এক
অনেকেই মনেহয় জানেন যে নারীবাদ তিনটি ডিস্টিংক্ট ওয়েভের মধ্য দিয়ে গিয়ে তাঁর আজকের এই অবস্থানে এসে উপনিত হয়েছে।
এই প্রতিটা ওয়েভেই নারীকে সম্মিলিত ভাবে আন্দোলন করে পরবর্তি পর্যায়ে পৌছুতে হয়েছে।
প্রথম ওয়েভে নারীকে লড়াই করতে হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতিতে সেগুলো অর্জনের জন্য। তাঁর মানে হলো, এখনো যাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন হয় নাই, তাদের আন্দোলনটা ঐ ফার্স্ট ওয়েভেই আটকে আছে।
ফার্স্ট ওয়েভটা এক অর্থে ব্রড স্পেক্ট্রামের ফ্যামিনিজম।
যারা এখনো এখানে আছেন, তাদের জন্য সেকেন্ড বা থার্ড ওয়েভ এখনো অনেক দুরের পথ।
যখন নারী ফার্স্ট ওয়েভের মধ্য দিয়ে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি পেল, তারপরেই কিন্তু তাঁর জন্য গুরুত্বপুর্ন হয়ে দাড়ালো, অর্থনৈতিক সাম্য, প্রজননে নারীর স্বার্থরক্ষা (অর্থাৎ, সন্তান উৎপাদনে অন্যের হাতের ক্রিয়নক হয়ে না পড়া), এইসব।
আর এ থেকেই দ্বিতীয় ওভেভটির সুত্রপাত। এটা তাই হয়ে দাড়ালো ম্যাক্রলেভেল ফ্যামিনিজম।
সিক্সটিজে শুরু হওয়া এই সেকেন্ড ওয়েভের মাধ্যমে নারীর সম-অধিকারের ব্যাপারগুলি গৃহিত হতে থাকলে সেই অর্জনগুলি নারীকে তৃতীয় ওয়েভের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল।
এবার আর নারী কিতাবি সম অধিকারে তুষ্ট না, প্রয়োগও চাই তাঁর।
– সে চাই ইকুয়াল ওয়েজ।
– সে চায় প্রজনন বেছে নেয়া বা না নেয়ায় তাঁর সীদ্ধান্তের স্বীকৃতি
– সে চায়, নারীর পেশা বলে আলাদা কিছু থাকবে না, এইসব…
এইসব মাইক্রো বিষয়াবলি তখন, সেই নব্বুয়ের দশকে আর্লি নাইন্টিজে নারীবাদে অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে।
যদিও বলা হয়, এই তৃতীয় ওয়েভটা এখনো চলছে তবে অনেকের মতে গত দশকের মাঝামাঝি থেকে একটি চতুর্থ ওয়েভ শুরু হয়েছে।
আগেই বলেছি,
– প্রথম ওয়েভ ছিল এওয়ারনেস জাগানিয়া
– দ্বিতীয় ওয়েভ ছিল ম্যাক্রো ইস্যু নির্ভর
– তৃতীয় ওয়েভটি হলো মাইক্রো ইস্যু নির্ভর
এবং এসবই ছিল মূলতঃ অর্গানাইযড ও সম্মিলিত প্রয়াস।
সেখানে চতুর্থ ওয়েভটি সোশাল মিডিয়া ও ব্লগ নির্ভর ভাবে ব্যাক্তি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে আরও খুটিনাটি বিষয় ও ব্যক্তি পছন্দ ঘিরে।
দুই
ঘটনা হলো, অর্জনের দিক দিয়ে আমাদের দেশে আমরা এখনো দ্বিতীয় ওয়েভই অতিক্রম করি নাই। তারমানে তৃতীয় ওয়েভে পৌছানোর পর্যায়ে উপনিত হই নাই।
কিন্তু প্রযুক্তির কারনে আমরা আবার চতুর্থ ওয়েভের চর্চ্চা করা শুরু করে দিতে পেরেছি।
এই মিসম্যাচটি এই মুহুর্তে এদেশে নারীবাদিদের জন্য বেশ ভাল রকমের একটা কনফিউজিং পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় ওয়েভের অর্জন আদায় করতে না পারা অবস্থায় তৃতীয় ওয়েভের কথাবার্তা বলে তসলিমা নাসরিন শুধু পুরুষ না, নারীদেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাই, সেই একই বা কাছাকাছি অর্জনে বসে থেকে চতুর্থ ওয়েভের কথাবার্তা বলারা যে আরও বেশি বিরাগভাজন হবেন, আরও বেশি কনফিউশনের মুখে পড়বেন, সেটাই তো স্বাবাভিক।
আর এইক্ষেত্রে প্রথমেই যা ঘটছে তা হলো, ১) তাঁরা যে নারীবাদি, এটাই নাকচ করে দিয়ে তাদেরকে একধরনের বিশৃংখলাপন্থি হিসাবে চিহ্নিত করা, ২) তাদেরকে পুরুষ বিদ্বেষি হিসাবে উপস্থাপন করা।
এখন প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েভের মধ্য দিয়ে না গিয়ে কি আমরা চতুর্থ ওয়েভে পৌছুতে পারবো না?
পারতে তো হবেই যখন বাকিটা দুনিয়া সেখানে পৌছে গেছে।
আমার এই লিখাটার উদ্দেশ্য একটা উপায় বাতলানোর জন্য যাতে করে আমরা ঐদুটি ওয়েভের অর্জন না থাকার পরেও সফল ভাবে চতুর্থ ওয়েভে পৌছুতে পারি, সেটার বেনিফিটগুলি নিতে পারি।
আবার পুর্ববর্তি ওয়েভের যে যে বেনিফিটগুলি পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে সেগুলা পরবর্তিতে একে একে ইন্টিগ্রেট করে নিতে পারি।
এই জন্য এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরী। আর তা হলো এই যে, পুর্ববর্তি ওয়েভগুলাতে নারীবাদ পুরুষদের যেভাবে প্রতিপক্ষ হিসাবে পেয়েছিল, এখন কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আর তা নাই। চতুর্থ ওয়েভের নারীবাদে প্রচুর পুরুষও তাদের সহযোগি। আর এই সহযোগি হবার মূল কারন হলো এই যে পুরুষরাও আজ বুঝতে পারছে, নারীবাদ আসলে মানবতাবাদ।
পুরুষতন্ত্র শুধু নারীকেই শিকলাবদ্ধ করে ক্ষান্ত হয় নাই, পুরুষকেও করেছে অমানবিক, নিষ্ঠুর, দায়িত্বজ্ঞানহীন।
বেশিরভাগ পুরুষই আসলে জন্মসুত্রে তা নন।
তাই নারীবাদের উত্থান ও পুরুষতন্ত্রের নিপাত শুধু নারীর নয়, পুরুষেরও মুক্তি।
নারীর শৃংখল থেকে মুক্তি ও পুরুষের অপবাদ থেকে মুক্তি দুইই আছে নারীবাদের উত্থানে…
তিন
এদেশে নারীবাদের ভবিষ্যৎ এখনো বেশ অন্ধকার। কারন:
– যারা নারীদের সমতা নিয়ে ভাবেন, বলেন, লিখেন – তাঁরা নিজেদের নারীবাদি বলতে সংকোচ বোধ করেন।
– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা অবশ্য তাঁরা করেন এই কারনে যে এতে করে তাদের স্টেরিওটাইপিং-এর শিকার হতে হয়। মাস পপুলেশনের একটি বড় অংশই নারীবাদকে “বাজে মেয়েদের আকাজ” বলে গন্য করে। এই স্টেরিওটাইপিং-এর শিকার হয়ে তাঁরা নিজেদের ও নিজেদের কাজটাকে হুমকির মুখে ফেলতে চান না।
– নারীবাদের একটি গৌরবোজ্জল ইতিহাস আছে। আছে গর্ব করার মত অনেক অর্জন। এদেশে সেগুলিকে যথাসময়ে যথাযথভাবে হাইলাইট করা তো হয়ই নাই বরং সেগুলার ভ্রান্ত প্রচারণা হয়েছে। এই জন্য একজন নারীবাদিকে নিজের পরিচয় হাইড করে বলতে হয়, “আমি মানবতাবাদি” বা “আমি নারী হিতৈষী”। “নারীবাদী” – এই পরিচয় এখানে গর্বের না বরং গালাগালির পর্যায়ে নামে এসেছে।
– “নারীবাদ কি এবং কেন?” – এই প্রশ্নের উত্তরে বোদ্ধারাও এমন সব দায়সারা, সুপারফিশিয়াল, গা বাচানো উত্তর দেন যে তাতে নারীবাদ নিয়ে জাগা আগ্রহ মিইয়ে যায়। নারীবাদের সপক্ষে প্যাশন নিয়ে প্রকাশ্যে কাজ করা মানুষ আমরা তৈরী করতে পারি না।
– নারীবাদ পুরুষদের বিপক্ষ শক্তি না। এটা পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে যা কেবলই পুরুষদের বিষয় না কারন আমাদের চারপাশে প্রচুর পুরুষতান্ত্রিক নারীও আছেন। আবার নারীবাদি হতে হলে নারীই হতে হবে এমন না। নারীবাদি পুরুষের সংখ্যাও এখন আর নগন্য না। “নারীবাদি = পুরুষবিদ্বেসি”, এই প্রচারনাটা নিরুৎসাহিৎ করতে হবে। সম্ভব হলে তা ভাঙ্গতেও হবে…
নারীবাদ এগিয়ে নিতে হলে তাই সকল নারীবাদিদের এগিয়ে গিয়ে বলতে হবে,
১) “হ্যাঁ আমি নারীবাদি, এনি প্রবলেম?”
২) “হ্যাঁ আমি নারীবাদি। কিন্তু আমি পুরুষবিদ্বেষি নই। আমি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করার জন্য পুরুষবিদ্বেষি হওয়াটা জরুরী নয়।
৩) “নারীবাদের একটি গৌরবোজ্জল ইতিহাস আছে। আমাকে ‘নারীবাদি’ বলে গালি দিয়ে তুমি বরং ক) আমার প্রশংসাই করছো, খ) আমাকে সেই গৌরবের সামিল করছো, গ) নিজের অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদতা প্রমান করছো।
চার
কিভাবে বুঝবেন, আপনি একজন নারীবাদি কিনা?
নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দিন দেখি একে একে…
১) আপনি কি নারীর ভোটাধিকার থাকাটা সমর্থন করেন?
২) নারী তাঁর ভোটাধিকারটি স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছায় প্রয়োগ করুক – আপনি কি এটা সমর্থন করেন?
৩) যেকোন গনপ্রতিনিধিত্বের জন্যই নারী যে উপযুক্ত, সেটা কি আপনি মানেন?
৪) পেশার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আলাদা করে “নারীর কাজ” “পুরুষের কাজ” বলে যে কিছু নাই, অর্থাৎ সব কাজই যে নারী পুরুষ উভয়েই করতে সক্ষম, এটা কি মানেন?
৫) একই কাজ করার জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে উপার্জনে কোনো তারতম্য হওয়া বাঞ্চনিয় নয় – আপনি কি এটা সমর্থন করেন?
৬) “নিজের জন্য সম্পত্তি অর্জনে নারীরও সমান অধিকার আছে” – আপনি কি এটা সমর্থন করেন?
৭) নিম্নলিখিত বিষয়াবলিতে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি দিতে আপনি কি সম্মত?
ক) পছন্দনীয় যেকোনো বিষয়ে নারীর শিক্ষাওগ্রহন
খ) নারীর উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহন
গ) এককভাবে যে কোনো চুক্তি সম্পাদন
ঘ) বিবাহ ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহনের অধিকার
৮) আপনি কি নারীর মাতৃত্বকালিন ছুটি প্রাপ্তির অধিকার সমর্থন করেন?
৯) নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে নারীর সুরক্ষার জন্য নেয়া যে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন আপনি কি সমর্থন করেন?
ক) ধর্ষণসহ যেকোনো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে
খ) ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধে
১০) স্বেচ্ছায় নারী তাঁর দৈহিক স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে অথবা তা থেকে বিরত থাকতে চাইলে – আপনি এর প্রতিটিই কি স্বাভাবিক বলে মানতে সম্মত?
১১) কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহার করা বা না করায় নারীর একক সিদ্ধান্ত মানতে আপনি কি সম্মত?
উপরের সবগুলা প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে:
“কংগ্রাচুলেশন, আপনি একজন নারীবাদি। সোশাল স্টিগমা ঝেড়ে ফেলুন এবং নিজেকে একজন নারীবাদি হিসাবে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করুন।
উপরের প্রায় সবগুলি প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি একজন “প্রায় নারীবাদি”। আপনার জানা ও শোনার পরিধী বাড়ান। অচিরেই আপনি একজন নারীবাদি হয়ে উঠতে পারবেন।
উপরের বেশিরাভাগ বা প্রায় সবগুলি প্রশ্নের উত্তর যদি না বোধক হয়, আপনি সম্ভবত একজন পুরুষতান্ত্রিক। বর্তমান দুনিয়ার জন্য আপনি যে আসলে আনফিট সেটা এখনো যদি বুঝতে না পারেন, অচিরেই তা বুঝতে পারবেন। সেই দুর্দিনের জন্য অপেক্ষা করে যান।
পাঁচ
পরিশেষে বলতে চাই:
আই এম প্রাউড টু কল মাইসেলফ এ ফেমিনিস্ট
আই এম প্রাউড টু কল মাইসেলফ এ ফেমিনিস্ট
চেকলিস্ট/ফিল্টার টা সেই ছিল... 🙂
অনেক ধন্যবাদ মাহমুদুল, তোমার এই মন্তব্যের জন্য।
আজকাল আমার লিখাগুলোতে কেউ খুব একটা কিছু লিখে না।
বুঝতে পারছি, পাঠকের প্রত্যাশা পুরন করতে পারছি না।
কি আর করার, বলো?
সব সময় কি আর পাঠকের কথা ভেবে লিখা যায়?
মাঝে মাঝে তো নিজের মনের আনন্দেও লিখতে ইচ্ছা হয়।
সেরকম একটা লিখায় তোমার এই মন্তব্য দেখে খুবই ভাল লাগলো...
চেকলিস্ট ইউজ করে আরেকজন ফেমিনিস্ট আবিষ্কার করাটা এখানে একটা বাড়তি লাভ!!!
কী বলো??? (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই,
আপনার অভিযোগ মাথা পেতে নিচ্ছি, যখন বলছেন লেখায় কেউ কিছু বলে না। আমার নিজের কথা বলি -- আমার মনোযোগ এত কমে গেছে! ধৈর্য ধরে দুপাটা পড়ার সময় যেন হারিয়ে গেছে। অথচ এই সময়টাই চলে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে। খুব যে কাজের কিছু করছি তা না --- স্রেফ ঘোরাঘুরি করেই চলেছি। অন্যদের কথা জানিনা, তবে খুব ধীরেসুস্থে ধৈর্যশক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
লেখাটা ভালো লেগেছে। নারীবাদের পেছনের কথা খুব জানিনা। পড়াশোনা কিছু করা হয়নি। তবে আপনার পয়েন্টগুলো পড়ে মনে হল --- আমি নারীবাদীই।
আরেকজন নারীবাদি আবিষ্কার করার আনন্দে অন্যসব দুঃখ ভুলে গেলাম!!!
নারীবাদ নিয়ে যে স্টিগমা বেশকিছুদিন ধরে তৈরী হয়েছে, এটা দূর হওয়া জরুরী।
ফেসবুকে অকারণ ঘোরাঘুরিটাও যে আনন্দের, সেটাও কিন্তু অনস্বীকার্য।
কত কত পছন্দের মানুষের দৈনন্দিন খবরাখবর, ভাবনা চিন্তা সম্পর্কে আপডেইটেড থাকা যায়।
তবে এই পর্বটা খুব বেশিদিন থাকে না, সেই এক স্বস্তির কথা...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.