***এই লেখাটাও আমার সামহোয়ারইনে লেখা একটি পোস্ট। এক রোমাঞ্চকর রাতের অনুভুতি শেয়ার করলাম। দুটি চরিত্র বাদে সব চরিত্রই বিভিন্ন জনের স্বভাবের মিক্সচার। তবে কাহিনীটা পুরোপুরি সত্য।
২০০১ সাল,সোহরাওয়ার্দী হাউস,মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ
রাত দশটা ,পোর্চ
সারাদেশে ক্রিকেটের জোয়ার চলছে। কয়েকদিন আগে মাত্র বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। ক্রিকেটিয় উম্মাদনার আচড় থেকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ও বাদ যায়নি। আর এইসব উম্মাদদের মধ্যে বদ্ধ উম্মাদ
তারা দুইজন পিয়াল আর পুলক। পিয়াল পাকিস্তানের অন্ধ সমর্থক। বাংলাদেশ ছাড়া সে আর একটা দলকেই সমর্থন করে পাকিস্তান। পুলক ঘোর শ্রীলংকার সমর্থক।সে জয়সুরিয়ার নামে পাগল।
পাকিস্তানের আরেক সমর্থক রাফাত। তার ভালবাসা ওয়াকার ইউনিস। সেলিম আরেক ক্রিকেট পাগল তার ভাললাগা শ্রীলংকা আর অস্ট্রেলিয়া। আরেকজন মাশফিক। সে নিজে ভালো খেললেও খেলাটা ঠিক বুঝেনা বলেই সবাই মনে করত। কারণ সে অসংলগ্ন কথা বলত বেশি আর সে ছিল সুবিধাবাদী দক্ষিন আফ্রিকার সমর্থক।
আর সবচাইতে রহস্যময় সাপোর্টার রাজন। সে যে কোন দল সমর্থন করে তা আজও সবার কাছে রহস্য। শোয়েব আখতারের বোলিং দেখে সে নাচছে একদিন তা দেখে তাকে পাকিস্তানের সাপোর্টার যদি কেউ ভাবেন ভুল করবেন। কেননা এই শোয়েব লারার হাতে মার খেলে সে নাচে। ভাববেন না সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেননা তার কাছে লারার চেয়ে আলেক স্টুয়ার্ট তার বেশি প্রিয়। নাহ,তাই বলে ইংল্যান্ড না কেননা শচীনের বেধড়ক বাড়ি গফ দের উপর পড়লে সে হয় রোমাঞ্চিত। আবার নিউজিল্যান্ড ভারতে তাকে নিউজিল্যান্ডের পক্ষেই দেখা যাবে। আবার জয়ার মার খেয়ে যখন কেয়ার্নসরা মুখ লুকায় তখনো সে উচ্ছসিত।
এমনি সব পাগলে ভরা এই সোহরাওয়ার্দী হাউস। প্রায় প্রতি দিন থার্ড প্রেপের পড় কিংবা ছুটির সন্ধ্যায় অবসরে ঝড় বয়ে যায় ক্লাশ টুয়েলভের রুম গুলোতে। বিষয় অবশ্যই ক্রিকেট। আজ অবশ্য কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছে না। সবাই আজ একাট্টা। পাকিস্তান শ্রীলংকার কালকের ম্যাচ দেখতেই হবে। আপাত গুরুত্বহীন এই ম্যাচ গুরুত্ব পাওয়ার কারণ একটাই।খেলা দেখার পারমিশন মেলেনি।কিন্তু কী ভাবে তারা রাতে টিভি দেখবে।টিভির রুম তালা মারা থাকে সেটা নিয়েই আজ এ জরুরী মিটিং।
মিটিং শেষ হলো।মোটামুটি সবাই যে যে যার যার কাজ বুঝে নিল। পুলকের মেজাজ খিচড়ে আছে কেননা সবচেয়ে লো প্রোফাইল অথচ ঝুকি পুর্ন কাজ তার।রাফাতকে দেয়া হলো বোরিং কাজ।আর বাকি সবাই রোমঞ্চিত চিত্তে ঘুমাতে গেল পরেরদিনের উত্তেজনা মাথায় রেখে।
সকাল ৮:১৫ কমন রুম
নিজাম ভাই স্টোর রুমে যাব খুলে দেন।-পুলকের আওয়াজে ঘুরে দাড়াল হাউস বেয়াড়া নিজাম।তার হাত ভেজা।আবার ওদিকে পুলকের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কী করবেন?-তার প্রশ্ন পুলকের দিকে।
আমার জুতা বদলাব । প্লিজ তাড়াতাড়ি করেন।
করিডোর মুছতে মুছতে নিজাম পুলকের দিকে চাইল। তাকেও তাড়াতাড়ি একটু বাসায় গিয়ে বাজার করতে হবে।আর পুলক তো অত্যন্ত বিশ্বস্ত। সে সরল বিশ্বাসে চাবির গোছা পুলককে দিয়ে বলল আপনি নিয়ে নেন আর চাবি দিয়ে যায়েন।আমি খুলে দিতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।
চাবির গোছা পেয়ে চুমা দিল পুলক।স্টোরে যাওয়ার ভান করল।আর এই ফাকে নিজেদের একটা চাবি গোছায় ভরে আসল টিভির রুমের চাবি খুলে নিল।
সে সফল।রিস্কি এবং লো প্রোফাইল কাজটি এতটা সহজে হবে বোধ করি সে এখন ও বিশ্বাস করতে পারছে না।পকেটে চাবি নিয়ে সে একাডেমিক ব্লকের দিকে রওয়ানা হল।
রাত দশটা,বক্স রুম
চাপা উত্তেজনা চারটি ছেলের মনে।পুলক আর পিয়ালকে আজ টিভির রুমে দেখা যায়নি।খেলা দেখার চেয়ে বড় রোমাঞ্চ তাদের জন্য।সেলিম রীতিমতো উত্তেজনায় ফুটছে।বিশালদেহী এই সহজ সরল ছেলেটি একটু বোকাও বটে।সে এরই মধ্যে পুরা হাউজ মাথায় তুলে ফেলেছে।এর ক্ষতিকর দিকটি নিয়ে সবাই শংকিত।জানাজানি হলে ধরা খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।মাশফিক কিছুটা ক্ষুব্ধ।সে আবার একটু নেতা শ্রেনীয় কিনা।একটু ভাব না নিলে তার কতৃত্ব আর থাকে না।সে বেশ ভাব নিয়েই সেলিমকে ঝাড়ল।না টুয়েলভে উঠেও তুই সেই বাচ্চাটাই রইলি।সে রাজন কে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিল কাজে।কাজটা হলো ক্লাশ মেট সবাইকে খেলা দেখতে আসতে বলা ।আর যাতে ব্যাপারটা গোপনীয় থাকে সে ব্যাপারে পই পই করে বলে দিল।এখন সবার প্রতীক্ষা কখন লাইটস আউটের বেল পড়ে আর রাফাতের থেকে সিগন্যাল মিলে।
রাফাত
উহ কী বিরক্তিকর এই কাজ।রাফাত মনে মনে কুৎসিত কিছু গালি দেয় তার বন্ধুদের।শালারা সব মজা নিব আর আমারে রাখছে পাহারায়। পাহারার কাজ সব সময় বিরক্তিকর আর যদি হয় রউফ ভাইয়ের মত লোকের।সে একটা সাক্ষাত টিকটিকি।আর কিছু হলেই ক ক করে অদ্ভুত শব্দ করে উঠেন।তাই তার নাম কাওয়া।এস এসসি পরীক্ষার সময় যখন তারা রুম ক্রিকেট খেলত তখন ফেউয়ের মত সে কোথেকে এসে কক করে হাজির হতো।তাই তো সেই সিরিজের নাম হয়ে গেল কাওয়ার ডাক সিরিজ।এসব কথা মনে করে আপন মনে হেসে উঠল সে।লাইটস আউট হয়েছে আধ ঘন্টা হলো এখনো ফেউটার শোয়ার নাম নাই।একটা সিগারেট হলে মন্দ হতো না সময়টা বেশ কেটে যেত।এসব ভাবতে থাকে সে।তার সিগারেট খওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে।দুই ব্যাচ সিনিয়র এক ভাইয়ের হাত ধরে তার শুরু।তার সাথে থেকে সেলিম মাশফিক রাও খায়।বেশ বীরত্বপূর্ণ মনে হয় তিন তলায় যাওয়া।পুলকটা সিগারেট খায় না শুধু মাঝে মাঝে এসে ভাগ বসায়।এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় তার মনে হয় রউফ ভাই ঘুমিয়েছে।সে তড়িত ছুটে গেল সিগন্যাল দিতে।
চুরি
রাফাতের সিগন্যাল পেয়ে কাজ শুরু করে দিল মাশফিক পিয়াল সেলিম আর রাজন।আর এদিকে বাকিরা মিলে শুরু করে দিল রুম ঢাকার কাজ।বাইরে থেকে যাতে টিভির আলো না দেখা যায়।চলতে লাগল অধীর অপেক্ষা কখন ঐ চারটা আসে।
টিভির রুমে এসে সন্তর্পনে চাবি খুলে ফেলল মাশফিক।বিশালদেহী দুই দৈত্য সেলিম আর রাজন ঢুকলো প্রথমে তার পিছে বডি বিল্ডার পিয়াল।তাদের তিনজনের টিভি আনতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় ভেবে বাইরে রউফ ভাইকে পাহারা দিতে থাকল মাশফিক।এই লোক ভান করে নেই তো।তার মনে শংকা হয়।কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এল ওরা টিভি নিয়ে।তাদের মনে এখন বিশ্বজয়ের আনন্দ।এর মাঝেও ঘাগু মাশফিক টিভির রুমের তালা মারতে ভুলল না।
বক্স রুম
এরই মাঝে পুলক রুমের সুইচ খুলে ফেলেছে।টিভির পাওয়ার তাতেই হলো।টিভি ছাড়া হলো।কিন্তু একি ?এন্টেনা নাই ।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ক্যাডেটরা পারেনা এমন কিছু নেই ক্যাডেট কলেজের ভুল প্রচলিত এই কথা সত্য করে দিয়ে কী এক খেল দেখিয়ে কোন ডান্ডা দিয়ে পিয়ার অপার দক্ষতায় টিভিতে ছবি নিয়ে এল।সাথে সাথে সারা রুম জুড়ে হাততালি পড়ল।শুধু বিরক্ত হলো মাশফিক।এর কোন মানে হয়।এই বুজি ওরা ধরা খেল
যাই হোক খেলা দেখতে হাউসের সবাই আছে।সেলিম আর পুলক ছাড়া সবাই পাকিস্তান।রাজনটা আজ ইউনুস খানের সৌজন্যে পাক সাপোর্টার বনে গেছে।খেলার পাচ ওভার মত বাকি।পাকিদের জয় মোটামুটি নিশ্চিত।সবাই উচ্ছসিত ওরা দুজন ছাড়া।
৩ ওভার বাকি।মোটে দরকার ১৯ রান।চার উইকেট আছে।আকরাম আর লতিফ আছে উইকেটে।কোন সম্ভাবনা না দেখে পুলক আর সেলিম ভাবছে এত ঘটা করে এই ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচের অল্প কিছু দেখলাম।ধ্যাৎ।কিন্তু ক্রিকেট ঈশ্বর যেন তাদের কথা শুনলেন।স্বভাব বিরুদ্ধ স্লো ব্যাটিং করে জমিয়ে তুললেন লতিফ আর পাক সাপোর্টাররা ডুবে যেতে থাকল হতাশায়।আকরামের সাথে একাত্ম হয়ে রেগে যাচ্ছে ১১টি প্রানী।২ বলে যখন ১১ রান দরকার আকরাম মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন আর সেলিম আর পুলক বিশ্বজয়ের আনন্দে মেতে উঠল সবার সামনে।বাকিরা বিরক্ত মুখে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল।পিয়াল বলল সবাই যাসনে কয়েকজন থাক, টিভি রেখে আসতে হবে আমি যেতে পারব না ,মেজাজ খারাপ।যত্তোসব ফাউল ……….পাকিস্তানের উপর তার ক্ষোভ ঝাড়ল……
চাবিটার কী হবে ভেবে অজানা আশংকায় শংকিত রইল শুধু পুলক……….
টিভির রুমে যেতে মাশফিক রাফাত রাজনরা রউফ ভাইয়ের চির চেনা ক ক শুনতে পেল…..
****এই গল্প যখন লিখি তখন এর একটি চরিত্র সেলিম(আসল নাম আলম আমি মজা করে সেলিম বলতাম) আর নেই।গত বছর ঢাকায় একটি ব্যাংকে টাকা টোলার পড় সে ছিনতাই কারীদের হাতে পড়ে।তদের সাথে ধস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে ওদের গুলিতে সে ইহধাম ত্যাগ করে।কিন্তু তার স্মৃতি মির্জপুর ক্যাডেট কলেজের ৩৪ তম ব্যাচের সবার হৃদয়ে সদা জাগরুক।আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস তার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত।
:party:
আমাদের এই অপারেশনটা এখনো আমার মনে পড়ে 🙂 😉 😉 । আমি স্টিলের স্কেল দিয়া এন্টেনা বানাইছিলাম B-) , চলার মতো কাজ করছিল, খারাপ হয় নাই একেবারে... 😉
আসলেই তাই। তৌফিক ঐ কাজ না করলে এমন দুর্ধষ অভিযান একেবারেই মাঠে মারা যাইত।
ভাইরে,
তোমার তো দেখি জিনিয়াস একেকটা। আমরা ও চুরি কইরা টিভি দেখছি, কিন্তু তা টিভি রুমে। তোমরা তো দেখি কঠিন পাবলিক... পুরা টিভি টা রুমেই নিয়া আসলা...?
এই আর কি ভাই আপনাদের দোয়া।
আমিন ভাই, সেইরকম হইছে!!!টিভি শুদ্ধা নিয়া আইছিলেন!আজকালকার পোলাপাইন ডিভিডি শো দেখে আর প্লেয়ার থাকে হাউসেই,সেন্ট্রালি নিয়ন্ত্রন করা হয়না।আফসোস,আমাদের সময় এইটা ছিলো না...
হুম ভাই। অভিযানের মূল হোতগুলি ব্লগে আইলে বড়ই জমত।
আহসান ভাই, যেসময় এই ঘটনা আমারা ঘটাইছিলাম, তখন কলেজের অবস্থা টাইট, হাউস বেয়ারাদের তখন পাওয়ার চরম, ক্যাডেটদের উপর নজরদারি করার জন্য অথরিটির কাছ থেকে তাদের উপর বিরাট চাপ। তাদেরই বা দোষ দেই কিভাবে, চাকরি তো বাঁচাতে হবে। আমাদের হাউস বেয়ারা টিভিরুমের পাশেই ঘুমাতেন বলে টিভি রুমে নেয়া ছাড়া গতি ছিল না। আমাদেরও খুব সাবধানে কাজ করতে হয়েছিল, পুরো হাউস ব্ল্যাক আউট করে জায়গায় জায়গায় লোক রেখে তারপর টিভি রুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, চৌকিদাররা যদি টের পেত, পরদিন এ্যাডজুটেন্ট পর্যন্ত খবর চলে যেত।
😀