একটি বিরিসিরি ভ্রমণ…

১…

ঘর থেকে দু’ পা ফেলে আশুলিয়া কিংবা ফ্যান্টাসী কিংডম যাওয়ার তিনদিন আগে থেকেই, পোলাপান সবাইকে সেটা জানান দেয় ফেসবুকের কল্যানে। এসে আরেকদফা। বেলা এগারোটায় জিহাদ ফোন করে একঘন্টার মধ্যে বিরিসিরি যাওয়ার প্রস্তাব দিতে শুরুতেই আমার মনে আসলো আগের কথাটা। ইসস!! এতো সুন্দর একটা জায়গায় যাচ্ছি, অথচ মাইক দিয়ে জানান দিতে পারলাম না। আমার কাছে পয়সা-পাতি কখনোই তেমন একটা থাকেনা। কিন্তু সেদিন (শনিবার) প্রায় সাতশ টাকার মতো ছিল। আমি দুই হাজার টাকায় সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করে আসছি, একহাজার টাকায় কুয়াকাটা- তাই বিরিসিরি যাওয়ার জন্য সাতশ টাকা বাজেট-ই আমার কাছে অনেক বেশী…

এর আগে বেশিরভাগ ভ্রমণ ছিল ক্যামেরাবিহীন। কিন্তু অনেকের কাছেই বিরিসিরির অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা শুনে এবং ইদানিংকালে সচল, ফেসবুকে মানুষজনের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে মনে হলো একটা ক্যামেরা নিয়ে গেলে ভালোই হয়। কয়েকদিন হয় একজনের ঘাড়ে চড়ে বসেছি। কোনকিছু দরকার হলেই তারে বলি, তিনি আলাদিনের দৈত্যের মতো নিমেষেই তা হাজির করে দেন। জি-টকে তাকে পাওয়া গেলো। ভণিতা ছাড়াই বললাম, ক্যামেরা দেন। বিরিসিরি যাবো। তিনিও ভণিতা না করেই বললেন, নিয়ে যাও- তবে খুব খিয়াল কইরা।

২…

গতবার ছুটিতে বান্দরবন গেলাম- এসে প্রবল উৎসাহে মেসেঞ্জারে একজনকে ভ্রমণের বৃত্তান্ত দিচ্ছি। অনেকক্ষণ শোনার পর সে বললো- খালি তো কেমনে গেলি, বাস ভাড়া কেমন, রাস্তা কেমন সেটাই বললি…এতো সুন্দর একটা জায়গার দেখে আসলি অথচ সেটার বর্ণনাই দিলি না…

এই হলো আমার অবস্থা। কোন জায়গায় গেলে আমি শুধু কিভাবে গেলাম সেইটার বর্ণনা দিতে পারি। অবারিত সৌন্দর্য কিংবা বহমান নদীর কথা বলতে পারি না- আমার এগুলো ঠিক আসেও না…

বিরিসিরি যাবার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি বাস রয়েছে। জিনাত পরিবহণ। তবে কয়েকদিন আগে আম্রিকার সৈন্যরা বাংলাদেশে বোমাবোমি করার কারণেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক এখন আর সরাসরি ঢাকা থেকে বিরিসিরি যাওয়া যায় না, কারণ যাত্রাপথে কয়েকটি ব্রীজ পড়ে- সেগুলো ভেংগে গেছে…

আমাদের সাথে মহাজ্ঞানী মুহাম্মদ ছিল। ওর বাসা ময়মনসিংহ। আমরা রাতে ওর বাসায় থেকে, একটু ভালো মন্দ খেয়ে পরদিন সকালে রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা করলাম…

সকালে ভালোমতো ডিম-পাউরুটি খেয়ে রওনা দেওয়া হলো বিরিসিরির উদ্দেশ্যে। বাসের অবস্থা জঘন্য। সিট কাভারগুলো ময়লা হতে হতে নতুন জুতার মতো চক চক করছে। এই বাসে তিন ঘন্টা কাটাতে হবে ভাবতেই মনটা ভরে গেল। বিরিসিরি ১২ থেকে ১৩ কি.মি দূরে; এমন সময় আমাদের বাস দাঁড়িয়ে গেলো। আর যাওয়া যাবে না। সামনে সেতু ভাংগা…আর্মির পোলাপাইন হলে এই ১২ কি.মি এক দৌড়ে পাড় হয়ে যেতো, কিন্তু আইইউটির তেলতেলে খাবার খেয়ে তেলতেলে হয়ে যাওয়া আমাদের সেই চিন্তা মাথাতেই আসলো না…

তারপরও আমরা অদৃষ্টের পথে যাত্রা শুরু করলাম। বেশ খানিকক্ষণ পর আমাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসলো ট্রাক্টর নামক এক ভয়ানক জন্তু। তিনপদের চাকা দিয়ে সাজানো এই অদ্ভুত জীবটার পেছনে চড়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। পশ্চাৎদেশে বাড়ি খেতে খেতে আমাদের মাথার ঘিলু হাঁটুতে নেমে আসলো। তাই বিরিসিরিতে নামার কথা থাকলেও আমরা আরো এগিয়ে চলে গেলাম সুসং দূর্গাপুর। এইবার কই যাই????

আশেপাশের মানুষদের বললাম, ভাই আমরা বিরিসিরি দেখতে আসছি- কি দেখে এইখানে সবাই? তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, নদী পার হয়ে হোন্ডা নিয়ে সীমান্তবর্তী বিজয়পুর নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে বিডিআর ক্যাম্প আছে। আর আছে চীনা মাটির পাহাড়। আমরা তাই তাদের কথামতো বিডিআর জোয়ানদের দেখার উদ্দেশ্যে পরবর্তী যাত্রা শুরু করলাম…

৩…

গতবছরের শুরুতে হাজার হাজার মানুষের কাছে জাফলং এর কথা শুনে আমি যখন জাফলং এর মাটিতে পা ফেললাম, তখন মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের হলো- “ও এই তাহলে সেই জাফলং”। আগে হয়তো ভালো ছিল, কিন্তু জাফলং এখন ভুয়া একটা জায়গা। মরা নদী, বালু বোঝাই ট্রাক আর সীমান্তের ওপারে ভারতের বাসা-বাড়ি ছাড়া জাফলং এ দেখার মতো কিছুই নেই…

বিজয়পুর পৌঁছে সেইখানে দুই মিটার উচ্চ পর্বত আরোহন করে আমার ঠিক একই কথা মনে হলো। ও এই তাহলে বিরিসিরি…একটু ছায়ার মতো বসে আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। মুহিবকে বললাম, দোস্ত কিছুই তো ঘটলো না…তুই পোস্টে লিখবি কি? ওর বলে কিছু ঘটালেই হয়। আয় নগ্ন হয়ে নাচানাচি শুরু করি। আমি ওর কথার প্রচন্ড গুরুত্ব দিয়ে বললাম, কিন্তু মানুষজন আছে তো। ও বলে, আরে ধুর! পাহাড়িরা এইসব বুঝবে না…

কথাই চলতে থাকে। আমাদের কিছুই ঘটানো হয় না। উঠে যাবো এমন পর্যায়ে মুহাম্মদ ফেরার পথে চীনামাটির পাহাড়টা দেখার প্রস্তাব করলো…

এই জায়গাটায় এসে আমরা সত্যিকারের মুগ্ধ হলাম। হাঁটাহাটি করছি, এমন সময় এক টিলার উপরের থেকে জিহাদ ডাক দিলো- দেইখা যা…যা দেখলাম তাতে আমি সত্যিকারের মুগ্ধ…টিলা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা লেক…আকাশের চেয়েও নীল তার পানি…

ছবি তুলতে পারি না, খালি সাটার টিপে যেতে থাকলাম…যা হয় হবে…

এবার ফেরার পালা…ময়মনসিংহ ফিরে এসে আমরা যার যা পয়সা আছে গোণা শুরু করলাম। দেখা গেলো, ঢাকা আসার জন্য চার জনের বাস ভাড়া নেই…তিনজনের হয়ে যাবে…

কিন্তু কথায় আছে না- মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনি। আমরাও উদ্ধার পেয়ে গেলাম…সবই কুদ্রত!!! B-)

৪,৮০৫ বার দেখা হয়েছে

৫৭ টি মন্তব্য : “একটি বিরিসিরি ভ্রমণ…”

  1. সামি হক (৯০-৯৬)

    ছবিগুলো বড়ই সুন্দ্র আসছে। বিরিশিরির কথা অনেক শুনছি কিন্তু কখনো ছবিও দেখি নাই, যাইহোক আজ দেখা হল। আরো অনেক জায়গায় যাও আরো ছবি দাও অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন একজন কি কোলে বসে আসছিল? কে সেই জন?

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আগেই পড়ছি, ভাবছিলাম হেইখানে কমেন্টও করি। কিন্তু কি করুম, ইচ্ছা করেনা।
    তাই এইখানেই কই, লেখাতো ভালা হইছেই, ছবিগুলা আরো ভালা হইছে, ইস্পিশালি পাঁচ নাম্বার আর লাস্টটা তো একেবারে সেইরকম :boss:

    এখন এইখানে কদেখি পঁচিশ হাজারি জিনিসটা কার?


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    ছবি তুলতে পারি না, খালি সাটার টিপে যেতে থাকলাম…যা হয় হবে…

    😮

    তোমার প্রায় প্রতিটা ছবিতেই পেশাদারী ছোঁয়া আছে... :clap:
    পোলাপাইন এত বিনয় করবার পারে রে ভাই... 🙁


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আমিও বিরিসিরি দেখুম :(( :(( :((


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  5. তানভীর (৯৪-০০)

    রায়হান, বিরিসিরি জায়গাটা আসলেই সুন্দর। পিছনে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর জন্য এই জায়গাটাকে আরো সুন্দর লাগে। কিন্তু ওখানে যাওয়ার রাস্তাটা সেইরকমই খারাপ। বিশেষ করে সেতুগুলার অবস্থাও খুব একটা ভাল না। এই সুন্দর জায়গাটা দেখার জন্য অবশ্য একটু কষ্ট সহ্য করা যায়।

    তোমার লেখা পড়ে মজা পাইসি, ছবিগুলাও সিরাম হইসে! :gulli: :gulli: :gulli:

    জবাব দিন
  6. নাজমুল (০২-০৮)

    লেখা ভালো হইছে ছবিও সুন্দর হইছে 😕 কিন্তু একটা সন্দেহ দূর হইলনা 😉 ছবিতে কিংবা জায়গা গুলাতে যারা গেছে তাদের ছবি তো নাই 😕
    আল্লাহ আবার গুগল এর ছবি নাতো:(
    তবে লেখা কিন্তু ভালো হইছে :))

    জবাব দিন
  7. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    কিছু প্রশ্ন, বিরিসিরি যাওয়ার উত্তম সময় কখন? ফ্যামিলি নিয়ে গেলে থাকব এইরকম হোটেল কি আছে? নিজস্ব ট্রন্সপোর্ট নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?

    রায়হান, ছবি গুলো যেমন সুন্দর, জায়গাটি আসলেই তেমন সুন্দর?


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  8. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    দোস্ত ,
    আমরা গেসিলাম ৮-৯ জনের মত। থাকার কথা ছিল মিশনারীদের হোস্টেলে(YWMC), গিয়ে দেখি বাংলা ছিনেমার স্যুটিং পার্টি দখল নিয়া আসে পুরাটা। দুইটা হোস্টেল আছে, একটা ছেলেদের জন্য আরেকটা শুধু মেয়েদের জন্য। ভাগ্য ভাল ছিল ছেলেদেরটা দখল করলেও মেয়েদেরটা খালি ছিল। তাও যিনি দায়িত্বে ছিলেন তারে খালা বানায়ে তারপর রক্ষা। ছেলেদের হোস্টেলে আসলে সবাই থাকতে পারে, ফ্যামিলি সহ। কিন্তু ফ্যামিলি না নিয়ে যাওয়াই ভাল, জার্নিটা অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। বিশেষ করে নদী পার হয়ে মোটরসাইকেল বা রিক্সা নিয়ে গ্রামের রাস্তায় দিয়ে প্রায় ৩-৪ কিমি(আরও বেশি হতে পারে) যেয়ে তারপর বিজয়পুর বর্ডার। তয় যাদের বাজেট কম কিন্তু এডভেঞ্চার বেশি 😉 নিঃসন্দেহে দৌড় দিতে পারেন। থাকতে চাইলে খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হবে না, গারোদের একটা হোটেল আছে যেখানে মামা বাড়ির মত খাওয়া দাওয়া করসিলাম 😛 । এছাড়া তথাকথিত চাইনিজ রেস্টুরেন্টও আছে একটা 😛 । হোস্টেলগুলো আসলে ট্রেনিং সেন্টারের আবাসিক ভবন। অন্য সময়ে ব্যবসা করে আরকি 😉 । তাই ভাড়া দেয়ার সময় খালা-আন্টি বানায় ফেলান, কে জানে ভাড়া মওকুফও হয়ে যেতে পারে। 😛

    জবাব দিন
  9. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    ছবিগুলা খুবই সুন্দর। বিরিশিরি না গিয়া এই ছবিগুলা দেখলেই হইতো। কারণ, ছবিতে যত সুন্দর মনে হচ্ছে বিরিশিরি ততো সুন্দর লাগে নাই। তবে চিনামাটির পাহাড়টা অসাধরণ এবং অনন্য। বাংলাদেশে এইরকম চিনামাটির পাহাড় আর এইরকম পানি বোধহয় আর কোথাও নাই। শিউর না অবশ্য।

    জবাব দিন
  10. ফরিদ (৯৫-০১)
    কিন্তু জাফলং এখন ভুয়া একটা জায়গা। মরা নদী, বালু বোঝাই ট্রাক আর সীমান্তের ওপারে ভারতের বাসা-বাড়ি ছাড়া জাফলং এ দেখার মতো কিছুই নেই…

    দিন দিন জাফলং এর অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।