রবিন ছেলেটাকে আমার একটুও পছন্দ হয় না। দেখলেই গায়ের মধ্যে জ্বলে ওঠে। রাগে, হিংসাই আমার মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। আর তখন পৃথিবীর সমস্ত গালিগুলি আমি তাকে একটার পর একটা বিড়বিড় করে দিতে থাকি। মনে হয়, যেন লাফ দিয়ে ওর গলাটা টিপে ধরি। অবশ্য ছেলেটির মধ্যে বেশ কয়েকটি ভালো গুন আছে। যেমন- ভদ্রতা, নম্রতা, সুরুচিবোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বেস্টফ্রেন্ড অর্ণবকে সে বস করে ফেলেছে। প্রত্যেক স্যারের মুখে তার প্রশংসা। এমনকি মেয়েরাও পর্যন্ত ওর জালে আটকেছে। রবিন ভাল ছেলে আমি মানলাম, কিন্তু ওর মধ্যে এমন কি আছে যা আমার মধ্যে নেই? ওর রোল চার, আমার দুই। আমিও সুরুচিসম্পন্ন ভদ্র-নম্র ছেলে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো যে, গতবার আমার জন্যই আমাদের স্কুল ফুটবল খেলায় জিতেছে। সামনের খেলায় আমিই হবো ক্যাপ্টেন।
রবিনের বাড়ি চট্টগ্রাম। ওর বাবা নেই। ওর মা কোন এক এনজিওতে চাকরি করে। ওর মাথা ভর্তি চুল। আমার মনে হয়, চুলতো নয় যেন কাকের বাসা। তার গায়ের রঙ আমার থেকে খারাপ, মুখটা ফুটবলের মতো। শরীরটা পাটকাঠির মত চিকন। আমাদের স্কুলের স্যার-ম্যাডাম থেকে শুরু করে আমার বন্ধুরা, ছোটরা, বড় ভাইয়া-আপুরা সবাই ওকে খুব পছন্দ করে। সেই দিনই দেখলাম স্কুলের বারান্দায় হেডস্যারের সাথে হেসে-হেসে পাথরের মতো বত্রিশ খানা দাঁত বের করে কথা বলছে। আমার বড়ভাই রকিবের মুখেও তার গুণগান। আমি বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি যে, রবিন ছেলেটি আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। একদিন স্কুলের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ কোথা থেকে ব্যাটা এসে জিঞ্জাসা করল- তোমার নাম কি?
আমি উত্তর দিলাম – অন্তু। এরপর সে আমাকে আরো কিছু বলবার আগেই আমি সেখান থেকে কেটে পড়লাম।
আজ গণিত পরীক্ষা। রাতে ঘুমাতে পারিনি। লম্বা সিলেবাস। এবার খালেদকে হারিয়ে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হবো এই আসায় আছি। আমার সিলেবাস ফুল কমপ্লিট। তিনবার সব রিভাইজ দিয়েছি। ১০০তে ইনশাল্লাহ্ ১০০ পাবো। সারা বছরের আমার অক্লান্ত পরিশ্রম আজ সফল করবার দিন। ক্লাসে নিজের সিট খুঁজতে বেশ সময় লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে সিট পেলাম। হাতে মাত্র দশটা মিনিট সময় বাকি আছে পরীক্ষা শুরু হতে। কাজেই সময় নষ্ট না করে মনোযোগ সহকারে শেষ বারের মতো রিভাইজ দিচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ ক্লাসে রবিন প্রবেশ করলো। আমার মনে হলো যে, পরীক্ষার আগে ওর মুখ দেখা ঠিক হলো না। রবিন ক্লাসে সামনে তার জায়গা খুঁজছে। আমি আবার আমার পড়াই মনোযোগী হলাম। হঠাৎ দেখি রবিন আমার সামনে বসে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমার ভিতরটা তখন জ্বলে উঠল। মনে হলো – যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। আমি তাকে মারবার জন্য হাত বাড়াবার আগেই স্যার ক্লাসে প্রবেশ করল। আমি স্যারকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলাম।
স্যার খাতা দিচ্ছেন। আমি আমরা কলম-পেন্সিল সব রেডি করলাম। এবার প্রশ্ন দেবার পালা। আমি মনে-মনে প্রভুর নাম করছি। প্রশ্ন পেলাম। তিন বার চুমু খেলাম। বুকে ঠেকালাম। এবার প্রভুর নাম নিয়ে চোখের সামনে প্রশ্নপত্র ধরলাম এবং তাতে স্পষ্ট সহকারে লেখা দেখলাম –
২য় সাময়িক পরীক্ষা
কাশেমপুর স্কুল এণ্ড কলেজ
শ্রেণীঃ দশম ; সময়ঃ ২ ঘন্টা
বিষয়ঃ বিজ্ঞান
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ইস, আমি জানতাম যে আজকে গণিত পরীক্ষা, এখন দেখি বিজ্ঞান। মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখ ফেটে জল এল। কি করবো, কি লিখবো তা কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে দশটা মিনিট পার হয়ে গেছে। আমার দ্বারা এতো বড় ভুল কি ভাবে হলো? এমন সময় হঠাৎ সামনে থেকে রবিন বলল, “আমারটা দেখ”। আমি অবাক হলাম। আমার মনের কথা ও কিভাবে বুঝল জানি না। তবে ওর প্রস্তাবটা বেশ ভালো। তাই বেশি না ভেবে শুরু করলাম।
সব পরীক্ষা শেষ। আজ রেজাল্ট দিয়েছে। আমি ১০ম হয়েছি। রবিন ৩য় হয়েছে। রবিনের প্রতি আমার একটু কৌতুহল জেগেছে। একদিন ক্লাসের বেঞ্চে রবিনকে একা বসে থাকতে দেখলাম। সেদিন তখনও সবাই ক্লাসে এসে পৌঁছেইনি। এই প্রথমবারের মতো রবিনের সাথে মন থেকে কথা বলবার ইচ্ছা করল। আমি ওর কাছে যেয়ে বসলাম। বললাম –
– সেদিনের সাহায্যের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
– ঠিক আছে। ওটা আমার কর্তব্য ছিলো।
– হি! হি! তা তোমার ভালো নাম কি?
– রবিন আহমেদ।
– তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। আমার সাথে বন্ধুত্ব পাতাবে?
– অবশ্যই।
এমন সময় ক্লাস শুরু হবার বেল পড়লো। স্যার ক্লাসে চলে এসেছেন। আমি মনে মনে হাসলাম। সব রাগ-হিংসা এতো সহজেই ভুলে গেলাম, বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি রবিন ছেলেটি অন্যদের থেকে একটু আলাদা।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। অর্ণবের সাথে সাথে রবিনও আমার বেস্টফ্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। শুধু স্কুলের সময় নয়, দিনের পুরো সময়টায় আমরা তিনজন একসাথে কাটাই। আমরা তিনজনে এমন কোনো কাজ নেই যা পারি না, আবার এমন কোনো কাজ নাই যা করি না। স্কুলের স্যার-ম্যাডাম থেকে শুরু করে বড়-ছোট সবাই জানে আমরা তিনজন একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড। সবাই আমাদেরকে থ্রী-ডায়মন্ড নামে চেনে। সামনে ফুটবল ম্যাচ। তাই কড়া প্রাক্টিস চলছে। আমি ক্যাপ্টেন হয়েছি। রবিন ভালো খেলে। ওকে তাই সহ-ক্যাপ্টেন বানিয়েছি। অর্ণব আমাদের দলের গোলকিপার।
আজ খেলা। রোদ্রময় দুপুর। মেঘমুক্ত নীল আকাশ। আমাদের স্কুলের জন্য আজকের দিনটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। মাঠ ভর্তি দর্শক। আমাদের অভিভাবকরাও এসেছেন। রবিনের মাও এসেছেন। আমি উনাকে এই প্রথম দেখলাম। উনি সাদা বোরখা পরে এসেছেন। আমার বড়ভাই তার বন্ধুদের নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন। আমরা যদি জিতি তবে হাজারপতি না হতে পারলেও অন্তত একেক জন শতপতি হতে পারব। আর যদি হারি তবে হয়তো আর বাড়ি যাওয়া হবে না। এখানেই আমাদের পুতে ফেলবে। আমাদের হেডস্যার আমাদেরকে সাহস দেবার জন্য পানির বোতল হাতে নিয়ে জোরে-জোরে চিল্লাচ্ছেন। সবার মনে টান-টান উত্তেজনা চলছে। আমাদের প্রতিপক্ষ দল আদর্শ স্কুল এণ্ড কলেজ।
খেলা শুরু হলো। দাউ-দাউ করে জ্বলন্ত রোদের মধ্যে আমরা গুলির মতো সাই-সাই করে খেলছি। পাশ থেকে আমাদের মনোবল বাড়াবার জন্য গলা ফাটানো আওয়াজের কোনো অভাব নাই। আমার একটা কিক ওদের বারে লেগে ফিরে এসেছে। ওরাও কম নই। অর্ণব বাঘের মতো লাফ দিয়ে একের পর এক বল ঠেকাচ্ছে। রেফারির বাঁশি ঘন-ঘন পড়ছে। হলুদ কার্ড পাওয়া খেলোয়ারে মাঠ ভরে গেছে। কিন্তু খেলার শেষ পর্যন্ত কোনো দলই বল গোলবক্সে ঢুকাতে পারলো না। শেষমেশ রেফারি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ট্রাইবেকার হবে।
আমরা সবাই মাঠের এক পাশে বসে ঠিক করছি যে কে কে ট্রাইবেকারে শর্ট নেবে। এমন সময় রবিন আমাকে সবার সামনে বলে উঠল, “আমি গোলকিপার থাকবো”। সবাই চুপ । যে ছেলে আজ পর্যন্ত কোনদিন গোলকিপিং প্রাক্টিস করেনি সে কিভাবে এমন কথা বলতে পারে। আমি বললাম, “রবিন তুই কি নিশ্চিত, যে তুই ওদের বল ঠেকাতে পারবি”?
রবিন বললো, “পারবো”।
রবিনের জেদ দেখে আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম। সবাই নিষেধ করলো, রবিনকে গোলকিপার বানাতে। কিন্তু রবিনের কথায় দৃঢ়তা ছিল। তাই আমি অর্ণবকে অনেক বুঝিয়ে গোলকিপার থেকে সরিয়ে, রবিনকে গোলকিপার বানালাম। দল যদি হারে তবে এর জন্য আমি একা সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকবো।
প্রত্যেক দল পাঁচটি করে গোলকিক করবে। প্রথমে আমাদের পালা। চারটি করে কিক করার পর ওদের তিন গোল, আমাদেরও তিন গোল। বারে লাগার জন্য ওদের একটি গোল কম হয়েছে। আর আমাদের একটি কিক ওদের গোলকিপার ঠেকিয়েছে। আমাদের দলের শেষ কিকটি আমার। বল রেখে বলের পিছনে পজিশন নিলাম। কিক করলাম। ভাগ্যক্রমে গোলবারের পাশঘেষে গোল হলো। প্রতিপক্ষের ক্যাপ্টেন এই মাঠের বেষ্টপ্লেয়ার। গুলির মত তার কিক করার গতি। কাজেই এবার বল ধরাটা অত্যন্ত কঠিন হবে রবিনের জন্য। রবিন প্রস্তুত। আমি গোলবারের পাশে যেয়ে দাড়ালাম। ওদের ক্যাপ্টেন বল রেখে পজিশন নিচ্ছে। মাঠের সবাই চুপ। বল কিক করলো। গুলির বেগে বল আসছে। হঠাৎ আমার ঝলক লাগলো। দেখলাম রবিনের ছায়া নেই। রবিন অদ্ভূত ভাবে লাফ মেরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলটা ধরে ফেললো। সবাই খুশিতে ফেটে পড়ল। চার-তিন গোলে আমরা জিতলাম। ফুটবল কাপ পেলাম।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। রবিনের সাথে মাঝে আর দেখা হয়নি। আমার মনের মধ্যে রবিনের ব্যাপারটা বারবার পাক খাচ্ছে। স্কুলে যেয়ে রবিনকে দেখলাম অর্ণবের সাথে কথা বলতে। আমাকে দেখে রবিন অর্ণবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। বলল –
– তুমি কি বলতে চাও, তা আমি জানি।
আমি অবাক হলাম। বললাম –
– ও, তাহলে তুমি সত্যি মনের কথা বুঝতে পারো তাই না?
– হ্যাঁ। আমি পারি।
– তোমার ছায়া ছিলো না কেন সে সময়?
– আমি জানতাম তুমি আমাকে এই প্রশ্নটি করবে।
– তুমি আসলে কে?
– আমি চাই না তুমি তা জানো। আমি কে তা তুমি জানবার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাব।
আমি চোখে অশ্রু নিয়ে বললাম,
– না, তুমি যাবে না। তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারো না। আমার প্রয়োজন নেই, তুমি কে তা জানবার।
– আমাকে যে যেতেই হবে বন্ধু। তা না হলে এই আমিই যে একদিন তোমার মৃত্যুর কারণ হবো। আর আমি তা কখনই চাই না। আমার সময় এই জায়গাতেই শেষ। খোদা হাফেজ।
এই কথা বলে রবিন পিছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করল। আমি পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
আজ নতুন বছর শুরু হলো। সবাই ক্লাসে হৈ চৈ করছে। আমি ক্লাসের এক কোণায় চুপ করে বসে আছি। রবিন আর নেই। সে আর কোনো দিনই ফিরে আসবে না। ভাবলেই চোখে জল আসে। সত্যি সে আজব ছিল। আমাকে হঠাৎ ঝলক দিয়ে চলে গেল। আর এটাই বোধ হয় ওদের নিয়ম, যে ওদের সত্য পরিচয় যে টেরপায় তাকে ওরা মেরে ফেলে। কিন্তু রবিন আমার প্রকৃত বন্ধু ছিল। যার কারণে সে নিজেকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। আচ্ছা, ওর খোঁজ করা যাবে না, এমনটি তো নয়। সে কি তাহলে মানুষ ছিল না? ………………………
(ধারাবাহিক)
-সমাপ্ত-
হঠাৎ ঝলক আবার
সত্যি, বন্ধু হারাবার ব্যথা আমি জানি। কারণ আমি আমার এক অতিপ্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি। স্কুলে গেলেই তার স্মৃতিগুলো আমাকে নাড়াদিয়ে ওঠে। তার কথা ভেবে চোখে পানি চলে আসে। সত্যি, সে আমার হৃদয়ে একটা বড়স্থান করে নিয়েছে। তাকে এই পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন কাজ। কে বা পারবে তাকে খুঁজে বার করতে? সে যে এক অসাধারণ মানুষ।
আমি যার কথা বলছি তার নাম রবিন। তার বাবার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। তার মা একটি এনজিওতে চাকরী করতো। পৃথিবীতে তার আর কোন আপনজন নেই। এই সব তথ্যই আমি জেনেছি তার সম্বন্ধে। তার মার সাথে আমার কোনদিন সামনা-সামনি দেখাও হয়নি। তাহলে, তাকে কোথায় বা পাব ?
একদিন আমি আর আমার বন্ধু অর্ণব দুজন মিলে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর বাড়ির ঠিকানার তালিকা থেকে রবিনের ঠিকানা খুঁজে বার করলাম। ঠিকানাটা বেশ অদ্ভুত ধরনের ছিল। ঠিক এই রকম-
কাজি রবিন আহমেদ
মাতা- বিলকিস আহমেদ
রোড় নং-১৭; বাড়ি-৯/২
পুকুর এলাকা-৩, বটতলা।
আমরা ঠিকানা অনুযায়ী একদিন সময় করে বটতলাতে গেলাম। সিএনজি থেকে নামলাম একটা বড়বাগানের সামনে। “পুকুর এলাকা-৩” খুঁজতে বেশি সময় লাগলো না। তবে জায়গাটা খুঁজে পাবার পর আমরা বেশ অবাক হলাম। কারণ জায়গাটার অবস্থা দেখে। বিশাল বড় একটা মাঠ, ঘর-বাড়ি অনেক কম। সেখানে একটা অনেক বড় পুকুর। তার পাশে বড়-বড় ছয়টা বটগাছ। সেগুলোর বয়স আনুমানিক একশোরও বেশি হবে। সেখানে মানুষজন খুব কম। দূরে কয়েকটি বাড়ি দেখে আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এবার “রোড় নম্বর-১৭” খোঁজার পালা। খুঁজতে বেশি সময় লাগলো না। কারণ, আমরা ১৭ নম্বর রোড়েই হাঁটছিলাম। সাইনবোর্ডে দেখলাম। এরপর ‘৯-নম্বর বাড়ি। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম রাস্তার শেষ প্রান্তে। বাড়িটা তিনতলা। এর দুইতলায় রবিনরা থাকে। বাড়িটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বড় একটা গেট কিন্তু, গেটে কোন দারোয়ান নেই। আমরা গেট ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে কোন মানুষের দেখা পেলাম না। বাড়ির সামনে ছোট একটা ফোঁয়ারা। ফোঁয়ারাতে পানি ঝরছে।
আমরা এবার বাড়ির সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে লাগলাম। দুইতলায় পৌঁছে দুটি দরজার মুখোমুখি হলাম। কোনটি ওদের বাসা হবে তা বোঝা কঠিন। প্রথমে আমরা বাম দিকের দরজার কড়া নাড়ালাম। দুই থেকে তিনবার কড়া নাড়াবার পর একজন রাগিগোছের মহিলা দরজা খুলে আমাদের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন –
– তোরা কে? এখানে কি চাস?
– আমি অন্তু আর ও অর্ণব। এটা কি রবিনদের বাসা?
– না। এটা রবিনদের বাসা না।
– আপনি কি রবিনকে চেনেন?
– তোরা এই ঠিকানা কোথায় পেলি?
– জ্বি, মানে রবিন আমাদের সাথে পড়তো। সে স্কুলে যায়না আজ অনেক দিন হলো। এই জন্য স্কুল থেকে তার ঠিকানা নিয়ে আমরা তারসাথে দেখা করতে এসেছি।
– তাকে তোরা কোন দিনও পাবিনা। এবার এখান থেকে তোরা চলে যা।
এরপর আরকিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমরা বুঝলাম, তিনি রবিনদের পরিবারের সকলকেই ভালোভাবে চিনতেন।
এতদূর থেকে এতকষ্ট করে এসে রবিনের সাথে দেখা না করে তো আর যাওয়া যায়না। অন্তত তার বর্তমান ঠিকানাটা তো আমাদের জানা দরকার। তাই আমরা দুই মিনিট পর আবার সেই দরজার কড়া নাড়ালাম। বেশখানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দরজা খুললনা, তখন আমরা দরজাই জোরে ধাক্কা দিলাম। দরজা এমনিতেই খুলে গেল। আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। দেখলাম, ঘরে আর কোন দরজা নেই, আর সেই মহিলা উধাও। শুধু একটা জানালা আছে। জানালা দিয়ে খুব আলো আসছে। জানালার পাশে একটা ঘুনধরা রিড়িংটেবিল। লাইট, ফ্যান কিংবা অন্য কোন আসবাবপত্র ঘরে নেই। আমরা ভয়ে একে অন্যের হাত ধরলাম। মনে সাহস আনলাম। এরপর জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে বটগাছ গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
এরপর হঠাৎ আমার চোখ পড়লো টেবিলের একটা ড্রোয়ারের উপর। ড্রোয়ার খুলে আমি অবাক হলাম। রবিনকে উপহার দেওয়া আমার সেই জ্যামিতি বক্সটা। যাতে প্রতিটি জিনিস এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। আরও কিছু কাগজ দেখলাম ড্রোয়ারে। সবই সাদা কাগজ ছিল। কিন্তু তারমধ্যে একটা কাগজে লাল কালিতে লেখা – “দুঃখিত অন্তু। আমি তোর মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে চাই না”।
অর্ণব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আমি গোপনে কাগজটা ভাজ করে প্যান্টের পকেটে ঢুকালাম।
আমি অর্ণব কে বললাম – অর্ণব, আমার মনে হয় আমাদের এখানে আর বেশীক্ষণ থাকাটা উচিত হবে না। অর্ণব বলল- চল, তাড়াতাড়ি চলে যাই। এরপর আমরা ঘর থেকে দ্রূত বের হয়ে আসলাম। বাড়িটা থেকে বের হয়ে খুব জোরে হেঁটে আমরা বটগাছ গুলোর নিচে এসে দাড়ালাম। গাছগুলোর দিকে দুজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। দুজনেই নির্বাক। চারিদিকে শান্ত পরিবেশ। এমন সময় হটাৎ চমকে উঠলাম। মনে হলো পেছন থেকে কেউ কর্কশ গলায় ডাক দিল, “অন্তু”।
সজোরে পিছনে ফিরলাম। দেখলাম একটা আলোর গোলা খুব দ্রুতগতিতে চোখের পলকে বটগাছ গুলোর উপর দিয়ে উড়তে উড়তে সেই বাড়ির দিকে যেয়ে জানালাটাকে উজ্জ্বল করে তুলল। এরপর ধীরে ধীরে আলোটা নিভে গেল।
আজ অনেক দিন হয়ে গেল। তারপর থেকে আমরা আর রবিনের কোন খোঁজ করিনি। আমি আর অর্ণব ঘটনাটিকে নিজেদের মধ্যেই রেখেছি। কাউকে বললে আমাদের ক্ষতি হতে পারে, এই কথা ভেবে কাউকে বলিনি। রবিন আমাদের খুব ভালো বন্ধু ছিল। একসময় স্কুলের স্যার-ম্যাডাম থেকে শুরু করে ছোট-বড় সবাই জানতো যে, আমরা তিনজন একেঅপরের বেস্টফ্রেন্ড। শুধু স্কুলের সময় নয়, দিনের পুরোটা সময়ই আমরা তিনজন একসাথে কাটাতাম। সবাই আমাদেরকে থ্রী-ডায়মন্ড নামে চিনতো।
রবিন আমার খুব ভাল বন্ধু হবার কারণে, তার একটা গোপনীয় ব্যাপার “তার পরিচয়” আমি একদিন হঠাৎ জেনে ফেলি। আর এটাই বোধ হয় ওদের নিয়ম, যে ওদের সত্য পরিচয় যে টেরপায় তাকে ওরা মেরে ফেলে। কিন্তু বরিন আমার প্রকৃত বন্ধু ছিল। যার কারণে সে নিজেকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। অবশ্য অর্ণব এব্যাপারে আগে কিছুই জানতো না। এইবার রবিনদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর তাকে সবকিছু জানাতে হয়েছে। নির্দ্বিধায় অর্ণব একজন সাহসী ছেলে বলা চলে।
তবে সেই কাগজটা আমার কাছেই আছে। সাদা কাগজে লাল কালির লেখাগুলি বেশ অদ্ভুত। দেখলে মনে হয় এর মাঝে আরও অনেক অর্থ লুকিয়ে আছে। যা আমাকে আরও অবাক করে তোলে। মনের ভেতরে রবিনকে নিয়ে জাগে নানান কৌতুহল। আসলেই সে আজব ছিল। আমাকে আরও একবার হঠাৎ ঝলক দিয়ে চলে গেল।
তবে জীবনে শেষবারের মত হলেও রবিনের সাথে আমার দেখা করবার ইচ্ছে আছে। দেখি, ভবিষৎতে তার দেখা মেলে কিনা। আমি সব চেষ্টাই করব তার সাথে দেখা করবার জন্য। তবে তার আগে আমার কিছু কাজ আছে। যেমন………বাবার তাবীজ…
(ধারাবাহিক)
-সমাপ্ত-
:clap: ভালো লাগলো।শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ গল্পটি পড়বার জন্য। 🙂
আশা করি ঐ অপেক্ষার সময় দ্রুত শেষ হবে।
ভালো থেকো।
ভালো থাকা অনেক সহজ।
ভাল হইসে
অনেক অনেক ধন্যবাদ সায়েম সিয়াম। :hatsoff:
ভালো থাকা অনেক সহজ।
বেশ ভালো লেগেছে।
ভুতের গল্প লেখা সহজ কাজ না। চলুক।
🙂
ধন্যবাদ ভাই। আপনার মন্তব্য পেয়ে অনেক ভালো লাগলো।
আশা করি আমি আপনার কথা রাখতে পারবো।
ভালো থাকা অনেক সহজ।
ভাল লাগলো। ভূতের গল্প লেখা কঠিন কাজ। সবাই পারে না। ভূত কীভাবে গল্পে আসবে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা এবার।
🙂
তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ, রেজা।
ভালো লাগলো।
ভালো থেকো।
ভালো থাকা অনেক সহজ।