যখন কোন মানুষের জীবনের ইচ্ছাটাই একটা অ্যাডভেঞ্চারের নায়ক হবার, তখন সে মানুষকে কি আর কেউ আটকাতে পারে? নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারের বুদ্ধি তার মাথায় নাড়া দিয়ে উঠতো। আর বুদ্ধিগুলোও ছিল অনেক আজব, অনেক রোমাঞ্চকর। বলা চলে, “যা আগে কেউ কোনো দিন ভাবেনি”। সে যা করতো আর যেভাবে করতো, তা অবশ্য ম্যাকগাইভারি বুদ্ধিই বলা চলে। অনেকটা সিনেমাতে যে ভাবে দেখা যায়, ঠিক সে রকম। আর তার সময় পরিমাপের ধরনটাও ছিল অসাধারণ। আমাদের এই আবাসিক ছাত্রাবাসটি ক্যাডেট কলেজের একটি হাউস। পালানোটা অবশ্য মোটেও কোনো সহজ বিষয় ছিল না। তাও ভালো যে সে ধরা পড়েনি। ধরা পড়লে তার জীবনটা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠতো। সে বলতো, “জীবনে যাই করো আর তাই করো না কেন, ধরা পড়ো না। ধরা পড়লেই সব শেষ”।
যাই হোক, সে পালিয়েছিল। আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানতাম। তার কিছু আমানত ছিল যা কিনা কাউকে না কাউকে বহন করতে হতো। আর সেই আমানতটি সে আমাকেই বহন করতে দিয়েছিল। আমি ছিলাম তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। আমি যে কেন তার এই বিশ্বস্ত ব্যক্তি হলাম তার কারণটা যখন আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তখন সে আমাকে বলেছিল যে, আমি তার অনেক ভালো বন্ধু। অবশ্য তারপর আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে তার আরও অনেক ভালো বন্ধু আছে। তাদের কাছে জিনিসগুলো রাখাটা অবশ্য আরও উত্তম হবে। তখন সে আমাকে বলেছিলো যে, তুই আমার কাছে এসব জিনিসপত্র রাখবার জন্য সবচেয়ে ভালো। আমি তার সেই সবচেয়ে ভালো হবার কারণটা যখন জানতে চেয়েছিলাম, তখন সে আমাকে বলেছিল যে, আমি যে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি, তাই আমি সবচেয়ে ভালো। আমি একথা আর এ ধরনের বিবেচনা দেখে, অবাক না হয়ে অবশ্য থাকতে পেরেছিলাম না। আর তার এতো চৌকশ বিবেচনা অবশ্যই প্রশংসা করবার মতো ছিল।
অবশ্য আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তার সেই নিখুঁত পরিকল্পনা। সে আমাকে তার পালিয়ে যাবার ব্যাপারটি সম্পর্কে হাল্কা আভাস দিয়েছিলো। আর তার কোনো অংশই আসলে মিথ্যে ছিল না। তাতে যা ছিল তা কেবল একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা মাত্র। ব্যাপারটা যেন অনেকটা এরকম যে, হাত দিয়ে সরাসরি ভাত মুখে না দিয়ে সেটি মাথার পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়া। আমার কাছে কেবল কিছু সময়ের ব্যাপার ছিল। কিছু সময় পরে আমার চোখের সামনে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠতো। এই আর কি। আর তখন আমি বেশ কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে যেতাম। মনে মনে ভাবতাম, কীভাবে যে, সে এসব করে।
অবশ্য, সে আমাদের কলেজ থেকে যে-বার সত্যি পালিয়েছিলো, তার আগেও সে আরও কয়েকবার সেই পালিয়ে যাবার জন্য বের হয়েছিলো। মানে, পালাবার বিষয়টা তার কাছে ছিল নিতান্তই একটি ছেলেখেলা। পালাবার পথ, পালাবার কৌশল আর পদচারনা সবটাই ছিল তার নখদর্পণে। আর সে বলতো যে, পালিয়ে যেয়ে মাঝপথে তার নাকি মনে হয়েছে যে, সে কিছু একটা মূল্যবান জিনিস ফেলে এসেছে। তাই সে এইবারের বার না পালিয়ে আবার ফিরে এসেছে। আমি অবশ্য একবার না বহুবার তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে সেই জিনিসটা কী। তবে সে আমাকে একবারের জন্যও তা বলেনি। আর যখন আমি তাকে সেটি বলবার জন্য জোর করে ছিলাম তখন অবশ্য সে আমার সামনে অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চা মানুষের মতো কেঁদেছিল। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম তার সেই কান্না। তার সেই চোখের পানি। আর উপলব্ধি করেছিলাম তার সেই বেদনার গাঢ়ত্ব। আমার অন্তরও তার সাথে কেঁদেছিল। আমি তাকে পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। তবে আমি বিষয়টি জেনেছিলাম। অনেকদিন পর। যখন কিনা আমাকে তার সেই আমানতের প্যাকেটটা খুলতে হয়েছিল। আর আমি তখন বোকার মতো করে কেঁদেছিলাম। নিজেকে অসহায় ভেবেছিলাম। আমার চোখের আর নাকের পানি এক সাথে মিশেছিলো। প্যাকেটের ভেতরের সেই মূল্যবান জিনিসটা আমার কাছে আজও আছে।
সে ছুটিতে বাড়ি যেতে চাইতো না। আর বাড়ি থেকে এসে আমরা সবাই যখন মনমরা হয়ে থাকতাম, তখন তার চোখে-মুখে আনন্দের রেখা দেখে ভালো লাগতো। সে বলতো যে, আমাদের হাউস যদি খোলা থাকতো, তবে সে আর বাড়ি যেতো না। তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে সে কথার প্যাঁচ দিয়ে এড়িয়ে যেতো। আমরা সেটি ধরতে পারতাম না। কিন্তু শেষবার যখন সে পালিয়ে যেয়ে আর ফিরে এলো না, তার আগে সে যে কদিন আমার সাথে ছিল, আমি তার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছিলাম। আমি বুঝেছিলাম যে সে এবার কোনো এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সে যেসব কথা আমাকে বলতো, যেসব কথা আমাকে সে জিজ্ঞেস করতো, তার সবগুলোই ছিল প্রেমের কোনো উপন্যাসের প্রেমে পাগল কোনো নায়কের কথা। যে নায়ক কিনা তার নায়িকার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমার অবশ্য এ কথাগুলো তখন অনুধাবন করবার ক্ষমতা ছিল না। আমি শুধু হা করে শুনতাম আর ভাবতাম যে, এমনও সুন্দর হয় জীবনটা। আর পরবর্তী জীবনে আমি যখন প্রেমে পড়লাম তখন আমি দেখলাম যে, আমি এই প্রেমের অনুভূতিগুলো সবই জানি। অনুভূতিগুলো আমার মধ্যে আগেও কাজ করেছে।
খাবার টেবিলে খেতে খেতে হঠাৎ একটু থেমে গিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দেয়া। গোসল করতে করতে হঠাৎ করে একটা গানের কলি গেয়ে ওঠা। পথে কথা বলতে-বলতে হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাওয়া। আর প্রতি রাতে আমার কাছে জানতে চাওয়া যে, কখনও কি তোর কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়েছে, কখনও কি খোলাচুল ওয়ালা মেয়ে, কখনও কি চোখে কাজল দিয়ে সাজা মেয়ে, কখনও কি গালে তিল আছে যা কিনা হাসলে সেই গালের টোলের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়, এমন মেয়ে দেখেছিস। আমি হা করে শুনতাম আর লজ্জা পেতাম। সে আরও বলতো, তুই কি কখনও কোনো মেয়ের খোঁপার কাঁটা টেনে খোঁপা খুলেছিস, কখনও কি বই দিতে গিয়ে হাতে হাত লাগার অসাধারণ অনুভূতি অনুভব করেছিস, কখনও কি আইসক্রিম খেতে গিয়ে ইচ্ছে করে ঠেলা দিয়ে সেই আইসক্রিম তার গালে লাগিয়ে সে তিলটাকে রুমাল দিয়ে বার বার মুছতে দেখেছিস। আমি শুধু শুনতাম আর হাসতাম। কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।
যাই হোক, সে শেষবারের মতো যখন পালিয়েছিল, তখন সে অনেক খুশি ছিল। মনে তার সেই ভালোবাসার জোয়ার ছিল। সে ভালোবাসার জন্য পালিয়েছিল। একটা সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ের ভালোবাসায় পড়ে, পাগলের মতো সেই মেয়ের হাত ধরবার জন্যই সে আমাদের কলেজ থেকে পালিয়েছিলো। তার বর্তমান-ভবিষ্যৎ, তার পরিবেশ, তার সমাজ, তার বন্ধু, তার পরিবার সবকিছুকে সে তুচ্ছ করে, তার বুড়ো আঙুলটা দেখিয়ে সে তার মনের আনন্দে এক জোছনায় পালিয়েছিলো। তাকে আমি সেদিন সন্ধ্যায় খুব আনন্দিত দেখেছিলাম। বাথরুমে সে ঝরণার নিচে গোসল করে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলো আমার সামনে। গানের কথা আমার আজো মনে আছে। সে এক প্রেমের গান, সে এক প্রেমের কবিতা –
সুন্দর গোলগাল নিষ্পাপ চেহারা,
মনটা সত্য নরম পেয়ারা,
কন্ঠে যেন তার স্বর্গের সেতারা
আমি তাকে দেখে হলাম দিলহারা।
আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম সে গান। বলেছিলাম, বন্ধু এতো খুশি যে। আবার তোর তাকে মানে পড়লো নাকি রে। সে বলেছিলো, আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম ও। আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম। বলতে বলতে সে রুমের দিকে চলে গেল।
আমি যদি তখন সে আনন্দের কথা, সে মনের ভেতরে ভালোবাসার ঢেউয়ের ধ্বনি আভাস বুঝতে পারতাম তবে হয়তো তাকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তাম না। আমি জানতাম যে সে পালিয়ে যেয়ে আবার ফিরে আসে, আমি জানতাম যে সে আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আমি জানতাম যে সে ফিরে আসবে তার সেই মূল্যবান জিনিসটার ভালোবাসার টানে। কিন্তু সে এইবার আমার বালিশের তলায় একটা কাগজ ফেলে চলে গেল। তাতে লেখা ছিল, “পাশা খেলতে যাচ্ছি রে বেডা। ভালোবাসার স্বপ্ন দেখ্। আর আমানতের খিয়ানতের হুকুম দেয়া হইলো”। আমি ঘুম থেকে উঠে কাগজটা পড়ে তার বিছানায় তাকে খুঁজতে যাই। ভাবি যে, সে ফিরে এসেছে। টয়লেটে খুঁজি, কমনরুমে খুঁজি, পাশের রুমে, তার পাশের রুমে, তার পাশের রুমে, তার পাশের রুমে, তার পাশে……
আমি মাঠের ভেতরে দৌড়ে এসেছি।
শব্দ করে কেঁদে উঠেছি।
কেউ নেই চারিদিকে।
একেলা আমি এই বেশে।
দূরে এক মালী রাস্তা ঝাড়ু দিতে থাকে।
লাল একখানা চোখ নিয়ে আমি রুমে ফিরে এলাম। আমি ক্লান্ত। হঠাৎ আমার মনে পড়লো, একটা প্যাকেটে করে সে কিছু জিনিস আমার কাছে রেখে গেছে। তার সেই আমানত। আমাকে দেখার অনুমতি দিয়ে গেছে সে। আমি আমার ড্রয়ারের ভেতর থেকে খুব দ্রুত সেই প্যাকেটটি বার করলাম। তাতে তার সেই মূল্যবান জিনিসটি ছিল, যার জন্য সে বার বার ফিরে আসতো। আমি প্যাকেটটা খুললাম। তার ভেতরে অনেক চিঠি ছিল। সবগুলোই ওর মায়ের লেখা চিঠি। সব চিঠির শুরুটা ছিল “আমার বাবু” দিয়ে, আর শেষ ছিলো “তোমার মা মনি” দিয়ে। মাঝে ছিল কিছু আশা, কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু ভালোবাসা, আর কিছু মমতাভরা কথা। তবে যে চিঠিটার তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছিছিলো যে এটি সবার শেষে এসেছে, সে চিঠিটা ছিল তার বাবার লেখা। তাতে তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদের কথা ছিল। আরও ছিল তার নতুন মায়ের অনেক ভালভাল গুণের কথা।
আপনমায়ের ভালোবাসা হারানো সেই ছেলে, আমাদের মাঝে এসে ভালোবাসা না পেয়ে, ভালোবাসার খোঁজে বার বার এক অজানার পথে পাড়ি জমাচ্ছিল। কিন্তু তার মায়ের সেই ভালোবাসার চিঠি তাকে বার বার পিছনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। সেই ভালোবাসা সন্ধানী ছেলের জীবনে হঠাৎ একদিন অন্য এক নারীর ভালোবাসার ছোঁয়া লাগে। আর তখন সে সেই ভালোবাসার জন্য পাগল হয়ে তার জীবনের পড়ালেখার মাঝ দরিয়ায় অন্য পথে পাড়ি জমাই। বেঁচে থাকুক তার সেই ভালোবাসা। ভরে উঠুক তার জীবনের সব আশা।
-সমাপ্ত-
খুব পছন্দ হলো লেখাটা।
মার্কেজের ছাপ দেখলাম।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। :hatsoff:
ভালো থাকা অনেক সহজ।
সাংঘাতিক লিখেছো! দারুণ সুন্দর এবং টানটান গল্পটা। গল্প বলার ধরণটা খুব ভাল লাগলো।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ... ভাই । 🙂
ভালো থাকা অনেক সহজ।
অসাধারন লাগলো .. :clap:
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। :guitar:
ভালো থাকা অনেক সহজ।
:clap: ভাল লিখেছো
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। :hatsoff:
ভালো থাকা অনেক সহজ।
লেখার গতিটা বেশ চমৎকার হয়েছে! বলার ধরনটি অপ্রশংসনীয়।। লেখতে থাকো। শুভ কামনা রইলো।।
অনেক ধন্যবাদ ভাই
ভালো থাকা অনেক সহজ।