প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (প্রথম পর্ব)

এক
একবার প্রেমে পড়লে, শক্ত কোনো কারন ছাড়া, তা থেকে আর বেরুনো যায় না।
শুধু অস্বীকার করা যায়।
তবে এই অস্বীকার করাটা হয়ে দাঁড়ায় নিজের সাথে প্রতারনা করার সমতুল্য!!!
*****

দুই
সিরিয়াস বা ক্যাজুয়াল, যে নামেই একটি সম্পর্ককে ডাকা হোক না কেন, মূলতঃ তা একটি প্রেমের সম্পর্কই।
সম্পর্কটি স্থাপনের সময় সেটার পরিনতি সম্ভব কিনা অথবা সম্ভব হলেও তাকে পরিনতি দিতে সংশ্লিষ্টগন আগ্রহি কিনা – তাঁর উপরেই নির্ভর করে সম্পর্কটি “সিরিয়াস রিলেশন” নাকি “ক্যাজুয়াল রিলেশন”।

একটি সম্পর্কের গভীরতা ও স্থায়িত্বের সাথে এর শ্রেনীবিভাগের কোনোই সম্পর্ক নাই।

কারন, পরিনতি পাবে না, এমন অনেক প্রেমের সম্পর্ক যেমন যুগ যুগ ধরে চলতে পারে, তা আবার হতে পারে অনেক গভীরও। পক্ষান্তরে পরিনতি পেতে যাচ্ছে, এমন অনেক সম্পর্কই হতে পারে খুবই হালকা অথবা ঠুনকো।
এর মূলে যা আছে, তা হলো এই যে, যেকোনো প্রেমের সম্পর্কের মূল উপাদান আসলে তিনটি:
– ইন্টিমেসি,
– প্যাশন ও
– কমিটমেন্ট।

আমরা যাকে ক্যাজুয়াল রিলেশন বলি, তাতে এই তিনটি উপাদানের প্রথম দুটি বিভিন্ন মাত্রায় থাকতে পারে। এই দুইটাই যখন উভয় পক্ষ থেকে পূর্নমাত্রায় থাকে, সেটাতে প্রকাশ্য কমিটমেন্ট না থাকা অর্থাৎ তাতে পরিনতি নিয়ে কিছু বলা না থাকলেও এবং সেটা ক্যাজুয়াল সম্পর্ক হবার পরেও তা হয়ে উঠতে পারে একটি স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর, দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রেমের সম্পর্ক।
পক্ষান্তরে শুধু কমিটমেন্ট থাকার পরেও একটি সিরিয়াস হিসাবে গন্য হওয়া সম্পর্ক হতে পারে অতি ঠুনকো, অতি হালকা – যদি তাতে ঐ তিনটি উপাদানের প্রথম দুইটি থাকে নুন্যতম মাত্রায় অথবা অনুপস্থিত।

মজার ব্যাপার হলো, সম্পর্কের গভীরতা ও স্থায়িত্বের বিচার হওয়া উচিৎ তিনটি উপাদানের সবকটির গভীরতার মিথোস্ক্রিয়া নির্ভর।
তা না করে আমরা দুইটি অতিগুরুত্বপূর্ন উপাদানকে অবজ্ঞা করে, কেবলই একটি উপাদান (কমিটমেন্ট)-এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিকে বেঞ্চমার্ক ধরে নিয়ে সম্পর্কটাকে সিরিয়াস বা ক্যাজুয়াল হিসাবে সনাক্ত করতে চাই।
এরপর ধরে নেই:
সিরিয়াস রিলেশন = গভীর + দীর্ঘ্যস্থায়ি সম্পর্ক এবং
ক্যাজুয়াল রিলেশন = হালকা + ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক
এই ধরে নেয়াগুলা এক একটা মস্তো বড় ভুল!!
মারাত্বক ভুল!!!
*****

তিন
অনেককেই দেখি, ক্যাজুয়াল রিলেশন ও ক্যাজুয়াল সেক্স – এই দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন।
এদু’টোর পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
ক্যাজুয়াল সেক্স হলো, নিয়মিত সঙ্গির বাইরে অন্যান্য সঙ্গির সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো, কেবলই শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য। এর মধ্যে প্রেমের কোনো ব্যাপার থাকাটা জরুরী না।
কিন্তু ক্যাজুয়াল রিলেশন হলো মূলতঃ এক ধরনের প্রেম, যা হতে পারে সেক্স বিহিন অথবা ঐ সঙ্গির সম্মতিতে কেবলই তাঁর সাথে সেক্স-ইনক্লুসিভ।
এখানে পরিপুর্ন প্রেমের একটা জিনিষই অনুপস্থিত থাকে। আর তা হলো, তাঁরা তাদের সম্পর্কটা কবে পুর্নতা দেবেন? অথবা আদৌ দেবেন কিনা সে ব্যাপারে তাঁরা তখনো আনডিসাইডেড অথবা আন উইলিং।
পুর্নমাত্রায় ইন্টিম্যাসি ও প্যাশন সম্বলিত একটি রোমান্টিক প্রেমও কিন্তু ক্যাজুয়াল রিলেশন হতে পারে, যতক্ষণ তাঁরা প্রকাশ্য পরিচয়, অর্থাৎ ফিয়াঁসে বা স্পাউস, ধারনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না।
আবার একটি ক্র্যাশ থেকে ঘনিষ্টতায় এগুনোর প্রক্রিয়ায় থাকা কালটিও আরেক ধরনের ক্যাজুয়াল রিলেশন।
দুজন বন্ধু যখন নিজেদের মধ্যে প্যাশন আবিষ্কার করেন এবং সেটা পরষ্পরকে জানানোর ও তা নার্চার করবার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন, সেটাও কিন্তু আর এক ধরনের ক্যাজুয়াল রিলেশন। তবে এগুলার সবই টেম্পোরারি, কেবল রোমান্টিক রিলেশনটি ছাড়া।

ক্যাজুয়াল রিলেশন ও ক্যাজুয়াল সেক্স, এই দুইটির মধ্যে আরও বড় পার্থক্য হলো এই যে, ক্যাজুয়াল সেক্সের প্রতি যারা আসক্ত হন, তাঁরা প্রধানতঃ নিম্ফোম্যানিয়াক অথবা সেক্সক্রেজি।
কিন্তু ক্যাজুয়াল রিলেশনের ব্যাপারটা বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে যে কারো ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে, বিশেষ করে যখন তাদের জীবনে প্যাশনেট সঙ্গি বা ইন্টিমেট সঙ্গি বা দুইটাই নাই।

এই ব্যাপারগুলো ইথিকাল নাকি আনইথিকাল, সেটা নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য না। আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কের এই ফেনোমেনা ও ডাইনামিক্সগুলা পাঠকেকে জানানো।
একটি প্রক্রিয়া জানাজানিতে ইথিকালিটির কোনো বাধা থাকে না, যদি না তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে কেউ সেই জ্ঞানের অনুশীলন করে।
আসুন জানি, প্রক্রিয়াগুলা কি?
তবে তা ব্যবহারে ইথিকাল হওয়াটা কিন্তু জরুরী……
*****

চার
একটি প্রশ্ন পেলাম, সম্পর্কের শুরুটা প্যাশান দিয়ে হওয়া নিয়ে।
২০%-এর বেশি প্রেমের শুরুই নাকি হয় এভাবে।
আগে যাকে বলা হতো “লাভ এট ফার্স্ট সাইট” আর এখন বলা হচ্ছে “ক্র্যাশ খাওয়া”।
আসল ঘটনা হলো কাউন্টার পার্টকে দেখে প্যাশনেট বোধ করা বা নিজের ভিতরে প্যাশানের উপস্থিতি অনুভব করা।
এই অবস্থায় ইন্টিমেসির দিকে এগুতে না পারলে শুধু ক্র্যাশ নিয়ে বসে থাকলে সম্পর্কটা দীর্ঘ্যস্থায়ি হবে না।
যেটা জরুরী, তা হলো, আগে বোঝা যে এখন ইন্টিমেসি দরকার।
সমস্যা হলো, প্যাশন জিনিষটা নিজ থেকে আসে মানে কুদরতি কিন্তু ইন্টিমেসি তা নয়। এটা এফর্ট দিয়ে ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়। এবং এটা অর্জনে একটা আস্থার জায়গাও তৈরী করতে হয়।
ক্র্যাশ খাওয়ার পর তাই প্রথমেই যা যা করনিয়, তা হলো, ১) ক্র্যাশারের কাছে ভ্যাকেন্সি আছে কিনা, জানা। ২) যদি ভ্যাকেন্সি থাকে তাহলে তাঁর প্রতি জন্মানো ভাল লাগার কথাটা বুঝানো এবং ঘনিষ্টতা বাড়াতে তাঁর আগ্রহ আছে কিনা সেই সম্মতি নেয়া। (মনে রাখবেন, আপনি ক্র্যাশ খেয়েছেন নিশ্চিত কিন্তু সে খেয়েছে কিনা – তা কিন্তু তখনো অনির্ধারিত।) ৩) একটা এগ্রিড ইন্টারভেলে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া যেন সেটার মাধ্যমে কোনো একধরনের ইন্টিমেসি ডেভেলাপ করে।
কাউন্টার পার্ট যদি শুরুতে প্যাশনেট বোধ নাও করে, সমস্যা নাই। ঘনিষ্টতা সৃষ্টির পরেও সেটা তৈরী হবার সুযোগ কিন্তু আছে।
এইভাবে ঘনিষ্টতার চর্চ্চা করতে করতে যখন আপনি বুঝতে পারছেন যে দুজনের মধ্যেই ইন্টিম্যাসি ও প্যাশন এসে গেছে, কংগ্রাচুলেট ইওরসেলফ।
বিকজ ইউ আর ইন এ রোমান্টিক রিলেশনশিপ নাও।
এখন যদি দুজনেই চান এটা কে পরিপুর্ন ভালবাসায় রূপ দিতে, ট্রাই ইনসার্টিং কমিটমেন্ট ইন ইট।
কোনো সমস্যা না থাকলে সেটা তাৎক্ষনিক ভাবেই শুরু করা যায় (শুভ কাজে দেরী কিসের?)। কিন্তু সমস্যা থাকলে সেটা একটা টাইমফ্রেমে আনা উচিৎ। হোক তা দুই, পাঁচ বা দশ বছর পর, সমস্যা নাই। তবুও তা কিন্তু এক ধরনের কমিটমেন্টই।
কিন্তু অনির্দিষ্ট কালের জন্য তা ফেলে রাখলে বা কমিটমেন্টে ঢুকতে কোনো অক্ষমতা থাকলে বুঝতে হবে, আপনাদের সম্পর্কটা পরিপুর্ন সম্পর্কে রূপ নেবে না।
তাতেও সমস্যা কি?
পরিপুর্ন না হলেও একটি রোমান্টিক সম্পর্কও কিন্তু কোনোক্রমেই কম উপভোগ্য কিছু না। আর সেটা যে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে নাই, দুজনের মিলিত এফর্টে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে, সেটাও কিন্তু গর্ব করার উপলক্ষ।
তাই গর্বটা করতে থাকুন এবং সম্পর্কের রোমান্টিসিজম উপভোগ করে যান পুর্নমাত্রায়, কার কি বলার আছে এতে?
শুধু মনে রাখবেন, কমিটমেন্টে যাবার যে অক্ষমতা বা অনিচ্ছা, সেটা যেন এই রোমান্টিসিজমকে মেঘ হয়ে ঢেকে না দেয়।
লিমিটেশনটা বুঝুন ও সেটা মেনে নিতে শিখুন।
একান্তই যদি মানাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে বলুন এবং শান্তিপুর্নভাবে সম্পর্কের অবসান ঘটান।
লাঠালাঠি, মারামারি, কাইজা-দাঙ্গা, কাঁদা ছোড়াছুড়িতে কোনো পক্ষেরই কোনো লাভ হবে না।
আর কেনই বা তা করা?
যা নিয়ে করছেন, সেই রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্কটা তো একতরফা ছিল না।
ছিল, দু’জনেরই পরম কাঙ্খিত ও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ত্যাগ স্বীকার করে নির্মিত।
পুর্নতা না পাক, একটা সুখস্মৃতি হিসাবে সেটা রয়ে যাওয়াতে সমস্যা কি???

(চলবে…)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (তৃতীয় পর্ব)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (চতুর্থ পর্ব)

৫,১৪৫ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।