মীথবাজি: বজ্রের জন্মকথা

** মাঝে কিছুদিন মীথবাজি হলো ব্লগে। সেই সময় আমি ভেবেছিলাম এই পোস্ট টা দিবো। আলসেমির কারণে দিতে দেরি হয়ে গেলো। অনেকদিন আগে ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের একটি ছোট গল্প পড়েছিলাম। তার যতটুকু মনে আছে একরকম মুখস্থ লিখে দিলাম।

অনেকদিন আগে দেবতা আর অসুররা মিলে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। তাতে যা অমৃত পাওয়া গেলো দেবতারা অসুরদের ফাঁকি দিয়ে সব ভাগাভাগি করে নিলেন। অসুরেরা এমনতেই শক্তিশালী তার উপর না আছে কাণ্ডজ্ঞান। তারা অমর হলে সারা সংসারই উচ্ছনে যাবে। অসুরেরা দেবতাদের এই চালাকি নীরবে সহ্য করলো না। তারা ঠিক করলো যে করেই হোক এর প্রতিশোধ নিতে হবে। অসুরদের রাজা তখন বৃত্র। তার মত পরক্রমাশালী রাজা অনেক দিন হয়নি। দেবাসুরে সংগ্রাম বাঁধলো। স্বর্গরাজ্যে হুলস্থূল পড়ে গেলো। দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের শরীর চিন্তায় চিন্তায় কালো হয়ে যাবার জোগাড়। দেবতারা কিছুতেই অসুরদের সাথে পেরে উঠলেন না । শেষে স্বর্গ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর সাধের অমরাবতী ছেড়ে মর্তের নৈমিষারণ্যে আশ্রয় নিলেন। দেবতাদের লাঞ্ছনার একশেষ হলেন। ভাগ্যিস অমৃত খেয়ে অমর হয়েছিলেন নইলে প্রাণ বাঁচানো দায় হতো।

স্বর্গ জয় করে অসুরদের ফুর্তি আর দেখে। স্বর্গের প্রসাদ শিখরে তাদের বিজয় কেতন উঠলো। বৃত্র আজ স্বর্গের রাজা। অসুররা দিনরাত একাকার করে শুরু করলো উৎসব। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে মর্তে স্বর্গে সবার প্রাণ হলো ওষ্ঠাগত। দেবতাদের বড় সাধের নন্দন কানন আজ অসুরদের ক্রীড়াভূমি আর স্বচ্ছ সলিলা মন্দাকিনী অসুরদের উপদ্রবে পঙ্কিল হয়ে উঠে। এত করেও অসুরদের সাধ মিটলো না। বৃত্র মহিষী ঐন্দ্রিলা ইন্দ্রানিকে তার দাসী করে দেবতাদের দর্প ধূলায় মিশিয়ে দিতে চাইলেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ হলো। অসুরদের কূটচালে দেবতারা আবার পরাভূত হলেন।

দেবতাদের মাঝে মহাদেব ভোলানাথ সাদাসিদে মানুষ। কায়মনে তাঁকে কেউ ডাকলে তিনি তার কথা না শুনে থাকতে পারেন না। বৃত্র তার আরাধনা করে তাকে খুশি করেছিলো। তার কাছে সে অজেয় ও অমর হবার প্রার্থনা করে। তখন তাকে মহাদেব এই বর দেন আত্মত্যাগীর অস্থি নির্মিত অস্ত্র ছাড়া কেউ তার একগাছি চুলও নষ্ট করতে পারবে না.। সেই জোড়ে আজ বৃত্রের এত পরাক্রম । দেবরাজ যখন দেখলেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন তিনি কৈলাসের শিবঠাকুর মহাদেবের কাছে যাওয়া মনস্থ করলেন। মহাদেবতো আর জানেন না তার বরে উম্মত্ত বৃত্রের কর্ম। দেবরাজের প্রার্থনায় যখন তাঁর হুশ হলো রাগে জ্বলে উঠলেন। বললেন, দেবরাজ, আপনাদের দুঃখে আমি দুঃখিত। আমি তো জানি না যে হাতে শক্তি ওপেয়ে বৃত্র এমন কেলেঙ্কারি বাঁধাবে। যাক যা হবার হয়ে গেছে। মর্তভূমে অলকনন্দা তীরে আমার ভক্ত দধীচির কাছে যাও।তিনি দেবতাদের মঙ্গলে তার দেহাস্থি দিতে রাজি হলে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। জগৎ মুগ্ধ নয়নে দেখবে পরোপকারী আত্মত্যাগীর কী তেজ এমন কি তাঁর দেহাস্থির কত শক্তি।

মহাদেবের কথায় ইন্দ্রের মনে আশার সঞ্চার হলো। তিনি নারদকে নিয়ে দধীচির আশ্রমে রওয়ানা হলেন। সন্ধ্যা নাগাদ তারা পৌঁছালেন।মহর্ষি তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। ইন্দ্র সংকোচে মুখ ম্লান করে রইলেন। ধ্যানে বসে মহর্ষি তাদের অভিপ্রায় জানতে পারলেন। বললেন, দেবরাজ আপনি সঙ্কোচ করছেন কেন। আজ যে আমার কত খুশির দিন। আমার এই দেহ কে দেবতাদের কল্যানে দিয়ে যাওয়াতেই তো আমার জন্মের সার্থকতা। আমার এই জীর্ণ পঞ্জর আজ দেবতাদের তরে লাগবে এতো আমার স্বপ্নেরও অতীত। তার কথা শুনে শিষ্যদের চোখে জল এলো। তাদের কাছে চির বিদায় নিয়ে সংসারের কল্যাণে দেবতাদের স্বার্থেভগবানের নামে ঋষি দেহত্যাগ করলেন।

এই অস্থি দেবরাজ নিয়ে দিলেন দেব শিল্পী বিশ্বকর্নমার কাছে। সেই অস্থি নির্মিত অস্ত্রই হলো বজ্র। এই বজ্রাস্ত্রে বৃত্রকে বধ করে দেবতারা অসুরদের তাড়িয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকার করেন দেবতারা।দধীচির আত্মত্যাগে ত্রিভুবন বিস্মিত হলো। কত যুগ যুগান্ত চলে গেছে, কিন্তু আজও বজ্র আকাশ বাতাসে কড়কড় শব্দে সেই আত্মত্যাগী দধীচির বিরাট ত্যাগের কথা জানিয়ে যায়।

৩,৬৫৫ বার দেখা হয়েছে

৫৬ টি মন্তব্য : “মীথবাজি: বজ্রের জন্মকথা”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পড়ে বেশ ভাল লাগল... চালায়া যা :hatsoff: (সময় করে ক্রিকেটের পোস্টটা দিয়ে দিস... অপেক্ষায় আছি)


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    দারুন ভাইয়া। :thumbup: :thumbup:
    তবে বৃত্রনিধন পর্বটুকু আরেকটু ডিটেইলস সহ দিলে আরো ভালো হতো।
    ভাইয়া, শেষ প্যারার বিশ্বকর্নমার শব্দটা কি বিশ্বকর্মার হবে না?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মাহমুদের পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়া দেখি আমিনের পোস্টে বহু পিছনে পিড়া গেলাম। বরাবরের মতো ভালো হয়েছে। মিথবাজি চলুক।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. আন্দালিব (৯৬-০২)

    খুবই চমৎকার হয়েছে আমিন। চালায়া যা। আমি মীথবাজির পরের পর্ব লিখতেছি! :thumbup:

    পড়তে পড়তে একটা জিনিশ খেয়াল করলাম। পৌরাণিক সকল কাহিনীতেই দেবতারা অনেক দূর্বলচিত্তের (যদি তাঁদের চিত্ত থেকে থাকে)। সহসাই রেগে যায়, মারামারি ঝগড়াঝাটি তো নর্মাল ব্যাপার। বেশিরভাগই নারীলিপ্সু, স্বর্গে নানা ক্যাচাল করার পাশাপাশি মর্ত্যেও স্ক্যান্ডাল! মুনিদের কাছে, মানুষের কাছে প্রায়ই ধরা খায়। এমনকি শক্তিতেও অসুর বা রাক্ষসদের সাথে অনেকসময়ে পারে না!

    তখন ভাবি পুরাণে কেনইবা এমন করে রচিত হলেন তারা। যেটা জবাব দাঁড়া করানো যায় সেটা হলো বিশ্বাসযোগ্য করতে "মানুষের মত" চরিত্র করা হয়েছে তাদের। এ কারণেই এই দোষত্রুটিগুলো ফুটে উঠেছে!

    এমনিতে ভিলেনদেরকেই আমার ভালো লাগে, রাবণ, কুম্ভকর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন এক একটা চীজ ছিলো!

    জবাব দিন
  5. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    আমার পিসি ঝামেলা করতেসে । তাই খুব ডিটেইলস বলতে পারতেসি না। তবে এর সাথে জড়িত রাজনীতি । যেমন রামায়ন মূলত আদি ভারতে আর্য দ্রাবিড় সংঘাত । সেটা মাইকেলের আগে কেউ বুঝে নাই । মিথগুলোর সুর অসুর অংকিত হয়েছে রক্ত মাংসের কোন মানব বা মানবীর মোডিফাইড ভার্সন হিসাবে ।

    জবাব দিন
  6. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    রাহুর গ্রাস হইল আরেক প্যাকেজ-রাহু নামে এক অসুর আইসা সমুদ্রমন্থনে দেবতাদের অমৃত খাওয়ার সময় দেবতা সাইজা অমৃত মুখে দেয়-অমৃত গলা পর্যন্ত নামার সাথে সাথে সূর্য তারে চিনা ফেলে আর আরেক দেবতা (বিষ্ণু মনে হয়) তার গলা কাইটা ফেলে।সেই থিকা রাহুর রাগ সূর্যের উপ্রে-যেহেতু গলা পর্যন্ত অমৃত গেছে তাই দেহ কাটা পড়লেও মাথাটা অমর হয়া গেছে।এই মাথা দিয়াই সে প্রতি বছর সূর্যরে খাইতে চায় আর সূর্য পলায় পলায় বেড়ায়।যখন সূর্য ধরা পড়ে তখন সূর্যগ্রহণ হয়-কিন্তু রাহূ সূর্যরে গিল্লা ফেললেও কাটা গলা দিয়া একটু পরেই সে বাইরাইয়া যায় আর গ্রহণও কাইটা যায়।

    এই হইল বিরিত্তান্ত,বুঝলি মদন?

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।