গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-১

এক: কি এবং কেন?
প্রযুক্তি দিনেদিনে অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে, এটা যেমন ঠিক, এটাও ঠিক যে তা অন্য অনেক নতুন নতুন সমস্যার সুত্রপাত করেছে।
গৌস্টিং (Ghosting) হলো প্রযুক্তির সৃষ্ট সেরকম এক উৎপাত…
সোশাল মিডিয়া, সেলফোন, ডেটিং সাইট ইত্যাদির কারনে মানুষের একাকিত্ব ও তাতে ভোগাটা এখন আর আগের মত নাই।
আবার এটাও ঠিক যে এসব আছে বলেই অনেক সময়েই আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী সোশালাইজড ও কানেক্টেড হয়ে যাচ্ছি।
এতে করে একটা সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে যে ওভার সোশালাইজেশন নিয়ন্ত্রনেরও দরকার হচ্ছে।
অনেকেই এসব সময়ে গৌস্টিং নামক পদ্ধতিটা বেছে নিচ্ছেন নিজের লিমিট রক্ষা করতে।
এভাবে ভাবলে গৌস্টিং-কে নির্দোষই মনে হতে পারে।
কিন্তু আসলেই কি তাই?
আসুন আলোচনা করে দেখি।
তাঁর আগে বলে নেই, কি করা হয় এই গৌস্টিং প্রক্রিয়ায়।
যার সাথে এই সেদিনও অনলাইন বা ভয়েস/টেক্সট মিডিয়ায় চুড়ান্ত মাখামাখি বা সার্বক্ষনিক যোগাযোগ ছিল, হঠাৎ একদিন সেসব থেকে কিছু না বলে এক তরফা ভাবে বেরিয়ে যাওয়ার নামই হলো গৌস্টিং।
যারা এটা করে, তাঁরা হয়তো এটা ধরে নেয় যে কিছু বলে কষ্ট দিয়ে কি লাভ, তারচেয়ে এভাবে নিরব অন্তর্ধানই হলো শান্তিপূর্ন অপশন।
কিন্তু তাঁরা এটা ভাবে না, বা ভাবার যৌগ্যতাই রাখে না যে এই নিরব অন্তর্ধান ভিক্টিমের কাছে হয়ে দাঁড়ায় একটা সরব মানসিক নিষ্ঠুরতা এবং তা তাঁর কোনো অপরাধ না থাকার পরেও…
(চলবে…)
কিছু গৌস্টিং টার্মিনোলজি:
গৌস্টার – যে গৌস্টিং করে।
গৌস্টী – যে গৌস্টিং-এর শিকার হয়।

দুই: সামগ্রিক ইমপ্যাক্ট
গৌস্টিং-এর কারনে ব্যক্তি পর্যায়ে তো বটেই, সামগ্রিক পর্যায়েও খেশারত গুনতে হয়।
ব্যাক্তি পর্যায়ে গৌস্টিং-এর শিকারগন কতটা ক্ষতির মুখোমুখি হন, কি কি দুরবস্থা পোহান – সেসব নিয়ে পরে লিখবো।
এই পর্বে জানাচ্ছি সামগ্রিক খেশারত নিয়ে।
যারা একবার সফল ভাবে গৌস্টার হিসাবে আবির্ভুত হন, দেখা যায় তাঁদের জন্য পরবর্তিতে গৌস্টিং চালিয়ে যাওয়াটা হয়ে ওঠে ডালভাত।
ইচ্ছামত যাকে তাঁকে ক্লোজ সার্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা ও ইচ্ছা হলেই গৌস্টিং করে তাঁদের তাড়িয়ে দেয়াটা তাঁদের জন্য হয়ে পড়ে একটা ছেলেখেলা।
এতে করে দিনদিন গৌস্টিং ভিক্টিমের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
তবে এটাই গৌস্টিং-এর আসল সমস্যা না।
আসল সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই যখন একজন গৌস্টি, মানে গৌস্টিং-এর শিকার যখন নিজের কম্পজার ফিরে পান এবং তাঁর গৌস্টারের কাছ থেকে শেখা গৌস্টিং টেকনিক অন্যদের উপরেও প্রয়োগ করা শুরু করেন।
এবং হ্যাঁ, দেখা যায় এটা করতে গিয়ে তারাও একসময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনলাইন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া শুরু করেন।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখিন হয় তাঁরা, যাঁরা একটা সরল উদ্দেশ্যে এই অনলাইন সম্পর্কগুলিতে ঢুকতেন, এবং যাদের তা নিয়ে গঠনমুলক ভাবনা চিন্তাও থাকতো।
যতই দিন যেতে থাকে, দেখা যায়, প্রযুক্তির আশির্বাদে পাওয়া একাকিত্ব ঘোচানোর এই বিশাল প্লাটফর্মটা মানুষকে দিনেদিনে আরও বেশী একাকিত্বে ঢুবিয়ে দিতে থাকে।
গৌস্টারকে এটা একা করে ফেলে কারন একটা সময়ে তাঁর ঐসব গৌস্টিং ইতিহাস অন্যদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
নতুন করে কেউ জেনেশুনে এইসব গৌস্টারের শিকার হবার জন্য আর এগিয়ে আসেন না।
একবার যারা গৌটি হবার ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, তাঁরা অনেক বেশী সতর্ক হয়ে পড়েন নতুন কোনো বন্ধু নির্বাচনের আগে। আবার নতুন কোনো বন্ধুত্বে ঢুকলেও দেখা যায়, তাঁরা আর আগের মত সহজ হতে পারছেন না।

মানুষে মানুষে আস্থার সম্পর্ক থাকার যে গুরুত্ব, নির্ভরতার যে মূল্য – দেখা যায়, এই চক্রে থাকা মানুষগুলোর জন্য দিনে দিনে তা লোপ পেতে থাকে।
একটি গৌস্টিং তখন শুধু একজনের জন্যই নিরব-উপেক্ষা হিসাবে আবির্ভুত হয় না, বরং অনেকের জন্য এবং অনেক সম্পর্ক ও বিশ্বাসের জন্যই নিরব-ঘাতক হিসাবে আবির্ভুত হয়…

তিন: এ যেন এক দুমুখো সাপ
চিন্তিত হবার মত কিছু পরিসংখ্যন দেই আগে।
অনলাইন বা প্রযুক্তিনির্ভর কোনো না কোনো সম্পর্কের জড়ানো নারী-পুরুষের অর্ধেকই কোনো না কোনো সময় গৌস্টিং-এর শিকার হন।
তবে এরচেয়ে আশংকার ব্যাপার যেটা, তা হলো, এদের অর্ধেকই আবার একটা সময়ে নিজেরা গৌস্টিং করা শুরু করে দেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এতে আশংকার কি আছে?
আশংকার ব্যাপার হলো এই যে গৌস্টিং-এর মত অনৈতিক, স্বার্থপর, কাপুরুষোচিত ও অন্যের সাফারিং উদ্রেককারী একটা কাজ যা নিজের জন্যেও মানসিক যন্ত্রণার উদ্রেক করেছিল, সেটার ভিতর দিয়ে যাবার পরেও একটা সময় মানুষ আর সেটাকে খারাপ ভাবছে না। বরং নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থসীদ্ধির একটা হাতিয়ার হিসাবে তুলে নিচ্ছে।
ব্যাপারটা হয়ে দাড়াচ্ছে এমন যে, নিজে এক্সটরশনের (বা ঘুষের) শিকার হয়ে, পরে সেটাকেই নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করার মত নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে পড়ার মত। যারা এটা করছেন, তাঁদের ভ্যালু সিস্টেম এতটাই ভেঙ্গে পড়ার আশংকার মধ্যে চলে যাচ্ছে যে তাঁরা অন্যের প্রতি সহানুভুতিশীল থাকা, নিজের নৈতিক অবস্থান ধরে রাখা – এসবের চেয়ে নিজের তাৎক্ষণিক লাভটাতেই ফোকাসড হয়ে যাচ্ছেন।
এসব লোকেদের জন্য স্বাভাবিকতা সম্পর্কিত অবস্থান তাই টালমাটাল হয়ে পড়াটা খুবই সম্ভব!!!
গৌস্টিং-এর ব্যাপারটা আগে যে একদমই ছিল না, তা না। কিন্তু সেটা করা খুব সহজ ছিল না বলে সেটা হতো কম এবং সেটার কুফল সম্পর্কে খুব একটা কেউ জানতো না।
মাত্র বছর পাচেক ধরে এটা হঠাৎ করেই মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভোগাচ্ছে। তাই গৌস্টিং টার্মিনোলজিটাও খুব বেশিদিন আগের না। এ সম্পর্কিত মানসিক অস্থিতিশিলতাগুলোও খুব একটা সুপরিচিত না। চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রোটোকল এখনো তৈরী হয় নাই।
তবে গৌস্টিং-এর শিকার হওয়া মানুষদের মধ্যে কিছু কমন ব্যাপার পরিলক্ষত হয়:
– গৌস্টেড হওয়াটা তাঁদের মানসিক অবস্থার মধ্যে একটা স্থায়ী ও গভীর ক্ষত রেখে যায়। বাকিটা জীবন তাঁদের সেই ক্ষত বয়ে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
– পরবর্তি যে কোনো সম্পর্ক স্থাপনে তাঁরা আর আগের মত পুর্ন কমিটমেন্ট নিয়ে এগুতে চায় না। হাতে কিছু আবেগ ধরে রাখে, কখন আবারও গৌস্টেড হয়ে পড়ে এই আশংকায়।
– সম্পর্ক উপোভোগের চেয়ে গৌস্টেড না হওয়াটাই তাঁদের কাছে প্রাধান্য পায় বেশী। তাই উপভোগের খাতাটা একটু বেশিই ফাঁকা রয়ে যায়।

আর কি হয় তাঁদের, যারা যথেচ্ছা যত্রতত্র গৌস্টিং করে বেড়ায়?
– তারাও একটা উভয় সংকটে থাকে নিজের সঠিক সম্পর্কটা চিনে নেয়ার ব্যাপারে।
– যে সম্পর্কটাকে ওয়ার্কেবল করার জন্য অন্য কাউকে গৌস্টিং করেছিল, সে সম্পর্কটা যদি ওয়ার্ক আউট না করে, তখন না পারে আগেরটায় ফিরে যেতে, না পারে এটাকে টানতে।
– পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় তখনই যখন প্রেজেন্ট সম্পর্কধারী এই বলে সন্দেহারোপ করে যে, “আমার জন্য যখন অমুককে গৌস্টিং করতে পেরেছিলে, কবে না আবার তমুকের জন্য আমাকেও আবার গৌস্টিং করে দেবে!!!” (পুরাই “যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর” সিচুয়েশন…)

গৌস্টিং এমনই এক দুমুখো বিষধর সাপ যা গৌস্টার ও গৌস্টি উভয়কেই শুধু দংশনই করে না, সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়েও বেড়ায়। যদিও কেউ কেউ কিছুদিন সেই ব্যাপারটা নিজের একটা অর্জন হিসাবে গন্য করে একটা মেকি আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে………

দ্বিতীয় পর্ব: গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-২
তৃতীয় পর্ব: গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-৩

৪,৭৮৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-১”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।