অদ্ভুত এক মানসিক অবস্থা, নাম তার “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” – (প্রথম পর্ব)

আমাদের আশেপাশে এমন অনেককেই দেখি, যারা সময় সময় কি যে উৎসাহের সাথে নানান উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন, উচ্ছাসে উল্লাসে ভরপুর হয়ে ওঠেন, আবার হঠাৎ করেই তেমন কোন কারন ছাড়াই নিজেদের গুটিয়ে নেন সব কিছু থেকে। আর তা এতটাই যে আমরা গভীর ভাবনায় পড়ি, “হলোটা কি ওর? এই না সেদিন দেখলাম, কি দারুন প্রানোচ্ছাসে ভরপুর? আর আজ………?”

অনেক সময়েই এঁদের এইসব অচরনকে আমরা “খামখেয়ালিপনা” ভেবে তাদেরকে “খেয়ালি মানুষ” আখ্যা দিয়ে তাদের এসব আচরনের সাথে খাপখাওয়ানোর চেষ্টা করে যাই। কিন্তু সেটা কি ঠিক?

আমরা কি ভেবে দেখেছি, এরকম আচরন কিন্তু “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” নামক বেশ অদ্ভুত এক ধরনের মানসিক অবস্থার কারনে হওয়া সম্ভব?
“খেয়ালি মানুষ” আখ্যায়িত করে যাঁদের আমরা ঘাটানো থেকে বিরত থাকছি, তারা যদি “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এইসব আনট্রিটেড বাই পোলার ডিজঅর্ডার আক্রান্তগন যে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুকির মধ্যে থাকেন, তাকি আমরা ভেবে দেখছি?

আমার এই লিখাটা অনেক দুঃখ আর কষ্ট বুকে চেপে লিখতে হচ্ছে।
আমি আমার পরিচিত / ঘনিষ্ট বেশ কয়েকজনের বাই পোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত থাকার কথা এমন সময় শুনেছি, যাদের বিষয়ে তখন আমার আর কোন কিছু করার ছিলো না। কারন জানাটা যখন হয়েছে, ততদিনে তারা ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন।

হ্যাঁ আমি আনট্রিটেড বাই পোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের অতিউচ্চ আত্মহত্যার হার নিয়েই কথা বলছি। চিকিৎসায় এই হার উল্লেখজনক ভাবে কমে আসে, সেকথা সত্য কিন্তু একেবারে চলে যায় না। তাছাড়া রোগ নির্নয় ও চিকিৎসা একারনেও করা দরকার যে এতে করে ঐ আক্রান্ত মানুষটির কোয়ালিটি অব লিভিং অনেক উন্নত করা সম্ভব।

বাই পোলার ডিজঅর্ডার এমন এক সমস্যা যার চিকিৎসা সারা জীবন নিতে হয়। কেবল মেডিকেশনই নয়, আশেপাশের (আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব) সকলকেই এগিয়ে আসতে হয় আক্রান্তের সহায়তায়। আর তাই এটা গোপন না করে, সবাই মিলে ভাগাভাগি করে সাপোর্ট দিয়ে আক্রান্তের উপকারে আসা যায়।

কারো মধ্যে কখনো অতিউতসাহ আবার কখনো ভেঙ্গে পড়া মনভাব দেখে সেই জন্য তাঁকে “খেয়ালি মানুষ” ভেবে ছাড় দেয়াটা হয়তো তাঁর জন্য মৃত্যু ঝুকিতে ঠেলে দেয়ার সমতুল্য একটি কাজ হয়ে দাড়াতে পারে, এটা কি একটু ভেবে দেখবো?

আজ প্রথম কিস্তিতে বাই পোলার ডিজঅর্ডারের ও এতে সংশ্লিষ্ট দুই ধরনের আচরনের কিছু পরিচিতি দেয়া যাক।

বাই পোলার ডিজঅর্ডারকে বলা হয় একটি উচ্চমাত্রার মুড সুইং পরিস্থিতি যেখানে আক্রান্ত ব্যাক্তি কখনো একটি উদ্দিপনাময় অবস্থা (ম্যানিক স্টেজ) আবার কখনো একটি বিষন্নতাময় (ডিপ্রেসিভ স্টেজ)-এর মধ্য দিয়ে চলাচল করেন।

এবার এই স্টেজগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেই।

প্রথমেই ম্যানিক স্টেজের বর্ননা
কমপক্ষে সপ্তাহখানেক থাকে। আনট্রিটেড হলে তিন থেকে ছ’মাস পর্যন্তও চলে। এইসময়ে দেহে মনে উত্তেজনা অস্থিরতা দেখা দেয়। নিচের তিন থেকে চারটি উপসর্গও প্রকট ভাবে ফুটে ওঠে
– থড়বড় করে কথার খৈ ফোটানো
– আচরনে এমন লাগাতার উল্লাস থাকে যা থামানো কঠিন
– হঠাৎ হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলা
– একের পর এক নতুন কিছু ভাবনা চিন্তা জাগিয়ে তোলা
– নতুন নতুন লক্ষ নির্ধারন, অথবা উষ্মা প্রকাশ
– ঝুকিপূর্ন কাজে আগ্রহ
– অস্বাভাবিক রকমের বেশি যৌনাকাঙ্খা
– টাকা উড়ানোর প্রবনতা, মদ্যপান, মাদকাসক্তি, সাবস্ট্যান্স এবিউজ ইত্যাদি।
– নিদ্রাহীনতা, অকারন ছটফটানি
এগুলো এত বেশি বেশি করে ঘটে যে তাতে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও সামাজিকতা বাঁধাগ্রস্ত হতে বাধ্য হয়।

এবার ডিপ্রেসিভ স্টেজ নিয়ে কিছু ধারনা
এই স্টেজটা উত্তরনের সাথে সাথে দুঃখবোধ, উৎকণ্ঠা, অপরাধবোধ, ক্রোধ, একাকিত্ব, অসহায়ত্ব ঘীরে ঘীরে ধরে।
নিজেকে অপ্রয়োজনিয়, অযোগ্য মনে হয় প্রতি পদে পদে।
এছাড়াও খাওয়ায় অরুচি, নিদ্রাহীনতা, উৎসাহহীনতা, বিব্রতবোধ, অকারন ব্যাথ্যা, উদ্যমহিনতা এমন কি মরে যাওয়ার আকাংখাও দেখা দেয়।

চলুন তো আমরা মনে করার চেষ্টা করি, আমাদের আশেপাশের কাউকে কি এমন কোন পরিস্থিতিতে দেখেছি সম্প্রতি?
যদি দেখে থাকি, আমাদের কি উচিৎ হবে না, তাদের নিয়ে, তাদের ব্যাপারে, একটু ভাবার?

আমরা কি পারি না তাদেরকে প্রোফেশনাল সাপোর্ট নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে?

অদ্ভুত এক মানসিক অবস্থা, নাম তার “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” – (দ্বিতীয় পর্ব)

অদ্ভুত এক মানসিক অবস্থা, নাম তার “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” – (শেষ পর্ব)

৪,৮০৬ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “অদ্ভুত এক মানসিক অবস্থা, নাম তার “বাই পোলার ডিজঅর্ডার” – (প্রথম পর্ব)”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    এটা নিয়ে অনেক লেখালেখি ও প্রচারনা প্রয়োজন।
    এরকম বিষয়কে গুরুত্ব না দেয়া এড়িয়ে চলা - এসব আমাদের দেশে স্বাভাবিক চর্চিত প্রকৃয়া।
    তবে নগর কেন্দ্রিক সমাজে আক্রান্তের সংখ্যা এবং এর প্রভাবিত আচরনের বিড়ম্বনা এসব বিবেচনা আর আক্রান্তের পেশাগত অবস্থানের কারনে সুস্থ্যতার তাগিদ - এগুলো মিলে চিকিৎসা গ্রহণের হার অনেক বেড়েছে।
    এটা পরিপূর্ণভাবে এক ধরনের দেহজ রাসায়নিক প্রকৃয়া।যার উৎসস্থল মানুষের মস্তিস্ক। সেখান থেকে নির্দিষ্ট রাসায়নিক উপাদানের উৎসরনের মাত্রা এই আপ সুইং আর ডাউন সুইং-এর হেতু।
    পাশাপাশি এর আচরনগত প্রভাব ও পরিবর্তিত মানসিক পরিস্থিতির প্রভাবে তা ওই রসায়নের সূত্র ছাপিয়ে আচরনকে স্বাভাবিক সীমানার বাইরে ঠেলতে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই আপন চিন্তা ভাবনা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরামর্শকের সহায়তারও প্রয়োজন তৈরী হয়।
    ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিসের মতোন এটাকে আজীবন চিকিৎসা সেবার আনুকূল্যে রাখতে হয়। তাই আর দশটা রোগের মতোন একই রকম দৃষ্টিতে দেখে এটাকে স্বাভাবিক মনযোগ দেয়া আক্রান্তের চারপাশের মানুষগুলোর কর্তব্য।

    তোর লেখাটা নিশ্চত সব কিছু ছুঁয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে। এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখার এই উদ্যোগটাকে আন্তরিক ভাবে সাধুবাদ জানাই।

    চিকিৎসক অপ্রতুলতা আর মানুষের অজ্ঞতা সামলে উঠতে এমন লেখার গভীর প্রয়োজনীয়তা মেটাবার এই উদ্যোগকে অযুত ধন্যবাদ।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      প্রথমে তাকে এটা পড়াও।
      তারপরে তাকে বোঝাও যে তার উচিত একজন প্রফেশনালের হেলপ নেয়া।
      যদি রাজি না হয়, মনে মনে রেডি হয়ে যাও একদিন তার আত্মহত্যার সংবাদ শোনার জন্য।
      বুঝাতে কি পারলাম?


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. মঞ্জুর (২০০২-২০০৮)

    ভাইয়া আমার মনে হয় এই রোগটা আমার মধ্যে আছে। মুড সুইং জিনিসটা চরমভাবে কাজ করে আমার মধ্যে। কখনো নিজেকে সুপিরিয়র লাগে, কখনো ইনফেরিয়র। কখনো প্রচণ্ডরকম কনফিডেন্স পাই। হতাশ মানুষদের উতসাহ দিয়ে বেড়াই। মানুষজন আমার কথা শোনে। আবার নিজেই চরম ডিপ্রেসড হয়ে যাই। প্রচণ্ড উদ্যম নিয়ে একটা লক্ষ্য ঠিক করি, আবার আরেক সময় কোনকিছুতেই উতসাহ পাই না। সারাদিন অনেক খাটাখাটনির পর ও রাত ২.৩০ পর‍্যন্ত জেগে আছি। ঘুম আসছে না, কমেন্ট লিখছি। কোন স্পেসিফিক বিষয় নিয়ে আমি ডিপ্রেসড না। কিন্তু এই মুড সুইং বিষয়টা আমাকে প্রচণ্ড রকমের বদার করে। এখন এই কমেন্ট লিখছি, কাল সকালেই মনে হবে, কি লিখলাম, আমার মোটেই উচিত হয়নি। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      মানুষ মাত্রই কিছু আপস এন্ড ডাউনস, কিছু মুড সুইং এসব থাকবে।
      এসব না থাকলে তো জীবনটাই নিরামিষ হয়ে যাবে, তাই না?
      তবে এই আপস এন্ড ডাউনস বা মুড সুইংটা দৈনন্দিন কাজে কর্মে বা সামাজিকতা পালনে কোন বাঁধা হয়ে দারাচ্ছে কিনা, সেট হলো লক্ষ করার জিনিষ।
      আবার যাঁদের বাই পোলার ডিস-অর্ডার থাকে তাদের ম্যানিক স্টেজে প্রকট ধরনের মুড-সুইং হতে দেখা যায়।
      এখন কথা হলো, মুড সুইং মানেই বাই পোলার না। তবে বাইপোলারে মুড-সুইং থাকে।
      আর আপস এন্ড ডউনস অথবা মুড সুইংটা সেরকম প্রকট কিছু কিনা, সেটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার।
      যদি এটা সেরকম তীব্র বলেই মনে হয় যে জন্য দৈনন্দিন কাজকর্ম বাঁধা গ্রস্ত হচ্ছে অথবা সামাজিকতা রাখা যাচ্ছে না, তাহলে একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলে নেয়াটা খুবই ভাল একটা অপশন।
      তারা এই মাত্রাটা গ্রহনযোগ্য কিনা বলতে পারবেন।
      আর তা গ্রহনযোগ্য না হলে, সাইকিয়াটিস্টের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে।

      আমি নিশ্চিত, সুষ্ঠু চিকিৎসা নেয়া হলে কোয়ালিটি অব লাইফ অনেক উন্নত হতে বাধ্য.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  3. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    খুব গুরুত্বপুর্ন একটা বিষয় নিয়ে চমৎকার একটা লেখা। বাকিটাও তাড়াতাড়ি লিখে ফেলেন ভাই।
    :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন
  4. অনেক সুন্দর একটা টপিক। এর আগে পড়া হয় নাই। অটিজম, স্পেসালিজড চিল্ড্রেন ইত্যাদির মতো এই বাইপোলার ডিস অর্ডার নিয়েও জন সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। এটা সাভাবিক মনে হয় কিন্তু সাইলেন্ট কিলারের মতো একটা ব্যাপার। বাইপোলার ডিস অর্ডার ব্যক্তিটি যদি কোনো কারনে সমাজে একটু হাই প্রোফাইলের ব্যক্তিত্ত হন, তাহলে তাকে বাইপোলার হিসাবে না বুঝার কারনে অন্যান্যরা খুবই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে তাদের হুইমজিক্যাল অতি উতসাহ কিংবা অতি নীরবতার কারনে। এই জন্য কোন কোন সিম্পটম গুলি বাইপোলার ডিস অর্ডার হিসাবে ধর্তব্য সেগুলি কারেক্টলি আইডেন্টিফাই করার জন্যই জন সচেতনতা গড়ে তোলা আবশ্যক।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।