বাঙ্গালনামা

অনেক অনেক দিন আগের কথা। রাম-রাবণের যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। স্বর্ণলঙ্কা পুড়ে ছাই। বিজয়ীরা কেউ রং ছিটাচ্ছে, কেউ পটকা ফোটাচ্ছে, কেউবা আবার রংমহলে আনন্দ উল্লাসে মাতোয়ারা। চারিদিকে বিজয়ী পক্ষের বীরদেরকে নানান মাপের পুরষ্কার প্রদান ও গ্রহনের ছড়াছড়ি চলছে। আনন্দ আর উত্তেজনার আতিশয্যে দেবতাগনও একফাঁকে কয়েকজনকে অমর বর দিয়ে দিলেন। একবার এই বর পেলে তাঁকে আর কোনোদিন মরতে হবে না। হনুমান থেকে শুরু করে বিভীষণ পর্যন্ত অনেকেই পেয়ে গেলেন সেই অমূল্য বর। কি আনন্দ কি আনন্দ!

বিভীষণের এই অমরত্ব প্রাপ্তির খবর শোনার সাথে সাথে রামের মুখ চোখ গেল অন্ধকার হয়ে। তিনি বিচক্ষণ মানুষ, মুহূর্তে বুঝে ফেললেন কী ভয়ানক একটা ব্যাপার ঘটে গেছে! এই ঘরের-শত্রু এখন থেকে অমর! আজ সে নিজের দেশ লঙ্কাপুরী পুড়িয়েছে, একে ঘরে রাখলে আগামী কাল সে আমার ঘরেও নিশ্চিত আগুন দেবে। তাঁকে অমরত্ব দেয়ার খেসারত অনন্তকাল ধরে সমগ্র দেশবাসীকে বয়ে বেড়াতে হবে।

কিন্তু বর আর অভিশাপ হল টিউবে রাখা টুথপেস্টের মত, একবার বের করলে আর ভিতরে ঢুকানো যাবে না। এখন উপায়? সভাসদ-পারিষদ-উপদেষ্টামণ্ডলী সবাই মিলে অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে একটা উপায় বের করলেন।
বিভীষণকে ডেকে রাম বললেন, “হে মহাত্মন! তোমার কাজে আমি অতিশয় প্রীত। তাই ইনাম স্বরূপ তোমাকে আমি গৌড় অঞ্চলের শাসনভার দিতে চাই। বড়ই পবিত্র সে ভুমি, পঞ্চ পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাস কালে ওখানেই ছিলেন। সেখানকার ভীমের জাঙ্গাল আজও সেখানে পাণ্ডবদের আগমনের সাক্ষ্য বহন করে। সুজলা সুফলা সে দেশের মানুষগুলোও খুবই ভালো, নরম মনের। তাঁরা কোনোদিন পররাজ্য আক্রমন করেনি। অন্যদের হাজার অত্যাচার অনাচার মুখ বুজে মেনে নিয়ে গান গেয়ে দিন কাটায়। যাও সেখানে গিয়ে বসত কর অনন্তকাল আর মনের আনন্দে খাও দাও ফুর্তি কর।”

মফঃস্বলে পোস্টিং পেয়ে যথারীতি বিভীষণ মনে মনে ভীষণ রকমের অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু কি আর করা? রাজার আদেশ শিরোধার্য্য করে পত্রপাঠ রওনা দিলেন গৌড় রাজ্যের পানে। তখনকার দিনে তো আর ক্যামেরা হাতে পাপারাৎজিরা ছিল না, আর গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডও ছিল না। তাই কেউ আর খুব একটা বেশিদূর বিভীষণের খবর কিংবা ঠিকানা রাখেনি। একসময় ইতিহাসের পাতা থেকে বেমালুম হারিয়ে গেলেন বিভীষণ, কি ভীষণ! কি ভীষণ!
তবে তিনি যে ঠিকই গৌড় রাজ্যে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন তা আজ প্রমানিত সত্য। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এতদঞ্চলের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের মাঝে বিভীষণের জিনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এত ছোট একটা ভূখণ্ডে তাঁর বংশধরদের এহেন অস্বাভাবিক ব্যাপক সংখ্যাধিক্য দেখে প্রত্নতত্ববিদেরা তাঁর বঙ্গে আগমনের ব্যাপারে একেবারে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছেন।

সেকালে এখানে বাস করত আমার পূর্বপুরুষেরা, তাঁরা ছিলেন আদিবাসি-দ্রাবিড়-পুণ্ড্র-কৈবর্ত-প্রাকৃতজন। তাঁরা অমর বিভীষণের আগমন ও শেকড় গেঁড়ে বসাটাকে বেশী কিছু না বলেই মেনে নিয়েছিলেন। এরপরে যুগ যুগান্তর ধরে তাঁর ও তাঁর সন্তানদের যাবতীয় কুকর্মের ঝড়-ঝাপ্টা বাঙালীদের উপর দিয়েই বয়ে গেছে। ঠিক নীলকণ্ঠের মত, বিভীষণের বিষে নিজেরা বিষাক্ত হয়ে জগতের অন্যদেরকে বাঁচিয়েছেন। বেশী কিছু না বলেই তাঁরা সব মেনে নিয়েছিলেন।
এ পর্যন্ত যা বলেছি তা নিছকই গল্পকথা, কিন্তু এরপরের গুলো সবই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। সবক্ষেত্রে একেবারে ঠিক ঠিক সঠিক হয়তো না ও হতে পারে, তবে কথাগুলো সবই বাস্তব।

কালের প্রবাহে এ মাটিতেই জন্মে বুদ্ধ, জন্মে দীপঙ্কর, জন্মে লালন। তাঁরা মানুষকে হাসিমুখে শান্তি পেতে শিখিয়েছেন, হাসিমুখে শান্তি দিতে শিখিয়েছেন। আজ আমাদের দেহে বিভীষণের রক্ত যেমন আছে তেমনি আছে বুদ্ধ কিংবা দীপঙ্কর কিংবা লালনের ও রক্ত।

এরই মাঝে এক সময়ে এসেছিল দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার। যীশুর জন্মের প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর আগের ঘটনা। সারা পারস্য তছ-নছ করে, সারা ভারতবর্ষকে পদ-দলিত করে এই দিগ্বিজয়ী পৌঁছছিল বাংলার সীমান্তে। কিন্তু নদী পেরিয়ে বাংলার ভেতরে পা রাখার সাহস হয়নি তাঁর। শুধু লালন-দীপঙ্কর নয়, এদেশে ভালো যোদ্ধাও তৈরি হয় দেখছি! দেশ মাতার জন্য হাসিমুখে প্রান দিতে দ্বিধা করে না। সত্যিই কি বিচিত্র এই দেশ! দুঃসাহস দেখানোর বোকামি না করে আলেকজান্ডার যাত্রা করেন উত্তর অভিমুখে, সে যুগের বাংলাকে পাশ কাটিয়ে। আমাদের উচিত ছিল পাল্টা আক্রমন করে সেই যুদ্ধবাজ ভিনদেশী কে একটা যথাযথ শিক্ষা দেয়া। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা বেশী কিছু না বলেই তাঁকে চলে যেতে দিলেন। আক্রান্ত না হলে অন্যকে আক্রমন করা আমাদের ধাতে নেই যে! বেশী কিছু না বলেই তাঁরা সব মেনে নিয়েছিলেন।

প্রায় হাল আমলেরই কাহিনী। অমর বিভীষণের এক সুপারস্টার সন্তানের সহায়তায় একদল ব্রিটিশ জল-বৈশ্য কব্জা করে নিল বাংলার শাসনভার। ধীরে ধীরে পুরো উপমহাদেশ, ক্রমান্বয়ে প্রায় গোটা বিশ্ব চলে এল তাঁদের করতলে। কিন্তু এর মাঝেই বাংলা হয়ে উঠল উপমহাদেশের শিক্ষা-সভ্যতা-শিল্প-জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-প্রগতি – এক কথায় সব কিছুর কেন্দ্রস্থল। একসময় ইউরোপের সাথে পাল্লা দিতে লাগলো।

দেরিতে হলেও টনক নড়ল ব্রিটিশ রাজের। তাঁরা এদেশে এসেছিল সবকিছু শুষে নিয়ে যেতে, নিয়েছেও কাঁড়ি কাঁড়ি ধন রত্ন অর্থ কড়ি। কিন্তু তাঁদের জ্ঞান-গরিমা আর সভ্যতা নিয়ে যে গর্ব, যে আত্মতুষ্টি, সেখানেই আগামী দিনের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভাব বাঙালীদের। রানী মৌমাছি যেমন আরেকটা রানীকে জন্মানোর আগেই ডিমের ভেতর থাকতে মেরে ফেলে, ঠিক তেমনি বাঙ্গালীকেও স্বরূপে আবির্ভূত হবার আগেই বিনাশ করার উদ্দেশ্যে মাঠে নেমে গেল পূর্ণ উদ্যমে।

সেই অতি-পুরোনো কৌশল, ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাঙলো বাংলাকে। অবলীলায় বঙ্গবিদ্বেষী অবাঙ্গালীদেরকে জুড়ে দিল দুই বাংলার সাথেই। বাঙালীরা পাঁচ-ছয় বছর ধরে গান গেয়ে আর কবিতা লিখে প্রতিবাদ করে চলল। অবশেষে রদ হল বঙ্গভঙ্গ। আমরা পেলাম অমর গান – “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ব্রিটিশরা হাল ছেড়ে দেবার জাত নয়।

আর কিছু না পেয়ে ভারতবর্ষের রাজধানী সরিয়ে নেয়া হল দিল্লীতে। এ যেন ভরা নদীতে বাঁধ দিয়ে তার গতিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বেশী কিছু না বলেই তা মেনে নিয়েছিলেন – যত যাই হোক, বঙ্গভঙ্গ তো রদ করা গেল! কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা – চার দশক না পেরোতেই বঙ্গ আবার ভঙ্গ হল। এবার একেবারে পাকা পোক্ত ভাবে – আবারও সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে। আগেই বলেছি, ওরা হাল ছেড়ে দেবার জাত না। আমার পূর্বপুরুষেরা বেশী কিছু না বলেই তা মেনে নিয়েছিলেন।

বাঙালী ফজলুল হক, ফার্সি উপাধি ‘শের-ই-বাংলা’, বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দিতে হবে। সেদিন আমরা হয়ত না বুঝেই ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম তাদের দীর্ঘ দিনের সযত্নলালিত স্বপ্ন পুরনের মহামন্ত্র। খুশীতে আটখানা হয়ে তাঁরা লুফে নিল সেই সুযোগ। সোমাসক্ত গুজরাটি-বিলাতি ব্যারিস্টার জিন্নাহকে নামিয়ে দিল মাঠে। শুরু হয়ে গেল দারুন মজার খেলা – ব্যারিস্টার বনাম ব্যারিস্টার, গান্ধী বনাম জিন্নাহ, কংগ্রেস বনাম মুসলিম লীগ, সেক্যুলারিজম বনাম ইসলাম। শের-ই-বাংলার কনসেপ্ট, ঢাকার নবাবদের হাতে সূচনাকৃত, বাঙালীর করা আন্দোলন – সব কিছু অবমূল্যায়ন করে পুরো আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গেল জিন্নাহ ও তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গদের হাতে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বেশী কিছু না বলেই তা মেনে নিয়েছিলেন। আশা করেছিলেন পাকিস্তান কায়েম হলে থাকবেনা আর কোনও বিভেদ বৈষম্য। বেশী কিছু না বলেই তাঁরা সব মেনে নিয়েছিলেন।

হিন্দু-মুসলমানে অনেক দাঙ্গা হলেও, আংরেজের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই না করেই “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” কায়েম হয়ে গেল। সম্পূর্ণ আলাদা দুটি ভূখণ্ড, আলাদা সংস্কৃতির দুই সমাজ নিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে তৈরি হল পাকিস্তান। ঠিক যেন সুকুমার রায়ের ছড়ার বক আর কচ্ছপের সংকর – বকচ্ছপ। বাংলা ভাঙলো আবার। মুসলমানের বাংলার নতুন নাম হল পূর্ব পাকিস্তান, সাথে বিহার/উত্তরপ্রদেশ থেকে এল না-বাঙ্গাল এর দল। বাপ-দাদার ভিটা ছাড়তে না চাইলেও লাখ লাখ হিন্দু-বাঙালীকে চলে যেতে হল হিন্দুর বাংলা – পশ্চিম বঙ্গে। ভেঙ্গে গেল বাঙালীর ভুমি, ভেঙ্গে গেল বাঙালীর সমাজ, ভেঙ্গে গেল বাঙ্গালীর সহস্রবর্ষের সার্বজনীনতা ও পরমত সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোপিত হল সাম্প্রদায়ীকতার বীজ। বাংলা হয়ে গেল হিন্দুয়ানী ভাষা, রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে গেল কাফেরের গান। আমরা পেলাম পেয়ারা পাকিস্তান!

ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান – একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেদেশের শতকরা ৫৬ জন মানুষ বাঙালী। অথচ এই “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের” একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানো হল উর্দুকে – যে ভাষার বলতে গেলে নিজস্ব কোন বর্ণমালাই নেই! আরবি হরফে হিন্দি আর তার সাথে দু এক চিমটি পার্সি, তুর্কি, আরবি আর গ্রীক শব্দের এক অনন্য মিশেল! সেখানে সারা দেশে খুঁজে পেতে শতকরা ২৫ জন উর্দুভাষী মানুষ পাওয়া যায়নি! আমার পিতৃপুরুষেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন, আন্দোলন করেছিলেন। দাবী তুলেছিলেন – উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। বুকের রক্ত দিয়ে সে দাবীর কিছুটা আদায়ও করাছিলেন। অথচ, আমাদের বলা উচিত ছিল, “আগে বাংলা হবে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রভাষা, তারপরে বিবেচনা করা যাবে দ্বিতীয়-তৃতীয় রাষ্ট্রভাষা কে কে হতে পারে।” আর ওদিকে ভারতের কাহিনিও কিন্তু কম মজাদার না, সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে “জাতীয় সঙ্গীত” বানানোর মত গান কোথায়? – বাংলায়। “জাতীয় কবি” বানানোর মত মানুষ কোথায়? বাংলায়। প্রধান “জাতীয় ভাষা” বানানোর মত ভাষা কোনটি? – বাংলা …নো নো না না নেহিইইই… হামারা প্রাইমারি ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ হবে হিন্দি এন্ড আংরেজি! তবে তাঁরা সৌজন্য হিসাবে বাংলাকেও তাঁদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। তাই সই, এটুকুই বা কে দেয়? তাই আমার পিতৃপুরুষেরা আর বেশী কিছু বলেন নি। বেশী কিছু না বলেই তাঁরা সব মেনে নিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের প্রথম সাধারন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাঙালীদের জোট সরকার গঠন করল। আমাদের উর্দুভাষী পাক বেরাদরেরা “কেয়া হুয়া? ক্যায়সে হুয়া?” বলে হুক্কা হুয়ার মাতম লাগিয়ে দিলেন। উর্দুভাষীদের সেই অন্তরজ্বালা জুড়াতে এগিয়ে এল উর্দিওয়ালাদের দল। দুই মাস না যেতেই গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে বন্দুক দিয়ে উৎখাত করে চালু হল সামরিক শাসন। প্রায় দেড় যুগের আন্দোলন-সংগ্রামের পর আবার নির্বাচন ১৯৭০ এ। আবারও বাঙালীর বিজয়। কিন্তু একজন “আনকালচার্ড” বাঙালী শেখ মুজিব হবে পাকিস্তানের সরকার প্রধান! কাভি নেহি! মাথায় রক্ত উঠে গেল “রইস আদমি” ভুট্টো সাহেবের। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার রণ-হুঙ্কার দিলেন। উর্দিওয়ালাকে দিয়ে রাতের আঁধারে গনহত্যায় মেতে উঠলেন। “ইসলাম গেল! ধর্ম গেল!!” বলে মুখে ফেনা তুললেন আর বাঙালীর রক্তে হোলিখেলায় মেতে উঠলেন সেই সব হুইস্কি-পায়ী ইসলামের রক্ষকগন! “মানুষ চাই না, মাটি চাই” – মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে চালিয়ে গেল বাঙালী-নিধন-যজ্ঞ। তাঁদের সাথে যোগ দেয় বাংলার বুকে জন্ম নেয়া কিছু বেজন্মা কুলাঙ্গার। বাঙালীনিধনে আর বীভৎসতায় ওরা ছিল পাকসেনাদের চেয়েও কয়েকগুন সরেস। বিভীষণের বঙ্গে-আগমন-তত্ত্ব আরেকবার প্রমানিত হল। তবে না, এবার আর আমার পিতৃপুরুষেরা অল্প কথায় ছেড়ে দেননি। উল্টা ঠ্যাঙানি দিয়ে (স্বঘোষিত) বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সেনাবাহিনীকে নাকে খত দিতে দিতে বাংলা-ছাড়া করেছিলেন। এখনও তারা লাথি খাওয়া নেড়ি কুত্তার মত দূরে বসে কেঁউ কেঁউ করে। আর রাতের আঁধারে সিঁদ কাটার সুযোগ খোঁজে।

স্বাধীনতার চার বছর যেতে না যেতেই রাতের আঁধারে খুন করা হল বাঙালীর স্বাধীনতার প্রধান রূপকারকে। জেলখানায় হত্যা করা হল চার নেতাকে যাঁরা কিনা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁদের অসাধারন মেধা-প্রজ্ঞা-সাহস-দেশপ্রেম আর বিচক্ষণতা দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাকে চালিয়ে নিয়ে মাত্র নয় মাসের মাথায় বিজয় এনে দিয়েছিলেন! জাতীয় সংহতির নামে শুয়োরের সাথে সহবাসের ফর্মুলা নিয়ে এলেন আরেক উর্দিওয়ালা। রাষ্ট্র ক্ষমতায় জেঁকে বসল পাকিস্তানের ভূত আর বিভীষণের সন্তানসন্ততিরা। খুনিদেরকে পুরস্কৃত করা হল, দায়মুক্তি দেয়া হল। আর নতুন ফরমান বাজারে এল, বলা হল মুক্তিযুদ্ধ অনেক পুরানো ঘটনা, সব বিবাদ ভুলে গিয়ে কুলাঙ্গারদের সাথে মিলে মিশে থাকতে হবে। আর রাতের আঁধারে শুরু হল মুক্তিযোদ্ধা নিধন – ক্যান্টনমেন্টে এবং বাইরেও। আহা! কি চমৎকার জাতীয় সংহতি! শুরু হল অষ্টপ্রহর ধরে দশমুখে মিথ্যা প্রচারনার ফুলঝুরি। গোয়েবলসের প্রেতাত্মাকেও লজ্জায় ফেলে দিলেন তাঁরা।

বাঙালী জাতীয়তার স্থানে বাংলাদেশী জাতীয়তা আমদানী করা হল। জয়বাংলায় লাথি মেরে জিন্দাবাদ কায়েম করা হল। ঘটনাক্রমে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা এক মেজরকে জাতিরপিতার চেয়ে বড় বানিয়ে প্রচার করা হল। পালিয়ে যাওয়া শকুনদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হল, যথাযথ তমীজ সহকারে তাঁদেরকে এদেশের নাগরিক বানানো হল। এরকম অগনিত তুঘলকি কাজ কারবার চলতে থাকলো দুই দশকের অন্ধকারের রাজত্ব জুড়ে। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের চেয়ে রাজনীতির অঙ্গনে দুর্বৃত্ত আর দৃষ্টি-মনোহরদের আধিক্য আর দাপট সমানে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো। আমার প্রজন্মের বড়রা বিশ্ববেহায়াকে তাড়ানোর পর থেকে গত দুই দশকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও দেশে একটা গনতন্ত্রের চর্চা চলেছে। দেশের মানুষ অজ্ঞতা, অসচেতনতা, আর দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। অথচ এখন আবার দেখি সেই পুরোনো ধর্ম ব্যাবসায়ীদের আস্ফালন, আবার শুনতে পাচ্ছি সেই পুরোনো গৎবাঁধা বুলি – “ইসলাম গেল! ধর্ম গেল!!” এবারও কি বেশী কিছু না বলেই সব কিছু মেনে নেয়া হবে?

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের একটি ঘটনা – জাহাজে চেপে রেঙ্গুন যাচ্ছেন শ্রীকান্ত। জাহাজের ইংরেজ ডাক্তার সব সময় বাঙালী খালাশীদের দেখলেই অকাতরে লাথি-চড়-থাপ্পড় মারতেন। না পেরে একদিন ডাক্তারের কাছে তাঁর এহেন আচরনের ব্যাখ্যা চাইলেন শ্রীকান্ত। ডাক্তার দাবী করলেন, এমনটি করলেই নাকি ওই বাঙালীরা খুশি হয়। শ্রীকান্তর তীব্র আপত্তি-উষ্মার প্রেক্ষিতে ডাক্তার তাকে নিয়ে গেলেন জাহাজের ডেক এ। চার-পাঁচ জন বাঙালী খালাশী সেখানে কাজ করছিল। ডাক্তার গিয়ে তাদের পশ্চাদ্দেশে দমাদম কয়েকটা লাথি মারলেন। ওরা দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে লাগলো। আরও কয়েক দফা লাথি-চড় মারার পরে শ্রীকান্তকে বলল, এখন প্রমান হল তো? যে যেটার উপযুক্ত, তাকে সেটাই দিতে হয়! ক্ষিপ্ত-বিমর্ষ-হতাশ-বাকরুদ্ধ শ্রীকান্তকে রেখে ডাক্তার চলে গেলেন। খালশীর দল তখনও পশ্চাদ্দেশ মালিশ করছে আর নিজেদের মধ্যে ফ্যা ফ্যা করে হাসাহাসি করছে। শ্রীকান্ত তখন স্থীর থাকতে না পেরে ধমক দিয়ে বললেন – “হাসছিস কেন বেহায়ার দল! লজ্জা করে না?” – আর যাবে কোথায়? সাথে সাথে তাদের পৌরুষত্ব জেগে উঠলো, মানবাধিকারে তীব্র আঘাত লেগে গেল! ডাক্তার লাথি মেরেছে, আরও হাজার বার মারবে। কিন্তু সেটা নিয়ে অপমান করার তুমি কে হে? এবং এহেন অপমানের দাঁত-ভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সদলবলে তেড়ে এল শ্রীকান্তর দিকে। সেযাত্রায় তাকে দৌড়ে পালিয়ে মান বাঁচাতে হয়েছিল কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না।

দিন অনেক বদলে গেছে। সেদিন ডাক্তারের সাথে তর্ক করার জন্য শ্রীকান্তকে কোনও বাঙালীর কাছে গালি শুনতে হয়নি। কিন্ত আজ পাকিস্তানকে ৭১ এর বর্বরতার জন্য ক্ষমা চাইতে বললে একদল বাঙালীর আঁতে পাকিস্তানীদের চেয়ে তিনগুন বেশী তীব্র ঘা লাগে। এহেন ‘অন্যায়’ ও ‘অপ্রীতিকর’ আবদারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের চেয়ে বেশী উৎসাহ নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন, জ্ঞান-গর্ভ বক্তৃতা লেখালেখি করেন। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে যুক্তি-তত্ত্ব-তথ্য দেন। জাহাজের সেই খালাশীরা আজ ঝাড়ে-বংশে বৃদ্ধি পেয়ে সংখ্যায় অনেক হয়েছে। সমাজের উচ্চ-শিক্ষিত মহলেও তাঁদের কমতি নেই।

তবে আসল কথা হল, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সদিচ্ছার হেরফেরের কারনে একই আচরনে ভিন্ন ফলও হতে পারে। ভুরি ভুরি উদাহরন আছে ইতিহাসে। ওরা যখন কাটতে কাটতে ইস্টার আইল্যান্ডের শেষ গাছটাও কেটে ফেলল তখন সেখানকার আম জনতাও হয়তো বেশী কিছু না বলেই তা মেনে নিয়েছিলেন। আবার মাহাথির যখন গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা – এসবকে বছরের পর বছর কাঁচকলা দেখিয়ে তিলে তিলে দেশটাকে উন্নতির চরমে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনও মালয়েশিয়ার আম জনতা বেশী কিছু না বলেই তা মেনে নিয়েছিলেন। আমি আশাবাদী মানুষ, আশা করতে চাই, আমাদের এই বেশী কিছু না বলার অভ্যাসটা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনুক।

কিছু বাংলাদেশি আজকাল বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমনের দিনটাকে ঘটা করে পালন করে থাকেন। বিভীষণের বঙ্গে আগমনের দিন তারিখ জানা থাকলে আমিও একটু ধূপ-ধুনা-আগরবাতি জ্বেলে, আর গোলাপজল ছিটিয়ে দিনটা পালন করতাম।

৫,৩৩৮ বার দেখা হয়েছে

৩২ টি মন্তব্য : “বাঙ্গালনামা”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমার কাছে এর সব কিছুই জানা।
    তারপরেও এত ক্ষুদ্র পরিসরে এতটা গুছিয়ে লিখার কারনে মনে হলো যেন নতুন করে অনেক অজানাকে আবিষ্কার করলাম।
    যারা ঘটনা পরম্পরা পুরোটা জানে না, সেইসব তরুনদের মিসিং ব্রিক খুজে পেতে এই লিখাটা খুবই সাহায্য করবে।
    সাব্বাশ মুজিব। নামের প্রতি যথার্থ সুবিচার করেছো।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      থ্যাংকস পারভেজ ভাই।
      আসলে অভ্যাসটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। আমার ছেলেবেলায় তিনি ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতি-সাহিত্য-বিজ্ঞান - এসবের বড় বড় বিষয়গুলো এভাবে গল্প বলার ঢং এ আমার কাছে সহজ-সোজা করে তুলে ধরতেন। ইতিহাস ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় সাবজেক্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাংঘাতিক রকমের অনুরক্ত ছিলেন অথচ কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত্ ছিলেন না। তাঁর এই গল্প বলার ধরনটা আমাকে অসম্ভব রকম মুগ্ধ করতো। তারই ছিটেফোঁটা আমার জিনেও চলে এসেছে মনে হয়।


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    (১) কোন লাইনটি ছেড়ে কোনটি উদ্ধৃতি দিব বুঝতে পারছি না। আপাতত এটা খুব ভাল লাগছে

    কিছু বাংলাদেশি আজকাল বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমনের দিনটাকে ঘটা করে পালন করে থাকেন। বিভীষণের বঙ্গে আগমনের দিন তারিখ জানা থাকলে আমিও একটু ধূপ-ধুনা-আগরবাতি জ্বেলে, আর গোলাপজল ছিটিয়ে দিনটা পালন করতাম।

    (২) বয়সে ছোট মানুষ তাই যখন বয়সে বেশখানিকটা বড় কাউকে মোটামুটি প্রলাপ পর্যায়ের কথা বলতে দেখি তখন উনি কোন দশকে কৈশোর ও তারুণ্য পার করেছেন সেটা খোঁজার চেষ্টা করি। কেন জানেন? এই কারণেঃ

    মেধাবী ছেলে-মেয়েদের চেয়ে রাজনীতির অঙ্গনে দুর্বৃত্ত আর দৃষ্টি-মনোহরদের আধিক্য আর দাপট সমানে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো।

    উর্দিওয়ালা যথার্থই বলেছিলেন, "I will make politics difficult for politicians." এই ডিফিকাল্ট পলিটিক্সের অভিশাপ আজকেও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি কারণ সেই সত্তর ও আশির দশকের তরুণ সমাজ যারা জানতে অজানতে পঁচে গিয়েছিলেন তারা আজ দুই পায়ের নিচে লেজ লুকিয়ে রেখে প্রলাপ বকেন।

    (৩) ব্লেম গেম খেলতে অনেকেই নিরুৎসাহিত করে সামনের দিকে তাকাতে বলেন। নিজেরটা করে দেখাতে বলেন। আরো কত কিছু। আমার কাছে সেইসব ব্যক্তিবর্গ আরেক কমিকাল রিলিফ। ভুলটা কোথায় করে এসেছি সেটা লাল কালির কলম দিয়ে গোল্লা দিয়ে দেখিয়ে না দেয়া পর্যন্ত সামনের দিকে তাকানো আর নিজেরটা নিজে করতে বলাটা পলিটিক্স ডিফিকাল্ট করার আরেকটি প্রচেষ্টা মাত্র। এটাকে দায় এড়ানোর চেষ্টাও বলা যেতে পারে। সমস্যা হলো এই ব্যক্তিবর্গ তখন দার্শনিক পর্যায়ে চলে যান। কোনটা ভুল কোনটা সঠিক সেটা বলতে পারার ক্ষমতাকে, নিজের বিচার বিবেচনাকে প্রশ্নবিদ্ধ তথা ডিফিকাল্ট করে তোলেন তারা।

    (৪) আপনি আশাবাদী মানুষ। আর আমি আশা-নিরাশার মাঝে ৯টা-৫টা অফিস করি প্রতিদিন। বয়সের দোষ হয়তো। অন্তত তারপরেও আপনার সাথেই বলতে চাই,

    আমাদের এই বেশী কিছু না বলার অভ্যাসটা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনুক।

    অসাধারণ একটি লিখা। বহুদিন পর "প্রিয়তে যোগ করুন" বাটনটি ব্যবহারের সুযোগ পেলাম।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      "এখন রাজনীতিবিদদের জন্য পলিটিক্স বড়ই সহজ বানিজ্য, আর জনগনের জন্য পলিটিক্স হয়ে গেছে কঠিন" - এইরকমের একটা থীমের উপরে একটা লিখা শুরু করেছিলাম মাস খানেক আগে। এখনো শেষ করা হয়ে ওঠে নাই।
      রাজনীতি নিয়ে লিখালিখি করি বলে বন্ধুরা বকাবকি করে গাল পেড়েই ক্ষান্ত হয় না, আজকাল দেখি সামাজিক অনুষ্ঠানেও ডাকে না।

      গেট-টুগেদারে জানায় না। রাত বিরাতে বার্থডে উইশ করতে আসা দূরে থাক, ফোনও করে না। আর কি কি প্রমান দেখালে বিশ্বাস হবে, রাজনীতিই করাই শুধু না, রাজনীতি নিয়ে ভাবাটাও একটা অপরাধ জনগনের জন্য।

      এরপর যখন শীর্ষ নেতৃত্বে থাকাদের বলতে শুনি "রাজনীতিবিদ্গনই রাজনীতি করুক, বাকিরা দূরে গিয়ে মরুক......" তখন সত্যিই মনে হয়, "হায় রাজনীতি, তুমি কার? কেবলই কি এলিটগণের?"


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু উনার কঠোর পরিশ্রমের ফসলে উল্টে গিয়েছে দাবার গুটি। আপনার মতন এই হতভাগা মনে হয় সব ব্যাচেই থাকে। আপনার মন্তব্যগুলো পড়তে পড়তে আমার ব্যাচের হতভাগা (একজনই আছে মনে হচ্ছে) একজনের কথা মনে পড়লো। বয়কট করা এখনো তাকে শুরু করা হয় নাই। তবে সুযোগ পেলেই তাকে বকবকি গাল মন্দ করতে ছাড়ে না। ওর সমস্যা হলো সরকারে চাকুরে হয়েও কনস্ট্রাক্টিভ ক্রিটিসিজম ফলাতে যায়। ফলাফলঃ দুই পক্ষের গোলাগুলির একদম মাঝে! 😀


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        লিখাটা শেষ করেন ভাই। আমরা কিছু যারা গুটি কয়েক আছি কিছুটা নাহয় শিখি। অন্তত নিজেকে বলতে পারবো যে চেষ্টা করেছি জানতে, বুঝতে।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
        • পারভেজ (৭৮-৮৪)

          শেষ করা যাবেখন।
          প্রথম অংশটা পড়ে দেখো না ততক্ষন...

          “আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্যা পলিটিশিয়ানস” – এই কথাটা সত্যিই কেউ বলেছিলেন কি না, তার কোন দালিলিক প্রমান কোথাও দেখি নাই। তবে দীর্ঘদিন ধরেই একজন প্রয়াতঃ সেনানায়ক টার্ন্ড পলিটিশিয়ানকে এই উক্তির জন্য যে কৃতিত্ব দিয়ে আসা হচ্ছে, সেটা সর্বজনবিদিত।
          ভাগ্যিশ উনি বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে ওনার সেই প্রচেষ্টাটি যে কতটা ব্যার্থতার রূপ নিয়েছে, তা দেখে হয়ত ওনার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা হতো না।
          প্রসঙ্গটার উল্লেখ এইজন্য যে আজকাল রাজনীতি রাজনীতিবিদগণের জন্য সত্যিই খুব সহজ একটা কাজ হয়ে পড়েছে। কোন প্রতিযোগিতা নাই, ফুল মনোপলি। যার যা খুশি, যেখানে খুশি বলতে পারেন। পক্ষে গেলা ফুল ক্রেডিট নেয়া যাবে। বিপক্ষে গেল বললেই হল: ১) বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে বা খুব বেশী হলে, ২) বক্তব্য প্রত্যাহার করলাম।
          কোন জবাবদিহিতা নাই, তারা যা খুশি করতে পারেন। ভরা মাহফিলে “ক্যাশ চাই ক্রেস্ট নয়” বলতে পারেন। ক্যাশ পেলে হে হে বলে সেটা পকেটে ঢুকাতে কোন বাধা নাই। আর না পেলে বা সমালোচিত হলে বললেই হলো, “আরে মিয়া মস্করাও বোঝেন না”। কেস ডিসমিসড। আসামি খালাস।
          তবে হ্যাঁ, রাজনীতি কিন্তু কঠিন হয়ে গেছে একটা গোষ্ঠির জন্য। এবং তা খুবই কঠিন। তারা হলো জনগন। ঐ উক্তির নতুন ভার্সান তাই এখন: “উই হ্যাভ মেইড পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্যা পিপল”। আর এটা বলছেন কে? এটা বলছেন ডান-মধ্য-বামপন্থি থেকে শুরু করে উদার-রক্ষন-উগ্রপন্থি সকল রাজনীতি সংশ্লিষ্টগণই। এনাদেরে মধ্যে নানা বিষয়ে নানা বিরোধ, মতের-পথের অমিল। কিন্তু একদিকে কঠোর ঐক্যমত। আর তা হলো: রাজনীতিকে কিভাবে জনগনের ধরাছোয়ার বাইরে ঠেলে নেয়া যায়। মধ্য সত্তুর থেকে একযোগে সেই যে ঠেলা শুরু হয়েছে, রাজনীতি এখন সত্যিই জনগনের ধরাছোয়ার বাইরে থাকা এক অলীক বস্তু! কি তাজ্জব!! কি তাজ্জব!!! তাই না?


          Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

          জবাব দিন
          • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

            আহা মাত্র গড়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি শেষ করেন!

            কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা এ নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। কিছু সময়ের জন্য একটু গুগলে খেলাধুলা করলাম। আমার দুঃখ লাগে কখন জানেন? যখন কোন গবেষক (পিএই,ডি ডিগ্রীধারী যেকোন মানুষকে আমি গবেষক বলবো, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে তো কথাই নেই) গবেষণা, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত ভালোলাগা, রাজনৈতিক মতাদর্শ সব ব্লেন্ডারে ঢেলে বোতাম চেপে ধরেন। উদাহরণ সরূপ এই লিখাটি পেলাম। জনগণের জন্য রাজনীতি সহজ করার দায়দায়িত্ব কিছু পেশার মানুষের উপর সরাসরি বর্তায়। ১৫ বছরের সামরিক শাসন ও ২৪ বছরের খোঁড়া কেতাবি গণতন্ত্রকে আমজনতাতন্ত্র বানাতে একটি দেশের শিক্ষক সমাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন। যেকোন দেশের পলিসি এনালিস্ট, পলিটিকাল এনালিস্ট, থিংক ট্যাংক এদের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা শিক্ষক হয়ে থাকেন। কিন্তু উনারা ঘাড়ে কোপ পড়ার ভয়েই হোক আর আখের গোছানোর লোভেই হোক সেই দায়িত্বটুকু পালন করেন নি। অন্তত আমি দেখি না। ফলাফলঃ যেটা বললেন, রাজনীতি ইজ ডিফিকাল্ট ফর আস, দ্য ম্যাংগোজ।


            \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
            অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

            জবাব দিন
          • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

            :thumbup: তাড়াতাড়ি লেখাটা শেষ করেন :boss: :boss:


            গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

            জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      :clap: :clap:
      ধন্যবাদ মোকাব্বির!

      মেধাবী ছেলে-মেয়েদের চেয়ে রাজনীতির অঙ্গনে দুর্বৃত্ত আর দৃষ্টি-মনোহরদের আধিক্য আর দাপট সমানে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো।

      এটা আমার অন্যতম প্রিয় একটি উপলদ্ধি


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      রাজীব, শুধু হুজুর হুজুর ( 😉 ) না করে একটু আধটু কথা-টথা বল! 🙂


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শেষ না করে থাকা যায় না, শেষ করেও ফিরে ফিরে পড়তে ইচ্ছে করে।
    খুব ভালো লাগছে মুজিব।
    আর অনেক কিছু শুনতে চাই -- অনেক জায়গা দেখতে চাই তোমার চোখ দিয়ে।

    জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      থ্যাংকস নুপুরদা!
      আসলে বিষয়বস্তুটা কিন্তু খুব একটা নতুন বা অজানা নয়।
      আপনি কিন্তু অল্প শব্দ খরচ করেই সাংঘাতিক ভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন! :hatsoff: :hatsoff:


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এত সুন্দর করে, সংক্ষেপে গোছানো ইতিহাস পাঠ অনেকদিন পরে হলো, ধন্যবাদ মুজিব ভাই :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. দিবস (২০০২-২০০৮)

    ইতিহাসের একটা শর্ট নোট ইন ডিটেইল। চমৎকার, মুগ্ধ হলাম পড়ে। ইতিহাস বিষয়ে জানতে ভাল লাগে। দেশভাগের আগের প্রায় সব কিছুই অজানা। ছোট্ট এই জীবনে এসব জানার পর্যাপ্ত সময় কি পাওয়া যাবে? 🙁


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      চেষ্টা চালিয়ে যাও দিবস, যতটুকু জানা যাবে ততটুকুই লাভ। তোমার কথার সুরেই বলি,
      হেরে যাবে বলে তো স্বপ্ন দেখতে বসো নি! 🙂 🙂


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      দেশ ভাগের আগের ৩০-৩৫ বছরের ইতিহাস জানার জন্য আমার জানা মতে সবচেয়ে অথেন্টিক বই হলো আবুল মনসুর আহমেদের "আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর। স্ক্যানড কপি নেটেও পাওয়া যায়। আর মূল বই খোশরোজ কিতাবিস্তানের আউট লেটে।
      আবার বাংলা একাডেমির একটা বই ছিল নাম "আমাদের মুক্তি সংগ্রাম"। ওখানে ব্রিটিশ দের আসা থেকে যাওয়া পর্যন্ত পুরো একাউন্ট ধারাবাহিক ভাবে আছে সংক্ষিপ্তাকারে।
      ওটা পড়লেও পুরো প্রক্রিয়ার একটা বার্ড আই ভিউ পাওয়া যাবে।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  6. টিটো মোস্তাফিজ

    ::salute:: ::salute:: ::salute::
    প্রিয়তে নিলাম বস :boss: :boss: :boss:
    শিরোনাম দেখে একটু ডরাইছিলাম। কারণ আমি বাঙ্গাল ইউটোপিয়া লিখছি। আমার আগে কেউ লিখে ফেললে পরিশ্রমটা বৃথা যাবে 😛


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।