যান তিনি, এক বিচিত্র ক্ষোভ বেরিয়ে আসে তাঁর ভেতর থেকে, হু অ্যাম আই? আমি কেন? আমার সাক্ষাৎকার কেন নিতে চাচ্ছ তোমরা? আই এম নট অ্যা হিরো। সত্যিকারের হিরো দেখতে চাও? সত্যিকারের হিরো ছিল তরু ওস্তাদ, মুনির ওস্তাদ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ সেনা ছিল তারা। সেক্টর টু-এর হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে ওরা, পাকিস্তানির সেনাদের সাথে চোখে চোখ রেখে ফাইট করছে। আজকে তারা কই? গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার গ্রামে এমন অসংখ্য আনসাং(Unsung) হিরো আজ অবর্ণনীয় দুঃখ- কষ্ট যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছে , যারা সত্যিকারের বীর ছিল। পারলে তোমরা তাদের কাছে যাও, সাক্ষাৎকার নিতে হলে তাদের সাক্ষাৎকার নাও। এখানে কি চাও তোমরা? এক মুক্তিযোদ্ধা ভয়ংকরভাবে আহত হয়েছিল, গুলিতে তার পেট ঝাঁজরা হয়ে গেছে, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার কিছু বলার আছে? আপনার পরিচয় দেন, আপনার বাড়ি কই? ঠিকানাটা বলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কোনমতে সে বললো, দুই নাম্বার সেক্টরেই আমার ভাই যুদ্ধ করে। ছোট বেলা থেকে সে আমারে ভিতু বইলা ক্ষেপাইত, বাপ-মা বহুত আফসোস করত আমার সাহস নাই বইলা। আপনি তারে খুঁজে বের করবেন। তারে বলবেন, আমি একলা কাভারিং ফায়ার দিছি, প্লাটুনের সবাই বাঁইচা গেছে। আপনি তারে বলবেন, আমি যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছি। আমি ভয় পাই নাই। কথাটা শেষ করে সে আমার কোলেই মারা গেল। তোমরা এই ধরনের অসংখ্য আনসাং হিরোদের বের করো। হোয়াই মি?হোয়াই মি? সুবেদার ওয়াহাবের কথা লিখ, শহীদ সুবেদার বেলায়েতের কথা লিখো, হারকিউলিসের মত বীরত্ব দেখাইছিল বেলায়েত, জাস্ট ওর একলার বীরত্বে সালদা নদী স্টেশন ঘাঁটি ছেড়ে প্রানটা হাতে নিয়ে পালাইছিল পাকিস্তানীগুলা, পেছনে ফিরে তাকানোর সাহসটা পর্যন্ত ছিল না। তোমরা ওদের বীরত্বগাথা তুলে আনো… । টর্চার সেলে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছিল রুমিকে, কিন্তু কোন তথ্য দেয় নাই রুমি, চোখে চোখ রেখে শুধু বলছিল, “You people are going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you- I can tell you this much”। ভয়ংকর মার খেয়েও বদি ঠাণ্ডা গলায় বলছিল, আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল… ওদের কথা বলো, আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার কি হল? জীবন দিল জুয়েল, মরে গেল বকর, আর আমি এখন নিজেকে বীর বলে বাহাদুরী করবো? তোমরা ভাবছটা কি?

******* ********** ********** ********

ফতেহ আলি চৌধুরীরা এভাবেই নিজেদের আড়াল করে রাখতে চান, মুক্তিযুদ্ধের ব্রাদার এ্যাট আর্মসদের হারিয়ে এভাবেই তাদের মুহূর্তগুলো কাটে অসম্ভব আক্ষেপ আর যন্ত্রণায়।ইতিহাস কখনই লেখা যায় না, তবুও ইতিহাসের ধুলো পড়া পাতায় তাদের পরিচয় লেখা হয় কাঁচা হীরেয়, তাদের নামটা ইতিহাসের অধ্যায়ে উচ্চারন হয় আনসাং হিরো হিসেবে, চিরকাল।

আমার কথাঃ

অনুজপ্রতিম রা’দের লেখা এখানেই শেষ। লেখাটি পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে উঠেছে বারবার, অঝোর ধারায় কেঁদেছি। ফতেহ আঙ্কেলের সাথে আমার পরিচয় তাঁর মেয়ে সিমিনের মাধ্যমে , বিশ্ববিদ্যালয়ে ও আমার সহপাঠী ছিলো। গত রোজার মাসে আংকেলের সাথে তাঁর বনানীর বাসায় প্রথম দেখা করি। সে সময়ে তিনি ক্র্যাক প্লাটুনের দুটি অপারেশনের কথা বলেছিলেন, আর ফোনে তাঁর সাথে আলাপের মাধ্যমে বেশ কিছু খুঁটিনাটি তথ্য পেয়েছি যেগুলো এই লেখায় যুক্ত করে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি।

১) ক্র্যাক প্লাটুন নামটা কিভাবে এল?

কিংবদন্তী অনুযায়ী,মেজর খালেদ মোশাররফ এই আরবান গেরিলাদেরকে বলেছিলেন ঢাকা শহরে যেটুকু সম্ভব অপারেশন চালাতে যাতে পাকবাহিনী কিছুটা হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। আর এই পাগলের দল করল কি, ঢাকা শহরের সবচাইতে সুরক্ষিত জায়গা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ( বর্তমান হোটেল শেরাটন) সামনে বোমা মেরে আসল। ওখানে তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর মিশনের সদস্যরা অবস্থান করছিল। তারা তাদের রিপোর্টে পরিষ্কার উল্লেখ করে যে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়- যেটা “স্বাভাবিক” দেখাতে পাক সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। এই সংবাদ শুনে মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর চোখ কপালে তুলে বলেন- “মাই গড, দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল!” সেই থেকে এই দলটির নাম হয় ক্র্যাক প্লাটুন। তবে ফতে আলী চৌধুরী এই কিংবদন্তী সম্পর্কে মন্তব্য করেননি(তাঁর এটা জানার কথাও না, তখন তিনি ঢাকায়, অপারেশনে)। তিনি বলেছিলেন, মেজর খালেদ মোশাররফ এমন একটি দল চাইছিলেন যেটি কোন ব্যক্তির নামে ( জেড ফোর্স, কে ফোর্স ইত্যাদি) হবেনা, এটা হবে একেবারে হাত দিয়ে বাছাই করা সদস্যদের একটি অত্যন্ত স্পেশালাইজড বা ক্র্যাক টিম( আরবান ডিকশনারি অনুযায়ী ক্র্যাক শব্দটির একটি অর্থ অতিমাত্রায় বিশেষায়িত বা Highly Specialized )। মূলতঃ এই ধারণা থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন নামটির উৎপত্তি। তবে লিজেন্ড সত্যি হোক বা না হোক, প্রথম ব্যাখ্যাটিও আমার পছন্দ। ক্র্যাক বা পাগল না হলে কি এরকম সাহস দেখানো সম্ভব?!

২) প্রথম প্লাটুনে এই ১৭ জনের ম্যাজিক ফিগারটা কিভাবে এল?এদের নির্বাচন করা হত কিভাবে?

তুর্কি যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি মাত্র সতের( মতান্তরে ১৮) জন অশ্বারোহী যোদ্ধা সংগে নিয়ে বাংলা জয় করেছিলেন। ক্র্যাক প্লাটুন গঠন করার সময় সদস্যদের মনোবল বাড়াতে ইতিহাসের এই গল্পটি তাদের শোনানো হয় এবং বলা হয়, “ তোমরা এই সতের জন মিলেই দ্বিতীয়বার বাংলা জয় করবে”। যেহেতু ঢাকায় অপারেশন করতে হবে, মূলতঃ দুটো বিষয়ের দিকে নজর দেয়া হয়েছিলোঃ

ক) ঢাকার স্থানীয় ছেলে হতে হবে, যারা ঢাকার অলিগলি চেনে। এরকম হলে অপারেশনের পর দ্রুত উধাও হয়ে যাওয়াটা সহজ হবে।

খ) কথাবার্তা, ট্রেনিং ইত্যাদিতে চৌকষ বা স্মার্ট হতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকা লাগবে যাতে বিপদ বুঝে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে । ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডি এম সি বা বুয়েটের ছাত্র, যারা ঢাকা শহর নিজের হাতের তালুর মত চিনতো।

ইতিহাসে বখতিয়ার খলজির অবস্থান যা-ই হোক না কেন, ফতেহ আংকেলের দেয়া এই তথ্যটি লেখায় সংযুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেছি, একেবারেই নতুন এই বিষয়টি।

৩) শহীদ আবু বকরের কথা বারবার বলছিলেন ফতেহ আংকেল। ১৮ বছর বয়েস, রাজপুত্রের মত চেহারা, সেই সময়ে গুলশানে বাড়ি, বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বিপদ এড়ানোর সব রকমের সুযোগ থাকার পরেও সব ছেড়েছুড়ে ও চলে আসল যুদ্ধে- দেশমাতার ঋণ শোধ করার শপথ নিয়ে। ওর একেবারেই নিষ্পাপ চেহারা আর অল্প বয়েস খুব কাজে লাগত গেরিলাদের। ট্রেনিং থেকে শুরু করে পুরোটা সময় ফতেহ চৌধুরীর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো ও, উনি যেখানেই যেতেন ও তার সংগে সংগে ছায়ার মত সে ও লেগে থাকত।প্রথম প্রথম সরাসরি যুদ্ধে ওকে যেতে দেয়া হত না, কিন্তু একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক কিছু কাজে ও ছিলো আলটিমেট চয়েস।এরকম একটা কাজ ছিলো হেড অফ ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স(আইএসআই), পূর্ব পাকিস্তান- গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে পরিবারসহ ভারতে পৌঁছে দেয়া।এই অফিসার পাক ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম সিনিয়র অফিসার হলেও হলেও বাংগালী বিধায় পাকিরা তাকে বিশ্বাস করতোনা, কঠোর নজরদারীতে রাখতো।এই ভদ্রলোক পরিবারসহ একটা বিয়ে খেতে এসে সেখান থেকে ক্র্যাক প্লাটুনের এক জ্যেষ্ঠ মেম্বারের সহায়তায় পালিয়ে এসে বাসাবোতে একটা সেইফ হাউজে উঠলেন।সেখানে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় বকরের, ফতেহ আর বকরের দায়িত্ব পড়ে তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেবার।এদিকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলাম(পরবর্তীতে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের এয়ার ভাইস মার্শাল ) নিখোঁজ হবার পর পাগলা কুকুর হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা, হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাঁকে।কারণটা স্বাভাবিক, যিনি ইন্টেলিজেন্সের এত সিনিয়র অফিসার, তাঁর কাছে ওরা নতুন তথ্য না দিলেও ইতোমধ্যে দেয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তো ছিলোই- সেগুলোও যুদ্ধে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে সক্ষম হত। আমাদের দুই “ক্র্যাক” (তারছেঁড়া অর্থে) সদস্য, যাদের বয়েস যথাক্রমে ১৮ এবং ২২, সিদ্ধান্ত নিলো এরকম বিপজ্জনক একজন সংগীকে তার পরিবারসহ নিয়ে যাবে ঢাকার বুক থেকে সোজা ভারতে, সব রকমের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। পাঠক, কল্পনা করুন তো, যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের কর্নেল র‍্যাংকের একজন আপনাদের পক্ষে কাজ করার জন্যে পালিয়ে এসেছেন , আর আপনার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে তাঁর স্ত্রী আর শিশুপুত্রসহ বর্ডার পার করে দেশের বাইরের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। স্বয়ং মাসুদ রানাও রীতিমত গর্ববোধ করত এরকম একটা মিশন সাকসেসফুল করতে- এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হবার প্রয়োজন পড়েনা। আমাদের সুপারহিরো ফতেহ আলী চৌধুরী আর তাঁর সংগী বাকের এই কাজটা করেছিলো,পরিবারসহ এভিএম ইসলাম সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলো ভারতের সোনামূড়াতে, যেখানে মুক্তিবাহিনীর একটি মেডিকেল ইউনিট অবস্থিত। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) আখতার এলেন, তিনি খবর দিলেন মেজর খালেদ মোশাররফকে।মেজর খালেদ মোশাররফ ফোনে কি কি জানি ইন্সট্রাকশন দিলেন- পুরো এলাকা গরম হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের ভেতরেই ভারতের ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এলেন, সংগে ডজনখানেক উচ্চপদস্থ অফিসার। প্রথমে তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি এরকম একটা কান্ড ১৮ আর ২২ বছর বয়েসি দুটো বাচ্চা ছেলে ঘটাতে পারে,এত এত চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে এরকম হাই প্রফাইল কাউকে বর্ডার পার করে দিতে পারে। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিলো যে ফতেহ আর বকরকে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হল, নেয়া হল আলাদা আলাদা লিখিত স্টেটমেন্ট। যাচাই বাছাই শেষে সত্যতা প্রমাণের পর ভারতীয় অফিসাররা এভিএম ইসলাম সাহেবের নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে নিয়ে রাখলেন রেড ফোর্টে, সেখান থেকে পাকিস্তানের যাবতীয় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করল মিত্রবাহিনী।। ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী তখন আশেপাশেই ছিলেন, তিনি ফতেহকে ডেকে বললেন- “ ফতে, তুই এইটা কি করছোস!!!! দিলি তো ব্যাটা পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজায়ে!!এই অসম্ভব কাজ তুই কেমনে করলি?”

এই ৪৩ বছর পরে অতি সাধারণ বংগসন্তান আমারও একই প্রশ্ন- “আংকেল, এই অসম্ভব কাজ কিভাবে করলেন?”
উত্তর পাননি শওকত আলী, উত্তর পাইনি আমিও, তবে ফতেহ আংকেলের মৃদু হাসির শব্দ কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলেছিলো। একাত্তর আসলে ছিল এক রূপকথার সময়, আর সেই রূপকথার জিয়নকাঠির ছোঁয়াতে ফতেহ আলীরা হয়ে উঠেছিল একেকজন মৃত্যুঞ্জয়ী রাজকুমার, তলোয়ার হাতে পংখীরাজ ঘোড়ায় যারা সংহার করেছিল বাংলার নরম মাটিতে থাবা বসানো পিশাচ আর দানবের দলকে।
যতই বীরত্ব দেখাক না কেন, বাস্তব জীবন তো আর হলিউড মুভি না- ভয় সবারই লাগে। এরকম দুর্বল মুহূর্তে বকর সব সময় ফতেহ চৌধুরীর কাছে সাহস নিতে চেষ্টা করত। ফতেহ অভয় দিয়ে বলতেন, চিন্তা করিস না বকর, আমি থাকতে কোন কিছু তোকে ছুঁতেও পারবেনা। ২৯ আগস্টের অল্প কিছুদিন আগে বড় একটা অস্ত্রের চালান নিয়ে বেংগল রেজিমেন্টের কিছু লোকদের সাথে করে ত্রিমোহনীতে আসে বকর আর ফতেহ, গুরু আর শিষ্য।দুজন কি কারণে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন, বকর আগেই গিয়েছিলো ফকিরবাড়ি নামের একটা জায়গায়, অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতে। হায়, এই বিচ্ছেদই হল কাল, ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত বকরও ধরা পড়ল ২৯ আগস্টে। “ মাসরুফ, কথা দিয়েছিলাম আমি জীবিত থাকতে আমার সাথে থাকলে ওর কিচ্ছু হবেনা-। কিন্তু আমার বকর মারা গেল সেই একাত্তরে, কই এই ৪৩ বছর ধরে আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। বকর, ভাই আমার, তোকে বাঁচাতে পারলামনা…” ফতেহ আংকেল ফোনে এ কথাগুলো বলছিলেন। একাত্তরের ২২ বছরের প্রাণোচ্ছ্বল তরুণ ফতেহ আলী চৌধুরী আজ অসম্ভব রাশভারী মানুষ, আবেগ বুঝতে দেননা- কিন্তু হাজার মাইল দূরে বসে তাঁর হাহাকার শুনে কার সাধ্য চোখের পানি আটকে রাখে! “আংকেল, আমাকে দুই মিনিট দিন”- এই বলে চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম।

bakar

(শহীদ আবু বকর বীর বিক্রম)

৪) সরাসরি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কখনো, আংকেল? জিজ্ঞাসা করেই নিজের উপর খুব রাগ হল, ক্র্যাক প্লাটুনে যোগদানটাই তো মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানানোর সামিল! তবে তিনি নিরাশ করলেন না।বলতে শুরু করলেন রোমহর্ষক এক গল্পঃ

“২৯ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের সবাই ধরা পড়ার পর রক্ত উঠে যায় আমার মাথায়- প্রতিশোধ নিতে হবে। এবার আরো বড় দল নিয়ে মেজর হায়দারের নির্দেশে বাংলাদেশে আসি আমরা- ঢাকার আশেপাশে অপারেশন চালাতে। প্রথমে আমরা ঘাঁটি গাড়ি রূপগঞ্জে।একদিন হঠাৎ সুযোগ পেয়েও গেলাম,একটু দূরে ডুমনী বাজারে। ওখানে দেখি জনাদশেক পাকসেনা বাজার থেকে জিনিসপত্র নিতে এসেছে।ওরা কিছু বোঝার আগেই গুলি চালালাম- আমার সাথে অন্যরাও ছিলো। বাজার করতে আসা পার্টি ওখানেই খতম , আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটলাম নিজ অবস্থানে।বুঝতে পারছিলাম, ওরা ভোররাতের দিকে সর্বশক্তিতে আমাদের আক্রমণ করবে। সিকোয়েন্সটা ছিলো এরকমঃ আমাদের আক্রমণ(ডুমনী), এর প্রতিক্রিয়ায় ভোররাতে আমাদের ওপর ওদের আক্রমণ- এবং সেটা আগে থেকেই আঁচ করে ওদের আক্রমণের পথে আমাদের এ্যামবুশ। মাথামোটা পাকসেনারা কঠোর সামরিক ট্রেনিং পেলে কি হবে, আউট অফ দা বক্স চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের ছিলনা, যেটা ছিলো আমাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। গর্ধবগুলোর মাথায় কি চলছে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর আমরা মোটা্মুটি ছকে ফেলার মত করে অনুমান করতে পারতাম। রোজার সময়ে সারাদিন ইছাপুর বাজারে ঢোকার পথগুলোতে এ্যামবুশ পেতে বসে আছি, কিন্তু হায়েনাগুলোর দেখা নেই।এভাবে বসে থাকতে থাকতে ভীষণ ক্ষুধা লেগে গেল। আমি তখন অস্ত্রসহই এ্যামবুশ পজিশন থেকে বেরিয়ে বাজারের ভেতরে গেলাম। একটা দোকানের কাছে গিয়ে হঠাৎ দেখি খাকী পোশাক পরা কে জানি আমার দিকে পিঠ দিয়ে এলএমজি(লাইট মেশিন গান) পজিশন ঠিক করছে। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি হারিয়ে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলঃ কে????????? সংগে সংগে পাকি সৈন্যটা আমার দিকে ফিরল। তবে ওই ব্যাটা ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই ওর গায়ে পুরো ম্যাগজিন খালি করলাম।গুলির শব্দে চারিদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম। ইছাপুর বাজারের ভেতরে হাঁটুপানির একটা খাল ছিলো, ওটাতে পড়লাম, পেছন থেকে আমাকে ধাওয়া করছিলো পাকসেনারা। এদিকে দলের লোকজনের কাছে বাজারের লোক খবর দিলো আমাকে পাকিস্তানিরা ধরে ফেলেছে, আর বিরাট পাকসেনার দল বাজারে আক্রমণ করেছে। এদেশী রাজাকারের বাচ্চারাই পাকিদেরকে আমাদের এ্যামবুশ ফেলে রাখা সাধারণ রাস্তাগুলো না দেখিয়ে অলিগলি চিনিয়ে দিয়েছিলো, যার ফলে এ্যামবুশ পেতে লাভ হয়নি। আমার সহযোদ্ধা ছিলো বক্সার আইউব, কাশেম আনসারী, আউয়াল, আজিজ, গায়ক আজম খান এবং তৎকালীন আনসার বাহিনীর একজন কমান্ড্যান্ট। গোলাগুলির শব্দ শুনে একদল গেল আর্মস রক্ষা করতে, আরেকদল গেল শত্রুপক্ষের এ্যাডভান্স আটকাতে। এল এম জি দিয়ে কভার ফায়ার দেবার কথা উঠতেই ধমকে উঠলাম, মাত্র দুটা এল এম জি, কোন অবস্থাতেই শত্রুপক্ষের হাতে পড়তে দেয়া যাবেনা। সহযোদ্ধারা একযোগে ইছাপুর বাজারে চলে আসা পাক আর্মির উপর পাল্টা আক্রমণ করায় সেদিন ভাগ্যক্রমে রক্ষা পাই আমি”।

৫) স্বাধীন বাংলাদেশের টেলিভিশন বিটিভিতে ঘোষণা দেয়া প্রথম মানুষটি যে ফতেহ আলী চৌধুরী এটা আগেই আমরা জেনেছি। চলুন দেখে নিই ঠিক ঘোষণার মুহূর্তের ছবিঃ
fateh btv

ফতেহ আলী চৌধুরীর প্রারম্ভিক ঘোষণার পরেই মেজর এটি এম হায়দারের ঘোষণার স্থিরচিত্র নীচে দেয়া হলঃ

fateh 3

দুটি ছবিই হাবিবুল আলম বীরপ্রতিক রচিত “ব্রেভ অফ হার্ট(২০১০)” বইটি থেকে নেয়া।

২০০৮ সালে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আসরার চৌধুরী(যিনি আমারও সরাসরি শিক্ষক) বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ডেইলী স্টারের পক্ষ থেকে গেরিলা ফতে আলী চৌধুরীর একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। এ প্রসংগে আসরার চৌধুরী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,

“I was just the rubber-stamp of history. If I weren’t there that day, somebody else would have done what I did. In the words of my friend, the noted singer Azam Khan, I want to say ‘’Today Bangladesh is free. And this is my achievement.’”

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কৃত্রিম বিতর্কের এই যুগে তাঁর এই দৃপ্ত , অসংকোচ উচ্চারণ কেন জানি বড় অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে!

শেষের কথাঃ

ক) এবছরের শুরুতে সরকারী কাজে ইউরোপ গিয়েছিলাম, ফেরার পথে পড়েছিলো ইস্তানবুল। ১৪৫৩ সালে সুলতান মেহমেত দি সেকেন্ড ইস্তানবুল জয় করেন।তাঁর সমাধি যেখানে, সে জায়গাটিতে একটি মসজিদ স্থাপন করা হয় যার নাম জা’মি ফাতিহ। এই মসজিদের উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রায় পাঁচ বছর আগে প্রতিশ্রুত একটি ব্লগ লেখার কথা। স্থানীয় তুর্কি গাইডকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম “ফাতিহ” ( বা ফতেহ) শব্দটির অর্থ বিজয়ী, যেটি আমাদের বীর ফতেহ আলী চৌধুরীর নামের সাথে হুবহু মিলে যায়। সে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিই বিস্মৃত এই বীরকে আমার সাধ্যমত ফিরিয়ে আনব লোকচক্ষুর আড়াল থেকে, লিখে নেব তাঁর বীরত্বের কাহিনী, যেন আমার সন্তানাদি এই বীরদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়, উজ্জীবিত হয় হয় স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে। সহোদর না হয়েও সহোদর রাআদ রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ওর কারণেই এই লেখাটি আলোর মুখ দেখতে পেল। শুরুতে একবার বলেছিলাম, আবারও বলি, রাআদ না থাকলে এ লেখাটি দাঁড় করানো ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি।

খ) ফতেহ আলী চৌধুরী, যাঁর নামটির অর্থই বিজয়ী , যুগে যুগে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে যাবেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে- এ লেখাটির উদ্দেশ্য মূলতঃ এটিই। আজ থেকে দশ বা বিশ বছর পরে হয়ত প্রত্যক্ষ মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়া কেউ আর আমাদের মাঝে থাকবেন না, তাই আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কাউকে পাওয়ামাত্র তাঁর গল্পটুকু লিখে রাখতে পারি। দেশমাতৃকার কাছে প্রতিটি প্রজন্মের একটি দায়বদ্ধতা থাকে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার মাধ্যমে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। আমরা যারা বর্তমান প্রজন্ম, আমাদের দায়িত্ব এই দেশটাকে ঠিকঠাক গড়ে তোলা- যে সোনার বাংলা গড়তে তাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন সেই সোনার বাংলা ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে আক্ষরিক অর্থেই দাঁড় করানো। আমরা জানি আমাদের দেশটা হাজার হাজার সমস্যায় জর্জরিত, একেকটা দিন পার করা প্রায় যুদ্ধ লড়ার মতই কঠিন হচ্ছে দিনকে দিন। তবুও, কোনও দেশ কি আর জন্ম থেকেই পারফেক্ট হয়? ওটাকে পারফেক্ট বানাতে হয়- আর এই কাজটা করার দায় আমাদের প্রত্যেকের, নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেটুকু পারি সেটা নিষ্ঠার সাথে করার মাধ্যমে-শুরুতে উল্লেখ করা রবিঠাকুরের ওই কবিতার মতঃ “আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি”

জাতীয় গৌরব না থাকলে কোন জাতি বড় হতে পারেনা, আর মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর বুকেই একটি গৌরবোজ্জ্বল নক্ষত্র- সূর্যের মত যে নক্ষত্রটি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, When we are cut, we bleed red and green.

প্রিয় পাঠক, এই মহাভারতসম লেখাটির এতদূর পর্যন্ত যেহেতু পড়েছেন কষ্ট করে, বিনীতভাবে একটা অনুরোধ করি? ২০১৪ সালের মহান বিজয় দিবসে চলুন না একটা প্রতিজ্ঞা করি! আগামী এক বছরে আশেপাশে যদি কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পান, তাঁর যুদ্ধের গল্পটি শুনুন, এবং নিজের ভাষায় লিখে রাখুন। জেনে নিন তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কার অধীনে- কোন সেক্টরে, তাঁর জীবিত ও মৃত সহযোদ্ধাদের কথা জিজ্ঞাসা করুন। ঢাকা সি এম এইচে এক শীর্ণকায়, রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ একবার আমার কাছে মোবাইল ফোনটি ধার চেয়েছিলেন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফোনটি তাঁকে দিলাম, ভদ্রলোক ফোন করে সম্ভবত তাঁর মেয়েকে ডাক দিলেন। আমার বিরক্তি দেখে ফোন রাখার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “বাজান , আপনি কি করেন?” “সরকারী চাকুরি করি”- রীতিমত কঠোর সুরেই তাঁকে বলেছিলাম। এরপরে তিনি যেটি বললেন তাতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল লজ্জায় ইঁদুরের গর্তে মুখ লুকোতে। “ বাজান, আমি একাত্তরে যুদ্ধ করসি, দেশটা স্বাধীন কইরা দিসি আপনাদের, এরে দেইখা শুইনা রাইখেন”
যে মানুষগুলো না থাকলে আমাদেরকে স্বাধীন দেশের ঘি মাংস খাবার বদলে পাকিস্তানি প্রভূদের পদলেহন করতে হত, সেই মানুষগুলোর খুব অল্প ক’জনের সাথেই আপনার দেখা হবে এসি রূমের বিলাসিতায়। এঁদের বেশিরভাগকে আপনি পাবেন এরকম হঠাৎ করে, জীর্ণ-শীর্ণ রূপে। কিন্তু একবার তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন একাত্তরের রণাংগনের কথা, দেখবেন ওই অশীতিপর বৃদ্ধের চোখে কি এক অপার্থিব আলো খেলা করছে, যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছেন আপনি এবং আপনার চারপাশ।এই আলোটুকুর কিছুটা হলেও স্বীয় লেখনির মাধ্যমে ধরে রাখুন, প্লিজ! এটুকু আশা কি পুরো এক বছরে আপনার দেশ আপনার কাছে করতে পারেনা?

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা!

পরিশিষ্টঃ

১) দি ট্রেইন ( ১৯৬৪) মুভিটার কথা মনে আছে? ওই যে, যেটার শেষ দৃশ্য দেখে ফতেহ আলী চৌধুরী যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন( দ্বিতীয় পর্ব দ্রষ্টব্য)? এই নিন শেষ দৃশ্যের ভিডিও লিংকঃ

মুভিটির পরিচালক এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরা কখনো জানবেন না, তাঁদের এই সিনেমাটি বাস্তব জীবনে একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে কি অবদান রেখেছিল!

২) একাত্তরের গেরিলাদের , বিশেষ করে ২ নম্বর সেক্টরের মেজর খালেদ মোশাররফের কার্যক্রম দেখতে “মেজর খালেদ’স ওয়ার” নামের এই ডকুমেন্টারিটি সকল বাংলাদেশীর জন্যে দেখা অবশ্যকর্তব্য। বিরল এই ডকুমেন্টারিতে গেরিলাদের সরাসরি যুদ্ধের ফুটেজ রয়েছে।

গান অফ অনারঃ

ভিডিওর শুরুতে যে স্মার্ট অফিসার হাসিমুখে সাংবাদিকের সাথে কথা বলছিলেন, তিনি ক্যাপ্টেন সালেক। দুই নম্বর সেক্টরের অন্যতম দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালেক। ক্র্যাক প্লাটুনের প্রথম পর্বের ১৭ জন গেরিলার ট্রেনিং শেষে যখন তাদের ঢাকায় অপারেশনে পাঠানো হবে, তখন হঠাৎ ক্যাপ্টেন সালেকের চোখ পড়ল খুব পরিচিত এক মুখের দিকে, একই পাড়ার ছেলে, বন্ধুমানুষ… হাঁক দিলেন সালেক, –আরে ফতেহ? — সালেক, তুমি? –এইখানে কিভাবে? –ট্রেনিং নিলাম, এখন ঢাকা যাইতেছি অপারেশনে। — “আরে সাবাশ” আনন্দে ঝলমল করে ওঠে সালেকের চেহারা। “গুডলাক, ক্যান আই হেল্প ইউ উইথ এনিথিং?” — নিজের একটা অস্ত্র থাকলে খুব ভালো হইত-ফতেহ বলেছিলেন। কিছুক্ষন যেন কি ভেবে কাঁধ থেকে নিজের সাবমেশিনগানটা নামায়ে ফতেহর দিকে বাড়ায়ে দিলেন সালেক, “হেয়ার, কিপ ইট”। –আরে, তোমারটা দিতেছ? তোমার লাগবে না? –ধুর, রাখো তো… আজ এত বছর পরেও ফতেহ আলী চৌধুরীর মনে হয় সেই চাইনিজ এসএমজিটা ছিল তার জন্য অনেক বড় এক উপহার। বীরত্বের জন্য সোর্ড অফ অনার পায় লোকে, তিনি তার বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন গান অফ অনার। সেই বীরযোদ্ধা মেজর সালেক পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনাদের সাথ্রে যুদ্ধ করতে করতে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে, হাসিমুখে…

এখানের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী সাংবাদিকের সামনে নিখুঁত ইংরেজিতে কিশোর যে ছেলেটি মেজর খালেদের কাছ থেকে ম্যাপ বুঝে নিচ্ছে, অনেকের মতে ইনিই তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং আমাদের সুপারহিরো ফতেহ আলী চৌধুরী। তথ্যটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, তবে তাতেও ক্ষতি নেই, ভিডিওটি অবশ্যই দেখা প্রয়োজন।

(পরবর্তীতে নাদির জুনাইদ অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন করেছেন)

“এই দৃশ্যটিতে তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে ম্যাপ নিয়ে আলাপরত তরুণ ফতেহ আলী চৌধুরী নন। এই তরুণ হলেন তৎকালীন ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সেক্টর টু’র নির্ভয়পুর অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। ১৯৮১ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল। চট্টগ্রামে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর যখন মেজর জেনারেল মঞ্জুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যান তখন অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবও জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে ছিলেন। সেই সময় সেনানিবাস থেকে তাঁদের বন্দী করার জন্য আগত একটি গ্রুপের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুব মারা যান।”

৩) অনেকেই জানেননা, মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের প্রায়শঃই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতেন/সরাসরি নানাভাবে সহায়তা করতেন সেযুগের অত্যন্ত স্মার্ট এবং সুশিক্ষিতা নারীরা। ফতেহ আলী চৌধুরী বেগম জাহানারা ইমাম এবং শাহীন নাম্নী আরেকজন মহীয়সী নারীর কথা উল্লেখ করেছেন। এঁরা তাঁদের গাড়িতে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বসিয়ে পাকসেনাদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতেন। আজকের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যে মেয়েদেরকে ঘরের ভেতরে আটকে রাখতে চায় এটা তো খুব স্বাভাবিক! হিস্টরি রিপিটস ইটসেলফ, আর এ কারণেই একাত্তরেও ওই হায়েনার দল জিততে পারেনি, এবারও পারবেনা।

সংযোজনঃ

সহযোদ্ধা সিরাজঃ

ফতেহ আলী চৌধুরীর আজো মনে পড়ে সিরাজের কথা, নভেম্বরের শেষে ত্রিমোহনী যুদ্ধে অভূতপূর্ব বীরত্ব দেখিয়েছিল যে সিরাজ, সাথে ছিল খালেদ, আজম(আজম খান, পপগুরু), খোকা(সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক মেয়র), ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এরা যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতাপে সম্মুখসমরে লড়েছেন। সেই সিরাজ আজ কোথায়? হাহাকার বেরিয়ে আসে ফতেহ আলীর গলা থেকে, “বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, দুর্ধর্ষ বীর সেই সিরাজ আজ কোথায়?”

মেজর হায়দার, ভারতীয় কর্নেল এবং সেই পুরোন স্টেনগান

ঢাকা অপারেশনের কমান্ডার ইন চার্জ ছিলেন মেজর হায়দার।হেড অফ ঢাকা অপারেশন। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ক্র্যাক প্লাটুনের অবস্থান ছিল রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায়। এদিকে ডিসেম্বরের ১০-১১ তারিখের দিকে নারায়ণগঞ্জ এবং রূপগঞ্জে এস ফোর্সের সেক্টর কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহর সেকেন্ড বেঙ্গলের সৈন্যরা অবস্থান নিল। ফতেহরা তো অবাক, দুই নম্বর সেক্টরের এই অংশে সেকেন্ড বেঙ্গলের সেনারা কেন? দুই নম্বর সেক্টরের সেনাদের না আগে আসার কথা… তাদের মন কিছুটা খারাপ। হঠাৎ একদিন দুপুরে দেখা গেল, রূপসা নদীর পাড় ধরে হেঁটে আসছেন হায়দার, দুই নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা তাকে সসম্মানে গার্ড দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে তার প্রিয় গেরিলাদের কাছে। প্রানপ্রিয় কমান্ডারকে কাছে পেয়ে অসম্ভব খুশি হল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা, সেটা আরও বেরে গেল, যখন শুনল, কেবল তাদের সাথে দেখা করার জন্য কি নৌকায়, জাহাজে , পায়ে হেঁটে কত বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন কমান্ডার। ক্র্যাক প্লাটুনের ক্যাম্পে সেই রাতে ছিলেন তিনি, সবাই রাত জেগে তাকে পাহারা দিল, কি উত্তেজনা, কি আনন্দ…

সারেন্ডারের পর ঢাকার অবস্থা তখন লাগামছাড়া। পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যত্রতত্র ফায়ার করছে, এদিকে আবার সুবিধাবাদী প্রাণীরা সুযোগ বুঝে কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র বাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাজছে, গুলি করে জাহির করছে, লুটপাটের চেষ্টা করছে। এমনই এক নকল মুক্তিযোদ্ধার কবল থেকে plant protection সংস্থার জিপ উদ্ধার করল ফতেহ, সেইটা নিয়ে হাঁটখোলার বাসায়, যেখানে বাবা ছাড়া আর কেউ নাই। জানা গেল, মা সিদ্ধেশ্বরী খালার বাসায়, সেখানেই আপাতত জাওয়া মনস্থির হল।

অভিসার সিনেমা হলের সামনে আসতেই মিলিটারি কায়দায় কেউ চিৎকার করে বলল, হল্ট…

গাড়ি থামিয়ে ফতেহ নামলো, হাতে উদ্যত অস্ত্র, সেই কণ্ঠটা আবার বললো, হ্যান্ডস আপ অ্যান্ড কাম ফরোয়ার্ড। সামনে আসার পর দেখা গেল, মানুশটা ইন্ডিয়ান আর্মির ড্রেস পড়া, র‍্যাংকে অশোকস্তম্ভটা দেখে বোঝা গেল, সে কর্নেল পদমর্যাদার কেউ হবে। প্রশ্ন এলো,
–হু আর ইউ? — অ্যা ফ্রিডম ফাইটার, ফোরথ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সেক্টর টু। –ক্যান ইউ টেক মি টু ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট? একটু ভেবে ফতেহ উত্তর বলল, তার বাবা তার সাথে আছেন, তাকে সিদ্ধেশ্বরী নামিয়ে দিয়ে তারপর তারা যেতে পারে কিনা… কর্নেল জানাল, সমস্যা নাই।
তারপর সিদ্ধেশ্বরীতে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে সেই লেঃ কর্নেলকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বেরোল ফতেহ। পথে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, শহীদ মিনার ইত্যাদি নানা জায়গায় যেতে চাইল কর্নেল, সবখানেই তাকে নিয়ে গেল ফতেহ। নানা প্রসঙ্গে গল্পের এক পর্যায়ে কাঁধের গানটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, হুজ গান ইজ দিস? হাসিমুখে জবাব দিল ফতেহ, মাই গান। একচুয়ালি ইট’স অ্যা গান অফ অনার, স্যার। কথায় কথায় ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি চলে এল ওরা। এক সময় শুকনো মুখে হুট করে ফতেহ জানতে চাইল, ক্যান ইউ হেল্প মি ফাইন্ড সাম অফ মাই ফ্রেন্ডস ইন ক্যান্টনমেন্ট? দে ফট উইথ মী। দে ওয়্যার ক্যাপচারড ইন টুয়েনটি নাইথ অগাস্ট… অবাক হয়ে কর্নেল আবিস্কার করল, এই ছেলেটা এতো দীর্ঘ সময় তার সাথে পুরো ঢাকা চক্কর দিয়ে বেড়িয়েছে কেবল তার বন্ধুদের খোঁজটুকু পেতে পারে এই আশায়। সারাটাপথ যে অপারেশনের গল্প শোনাল এই ছেলে, এতো বীরত্বগাঁথার পরেও কেবল সহযোদ্ধাদের জন্য এভাবে উদ্বিগ্ন হওয়া খুব অদ্ভুত। কি আশ্চর্য…
ক্যান্টনমেন্টের আর্টিলারি মেসে পৌঁছানোর পরেই সেই কর্নেল নির্দেশ দিলেন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের সব বন্দিসেল খুজে দেখতে। নানা জায়গায় খোঁজা হল, কিন্তু রুমি-বদি-জুয়েলদের কোথায় পাওয়া গেল না।

এদিকে আর্টিলারি মেসে তখন বিশাল ঝামেলা শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা এইখানে কেন? পাকিস্তানি সেনাদের ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে ঢোকা নিষেধ। সুতরাং ব্যর্থ মনোরথে আরেকবার ফতেহ ফিরে আসলো। তার তারছিঁড়া সেই ক্র্যাক বন্ধুদের আর খুজে পায়নি সে কোনোদিন, তাদের আর খুজে পাওয়া যায়নি।

সেই লেঃ কর্নেলের সাথেও আর কোনোদিন দেখা হয়নি। ইন্ডিয়ান আর্মির ফোর্থ গার্ড রেজিমেন্টের লেঃ কর্নেল হিম্মতকে সে বহু খুজেও পায়নি আর কখনো। ২০১০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাওয়াতে সস্ত্রীক গিয়েছিলেন ফতেহ আলি চৌধুরী, সেখানে বহু খুঁজেও পাননি সেই কর্নেলকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নাকি এই নামে এই রেজিমেন্টে কোন কর্নেল ছিলেন না কখনই। অল্প পরিচয়ে খুব আপন হয়ে যাওয়া সেই কর্নেলকে আজো খুজে ফেরেন ফতেহ আলি, মানুষটা যেন হুট করেই হারিয়ে গেছে, কেবল রেখে গেছে স্বল্প পরিচয়ের দীর্ঘ এক স্মৃতি।

খালেদ মোশাররফের কথাঃ

মানুষটার নাম খালেদ মোশাররফ, মুক্তিযুদ্ধের এক বিচিত্র কিংবদন্তীর নাম। সেক্টর কমান্ডার হয়েও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে যেতেন মেশিনগান হাতে। পাকিস্তানী সেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ চলতেছে, নির্বিকারচিত্তে এক হাতে সিগারেট টানতে টানতে আরেকহাতে গুলি করছে্ন খালেদ, যুদ্ধক্ষেত্রের খুব সাধারন দৃশ্য ছিল এটা। একজন সেক্টর কমান্ডার সাধারণতঃ পিছনের তাবুতে বসে নিরাপদে যুদ্ধ পরিচালনা করে, খালেদ ছিলেন পুরাই উল্টা… নিজের হাতে মেশিনগান চালাতে না পারলে সেটাকে যুদ্ধ বলে নাকি? অক্টোবরের ২২ তারিখ প্রচণ্ড মর্টার শেল পড়ল ঠিক পাশে, স্পিটার কপাল ভেদ করে সরাসরি ঢুকে গেল মগজে। ক্ষতবিক্ষত খালেদকে সাথে সাথে তুলে নিয়ে যাওয়া হল, ভারতীয় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তাঁর বেঁচে ফেরাটা ছিল মেডিকেল সায়েন্সের বিচিত্র মিরাকল। ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, অধিনায়কের জন্য ফতেহ আলী চৌধুরী আর হাবিবুল আলম একটা বাড়ি ঠিক করছেন গুলশানে, অন বিহাফ অফ বাংলাদেশ আর্মি। সেখানেই উঠলেন খালেদ, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ফতেহ, আলম, মোজাম্মেল, গিয়াসসহ তার প্রিয় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা তার নিরাপত্তার দায়িত্বে অন ডিউটি এটাচ ছিলেন।

কিংবদন্তীসম এই যোদ্ধাকে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল এদেশেরই বিপথগামী সৈন্যরা। দেশকে তিনি দিয়েছিলেন অনেক, নিজের জীবনের পরোয়া করেন নি, সেটারই মাশুল তিনি দিলেন নিজের জীবন দিয়ে। কি নির্মম পরিহাসপূর্ণ আমাদের ইতিহাস!

খালেদ মোশাররফের স্টেনগান হাতে একটি ছবি এবং সেইসাথে তাঁর অসামান্য একটি উক্তি এখানে যোগ করে দিলাম, ক্লিক করলেই বড় আকারে দেখতে পাবেন। কষ্ট করে ক্লিক করুন, হতাশ হবেন না কথা দিচ্ছি!

Khaled

সহযোদ্ধা-২ঃ ইছাপুর যুদ্ধে ছিলেন বক্সার আইয়ুব, ফুয়াদ, নুরুল আমিন, কাশেম আনসারী(পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন)

(লেখাটিতে খুঁটিনাটি ত্রুটি দ্রুত সংশোধন করা হবে। আপনাদের চোখে কিছু পড়লে আমাদেরকে জানান)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১) সিমিন চৌধুরী , বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীর কন্যা এবং প্রিয় সহপাঠিনী। ও না থাকলে আমার বা রাআদের কারো পক্ষেই এই বীরের সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হতনা।

২) অমি রহমান পিয়াল, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। ডেইলি স্টারে ২০০৮ সালে ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের লিংক এবং মেজর খালেদ’স ওয়ার ডকুমেন্টারিটি তাঁর মাধ্যমেই পাওয়া।

৩) পরমা কন্যা, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। “When We Are Cut, We Bleed Red And Green”- এই উক্তিটি ওর।

৪) তারিক লিংকন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং রাআদের সাথে ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের অন্যতম সঞ্চালক।

৫) আসরার চৌধুরী, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক , অর্থনীতি বিভাগ, জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ডিসক্লেইমারঃ

লেখাটির যে কোন সমালোচনা, ত্রুটিবিচ্যুতি , তথ্যগত ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিলে পর্যায়ক্রমে সংশোধন করে নেব এবং কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা কেউই পেশাদার একাডেমিশিয়ান নই- কাজেই আপনাদের সহায়তা সানন্দে গৃহীত হবে।

৭৮ টি মন্তব্য : “বিজয়ের দিনে বিজয়ীর কথাঃ বিস্মৃত এক সুপারহিরোর গল্প”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    বিশাল পোস্ট। সময় নিয়া পড়তে হবে। কিছু ভেজালে আছি, শেষ কইরা আইসা পড়তেসি। আপাতত সশ্রদ্ধ সালাম ::salute::

    ওয়েল্কাম ব্যাক, মাস্ফ্যু ভাই। গেসেন তো বৈদেশে পড়তে, এইবার একটু নিয়মিত ব্লগান।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. শ্রদ্ধেয় মাশরুফ হোসেন, ফেসবুকের সুবাদের আপনার লেখা নিয়মিতই পড়ার সৌভাগ্য হয় এবং আপনার সুবাদের ডন মাইকেল করলেওনের। ইতিহাসভিত্তিক লেখা আমার কাছে সাগর সেচে মুক্তো খুঁজে আনার মতোই কঠিন কাজ। গত ছয় বছরে এই সাগরে নামতেই ভয় পেয়েছি। তথ্যগত ভুল ও বিভ্রান্তি না থাকা, রেফারেন্স ঠিক রেখেও একটি লেখাকে অসাধারণ বলার পিছে যা বাকি থেকে যায় তা হচ্ছে এর ভাষাশৈলী। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের লেখা লিখেন, তবে ট্র্যাক থেকে বিচ্যুত হন অসততার কারণে। যেহেতু সততা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করার জন্য, তাই আমরা এই প্রজন্মের যারা আছি তারা আশান্বিত হতে পারি। আপনাদের দু'জনকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বিজয় দিবসের বিশেষ উপহারের জন্য। আর প্রেরণাদায়ক তো বটেই 🙂 ভবিষ্যতে আরও গবেষণাধর্মী তথ্যসংবলিত লেখা পাবার প্রত্যাশায় রইলাম।

    জবাব দিন
  3. শের আলী ( পকক,৮৫-৯১)

    :salute: ::salute::
    " জাস্ট ডোন্ট ডাই, দ্যাটস মাই অর্ডার। "
    আবার তোরা মানুষ হ।
    ওরা এগার জন।
    আগুনের পরশমনি এর চেয়েও বেশী স্পর্শ করেছে লেখাটি।
    নিজের চোখে জল আর শরীরের লোম দাঁড়ানোর কথা বাদ রাখি।
    আমি আরও অনেক বার পড়ব। কতবার তা জানিনা।
    ধন্যবাদ তোকে মাশরুফ। ধন্যবাদ তোর শেষ আবেদনের, যেন আমারা সাবাই মুক্তি যোদ্ধাদের দুর্ধষ ঘটনাবলী সংরক্ষণের চেষ্টা করি।

    জবাব দিন
    • স্নেহের মাসরুফ, ফেসবুকে আর কোরায় তোমাকে নিয়মিত পড়ি। তুমি তো এখন বড় পুলিশ অফিসার। আমি ৬৫ বছর বয়সের সিনিয়র সিটিজেন। তাই তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে কোর না। আমি তোমার মধ্যে আমাকেই দেখতে পাই, যেন প্রত্যেকটা জায়গায় আমি যা বলতাম তুমি তাই লিখে দিয়েছ। ক্র্যাক প্ল্যাটুন সম্বন্ধে আগেও বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি। কিন্তু ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর আবেগ মেশানো এই লেখাটা সেভ করলাম। শের আলির ভাষাতেই বলতে হচ্ছে ভবিষ্যতেও কতবার পড়ব ঠিক নেই। এগুলো যখন পড়ি গলা ধরে আসে, চোখে পানি আসে, চোয়াল শক্ত হয়, শ্বাস দ্রুত হয়। একদিন তোমাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে এই বিশ্বাস রাখি। কাজটা হয়তো সহজ হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজটাই কি সহজ ছিল? ভালবাসা জেনো।

      জবাব দিন
  4. ডাঃ মোরতায়েজ আমিন।

    মাশরুফ, ভাই, তুই সুন্দর লিখিস, জানি কিন্তু এতো সুন্দর! আমার চোখে শুধুই পানি। তোর এই লেখা পড়ার আগে MGCC'র 48 LC এর Jannatul Tany'r সাথে কথা হলো। ও এখন কঙ্গোতে। আমি বিজয় দিবস উপলক্ষে 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' আর বাংলাদেশের waving flag post করার পর inbox করে সে। বলে, ভাইয়া, চলুন, আমরা দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করি। আমি অনেকের জন্যই নিজের সামরথের মধ্যে কিছু করার চেষ্টা করি। জান্নাতুল কে কথা দিয়েছি, এইবার দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। তোর লেখা পড়ে আমার মনে হচ্ছে কেন আগে এ রকম চিন্তা করিনি। একেবারেই যে করিনি, তা নয়। অনেক বছর আগে, ঠিক করেছিলাম, গ্রামে গঞ্জে যাবো, মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করবো, তাদের কথা লিখে আনবো, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম বুঝতে পারে কতো ত্যাগ, রক্ত, জীবন এই দেশের জন্য, এই মাটির জন্য বিসর্জন দিয়েছিলো ছেলে-মেয়েরা। পেশাগত কারনে, আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য পিছিয়ে গেছি। মাশরুফ, তুই তো একজন রাফ অ্যান্ড টাফ অফিসার। কিন্তু ভিতরে তুই অনেক নরম, অনেক অনুভুতিপ্রবন। তোর মতো মানুষ খুবই দরকার এই অভাগিনী দেশের। ভালো থাকিস। যে জন্য বিদেশে গেছিস, সেটায় খুব ভালো করা চাই। দেশের সম্মান জড়িত এর সাথে। ভালো থাকিস ভাই। দোয়া করি তোর জন্য।

    জবাব দিন
    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      ভাইয়া, প্লিজ লেখুন, এক জন যোদ্ধা হলেও লিখে ফেলুন। কিভাবে সে আহত হল ওটাই নাহয় বলুন, তাও এই বীরদের গল্প ছড়িয়ে পড়ুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আমার কাছে একাত্তরটাকে অবিশ্বাস্য একটা সময় বলে মনে হয়- এই আমরা কিভাবে পেরেছিলাম সেই সময়টার মুখোমুখি হয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে!!

      অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা পড়বার জন্যে 🙂

      জবাব দিন
  5. তন্ময় (২০০৬-২০১২)

    মাস্ফু ভাই,এই ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে আমার পরিচয় ক্লাস ফোর এ । জাহানারা ইমামের একত্তরের দিনগুলির মাধ্যমে । এরপর আনিসুল হকের মা,ডেইলি স্টার এ ফতেহ আলীর সাক্ষাতকার দুটোই পেয়েছিলাম । রুমি,কাজী,বদি,উলফাতরা আমার হিরো সেই তখন থেকেই । বাবা মুক্তিযোদ্ধা । মেলাঘরে ছিলেন । উনিও কিছু গল্প শুনিয়েছিলেন । কিন্তু সব ছিল একেক টি ছেড়া সুতো । আজ আপনার এই লেখায় সবগুলো সুতো জোড়া লাগল । বিজয়ের এই দিনে ফেবুতে প্রোফাইল পিক দিয়ে বাঙ্গালীয়ানা জাহির করার ছড়াছড়ি । বিরক্ত হয়ে মাঝরাতে সিসিবিতে ঢোকা এবং বাকিটা ইতিহাস । বাবার গল্প এতক্ষন চলল বলেই মন্তব্য করতে খানিকটা দেরী হয়ে গেল । বাংলাদেশ নামের শিশুটার ৪৩ তম জন্মদিনে এর চেয়ে ভালো কোনো উপহার হয় বলে মনে হয়না । অসম্ভব সুন্দর এবং as usually আপনার গোছানো লেখা । এই একাত্তরের চেতনাই এই বাংলাদেশ কে টিকিয়ে রাখবে । রইস স্যার (আবু রইস,বাংলা) একবার বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের জীবনে লবনের মত । সব কিছুতেই তার দরকার পড়ে । আপনার গল্প কালেকশনের আইডিয়াটা ভালো লেগেছে । সবাইকে লেখাটা শেয়ার করার অনুরোধ জানাচ্ছি । আর কিছু না হোক , প্রো পিকের সাথে আরেকটু ট্রিবিউট না হয় করলেন ই ?? (সম্পাদিত)


    চলো বহুদুর.........

    জবাব দিন
    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      একাত্তরের ক্র্যাক প্লাটুন আমার কাছে ফ্রেঞ্চ গেরিলা, নেপালী গুর্খা, আমেরিকান মেরিন আর ব্রিটিশ এস এ এস-এদের সব কয়টা যোগ করলে যতটা কুল তার চাইতে ডাবল কুল লাগে। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা লেখাটা পড়ার জন্যে। রইস স্যারের কথার সাথে তীব্র সহমত, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের জীবনে আছে কি আর?!

      জবাব দিন
  6. এই একটা লেখার জন্যই এবারের বিজয় দিবসটা খুব অন্য রকম হয়ে গেলো। অনেক ধন্যবাদ দিনটিকে স্মরনীয় করে তোলার জন্য। অনেক ধন্যবাদ অসাধারণ এক টুকরো ইতিহাস উপহার দেয়ার জন্য। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা আপনার জন্যও।

    জবাব দিন
  7. মেহেদী (২০০৮-২০১৪)

    মাশরুফ ভাই.........পড়তে পড়তে ভাই অন্যরকম একটা জগতে চলে গেছিলাম......জিনিসগুলা হালকা পাতলা চোখের সামনে ভাইসা ঊঠসিল......যদিও বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নাই......ওনেকটা বর্তমানে বিদেশী ফিল্ম দেখার সুফল বা কুফল......

    কিন্তু যাই হোক ভাই......এই লেখাগুলা যদি বাইরের কোন মানুষ পরে তারা বিশ্বাস করতে পারবে না......khaleds war-1 আর 2 দেখার পর আমারো মাথায় এই জিনিস আসল......কেমনে এই থ্রি নট থ্রি আর কালাশ্নিকভ দিয়া এশিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ আর্মিরে কান্দাইতে কান্দাইতে বাড়ীত পাঠাইল!!!!! ভাই এইখানে আমার দিমত আছে.........

    নট অনলি ক্র্যাক প্লাটূন......প্রত্যেকটা মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মাথাত ই ক্র্যাক আছে!!!!!! it is proved!!!!!!!!!!!
    বাঙালি মানেই ক্র্যাক!!!!!! এহুলা কখন কি কইরা বসবে কারো ঠীক নাই.........আমরা যতই পীটবুল আর জেনিফারের গান শুনি......যতই আমরা ভারতীয় সিরিয়াল দেখি আর যতই আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি ফলো করি......... when we cut....we all bleed red and green

    we all are at some point....CRACK PEOPLE!!!

    জবাব দিন
  8. অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য আবার সেই ৭১-রে চলে গিয়েছিলাম।

    ফেইসবুকে আপনার লেখা নিয়মিতই পড়া হয়, আপনি যে ব্লগে লিখতেন জানা ছিল না ভাই। সত্যি অসাধারণ বাস্তব লেখনী। আপনার এই ব্লগ "বাস্তবতার সাক্ষী"

    বাস্তব ঘটনাগুলো এভাবেই সবার সামনে উঠে আসা উচিত। উঠে আসা উচিত অসংখ্য শহীদদের আত্মত্যাগের কথা, তাদের মহিমার কথা।

    সেই সাথে, গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছি সেই সব বীর সেনানিদের যারা শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়ার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

    অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মাসরুফ ভাই।

    জবাব দিন
  9. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের কথা প্রথম জেনেছিলাম 'আগুনের পরশমনি' থেকে। জাহানারা ইমামের বইটি থেকে রুমি এবং তাদের ক্র্যাক প্লাটুনের খোঁজ পাই। পরে মুক্তিযোদ্ধা আজাদের নামও জানি বিটিভিতে প্রচারিত একটি নাটক থেকে। এই পাগল ছেলের দলের খন্ড খন্ড বীরত্বগুলো খুব ফোকাসে আসে নি কখনোই। অথচ এরা এত অল্প বয়সে কতটা অসম সাহসী ছিলো সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়।
    এদের নিয়ে একটা ছবি হবে শুনেছিলাম (দীপ নেভার আগে)। দেশে গিয়ে খুব আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছিলাম ছবিটা কবে রিলিজ পায়। তবে কোন কারণে সেটা রিলিজ পায় নি। এই পোস্ট টা পড়ে সিনেমার মতই দেখলাম সেই দিনের ছবি গুলো।প্রায় একঘন্টা ধরে পড়বার পরে টের পেলাম নিজের অজান্তেই ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি। লেখাটার জন্য লেখকদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।

    সিসিবিতে লেখাটাকে স্টিকি করা হউক। সকলের লেখাটা পড়া অবশ্যপাঠ্য মনে করি।

    পুনশ্চ: আমাদের এইখানে একটা ছেলে আছে যার মামা ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিল (তৌফিক এ ব্যাপারে আরো বিশদ বলতে পারবে)। টুকরো টুকরো গল্প তার ব্যাপারেও শুেছি। তবে সবই পরের মুখে ঝাল খাওয়ার মত, নিজে সরাসরি কখনও এ বিষয়ে কথা বলি নি। তৌফিকরে রিকোয়েস্ট করে দেখতে পারিস মাস্ফ্যু, সে হয়তো আড়ো কিছু গল্প এনে দিতে পারবে ক্র্যাক প্লাটুনের।

    মাস্ফ্যুরে ওয়েলকাম ব্যাক সিসিবিতে (যদিও আমি নিজেই নাই তেমনভাবে)। এমন লেখা আসলে বছরে একটা হইলেও দারুণ।

    সকলে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

    জবাব দিন
  10. ভালো লাগলো লেখাটা, খুব ভালো লাগলো।
    যাঁদের জন্য আমাদের এই স্বাধীন ভূমি, দেশ, রাষ্ট্র এবং জাতি, আড়ালে পড়ে থাকা সেই বীর স্বজনদের কথা আরো বেশি বেশি শুনতে চাই আমরা। তাঁরাই আমাদের জীয়নশক্তি, তাঁরাই আমাদের নিজস্ব অহঙ্কার। তাঁদের কথা না বললে আমরা কাঁদের কথা বলবো ! এই রক্তের স্বজনদের ত্যাগ ও বীরত্বের গাথা শুনে শুনে আমরা কাঁদতে চাই, পরিশুদ্ধ হতে চাই। তবেই না আমরা শুদ্ধ হবো, তাঁদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হবো ! তাঁদের অমৃত-ঔজ্জ্বল্যের আভায় বিষাক্ত অন্ধকার মুছে আলোকিত হতে পারবো আমরা !

    চমৎকার ঝরঝরে আবেগঘন লেখাটার জন্য কেবল ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়, একরাশ কৃতজ্ঞতাও সাথে রইলো।

    জবাব দিন
  11. সত্যিই অসাধারণ লিখেছেন ! এই আনসাং হিরোর কাহিনী না লিখলে হয়ত জানতেই পারতাম না ! বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এমন অনেক আনসাং হিরোই আছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সালাম ; অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভেচ্ছা আমাদের বাংলাদেশ উপহার দেয়ার জন্য ::salute::

    জবাব দিন
  12. মুজিব (১৯৮৬-৯২)
    মাথামোটা পাকসেনারা কঠোর সামরিক ট্রেনিং পেলে কি হবে, আউট অফ দা বক্স চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের ছিলনা, যেটা ছিলো আমাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। গর্ধবগুলোর মাথায় কি চলছে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর আমরা মোটা্মুটি ছকে ফেলার মত করে অনুমান করতে পারতাম।

    =)) =)) =))


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন
  13. অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই অসাধারণ এই লেখাটির জন্য।

    অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করছি এই সময়ের কমবয়সীরা তো বটেই অনেক প্রবীণ ব্যক্তি যাদের মাঝে আছেন সমাজের প্রগতিশীল এবং সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসর হিসেবে পরিচিত মানুষরাও, তাঁরাও ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যসহ ঢাকা শহরে যুদ্ধ করা অন্য গেরিলাদের নামও জানেন না। এই সত্যিকারের "হিরো" দের নাম জানা যে জরুরি এই স্বাধীন দেশে এই ধারণাটিও আমরা মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। ক্র্যাক প্লাটুনের যে জীবিত সদস্যরা আছেন তাঁরা যদি শহরের পথ দিয়ে হেঁটে যান ক'জন মানুষ এই প্রকৃত "নায়ক" দের চিনতে পারবেন? তাঁরা নিজেদের চেনানোর জন্য আগ্রহী নন জানি, কিন্তু তাঁদেরকে মানুষের কাছে পরিচিত করানোর দায়িত্বটি ছিল সমাজের। এই স্বাধীন সমাজ সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে যখন বছরের পর বছর নতুন ছাত্রদের এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করি আর দেখি ক্লাসভর্তি ষাট-সত্তর জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কেবল একজন অথবা দু'জন বলতে পারে এই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, তখন বুঝি কীভাবে সমাজ ভুলে গিয়েছে এই দেশের জন্য যারা প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের। কেবল ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এলেই এই মানুষদের স্মরণ করা একদিনের জন্য। আর বাকী সময় তাঁদের নিয়ে মাথা না ঘামানো। এই চর্চাই তো চলে আসছে আমাদের দেশে বহু বছর ধরে।

    এই লেখাটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বহু কমবয়সীরা ফতেহ আলী চৌধুরী সহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানবেন। এবং আমি বিশ্বাস করি তাঁরা গভীরভাবে অনুভব করবেন সেই সময়ের সেই অসীম সাহসী তরুণ-তরুণীদের কথা যাঁদের সাহস, ত্যাগ আর দেশপ্রেমের কারণে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের মানুষরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছি এবং স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে বেড়ে উঠেছি। আশা করি আমাদের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আমরা কখনো ভুলে যাবো না।

    পুরো লেখাটি খুবই সু্বিন্যস্ত এবং অত্যন্ত সুলিখিত। একটি ছোট ভুলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একটি অংশে লেখা আছে "তোমরা এই ধরনের অসংখ্য আনসাং হিরোদের বের করো। হোয়াই মি? সুবেদার বেলায়েতের কথা লিখো, সুবেদার ওয়াহাবের কথা লিখো। এরা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিল।"
    দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই দুই সুবেদারই ছিল পাকবাহিনীর তীব্র ভীতির কারণ। এদের মধ্যে সুবেদার বেলায়েত সালদানদীর যুদ্ধে শহীদ হলেও সুবেদার ওয়াহাব ১৯৭১ সালে মারা যাননি। তিনি বেঁচে ছিলেন। এবং স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যা্প্টেন হিসেবে তিনি অবসর নেন।

    জবাব দিন
  14. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    মাশরুফ ভাই, অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম, সময় নিয়ে পড়লাম, ভীষন স্পর্শ করে গেলো, কত অজানা গল্প, কত অজানা বীরেদের কথা আমাদের জানা হয়নি।
    বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা রইল।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  15. আরেকটি তথ্য যোগ করতে চাই। এই লেখায় ১৯৭১ সালে গ্রানাডা টেলিভিশন নির্মিত এবং ভানিয়া কিউলী পরিচালিত "মেজর খালেদ'স ওয়ার" নামে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রটির একটি অংশ সংযুক্ত করা হয়েছে। এই সংযোজন লেখাটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। ভিডিও ক্লিপটির নীচে লেখা হয়েছে "এখানের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী সাংবাদিকের সামনে নিখুঁত ইংরেজিতে কিশোর যে ছেলেটি মেজর খালেদের কাছ থেকে ম্যাপ বুঝে নিচ্ছে, অনেকের মতে ইনিই তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং আমাদের সুপারহিরো ফতেহ আলী চৌধুরী।"

    এই দৃশ্যটিতে তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে ম্যাপ নিয়ে আলাপরত তরুণ ফতেহ আলী চৌধুরী নন। এই তরুণ হলেন তৎকালীন ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সেক্টর টু'র নির্ভয়পুর অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। ১৯৮১ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল। চট্টগ্রামে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর যখন মেজর জেনারেল মঞ্জুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যান তখন অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবও জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে ছিলেন। সেই সময় সেনানিবাস থেকে তাঁদের বন্দী করার জন্য আগত একটি গ্রুপের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুব মারা যান।

    জবাব দিন
  16. লেখাটা পড়েছি আর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে।আপনাদের দুজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই আমার।আর এই মহাবীর দের ঋণ হয়তো শোধ করা যাবেনা তবে-

    কোনও দেশ কি আর জন্ম থেকেই পারফেক্ট হয়? ওটাকে পারফেক্ট বানাতে হয়- আর এই কাজটা করার দায় আমাদের প্রত্যেকের, নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেটুকু পারি সেটা নিষ্ঠার সাথে করার মাধ্যমে-শুরুতে উল্লেখ করা রবিঠাকুরের ওই কবিতার মতঃ “আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি”

    এটুকু অবশ্যই করব ... এই বীর দের সম্মান রক্ষার্থেই করব

    জবাব দিন
  17. মাসরুফ, অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সময় নিয়ে এত সুন্দর একটা লেখা উপহার দেয়ার জন্য। কৃতজ্ঞতা। রাআদ কে আর একটু বেশি ধন্যবাদ (৯৫%) 🙂

    ক্র্যাক প্লাটুন সম্পর্কে অনেক নতুন কিছু জানলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীর মত একজন সুপার হিরোর এত কাছাকাছি নিয়ে যাবার জন্য আবারও ধন্যবাদ! খুব বেশি আত্তপলোব্ধি - যারা আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ, সময় এবং সম্মানের দাবিদার, আমার জায়গা থেকে তার কিছুই আমি দিতে পারিনি, এখন থেকে অন্তত সচেতন চেষ্টা করব!

    পুনশ্চ: তোমাদের লেখার হাত অনেক ভালো। আরো বেশি লেখো। সম্ভব হলে বই প্রকাশ এর কথা বিবেচনা কর, অনেকেই উপকৃত হবে। শুভেচ্ছা

    জবাব দিন
  18. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    গর্ব করে 'লেখাটা পড়েছি' যাতে বলতে পারি- তাই কমেন্ট করে গেলাম!
    মাস্ফু, রাআদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সবাই...তোদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!

    একটি অনুরোধ- বর্ণনার সময় ফতেহ আলী চৌধুরীর বড় ভাই এর নাম 'শাচৌ' উল্লেখ না করে পুরোটাই বা শুধুমাত্র 'শাহাদাৎ' কিংবা 'বড় ভাই' ব্যবহার করা যায় কি?
    ভেবে দেখিস।


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  19. তানভীর (০২-০৮)

    অনেক দিন পর গতকাল সিসিবিতে ঢুকে লেখাটি পড়লাম।এক কথায় অসাধারণ। লেখাটি চুম্বকের মতো টানছিলো, তাই বিরতিহীন ভাবে পড়ে শেষ করেছি। ফোন থেকে পড়ছিলাম বলে কমেন্ট করতে পারিনি। অনেক বার চোখ ভিজে গেছে।এপিটাফের লেখাটি কোট করছি ''When you go home, tell them of us and say,For your tomorrows these gave their today''. সবসময় ই কৃতজ্ঞ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি,যাদের কারণে স্বাধীন বাংলায় বেড়ে উঠতে পেরেছি।লেখাটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো চোখের সামনে দেখতেছি। অসম্ভব আবেগ প্রবন এবং প্রাঞ্জল লেখাটি। ধন্যবাদ মাসরুফ ভাই এবং রাআদ রহমান। আপনাদের কারণে এতো সুন্দর একটি লেখা পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের উপরে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই গবেষণা মূলক আরও অনেক লেখা পাবো বলে আশা করি।
    সেকন্ড ওয়ার্ল্ডওয়্যার নিয়ে অনেক অসাধারণ মুভি আছে যা চোখ ভিজিয়েছ আমাদের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এতো অসংখ্য হৃদয় কাঁপানো প্লট আছে সেই তুলনায় ভালো মুভির সংখ্যা নেই বললেই চলে। এই ব্যাপারে কোনও ইনিটিয়াটিভ নেওয়া গেলে অনেক ভালো হয়।
    অফ টপিকঃ মাসরুফ ভাই আপনার সাথে ফেইস টু ফেইস কোনও পরিচয় নেই। আপনার পুলিশ বাহিনীতে উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অনেক প্রশংসার দাবিদার। একজন ক্যাডেট হিসেবে উই আর প্রাউড অফ ইও। কীপ ডুইং ইউর স্প্লেন্দিদ জব। :salute:
    অন্তত এক কাপ কফি খাওয়াবো আপনাকে কোনও একদিন।

    জবাব দিন
  20. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মাস্ফু,
    তোমাকে এবং রাআদ রহমানকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই আমার।
    ১৬ই ডিসেম্বরে, দেশের বাইরে বসে মুক্তিযুদ্ধের এই বীরত্বগাঁথা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এত তাড়াতাড়ি লেখাটা শেষ হয়ে গেলো! একটানে পড়ে শেষ করলাম।
    ফতেহ চৌধুরী এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের জন্যে আমার বিনম্র প্রণাম রইলো।

    স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কৃত্রিম বিতর্কের এই যুগে তাঁর এই দৃপ্ত , অসংকোচ উচ্চারণ কেন জানি বড় অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে!

    এই লাইনটা ক্লাসিক ছিল!

    জবাব দিন
  21. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ভাবসিলাম আর ৩টা দিন, আর ২টা দিন। তারপরেই আরাম করে পড়বো। এখন পড়তে গেলেই আবেগ আর চিন্তা মিলিয়ে প্রচুর সময় যাবে। কিন্তু কবি বলেছেন অপেক্ষার মায়েরে বাপ। পড়ে ফেললাম।

    “I was just the rubber-stamp of history. If I weren’t there that day, somebody else would have done what I did. In the words of my friend, the noted singer Azam Khan, I want to say ‘’Today Bangladesh is free. And this is my achievement.’”

    এর প্রেক্ষিতে

    স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কৃত্রিম বিতর্কের এই যুগে তাঁর এই দৃপ্ত , অসংকোচ উচ্চারণ কেন জানি বড় অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে!

    শিরদাঁড়ায় বিদ্যুৎ খেললো।

    যে মানুষগুলো না থাকলে আমাদেরকে স্বাধীন দেশের ঘি মাংস খাবার বদলে পাকিস্তানি প্রভূদের পদলেহন করতে হত, সেই মানুষগুলোর খুব অল্প ক’জনের সাথেই আপনার দেখা হবে এসি রূমের বিলাসিতায়। এঁদের বেশিরভাগকে আপনি পাবেন এরকম হঠাৎ করে, জীর্ণ-শীর্ণ রূপে। কিন্তু একবার তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন একাত্তরের রণাংগনের কথা, দেখবেন ওই অশীতিপর বৃদ্ধের চোখে কি এক অপার্থিব আলো খেলা করছে, যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছেন আপনি এবং আপনার চারপাশ।এই আলোটুকুর কিছুটা হলেও স্বীয় লেখনির মাধ্যমে ধরে রাখুন, প্লিজ! এটুকু আশা কি পুরো এক বছরে আপনার দেশ আপনার কাছে করতে পারেনা?

    কি যে ভালো লেগেছে কথাটা বলে বোঝাতে পারবো না। সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবো না প্রতিজ্ঞা করলাম। ::salute::


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  22. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    এই লেখাটা থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন ধরণের একটা তথ্য জানলাম- যুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের ভূমিকা কতটা প্রভাব ফেলেছিল। ক্র্যাক প্লাটুনের কথা জানতাম। কিন্তু তাঁরা কতটা সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল পাক বাহিনীকে, এটা এখন জানলাম। এবং আবিষ্কার করলাম, মুক্তিযুদ্ধের "ঘটনাপ্রবাহ" নিয়ে আমি খুব বেশি জানি না। মার্চে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ, এপ্রিলে প্রবাসী সরকার গঠন, ডিসেম্বরে ভারতের স্বীকৃতি, মিত্র বাহিনীর সাথে যৌথ যুদ্ধে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ। এর মাঝে শুধু জানি, যুদ্ধ হয়েছে। সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কখন কেমন অবস্থা ছিল, কোন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা যুদ্ধের এক একটা মাইলফলকের মত- খুব বিস্তারিত জানি না। কিন্তু জানতে ইচ্ছা করছে এখন। যদি তেমন কোন লেখার কথা কেউ দিতে পারেন তো খুব ভাল হয়।

    আরেকটা কথা- যখন মুক্তিযুদ্ধের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনি, তখন তাদের মধ্যে একটা স্পিরিট দেখি। যেই স্পিরিট দিয়ে তাঁরা নিজের প্রাণ বাজী রেখে সামান্য অস্ত্র নিয়ে একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথে লড়েছিলেন, দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। মাসরুফ ভাই সবার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করার যে আবেদন জানিয়েছেন, তার সাথে পরিপূর্ণ সহমত। এতে মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটটা আমরা আরও ভালভাবে বুঝতে পারব। এখন অনেকের অপছন্দনীয় হবার ঝুঁকি নিয়ে আরেকটু বলি- আমার মতে মুক্তিযুদ্ধের এই স্পিরিটটাই হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- যার সাথে আমি বর্তমানে "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" বলতে যা বোঝানো হয়, তার সামান্যই মিল পাই। বরং সেটা বেশি মিলে যায় জহির রায়হানের "সময়ের প্রয়োজনে" গল্পের সাথে।

    জবাব দিন
  23. "বিনীতভাবে একটা অনুরোধ করি? ২০১৪ সালের মহান বিজয় দিবসে চলুন না একটা প্রতিজ্ঞা করি! আগামী এক বছরে আশেপাশে যদি কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পান, তাঁর যুদ্ধের গল্পটি শুনুন, এবং নিজের ভাষায় লিখে রাখুন। জেনে নিন তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কার অধীনে- কোন সেক্টরে, তাঁর জীবিত ও মৃত সহযোদ্ধাদের কথা জিজ্ঞাসা করুন।"-লেখা থেকে তুলে দিলাম। এভাবে আমরা হয়ত অনেক না জানা বীরের না বলা কথা তুলে আনতে পারি ও ছড়িয়ে দিতে পারি সবার মাঝে। তাতে করে আর কিছু না পারি ইতিহাসের কিছু খন্ডচিত্র হয়ত আমরা লিখিতভাবে সংরক্ষণ করতে পারব। ধন্যবাদ না জানালে রাআদ ও মাশরুফকে ছোট করা হবে কেননা, ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী (কোথাও কোথাও ফতে আলী চৌধুরী লিখেছেন)'কে ক্র্যাক করা সহজ ব্যাপার নয়। ::salute::

    জবাব দিন
  24. Nekvi

    অসাধারন একটা লেখা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোমার যে দুর্দান্ত আবেগ, তা এই লেখার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে। খুব ভালো লাগলো, শিহরিত হলাম। এতো পরিশ্রম করে ও এতো সুন্দরভাবে ইতিহাসের এই মহানায়ককে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। পুরো লেখাটা কয়েকবার পড়লাম। দু একটি তথ্যগত দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
    (১)
    ৩ নং পর্বের বিধৃত ঘটনাগুলি তোমার বর্ণনামতে ২৬শে মার্চ সকালে শুরু হয়ে সারাদিন অবধি ঘটেছে প্রায় কাছাকাছি সময় ব্যবধানে (বোল্ড করা অংশ):

    একাত্তরের ২৬শে মার্চ সকালে কেবল প্রতিশোধের প্ল্যান ঘুরছিল তার মাথায়। কিছুক্ষন পর হাজির হল দুধওয়ালা

    সুতরাং দুধওয়ালার সাথে চলে যাওয়াটাই বেটার অপশন। তিন বোন, মা আর বড় ভাইকে নিয়ে ত্রিমোহনী চলে এল ফতেহ। স্থির হয়ে বসতে না বসতেই শাচৌ গায়েব, একটু পর তাকে দেখা গেল ফিরে আসতে। ফতেহকে ডাকলেন, এদিক আয়। গোপন শলাপরামর্শ করছেন এমন ভঙ্গিতে ফতেহকে বললেন, কিছু পুলিশ আছে এইখানে, রাজারবাগ থেকে পালায়ে আসছে। গতকাল রাতে তো পাকিস্তানীগুলার সাথে বিশাল ফাইট দিছে পুলিশগুলা, শেষে যখন ভারী এমজি(মেশিনগান) দিয়া ফায়ার শুরু করছে, তখন আর পারে নাই। বেশিরভাগই মারা গেছে, কয়েকজন পলায়ে আসছে এইখানে, এক বাড়িতে আশ্রয় নিছে। চল দেইখা আসি।

    যুদ্ধে করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফতেহ পুলিশগুলোকে দেখতে গেল ভাইয়ের সাথে। কিন্তু তাদের হতাশ হতে হল। দুধওয়ালা বুঝিয়ে বলল, এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। সারারাত যুদ্ধ করে ভয়ংকর ক্লান্ত মানুষগুলা, বিশ্রাম নিচ্ছে আপাতত, পরে আসেন। মনঃক্ষুণ্ণ এবং কিঞ্চিৎ অপমানিত হয়ে ফিরে আসবার সময় হঠাৎ নদীর পাড়ে নৌকা থেকে কেউ একজন ডাকলো ওদের।কাছে যেয়ে দেখল , নানা বয়সের অনেকগুলা মানুষ, বাক্স-পেঁটরা নিয়ে পালাচ্ছে ওরা। যে ডেকেছিল, সে বাষ্পারুদ্ধ গলায় বলল, ভাই দেখেন তো, রেডিওতে কোন মেজর জিয়া না কে যেন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়া কি বলল… আপনারা কিছু শুনছেন নাকি? আশে পাশে আরও কয়েকজন দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ একজন বলল, হ আমি শুনছি। মেজর জিয়া নামে একজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিছে, একটু আগেই শুনছি। ততক্ষনে আরেকজন এসে বলল, খালেদ মোশাররফের ফোরথ বেঙ্গল রেজিমেন্ট , সফিউল্লাহর সেকেন্ড বেঙ্গল, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ সবাই বিদ্রোহ করছে, যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।

    কথাটা শেষ হবার আগেই ফতেহর হাত ধরে শাচৌ বলল, চল, খবরটা পুলিশগোরে দিয়া আসি।

    খালি একটা কথা জানাইতে আসছি। ফোরথ বেঙ্গলের কর্নেল খিজির হায়াত খানকে বন্দী করা হইছে, মেজর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহ করছে সেইখানে, সেকেন্ড বেঙ্গলে শফীউল্লাহ, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ বিদ্রোহ করছে, একটু আগে মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছে, ওয়ার ইজ অন—চিৎকার করে কথাগুলা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল শাচৌ।

    কিন্তু আন্ডারলাইন করা আরও যে সমস্ত ঐতিহাসিক বিবরণ ২৬ শে মার্চে জনতার মুখে শোনা যাচ্ছে তার কিছু কিছুর ঘটনকাল আরও এক বা দুই দিন পর অর্থাৎ ২৭ শে মার্চ - ২৮ শে মার্চ ঘটেছে। যেমন: (১) ফোর্থ বেঙ্গলের (মুল বেস কুমিল্লা) পাকিস্হানী কর্ণেল খিজির হায়াত মেজর শাফায়েত জামিল দ্বারা বন্দী হয় ২৭ তারিখ সকাল ৮ টার দিকে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার অস্হায়ী ক্যাম্পে আর মেজর খালেদ মোশারফ মৌলভীবাজারের কাছাকাছি আরেকটি অস্হায়ী ক্যাম্প থেকে সেখানে যোগ দেন ঐদিন বিকেল তিনটায়। উনার প্লাটুনে আর কোনো পাকিস্হানী অফিসার না থাকায় আলাদা বিদ্রোহ করতে হয় নি। (২) মেজর শফিউল্লাহ ২৮ তারিখ সকাল পর্যন্ত ঢাকার জয়দেবপুরে অবস্হান করছিলেন উনার বাহিনী নিয়ে উনার পোস্টিং টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হও্য়ার পুর্ব পর্যন্ত, জয়দেবপুরে ২৮ তারিখ বিকেলে মেজর মইন বিদ্রোহ করে উনার সাথে যোগ দেন পূর্ব পরিকল্পনা মতো। (৩) মেজর জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ ভোর ২টায় বিদ্রোহ করলেও উনার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা আসে ২৭ তারিখ সন্ধ্যায়।
    (২) যুদ্ধের শুরুর দিকে সেনা অফিসার হায়দারের পদবী ছিলো ক্যাপ্টেন, উনি পরে মেজর পদে প্রমোশন পান। ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে পরিচয় পর্বে উনি মেজর পদে থাকার কথা না যেটা তোমার লেখায় এসেছে (৪র্থ পর্ব)।
    (৩) বদির বিষয়টা খুব শিওর না, তবে মনে হচ্ছে কোথায় পড়েছিলাম উনি বর্ডার ক্রস করে ট্রেনিং নেন নি উনার আগের রাজনৈতিক পরিচয়ের সমস্যার কারনে। তোমার লেখার পেলাম উনি ২৭ তারিখে বেরিয়ে পড়েছেন। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  25. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    রাআদ এবং মাসরুফ,

    দুর্দান্ত! :boss:

    বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে আবেগ, তা' পুরোমাত্রায় পেলাম এই লেখায়। আমার বিশ্বাস, অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবে তোমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের 'লোক-ইতিহাস' সংগ্রহে।

    যে মানুষগুলো না থাকলে আমাদেরকে স্বাধীন দেশের ঘি মাংস খাবার বদলে পাকিস্তানি প্রভূদের পদলেহন করতে হত, সেই মানুষগুলোর খুব অল্প ক’জনের সাথেই আপনার দেখা হবে এসি রূমের বিলাসিতায়। এঁদের বেশিরভাগকে আপনি পাবেন এরকম হঠাৎ করে, জীর্ণ-শীর্ণ রূপে। কিন্তু একবার তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন একাত্তরের রণাংগনের কথা, দেখবেন ওই অশীতিপর বৃদ্ধের চোখে কি এক অপার্থিব আলো খেলা করছে, যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছেন আপনি এবং আপনার চারপাশ।

    এই প্রয়াসকে আমি সাধারণ/প্রচলিত ইতিহাস চর্চার থেকেও জরুরী মনে করি। কেন, সেটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা বিষয়ে মাসরুফের আগের একটা ব্লগে বিস্তারিত বলেছিলাম। তাছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলেও এটা যে কেউই বুঝবে।

    এই ব্লগটা আরো একটা কারণে আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।-এর মধ্যেই বিদ্যমান কেন শুধুমাত্র আবেগ 'স্বাধীন বাংলাদেশ' কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, কেন এই আবেগকে গঠনমূলক পথে চালিত করা অবশ্যম্ভাবী। একটা উদাহরণ দেই-

    আজকের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যে মেয়েদেরকে ঘরের ভেতরে আটকে রাখতে চায় এটা তো খুব স্বাভাবিক!

    স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যা' যা' করেছে এবং এখনো করতে চায়, সেইসব অপরাধ/দোষকে যেন কোনভাবেই তাদের বৈশিষ্ট্য বলে প্রতিষ্ঠা করা না-হয়। কারণ, আমি নিশ্চিত জানি যে বাংলাদেশে মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখার প্রবণতা শুধুমাত্র স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের, তথা বিদ্যমান সমাজকাঠামোরই একটা সাধারণ প্রবণতা, প্রায় সকল ধর্ম+সম্প্রদায়ের মধ্যেই। একই কথা স্বাধীনতাবিরোধীদের অন্যান্য অপরাধগুলোও ক্ষেত্রেও- যথা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, জিম্মী করা, বাড়ীঘর জবরদখল করা, ইত্যাদি। মোটকথা, দেশকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে হলে 'স্বাধীনতাবিরোধী' লেবেলের মধ্যে যেন সম্ভাব্য অপরাধগুলো আটকে ফেলা না-হয়।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  26. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    জিয়ার ঘোষণা ছিলো ২৭শে মার্চে। কিন্তু এতে করে জিয়ার অবদান ক্ষুন্ন হয়ে যা না।
    এই সংক্রান্ত দলিল সমূহ এইখানে। লেখার লিঙ্ক।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  27. আপনার এই লেখাটি পড়ে আগেও মন্তব্য করেছিলাম। খুবই ভাল লেখা। গতকাল আবার এক জায়গায় এই লেখার লিঙ্ক দেখে আরেকবার পড়লাম। আরেকটি জায়গায় একটি তথ্যগত ভুল চোখে পড়লো তাই আপনাকে জানানোর জন্য এই মন্তব্য করছি।

    "সেই বীরযোদ্ধা মেজর সালেক পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনাদের সাথ্রে যুদ্ধ করতে করতে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে, হাসিমুখে…"

    মেজর সালেক চৌধুরী পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করার সময় মারা যাননি। তিনি মারা যান ১৯৭২ সালে, যশোর ক্যান্টনমেন্টে। তখন তিনি ৯ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার। অফিশিয়াল ভাষ্যে বলা হয়েছিল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে শুনেছি এই ভাষ্য নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন। মেজর সালেকের পরিবারও নাকি এই ভাষ্যকে সত্য মনে করেননি।

    জবাব দিন
  28. বই/লিখা পড়ে খুব কম সময় ই চোখের পানি ফেলেছি। কিন্তু এই লেখাটা পড়তে গিয়ে কখন যে চোখ দিয়ে পানি বের হয়েছে টেরই পাইনি। বাবার মুখে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি, কিন্তু লিখে রাখতে পারিনি, এইবার হয়তো আর মিস করবোনা।

    জবাব দিন
  29. ভাই, মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে নিছক কোন যুদ্ধ নয়। অনেক আবেগ আর অস্তিত্বের ধারক। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটুক্তির কারনে কত বন্ধু যে আমার চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছে বলতে পারবনা। আপনার এই লেখা পড়ে কতবার যে চোখে পানি এসেছে আর ভেবেছি হাতি হিসেবে আমরা কতটা গর্বিত। কতটা বীরত্বে লেখা আমাদের জন্মের ইতিহাস। ধন্যবাদ ভাই। এরকম একটা শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের দলিল আমাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

    জবাব দিন
  30. আপনার ওয়ালে এই লেখাটা মনে হয় গত বছর পড়েছিলাম।
    তখন ছবি বা এতো সুন্দর করে গোছানো ইনফো ছিলনা। সেখানে অবশ্য উল্লেখ করেছিলেন, এই লেখাটা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত লেখাটা পেলাম।
    তাঁদের প্রতি রইল মাথা নুয়ে পড়া শ্রদ্ধা!
    আর আপনাদের প্রতি রইল অনেক অনেক ভালবাসা, বেঁচে থাকুন হাজার বছর, চলতে থাক কলমি সুখ!

    *বারবার এমন নোনাজলে মুছে ফেলতে চাই সকল গ্লানি।

    জবাব দিন
  31. যদিও আমি ক্যাডেট এর ছাত্র না। গুগলে সার্চে আসার পর শিরোনাম দেখে পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। পুরোটা শুরু থেকে পড়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলাম। অসাধারণ বিবরণী।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।