বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির কিছু উপরে, যার মধ্যে শতকরা ৮৭ ভাগই মুসলমান। এই হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪র্থ বৃহত্তম মুসলিম দেশ। আমরা জানি, ভারতবর্ষ ঐতিহাসিকভাবে সিন্ধু ও গঙ্গা নদীর তীরবর্তী দ্রাবিড় এবং আর্য সভ্যতার আবাসভূমি। এরা ছিল মূলতঃ বৈদিক বা হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। এদের মধ্যে এতোগুলো মুসলমানরা এলো কিভাবে? তাও আবার প্রতি দশজনে নয়জনই মুসলমান? উপরন্তু ভারতবর্ষের একেবারে পূর্বপ্রান্তে যা কিনা মুসলমানদের শাসনকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল? এটা কিভাবে সম্ভব হলো? অর্থ্যাৎ, বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও বিকাশ হলো কি করে?
এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন লুৎফুল ভাই (১৯৭৮-৮৪) তার ব্লগের এক মন্তব্যে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, “তিন শ্রেণীর মুসলমানরা তৎকালীন ভারতবর্ষে এসেছে বা উদ্ভূত হয়েছে। এক) ধর্ম প্রচারক, সাহাবী পরিবেষ্টিত; দুই) হারেরেরে পার্টি, লুণ্ঠনের সংগী ও সাগরেদ সহ; তিন) বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে জাহাজ ভেড়ানো বা পাড়ি জমানো। এদের আবাস গড়া, বংশ বৃদ্ধি, অনুসারী ও ধর্মাবলম্বী সৃষ্টি, শাসক হিসেবে রাজ্য দখলের সূত্র ধরে মিত্র-সহযোগী-অনুসারী-সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি। তৎপরবর্তীতে দীর্ঘ মুসলিম শাসনের ভেতর দিয়ে প্রসার লাভ”।
এই তিনটি অনুমানকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি কয়েকটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন- ধর্ম প্রচারক ও তাদের সঙ্গীসাথী এবং আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার, এদের পাশাপাশি মুসলমান শাসকদের আগমন এবং ক্ষমতার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার, এবং এইসব বহিরাগত মুসলমানদের স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার। একাডেমিক আলোচনায় এই অনুমানগুলোকেই আরেকটু সাজিয়ে গুছিয়ে চারটি তত্ত্বের আকারে উপস্থাপন করা হয়, যথা- মধ্য-এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে মুসলমানদের মাইগ্রেশন, তলোয়ারের মাধ্যমে তথা রাজক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার, বস্তুগত তথা আর্থ-সামাজিক সুবিধার বিনিময়ে ইসলামে ধর্মান্তর এবং পূর্বের বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে মুক্তি লাভের আশায় তুলনামূলকভাবে সাম্যবাদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। অনেক লেখক ও গবেষক এই তত্ত্বগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেগুলোকে সিস্টেম্যাটিক্যালি পর্যালোচনা করেছেন রিচার্ড ঈটন (১৯৯৩, ৫ম অধ্যায়)। আমি ঈটনের বই থেকে নিয়ে আলোচনাটা এখানে উপস্থাপন করছি।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রসারে উল্লিখিত তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবথেকে দূর্বলটি হলো বাইরে থেকে মুসলমানদের মাইগ্রেশন। বাইরে থেকে মুসলমানরা অবশ্যই এসেছে- ইরান থেকে, মধ্য-এশিয়া থেকে, আরবের কিছু কিছু অঞ্চল থেকেও। কিন্তু তারা কতজন? আর তারা ভারতবর্ষের কোথায়ই বা স্থায়ী হয়েছে? তাদেরকে সংখ্যায় গুনতে চাইলে হাজারে হাজারে এসেছিল বলে ত’ মনে হয়না। কোন ঐতিহাসিক তথ্যও নেই হাজারে হাজারে মুসলমানের বাইরে থেকে ভারতবর্ষে মাইগ্রেট করার। সেসময় ত’ আর আজকের মতো সহজ+দ্রুত+প্রর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চলাচলের মাধ্যম ছিল না। উপরন্তু, এমন কোন ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রও নেই যা’ লাখে লাখে, অন্ততঃ হাজারে হাজারে বহিরাগরত মুসলমানের ভারতবর্ষে মাইগ্রেট করাকে সমর্থন করে। সবশেষে, দীর্ঘ কয়েক শতকব্যাপী যে সামান্য কয়েক হাজার মুসলমান ধর্মপ্রচারক, বণিক ও প্রশাসক এসেছিলেন, তারা খুব সম্ভবতঃ ব্যবসাকেন্দ্র ও শাসনকেন্দ্র তথা নগরে+বন্দরে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। কিন্তু সেসময়কার ভারতবর্ষে এমন কোন নগর বা বন্দর নেই যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। বরং, এর উল্টোটিই সর্বত্র দেখা যায়। অর্থ্যাৎ, মাইগ্রেশনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের কতিপয় অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেনি, বাংলায় ত’ অবশ্যই না।
শাসনক্ষমতা দখলের মাধ্যমে বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তর করার তত্ত্বের উৎপত্তি আরব বিশ্বে তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রসারের বিতর্কিত ওরিয়েন্টালিস্ট ন্যারাটিভ থেকে এসেছে। এই তত্ত্বের প্রস্তাবনা হলো- ইসলাম ধর্মের জন্মলগ্নে আরব বিশ্ব ছিল কতগুলো যুদ্ধবাজ গোত্রের আবাসভূমি, আর সেই গোত্রগুলোর মধ্যে একটা- কুরাইশ- যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমগ্র আরব বিশ্বকে পদানত করে সবাইকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছে। একইভাবে মূলতঃ ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসারকেও তলোয়ারের মাধ্যমে হয়েছে বলে অনুমান করে। উপমহাদেশে ইসলাম বিস্তার তলোয়ারের মাধ্যমে হওয়ার ধারণার আরেকটা উৎস হলো ফার্সী ভাষায় লেখা মুসলমানদের বিজয় কাহিনী। ভারতবর্ষে আগত মুসলমান বিজেতারা ছিল প্রধানতঃ ফার্সী ভাষাভাষী তুর্কী। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনীকে তারা বলত ‘লস্কর-ই-ইসলাম’ বা ইসলামি সেনাদল। একইভাবে তারা বিজিত জনগোষ্ঠীর পরাজয় মেনে নেওয়াকে বলত ইসলামের অধীনে আসা। ফার্সী থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে মুসলমান বিজেতাদের ভারত বিজয়কে ইসলাম ধর্মের বিজয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে তুর্কীদের বিজয়গাঁথায় নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ আর বিজিতদেরকে ‘কাফির’ বলে অভিহিত করার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, সেসময় এখনকার মতো দেশ, জাতি বা এথনিক গোষ্ঠীর ধারণা ছিলনা। মানুষ ছোট পরিসরে গোত্রের মধ্যে নিজেদের পরিচয় নির্ণয় করতো, আর বৃহত্তর পরিসরে সাম্রাজ্য বা রাজ্যের প্রজা হিসেবে। আর সেই সাম্রাজ্যগুলোর পরিচয়ে রাজবংশের পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় পরিচয়ও চলে আসত। সাধারণজ্ঞানেও একথা বোঝা কঠিন নয় যে, গলায় ছুড়ি ধরলেই একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে বহিরাগত একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে নেয়না। আর তাই ভারতবর্ষে মুসলিম বিজাতের ইতিহাসে এমন কোন যুদ্ধের ঘটনাও নেই যেখানে বিজিত জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকহারে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। বর্তমানের দিকে তাকালেও এই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একেকটা জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার তত্ত্ব বাতিল করা কঠিন নয়। এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবথেকে জোরালো যুক্তি হলো ধর্মের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক অবস্থান। তলোয়ারের মাধ্যমেই যদি ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসার ঘটে থাকে, তাহলে সবথেকে বেশি মুসলমান থাকার কথা যেসব অঞ্চলে যেখানে মুসলমানদের শাসন বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এই হিসেবে দিল্লী ও এর আশেপাশের অঞ্চল এবং সাধারণভাবে বর্তমান উত্তর প্রদেশ মুসলমান প্রধান হওয়ার কথা। অথচ, দেখা যাচ্ছে মুসলমান প্রধান এলাকা হলো বাংলা যেখানে মুসলমানদের শাসন ছিল তুলনামূলকভাবে সবথেকে দূর্বল এবং স্থানীয়দের (তথা অমুসলিমদের) উপর অধিক নির্ভরশীল। অতএব, তলোয়ারের ভয়ে স্থানীয় অমুসলিম জনসংখ্যার ব্যাপক হারে মুসলমান হয়ে যাওয়ার ধারণা ভ্রান্ত। বাস্তবে মুসলমান শাসনের অধীনে, নির্দিষ্ট করে বললে মুঘল আমলে, হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটেছিল বাংলায়।
তৃতীয় একটা তত্ত্ব অনুযায়ী ভাতরবর্ষের স্থানীয়রা বৈষয়িক লাভের আশায় (যথা- কর মওকুফ, সরকারী চাকুরী বা খাস জমি, রাজপদবি, ইত্যাদি) বিজয়ীদের ধর্ম ইসলামকে গ্রহণ করেছিল। এই তত্ত্ব মূলতঃ পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। এই তত্ত্বের সমর্থনে কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্যও আছে, যেমন ইবনে বতুতা উল্লেখ করে গেছেন যে, খিলজী সুলতানদের দরবারে কতিপয়র হিন্দু নিজেদেরকে ধার্মান্তরিত মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুলতানের অনুগ্রহ লাভ করেছিল। এই প্রক্রিয়াকে অনেকটা ইংরেজদের সময় ‘ওয়েস্টার্নাইজেশনের’ সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে দেশীয়দের মধ্যে কিছু লোক ও পরিবার ইংরেজি শিক্ষা ও লাইফস্টাইল রপ্ত করে নিয়ে ইংরেজদের কাছ থেকে চাকুরী, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সামাজিক পদবি অর্জন করেছিল। সত্য যে এভাবে একটা অঞ্চলের সামান্য কিছু লোক ধর্মান্তরিত হতে পারে, কিন্তু তার সংখ্যা কিছুতেই শতকরা ৮০ জন হবে না।
সর্বশেষ তত্ত্বটি হলো বর্ণবৈষম্যমূলক হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের লোকেরা সাম্যবাদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে সামাজিক মুক্তির আশায়। এই তত্ত্বই আমাদের ইতিহাসের টেক্সট বইয়ে আছে, এর কথাই পারভেজ ভাই এবং লুৎফুল ভাই উল্লেখ করেছেন। আমিও এই ধারণাকেই সঠিক বলে জেনেছি মাস খানেক আগে পর্যন্ত। এই তত্ত্বের জন্ম বৃটিশ এথনোগ্রাফার আর ঐতিহাসিকদের হাতে, এর বিকাশ হয়েছে বাঙালি আর পাকিস্তানী মুসলমান গবেষক ও লেখকদের হাতে, আর এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে অসংখ্য জার্নাল, বই ও নানান প্রকাশনার পাশাপাশি জাতীয় টেক্সট বুক বোর্ডের মাধ্যমে। এই তত্ব বেশ কয়েকটা অনৈতিহাসিক এবং অযৌক্তিক অনুমানের উপর গড়ে উঠেছে। প্রথমতঃ সামাজিক সাম্যের ধারণা তথা সকল মানুষের অধিকার জন্মগতভাবেই সমান এই ধারণার জন্ম হয়েছে ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে যা’ ভারতবর্ষে মুসলমানের আগমনের কয়েক শতাব্দী পরের ঘটনা। কালের প্রেক্ষিতে আগের ঘটনাকে পরের কোন ঘটনার ফলাফল হিসেবে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়না। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, পলাশীর যুদ্ধে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে জিতেছিল তাদের উন্নত সমরাস্ত্রের কারণে (যেগুলো আমরা পরবর্তীতে বৃটিশ সেনা ও নৌবাহিনীতে দেখি)। এছাড়া হিন্দুরা বিশ্বাস করে পূণর্জন্মে যার মূলকথা হলো বর্তমান জন্মে পুণ্য করলে পরজন্মে সমাজের উচ্চ অবস্থানে জন্ম নিবে, আর পাপ করলে পরজন্মে সমাজের নিচু অবস্থানে জন্ম নিবে। এর ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কখনো ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেছে এমন নজির পাওয়া যায়না। এমন ধর্মবিশ্বাসীদের মাঝে ইসলামকে সাম্যের ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করে বাপদাদাদের হিন্দু ধর্ম বিসর্জন দেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে সকলেই এদের ধর্মতাত্ত্বিক (একেশ্বর বনাম বহু ঈশ্বর) দিকেই নজর দেয়, এদের সামাজিক কাঠামোগত পার্থক্যে নয়।
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে ইসলাম গ্রহণের তত্ত্বের অসারত্ব সবথেকে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ভৌগলিক অবস্থান লক্ষ্য করলে। বুদ্ধায়ন-ধর্মুসূত্র নামের সর্বশেষ বৈদিক গ্রন্থে পুরো ভারতবর্ষকে বর্ণের শুদ্ধতার ভিত্তিতে তিনটি আলাদা আলাদা এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে- কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে আর্যাবর্ত, যেখানে সবথেকে শুদ্ধ ও সর্বোচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য। দিল্লী এবং এর আশাপাশে গঙ্গা নদীর অববাহিকা নিয়ে এই অঞ্চল। এর চারদিকে বেষ্টন করে পরবর্তী এলাকা (অবন্তি, মগধ, সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণাপথ, সিন্ধু, প্রভৃতি), যার অন্তর্গত ছিল আজকের উত্তর ও মধ্য বিহার, গুজরাট, দক্ষিণ ভারত এবং সিন্ধু। সেখানে বাস করতো মিশ্রবর্ণের জনগোষ্ঠী, বৈদিক সভ্যতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করলেও এদের বর্ণের শুদ্ধতা কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্যাবর্তের চারদিকে অবস্থিত চক্রাকার বেল্টের বাইরের দিকে ছিল বৈদিক সভ্যতার সীমান্তবর্তী এলাকা আর সেখানকার অধিবাসীদেরকে বেদ উল্লেখ করেছে অশুদ্ধ হিসেবে। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল পাঞ্জাবের জাঠ, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সুবীর, উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্র, মধ্যবঙ্গের ভাঙ্গা, প্রভৃতি। এসব জনগোষ্ঠীকে বেদ শুধুমাত্র হিন্দু সমাজের বাইরেই মনে করেনি, বরং কোন হিন্দু এসব অঞ্চলে ভ্রমণে গেলে তার জন্য শাস্তি বিধানও করেছিল। এখন, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যদি উচ্চবর্ণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েই ইসলাম ধর্মে কনভার্ট করে থাকে, তাহলে তা’ সবথেকে বেশি হওয়ার কথা আর্যাবর্তে, তথা উত্তর ভারতে, যেখানে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা এবং প্রতাপ বেশি ছিল। উপরন্ত, সেখানে মুসলমানদের শাসন এবং প্রভাবও ছিল ব্যাপক। কিন্তু আমরা সেখানেই দেখি সবথেকে কম মুসলমান।আর বৈদিক সভ্যতার সীমানার বাইরে যেখানে হিন্দু ছিলইনা, সেসব অশুদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই দেখি সবথেকে বেশি মুসলমান। অর্থ্যাৎ, কনভার্সন তত্ত্ব যেরকম অনুমান করে, বাস্তব চিত্র তার ঠিক উল্টো।
পরের পর্বে নির্দিষ্ট করে বাংলার প্রেক্ষিতে মুসলমান হওয়ার উল্লিখিত তত্ত্বগুলোর যথার্থতা নিয়ে আলাপ করবো।
মুসলিম দের বহুবিবাহ, জন্মনিরোধ ব্যবহার না করা, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহন আর লম্বা সময় দধরে মুসলিম শাসন এই এলাকায় মুসলিম দের সংখ্যাধিক্যের মূল কারণ।
এছাড়া দেশ ভাগ এর ফলে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে গেছে আর ভারতের মুসলিমরা এদেশে এসেছে। তারপর আবার ১৯৭১ এ অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করেছে এবং স্বাধীনতা র পরেও ফিরে আসেনি। (সম্পাদিত)
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
এই অনুমানের যর্থার্থতা যাচাই করার জন্য যেসব তত্ত্ব থেকে এর উৎপত্তি সেগুলো পর্যালোচনা করলাম। এগুলো অযৌক্তিক এবং বাস্তবের সাথে অসামঞ্জ্যস্যপূর্ণ।
এই বিষয়টা পরবর্তী পর্বে আলোচনায় আসবে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
লেখার শেষাংশে খুঁজে বেড়ানো তথ্যটির তাত্ত্বিক উত্তরসূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়।
কেন্দ্র বা উচ্চবর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় নিম্ন বর্ণেরা ধর্ম ত্যাগ করে ইহকাল ও পরকাল দুইই হারাবার মতোন সিদ্ধান্তে আসতে সচেষ্ট হয়নি। হওয়া যৌক্তিকভাবে সম্ভবও ছিল না। কিন্তু সীমান্তবর্তী ও দূর অঞ্চল, যেখানে ভ্রমণেও অলিখিত বিধি-নিষেধের বেড়াজালের ইংগিত দেয়া হয়েছে সেই অঞ্চলগুলোই ছিল অবহেলিত এবং ধর্মান্তরিত হবার প্রেক্ষাপটপুষ্ট জনতার বসতিপূর্ণ।
পাশাপাশি সুফীইজমের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব এর পাশাপাশি ক্রিয়াশীল ছিল। যার নিদর্শন হলো হাজার হাজার মাজার-দরগাহ। আর তার ছাপ বর্তমান সময়ের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থানের বিন্যাসে ও সেই সাথে বিশ্বাস এবং চর্চার প্রকরণেও দৃশ্যমান আছে।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ভাইয়া,
আপনার পর্যবেক্ষণ দারুন উৎসাহব্যঞ্জক, এবং সেইসাথে লেখক হিসেবে আমার জন্য চ্যালেঞ্জিংও। কারণ, বুঝে গেছি যে, সামান্য হেলাফেলা করা যাবেনা, এমনকি একটা প্যারাগ্রাফেও 🙂
আপনার অনুমান ঠিকই আছে। পরের পর্বের আলোচনাও প্রচলিত ধারণাগুলোকে বাটিলের মধ্যেই থাকবে। এরপর বিকল্প তথ্য এবং তার উপর ভিত্তি করে যে তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সেই আলোচনা।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
চমৎকার লেখা ! পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ ভাইয়া উৎসাহিত করার জন্য।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:boss:
"গলায় ছুড়ি ধরলেই একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে বহিরাগত একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে নেয়না" - এটা ঠিক। কিন্তু কোনো কজের প্রতি এটাচমেন্ট কম থাকলে সুবিধা পেতে যে এই ভূখন্ডের মানুষ তা নিতে পারে, তার প্রমান কিন্তু আছে।
অতিতে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হবার পর যে এখানে একটা মাস কনভার্শন ঘটেছিল, তার কতটা নির্বান লাভে আর কতটা রাজ কৃপা পাওয়ার লোভে, সেই প্রশ্ন করাই যায়।
সম্প্রতি অনেককেই যুদ্ধংদেহি রূপে অবতির্ন হতে দেখলাম, সেলফোনের বায়োমেট্রিক রি-রেজিস্ট্রেশনের জন্য হাতের ছাপ না দিতে। যেদিন থেকে শোনা গেল, ওটা না করলে ৪০০০ টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে, উচ্চ-বাচ্য এখন অনেক কম।
মাস কনভার্সান একটা না ঘটে থাকলে এই ভুখন্ডে এত মুসলমান থাকার কথা না।
তবে আমার ধারনা, সেই মাস কনভার্সানটা মাল্টি-ফ্যাক্টরড। আমাদের এখানকার ফ্যাক্টরগুলা একটা অন্যটাকে কমল্পিমেন্ট করায় এখানে সেটা কাজ করেছে। অন্যত্র কোনো কোনো সিঙ্গেল ফ্যাক্টরের ইফেক্ট বেশি থাকলেও তাকে কাউন্টার করে নাল এন্ড ভয়েড করেছে নেগেটিভলি কোরিলেটেড অন্য কোনো ফ্যাক্টর। তাই সিঙ্গেল ফ্যাক্টর ধরে এগুলে লক্ষে পৌছুনো যাবে বলে মনে হয় না।
আশা করছি পরের পর্বগুলাতে অনেকগুলা ফ্যাক্টরের মিথোস্ক্রিয়া নিয়ে কিছু একটা দেখতে পাবো......
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ভাইয়া, আপনার সাথে একমত।
সেই ফ্যাক্টরগুলো কি কি এবং কিভাবে সেগুলো মাস কনভার্সন, বা সুনির্দিষ্ট করে বললে, ইসলামাইজেশন করেছে, সেই আলোচনা আসবে। তবে তার আগে আরেকটা পর্ব আছে বাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর অভ্যুদয় নিয়ে। (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে সুফিজম খাটে না।
আর গ্রামের যে গরীব মুসলিম চাষী সে নিশ্চয়ই ইরান তুরান থেকে আসে নাই।
তার মানে সে হাজার বছর ধরে এই ভূখন্ডে আছে।
যদি তাই হয় তবে সে হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিলো।
কিংবা চিন্তাভাবনা কে একটু লাগামহীম করে দিলে এটা ভাবা যেতেই পারে তখন বড় একটা অংশই ধর্ম মানতো না। যেটা মানতো সেটা লোকাচার।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
খানিকটা একমত। তবে গল্প আরও আছে। আর ইতিহাস ত আমাদের ভাবাভাবির বিষয় নয়। তবে হ্যাঁ, তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। ৩ নম্বর পর্বে গল্প আরও জমবে আশা করি 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
পড়ছি। আজকাল ব্যস্ততার কারণে জীবন তামা তামা হয়ে গেছে।
আরেকটু সময় নিয়ে দ্বিতীয় পর্বটি পড়ব।
চলুক। তোমার লেখা দিয়েই সিসিবিতে ফিরে আসা হোক আমার।
অনেকদিন, অনেকদিন কিছু বলা, লেখা হয় না।
অ-নে-ক দিন আপনাকে সিসিবি'তে দেখা যাচ্ছে না। আপনার কবিতাগুলো নিয়েই নাহয় সিসিবি'তে যাতায়াত চালু রাখেন। আমি কবিতা পড়িনা, কিন্তু অন্য অনেক কবিতা লেখন এবং পাঠক ত সিসিবিতে আছেই 🙂
আপনাকে সিসিবিতে মিস করি নূপুর ভাই।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
পড়ছি।
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
ধন্যবাদ ইশহাদ
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
প্রথম পর্ব পরে নিজেকে বোকা বোকা লাগছে।
ধাঁধার উত্তর খুঁজে না পেলে যেমন লাগে-অনেকটা সেরকম!
যাই, দ্বিতীয় পর্ব পড়া শুরু করি...
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
কেন? অনেকদিনের বিশ্বাস/সাধারনজ্ঞান নাড়া খেয়েছে বলে? 😀
সবুর করো, অনেকগুলোই ঝরে পড়বে, যদি মনটাকে খোলা রেখে এই সিরিজে আমার সাথে চলো।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx