বাংলা বিতর্ক, ক্যাডেট রায়হান এবং কিছু বিরক্তিকর প্যাচাল

কলেজে ক্লাস এইটে থাকার সময়কার একটা কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ভলিবল কম্পিটিশনের শেষ দিন। গেমস টাইমের ব্রেক অফের পর হাউসে ফিরে যাচ্ছি। তখন হঠাৎ করে এই বিশাল কলেজে আমার নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। হাউস ভেস্ট পড়ে থাকা নিজের ক্লাসের কয়েকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ঘরে ফেরা কয়েকজন বীর সৈনিক। আহারে একবছর হয়ে গেল আমি এখনো কিছুই করতে পারলাম না। কি প্রচন্ড হীনমন্যাতা যে আমাকে গ্রাস করেছিল তা বলে বুঝানো যাবেনা। কলেজে আসার আগে আমার একমাত্র কো-কারিকুলার এক্টিভিটি ছিল- আমি আগের স্কুলে মাঝে মাঝে বিতর্ক করতাম। খুব সিরিয়াস কিছু না। একজন স্যার ছিলেন উনি মাঝে মাঝে ক্লাসের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন; এই টাইপ বিতর্ক।

যাইহোক, ক্লাস এইটে পাওয়া প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতাটাকে আমি লুফে নিলাম যুদ্ধে সৈনিক হবার জন্য, নিজেকে যোগ্য প্রমানের জন্য। প্রায় এক মাস আগে থেকে স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করে দিলাম। বিষয় ছিল “আমাদের চেয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা বেশি সুখি ছিলেন”। আমি বিষয়ে পক্ষে। সারাদিন খালি বিতর্ক নিয়ে চিন্তা করতাম। স্ক্রিপ্ট লিখতাম আর কাটতাম। এভাবে দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো এক মাস।

এসে গেলো আমার জীবনের প্রথম স্টেজ কম্পিটিশন। স্টেজে বসলাম। আমি ছিলাম ৫ম বক্তা। অন্য কারও কথা মাথায় ঢুকছেনা। ঢুকার দরকারও তেমন নাই। কারণ জুনিয়ার গ্রুপে যুক্তি খন্ডনের কোন বালাই নেই। খালি নিজেরটা ঠিক মতো বলে আসতে পারলেই চলে। আমার পালা চলে আসলো দেখতে দেখতে। আদনান ভাই (তখনকার কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট) বলে দিয়েছিলেন, স্টেজে উঠে নার্ভাস না হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্দিষ্ট কারও মুখের দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। বক্তব্য শুরু করলাম। আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবাণীতে কোন কিছু ভুল না করে কিভাবে কিভাবে যেন শেষও করে ফেললাম। জুনিয়ার গ্রুপের পর সিনিয়ার গ্রুপ। আমি নিচে নেমে সবার সাথে বসলাম। ক্লাসমেটরা সবাই খুব প্রশংসা করলো। হটাৎ করে নিজেকে খুব ভস ভস মনে হচ্ছিল। এরপর ফলাফল ঘোষণা। আমি জুনিয়ার গ্রুপে সেকেন্ড। উফ! কি যে ভালো লাগার একটা অনুভূতি, বলে বোঝানো যাবেনা। আমার কলেজ জীবনের প্রথম স্মরনীয় দিন ছিল সেটা।

আমাদের হাউসমাষ্টার তখন ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান ওরফে টাল বাবা (পরবর্তিতে আমার অসংখ্য টিজ নামের একটা হয়ে যায় টাল)। আমার চেহারার কারণেই হোক অথবা অন্য কোন কারনেই হোক উনি আমাকে একদমি দেখতে পারতেন না। বিতর্কে প্রথম হবার পর থেকে তার কাছে আমার দাম বেড়ে গেলো। ততদিনে জুনিয়ার আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আমি রুমলিডারশীপ পেলাম। শুধু তাইনা, সব রুমে দুইজন হলেও একটা রুমে থাকবে তিনজন জুনিয়ার। টালবাবা আমাকে সেই রুমের দায়িত্ব দিলেন। জুনিয়ার আসার কয়েক মাস পরে অবশ্য উনি নিজেই কোন কারণ দর্শানো ছাড়া আমার রুম লিডারশীপ সিজ করে ক্লাসমেটদের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আরেক ইতিহাস।

এভাবে ঘটনা প্রবাহে কেটে যেতে থাকলো সময়। ক্লাস নাইনে আবার বিতর্কে গেলাম। এবার আমি লিডিং ব্যাচ। টপিক মনে নাই, কিন্তু ফার্স্ট হইয়েছিলাম এইটা মনে আছে। তারপর ক্যান্ডিডেট থাকার সময় আবার সেকেন্ড এবং ক্লাস টুয়েলভয়ে ফার্স্ট। এবং ICCLM এ যাবার সুযোগ। তখনো আমার বিতর্কের উৎসাহের ভাটা পড়ে নাই। LM এর অনেক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করালাম। কলেজে অনেক বোরিং অডিশনের ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসলো। রওনা দিলাম রংপুর ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্যে।

আমার কম্পিটিশন ছিল দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চের ঠিক আগে (ভুল হতে পারে)। আমাদের কলেজের টিম অতটা ভালো ছিলনা। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেনো সবাই যার যার ইভেন্টে খুব ভালো করে ফেলল। আমারটার আগে আমাদের কলেজের স্থান ছিল দুই নাম্বারে। এইবার আমার পালা। স্টেজে বসলাম। প্রথম বক্তা ছিল গার্লস ক্যাডেটের অর্চি। ও বলল, এভাবে একে একে সবাই যেতে লাগলো। স্টেজ থেকে একটা জিনিস খেয়াল করলাম কেউ যখন বক্তব্য দিতে জায় তখক বিতর্কের মাঝখানে হোক কিংবা শেষে হোক তার নিজের কলেজ বাদে আর কেঊ তালি দেয় না। কারণটা খুব সহজ। যাই হোক আমি বক্তব্য শুরু করলাম। আমার স্ক্রিপ্টে অনেক মজার মজার উপমা ছিল। এই যেমন “……তাতে করে উন্নয়নের আন্ডা চিরজীবন আন্ডাই থেকে যাবে; কোনদিন বাচ্চা হয়ে বের হবেনা না” টাইপ। আমি দেখলাম আমার বক্তব্যে সবাই খুব মজা পাচ্ছে; আরও অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমাকে সবাই হাততালি দিচ্ছে। আমি অনেকের চেহারা লক্ষ্য করলাম। দেখলাম তারা সবাই আমার সাথে আছে। MGCC পর্যন্ত। সময় ফুরিয়ে এলো। আমি ছিলাম ৫ম বক্তা। আমার পরে আরও পাঁচ জন। আমার জীবনে আমি যতো প্রতিযোগিতায় এর আগে গিয়েছিলাম এবারের মতো আমি ফলাফল নিয়ে নিশ্চিন্ত কখনো হইনি। নিজেকে প্রথম ছাড়া আর কিছু কল্পনাও করতে পারছিলাম না। জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের সপ্নে আমি তখন বিভোর। মেডেল নেবার সপ্ন, কলেজে ফিরে পার্ট মারার সপ্ন। সত্যি মধুর অনুভূতি। বিতর্ক শেষ হোল। নীচে নেমে আসলাম। কলেজের সবার মুখ আনন্দিত কারণ অবশ্যম্ভাবী আরেকটা ফার্স্ট এবং ১০ পয়েন্ট। রাকিব স্যার বললেন “রায়হান তুমি ফার্স্ট হবানা, রংপুর ফার্স্ট হবে আর তুমি হবা দ্বিতীয় “। রেজাল্ট দেবার সময় ঘনিয়ে আসলো। ১০ম FCC এর শাওন। সবাই খুব খুশী। কারণ ওরে আমাদের কলেজের কেউ দেখতে পারেনা। তারপর ৯ম…ক্যাডেট রায়হান; বরিশাল ক্যাডেট কলেজ।

এরপর আমার স্পষ্টভাবে আর কিছু মনে নাই। খালি মনে আছে সবাই এসে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। DIG আসলো, আসলো আমাদের ভয়ঙ্কর এডজুটেন্ট নুরুল আলম। অনেকে…

আমার জীবনের অন্যতম সুখের এবং একি সাথে দুঃখের দিন ছিল সেটা। পরে ভেবে দেখলাম ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড না হওয়াতে একদিক দিয়ে ভালই হইয়েছিল। অনেকেই আমাকে ওই একটা কারণে চিনে। ভালো……

ও সেদিন বিচারক হিসাবে থাকার কথা ছিল কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের। তিনি উপস্থিত না থাকাতে বিচারক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালম করেছিলেন আভিনেতা খাইরুল আলম সবুজ। এবং আমাকে ৯ম স্থান দেবার কারণ আমাদের এডজুটেন্ট তাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন আমার বক্তব্য ছিল অশ্লীল…সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র।

১৩,৩৮৮ বার দেখা হয়েছে

৪৮ টি মন্তব্য : “বাংলা বিতর্ক, ক্যাডেট রায়হান এবং কিছু বিরক্তিকর প্যাচাল”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    রায়হান......সচলে তোমার লেখা আমি নিরবে পড়ে যাই। তোমার লেখার একজন ভক্ত-ও বলতে পারো আমাকে! বিতর্কতে বিচারকদের কাছে তুমি নবম হতে পারো কিন্তু আমার কাছে সাহিত্যিক হিসেবে তুমি প্রথম শ্রেণীর। বেশি বেশি করে লিখো এই আশা রইল।

    জবাব দিন
  2. রাফি (০২-০৭)

    ওহ!!! রংপুরের ওইটা ছিল আমার যাওয়া প্রথম LM । তবে সরি রায়হান ভাই, আপনার ইভেন্টের কথা মনে নাই, সম্ভবত ঘুমাইসিলাম। কিন্তু ভাই আপনার লেখাতার কন জুরি নাই, খুবই মজা পাইলাম। 😀

    জবাব দিন
  3. হোসেন (৯৯-০৫)

    দোস্ত ঐ রেজাল্ট টা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বড় জোকস.........আমিও ভাবছিলাম তুই ফার্স্ট হবি......(আর বেশী কিছু বলতাছিনা ,মানুষ জন মাইন্ড খাইতে পারে)


    ------------------------------------------------------------------
    কামলা খেটে যাই

    জবাব দিন
    • অর্চি (৯৯-০৫)

      মাইন্ড খাবেনা কেউ, বলে ফেল! 😛
      আসলে আমিও ভাবছিলাম রায়হান ফার্স্ট/সেকেন্ড কিছু ১টা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আমিই ফার্স্ট হয়ে যাবো এটা ভাবিনি। অবশ্য ১দিক দিয়ে ভালই হইসে mgcc-র জন্য 😀 ওইবার আমরা হ্যাটি্ৃক করসিলাম championship trophy নিয়ে!:awesome:

      জবাব দিন
      • Raihan rouf

        রায়হান,তোমার লেখাটা খুব আগ্রহ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পরলাম।প্রথমত শিরনামে আমার নিজের নাম দেখে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়,তার উপর আবার বিতর্ক। infact বিতর্ক ছিল আমার passion। ৯৭ এর icclm ছিল কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে।আমি অবশ্য বক্তৃতার মাঝে ২ বার আটকে গিয়েছিলাম। যে কারনে আমার নিজের কলেজের পোলাপানরাও দেখি আর হাত তালি মারে না।বক্তৃতা শেষে যখন গিয়ে সিট এ বসলাম, তখন যে লুক টা সবাই দিল x-( । অবশ্য ৩ য় হবার পর আর ধোলাই খেতে হয় নাই। নইলে খবর ছিল।অনেক ধন্যবাদ, এত সুন্দর একটা পোস্ট এর জন্য।

        জবাব দিন
  4. মনিরুজ্জামান মুন (২০০২-২০০৮)

    আবার মনে পরে গেল icclmm এর কথা,আমার কাহিনীটাও সেম,আমি ১১ আর ফেনীর কলেজ প্রেফেচ্ট ১২,আমি ডিবেট তেমন করতে পারতাম না,কিন্তু প্রতিপক্ষ কে অনেক পেইন দিতাম,এতেই আমি মজা পাই 😀 😛

    জবাব দিন
  5. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আইসিসিএলএমেম ২০০১ এবং ২০০২ এর কথা মনে পড়লেই আমি এক ছুটে ৯ বছর পেছনে চলে যাই।এই দুটো আইসিসির স্মৃতি কোনভাবেই ভোলা সম্ভব নয়।সময় করে লিখবো একদিন...এটুকু বলি,দুটো আইসিসি আমাকে যা শিখিয়েছে ৪ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই পরিমান শিখিনি...

    জবাব দিন
  6. শেখ সাদী (০৬-১২)

    icclmm 2010 এ যা দেখলাম। জোকস আর কারে কয় ........ স্যাররা ছিলেন জাজ !!!!!!!! একজন ১ম দেয় তো একজন লাস্ট. x-( x-( :gulli2: :gulli: :duel: :chup: :bash: :bash: :bash: :bash: :bash:


    \"why does the weasel go pop? does it matter?
    if life is enjoyable, does it have to make sense?\"

    জবাব দিন
  7. তানভীর (০২-০৮)

    কোনো এক দৈব কারণে এই icc তে যাওয়া হইছিল আমার ।আপনার ডিবেট এর কথা মনে নাই তয় কল্পনা করতেছি ।তবে আমার কাছে অত্যন্ত বোরিং লাগে যারে ''খায়রুল আনাম সবুজ '' ওনার একক অভিনয় এর কথা মনে পরছে ।উফ কি বোরিং ! 😛

    জবাব দিন
  8. আই সি সি?
    পানির মত সোজা...
    সারা জীবন ইন্টার হাউজে ৪র্থ এর উপর যাইতে পারি নাই...
    আই সি সি তে গিয়া সেকেন্ড হইয়া আইছিলাম...
    তাও বাংলা উপস্থিত বক্তৃতায়...
    ধুর...

    জবাব দিন
  9. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমি ক্লাস ১২ এ উঠে কোনও এক পলিটিক্স এর কারণে ইংরাজি বানান প্রতিযোগিতায় গেলাম। যথারীতি কিছুই জানি না। সূত্রধর না কি যেন বলে যিনি শব্দগুলি বলেন আর কি; তিনি ছিলেন রঞ্জিত চন্দ্র বণিক স্যার। স্যার ক্লাসেই কি পড়াতেন তাই বুঝতাম না আর অডিটরিউমের সেই পরিবেশে কিছু বোঝাই না। স্যার একেক্টা শব্দ বলেন আমি বলি এক্সকিউজ মে; স্যার শব্দটা আবার বলেন আমি বলি সরি। সবগুলাতেই সরি বললাম। দুই হাউসের অপনেন্টই ছিল আমাদের ক্লাসের। ওদের বললাম কিছুই তো জানি না; একটার ও উত্তর দিতে না পারলে তো খারাপ দেখায় এট লিস্ট একটা লিখে দিস। শালারা বোনাস মারছে কিন্তু আমারে বলে নাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।