বই পড়ার নেশা আমাকে পেয়েছিল বেশ ছোটবেলা থেকেই, কলেজে থাকা অবস্থায় সেটা পূর্ণ মাত্রা পায়, এমনকি বিএমএতে থাকতেও সেটা বিজায় ছিল (বিশেষ করে শেষের এক বছর)। কিন্তু ‘চাকুরী’ পুরোপুরি শুরু করার পর থেকেই বই পড়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে সুযোগ পেয়ে কিছু পড়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ পড়া সীমাবদ্ধ ছিল ছিল শুধুমাত্র গল্পের বইয়ের মধ্যেই, নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যে।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আবেগ, অনুভুতিও সৃষ্টি হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই আর সেটা পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। তবে সত্য কথা বলতে সেটা অনেকদিন যাবত শুধু আবেগেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইন্টারনেটে নিয়মিত হবার পর থেকে আরো নির্দিস্ট করে বললে ব্লগ জগতের সাথে পরিচয় হবার পরে আবিষ্কার করলাম আমি আমাদের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে কত কম জানি। গল্পের বইয়ের হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেলেও এ সম্পর্কে আমি কিছুই পড়িনি। ধীরে ধীরে নেটে যা পাওয়া যায় পড়া শুরু করলাম। সবখানেই বিভিন্ন বইকে রেফারেন্স দেখে মনে মনে ঠিক করতাম বইটা পড়তে হবে, কিন্তু সেটা আর করা হয়নি। মাঝে বিশাল একটা উপকার করলেন ফয়েজ ভাই বইয়ের তালিকা খুঁজছি নামে পোস্টটা দিয়ে। সবার অংশগ্রহনে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৯০ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের উপরে লিখিত বইয়ের একটি বিস্তারিত তালিকা তৈরী হয়েছে। পোস্ট প্রিয়তে রেখে ভাবলাম এবার একে একে শুরু করা যাক। কিন্তু সব মনে মনেই থেকে যায়, শুরু আর করা হচ্ছিল না।
গতমাসে পেশাগত কাজে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল কক্সবাজারের ইনানীতে। দিনের অধিকাংশ সময়েই ইলেক্ট্রিসিটি আর পূর্ন সময় মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতে হবে জেনে যাবার আগে ভাবলাম বই পড়া শুরু করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। নিজের ইউনিট লাইব্রেরি থেকে দুটো বই নিয়ে নিলাম, মূলধারা ‘৭১ আর Witness to Surrerender. সমুদ্রের পাড়ে বসে বইয়ের মাঝে ডুবে গিইয়েছিলাম। মুলধারা ‘৭১ শেষ করে আসতে পারলেও Witness to Surrerender শেষ করা হয়নি। সেটা শেষ করার জন্য বই পড়া চলতে থাকলো, আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এখন থেকে প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য হলেও বই পড়বো।
ব্লগ পড়তে পড়তে নতুন একটা অভ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। কোন লেখা পড়া শেষ হলেই পাঠকের মন্তব্য পড়তে ইচ্ছে করে, বিশেষ করে তথ্যমূলক কিছু পড়লে। কারন মন্তব্য থেকে অনেক তথ্য, বক্তব্যের সত্যতা বের হয়ে আসে। কিন্তু বইয়ের বা পত্রিকার রিপোর্টের ক্ষেত্রে সে সুযোগ কম। এই পোস্টটা দেবার উদ্দেশ্য হলো বই দুটো ইতিমদ্ধ্যে যারা পড়েছেন তাদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া আর যারা এখনো পড়েননি তাদের সাথে শেয়ার করা। এটা কোন রিভিও তো নয়ই এমনকি পাঠক প্রতিক্রিয়াও বলা যায় না। বইগুলো একবার পড়ে রেখে দেবার মত না, বারবার পড়তে হয়। আমি আবারো পড়া শুরু করেছি। ভবিষ্যতে আশা করি প্রতিক্রিয়া জানাবো।
মূলধারা ‘৭১
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারনার কারনে বঙ্গবন্ধু আর জিয়াউর রহমান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আর কারো কোন অবদান আছে বলে মনে হয় না। অনেকের কাছেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে শুনেছিলাম, কিন্তু সে সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না। মইদুল হাসানের লেখা এ বইটি পড়ে তার ব্যক্তিত্ত, বিচক্ষনতা আর নেত্তৃত্বের গুনাবলী সম্পর্কে জানতে পেরে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়েছে। সেই সাথে লজ্জা পেয়েছি তার সম্পর্কে এতদিন কিছুই না জানার কারনে। জাতি হিসেবে আমরা মনে হয় তাজউদ্দিন আহমেদকে যতটুকু শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত তার বিন্দুমাত্র করি নাই।
বইটি অনলাইনে সরাসরি পড়া যাবে এই ওয়েবসাইটে।
Witness To Surrender
১৯৭১ সালে তৎকালীন মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) সিদ্দিক সালিক ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান আর্মির পাবলিক রিলেশন অফিসার। পুর্ব পাকিস্তানের মার্শাল ল প্রশাষন আর সেনাবাহিনীর উভয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল বলে অনেক ভিতরের জিনিষ উঠে এসেছে তার এই বইতে। রাজাকার, আলবদর, আল সামস এর কার্যক্রম সম্পর্কেও অনেক কিছু বলা হয়েছে। সেই সাথে ৭০ এর নির্বাচনের আগ থেকে ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রম বিশেষত মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে বিভিন্ন সময়ের সংলাপ, বোঝাপড়া ইত্যাদিও এসেছে। কিছু কিছু জায়গায় বাঙ্গালীদের দ্বারা বিহারীদের উপর অত্যাচার (যুদ্ধের আগে এবং পরে), ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা ইত্যাদি এসেছে। আর বিস্তারিত এসেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোন সেক্টরে কোন রণপরিকল্পনার কাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তবে সত্যি কথা বলতে এই বইটি পড়ার পরে আমার মনে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই বেশি জন্ম দিয়েছে। আশা করি যারা এ বইটা পড়েছেন তারা সিদ্দিক সালিকের বক্তব্যের সত্যাসত্য কত টুকু তা জানাবেন।
বইটি ডাউনলোড করা যাবে এই লিঙ্ক এ থেকে।
শুভেচ্ছা।
আমাদের ইতিহাস ত আমরা 'ইতিহাস' হিসাবে সংরক্ষণ করি নি, আমরা করেছি 'বিরত্তগাথা' হিসাবে, তাই শত বিরত্তগাথা এর মাঝে আসল ইতিহাস পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পরেছে. আসলে সঠিক ইতিহাস জানতে হলে অনেক বই পড়লে একটা ধারণা পাওয়া যায়. তুমি শুরু করেছ যেহেতু, আসতে আসতে জানতে পারবে. আর আমার মতে 'অবদান' এর মাপকাঠি টা আপেক্ষিক, কেউ সম্মুখ সমর এ অংশগ্রহন করেছে, কেউ রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেছে, কেউ কুটনৈতিক পন্থায়, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছে....ইত্যাদি...সবার ই কম বেশি অবদান আছে.
আমার মনে হয় শুধু আমরা না, প্রাথমিক অবস্থায় সব ইতিহাসই বীরত্ত্বগাথা থাকে। সময় যাওয়ার সাথে সাথে সেটা আস্তে আস্তে তা থেকে সত্যিকারের ইতিহাস বেরিয়ে আসে, কোথায় যেন শুনেছিলাম কোন ঘটনার আসল ইতিহাস পাওয়া যায় ৫০ বছর পরে, সে অনুযায়ী আমাদের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আর যুদ্ধে বিভিন্ন অবস্থান থেকে মানুষেরা বিভিন্ন ভাবে অবদান রেখেছে, অনেকের সম্পর্কে আমরা জেনেছি, অনেকের সম্পর্কে জানিনি, কারো কারো ক্ষেত্রে আবার অতিরিক্ত বা ভুল জেনেছি। তবে তাজউদ্দিন আহমেদ, যে কিনা সে সময়ে আমাদের সরকার প্রধান ছিলেন তার সম্পর্কে মনে হয় আমাদের আরো বেশি জানা উচিৎ ছিল।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
বই দুটা পড়ে মতামত জানিয়ে যাবো।
অপেক্ষায় থাকলাম।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মূলধারা ৭১ পড়া। পড়ার পর যে কথাটা মাথায় আসছে সেটা হল মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির বিভিন্ন বিভাজন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে হলে এই বই অবশ্য পাঠ্য। আর এই বিভাজন সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরী এই জন্য যে, এটা পরবর্তীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পটভূমি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়।
আর উইটনেস টূ সারেন্ডার এখনো পড়া হয় নায়। বইমেলা থেকে কিনা হইছে তবে সময় করে পড়া হয় নি। ঠিক করছি মুক্তিযুদ্ধের উপর বাংলাদেশীদের লেখার সাথে সাথে পাকিস্তানীদের লেখা গুলোও আস্তে আস্তে পড়ে ফেলব।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
দারুন বলেছো... :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
পড়তে হবে। লিঙ্ক দুইটার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
অফটপিকঃ কেমনাছেন? টোনাটুনি জীবন কেমন চলে?
পড়ার পরে জানিয়ো কেমন লাগল।
অফটপিকঃ টোনাটুনি জীবনে আপাতত বিরতি চলছে, টুনি ঢাকাতে, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত 🙁
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
বইগুলোর লিংক সংগ্রহে রাখলাম। ধন্যবাদ।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi