আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ১

এক

জন্মগত ভাবে কেউই আত্মপ্রেমী নন।
ছোটবেলা থেকে পারিপার্শিকতার প্রভাবে এক একজনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় কিছু কিছু আত্মকেন্দ্রিক আচরন দেখা দিতে শুরু করে।
বেশীরভাগ মানুষই সেগুলি সহনিয় মাত্রায় রাখতে পারেন।
যারা তা পারেন না, তাঁরা ধাপে ধাপে আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
আত্মকেন্দ্রিক থেকে আত্মপ্রেমী – সবাই নিজের জন্য তো বটেই, অন্যদের জন্যেও নানা জটিলতা তৈরী করে। তাই এ বিষয়টা নিয়ে কিছু ধারনা থাকা মন্দ না………

আত্মকেন্দ্রিকতার সুচনাটা হয় বিপরীত ধরনের দুই পরিস্থিতির কারনে। ছেলেবেলায় পাওয়া অতি রক্ষনশিলতা/যত্ন অথবা অতি অবহেলা থেকে শিশুর মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক আচরনগুলি আসা শুরু করে। এই পর্যায়ে সেগুলোর লাগাম টেনে ধরা গেলে তা থাকে সহনিয় মাত্রায়।
কিন্তু তা করা না গেলে, একসময় যা ছিল আত্মকেন্দ্রিক আচরন, তা থেকে আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্ব বা আত্মপ্রেমি ব্যক্তিত্বের উত্তরণ ঘটা শুরু হয়।
একজনের মধ্যে আত্মপ্রেমি ব্যক্তিত্বের উদ্ভব একবার ঘটে গেলে তা থেকে আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা বা Narcissistic Personality Disorder (NPD) সৃষ্টি হওয়াটা আর খুব কঠিন কিছু থাকে না।
NPD-তে আক্রান্তগন নিজের জন্যে তো সমস্যা করেনই, তাদের কারনে অন্যদেরও অনেক সাফারিং হয়।
তাই NPD নিয়ে সবারই কিছু কিছু ধারনা থাকা দরকার যাতে করে আপনার কাছের মানুষটির NPD আছে কিনা, তা যেন বুঝতে পারেন এবং তাঁকে প্রয়োজনীয় প্রফেশনাল হেলপ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

দুই

প্রথমেই আত্মপ্রেম সম্পর্কিত ব্যক্তিত্ব জটিলতা বা Narcissistic Personality Disorder (NPD)-র লক্ষনগুলো বিবৃত করে নেই।
DSM V অনুযায়ী নীচের প্রায় সব বা বেশির ভাগই এদের মধ্যে দেখা যায়:
– এরা নিজেদের এতটাই বড় ভাবে যেজন্য অন্যদের কাছ থেকে সার্বক্ষনিক গুরুত্ব আশা করাটা এদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনেহয়।
– নিজেদের ক্ষমতা, সাফল্য, বুদ্ধিমত্তা অথবা সৌন্দর্য্য নিয়ে এরা এক কাল্পনিক সুখের সাগরে সারাক্ষণ অবগাহন করে চলে।
– এরা নিজেকে বিশেষত্ব সম্পন্ন, উচ্চমার্গিয় এবং উচ্চস্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করে থাকে।
– অন্যদের কাছ থেকে সার্বক্ষনিক প্রশংসা দাবী করে। সেটা পেতে নানান কর্মকান্ড করে যায়।
– অন্যদের কাছ থেকে বিশেষ আচরন ও আনুগত্য পাওয়াটা নিজের অধিকার বলে মনে করে।
– নিজের স্বার্থ হাসিলে অন্যদেরকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে থাকে।
– অন্যদের অনুভুতি, চাওয়া ও প্রয়োজনের প্রতি এদের কোনো রকমের গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না।
– অন্যদের প্রতি নিজে ঈর্ষায় জর্জরিত থাকে এবং ভাবে, তারাও তাঁকে নিয়ে একইভাবে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে।
– এরা সচরাচর আত্মম্ভরী ও উদ্ধত হাবভাব প্রদর্শন করে থাকে।

সমস্যা হলো, এই লক্ষনগুলি যাদের থাকে, তাঁরা নিজেরা তো অশান্তিতে থাকেই তাদের আশেপাশের ও তাদের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর জীবনও তাঁরা বিষিয়ে তোলে।

তবে কথা হলো, কেউই কিন্তু হঠাৎ করে একদিন আত্মপ্রেম সম্পর্কিত ব্যক্তিত্ব জটিলতায় আক্রান্ত হয় না। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে সে তাঁর আত্মপ্রেম সম্পন্ন ব্যক্তিত্বটা অর্জন করে।
আবার এই ব্যক্তিত্ব অর্জনটা শুরু হয় কিছু কিছু আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মপ্রেমের আচরনে অভ্যস্ত হবার কারনে।
পরবর্তি অধ্যায়ে আলোচনা করবো, এইসব আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মপ্রেমের আচরনগুলির শুরুটা কিভাবে হয়, তা নিয়ে।

তিন

মূলতঃ শৈশবের বেড়ে ওঠা এবং/অথবা বয়ঃসন্ধিকালে ঘটা ঘটনাবলি সম্পর্কিত জটিলতাই আত্মকেন্দ্রিক হবার বা তা থেকে আত্মপ্রেমে উত্তরন ঘটার কারন।
এই সময়কার অতি প্রশ্রয় অথবা অতি শাসন, দুই-ই হতে পারে এই পরিনতির উৎস।
অতি প্রশ্রয় কিভাবে এটা করে, তা বোঝা তুলনামূলক ভাবে সহজ। সেটাই তাই আগে বলি।
ঘটনাটা ঘটে “অতি আদরে নষ্ট” হবার মত করে।
শিশুটি নিজেকে সব কিছুর মধ্যমনি হিসাবে আবিষ্কার করে ধরে নেয়া শেখে, “আমার জন্যই সবাই – সবকিছু”, কিন্তু “আমি কারো জন্যই না”।
তাঁর কোনো যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, এই বোধটা তার মধ্যে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলে।
তা যদি হয়, তাহলে অতি শাসন বা অতি অবহেলায় তো তার মধ্যে এরকম হবার কথা না, তাই না?
হ্যাঁ, কথা না। কিন্তু হয়।
আর সেটা হয়, ভিন্ন এক প্রক্রিয়া মেনে।
অতি প্রশ্রয় একজনের সুপিরিয়রটি কমপ্লেক্স ঢুকাতে পারলে, অতি শাসন যে তার জন্য ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স ঢুকাবে, সেটা সহজেই বোধগাম্য।
এই ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সের কারনে সে সেলফ এসটিম হারিয়ে ফেলে।
দেখা যায়, এমন সব টার্গেট সে বা তাঁর পরিবার তাঁর জন্য স্থির করছে, যা তাঁর পক্ষে তখন আর অর্জন করা সম্ভব না।
এরকম পরিস্থিতিতে সে অন্যকোনো অবলম্বন খোজে নিজের মূল্য বোঝানোর জন্য।
আর একবার সেরকম কিছু পেয়ে গেলে তাতে লেগে থেকে সে এমনই উৎকর্ষতা অর্জন করে যেন যে তাতে সে হয়ে ওঠে সকলের মধ্যমণি। এটা হতে পারে নাচ, গান, যন্ত্রসঙ্গিত, ছবি আঁকা, লেখালেখি, উপস্থাপনা, খেলাধুলা, ইত্যাদি যেকোনো কিছু – যেগুলিতে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বা লেগে থেকে উৎকর্ষতা অর্জন করা সম্ভব। অথবা তা হতে পারে সৌন্দর্য্য চর্চ্চা জাতীয় কিছু – যেটা ঘসামাজা করে দৃষ্টিনন্দন করা যায়।
এভাবে হীনমন্যতায় ভোগা অবস্থায় একবার যখন কেউ দৃষ্টি আকর্ষনী কিছু করা শুরু করে আর সেটায় ভক্তদের সমর্থন পেয়ে তাতে উৎকর্ষ সাধন করা শুরু করে, দেখা যায়, তাঁর এই নতুন পরিচয়ের উপর ভর করে সে নতুন করে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ঢোকা শিখে ফেলে। আর এ থেকে তার আত্মকেন্দ্রিক হতে শুরু হওয়াটাও তখন খুব কঠিন কিছু আর থাকে না।
এবার আসি, আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মপ্রেমিকের পার্থক্য কোথায়, সেটা নির্ধারনে।
আত্মকেন্দ্রিক সবকিছুতেই নিজেকে মধ্যমণি জ্ঞান করে আর তা হতে পারে অন্যদের কথা না জেনেও।
আত্মপ্রেমী একইভাবে নিজেকে মধ্যমণি জ্ঞান করে কিন্তু তাঁরা তা করে অন্যদের সামর্থ জানার পরেও সেটাকে অস্বীকার করে।
এই অর্থে আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মপ্রেমী – উভয়ের আচরনে একই রকম হলেও, আত্মকেন্দ্রিক যা করে তা অজ্ঞতাপ্রসুত তাই সংশোধনের আওতাধীন।
কিন্তু আত্মপ্রেমীরা হলো জ্ঞানপাপিদের মত, তাই তারা চলে যায় সংশোধনের উর্ধে।
আবার সংশোধনের আওতায় না এসে যেসব আত্মকেন্দ্রিক আত্মপ্রেমীতে পরিনত হয়, তাঁরা তখন আর সাধারন কোনো সংশোধনের আওতায় থাকে না………

(চলবে…)

আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ২

আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৩

আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৪

আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৫ (শেষপর্ব)

৫,০২৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।