“কাম সেপ্টেম্বর” ছবিটা তরুণ্যের কালে বিটিভিতে দেখেছিলাম।
কিন্তু তখন রক হাডসন আর জিনা লোলা ব্রিজিডাকে দেখায় এতটাই মশগুল হয়ে ছিলাম যে এ ছবির তরুণ সাপোর্টিং একটর-একট্রেসদের কে লক্ষ করা হয়নি সেভাবে।
তাছাড়া তখনতো আর তথ্য-প্রযুক্তির কাল আসে নাই, তাই পরে তাঁরা এছবি থেকে কি কি স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন, তার কোন কিছুও জানা হয়নি আর।
কিছুদিন আগে অনেকটা হঠাৎ করেই এক বন্ধুর কাছে জানলাম, ববি ডারিন সম্পর্কে।
এই অসম্ভব গুনি মানুষটির অদ্ভুত বেড়ে ওঠা, শো-বিজ অর্থাৎ সঙ্গিত ও চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার, ছেলেবেলা থেকে বয়ে বেড়ানো অসুস্থতা, লাভ-লাইফ, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু নিয়েই অনর্গল বলে গেল আমার বন্ধুটি।
শুধু যে তার ঐ সব কথা শুনে ববি ডারিনের প্রতি আগ্রহ জন্মালো, তা না, ববি ডারিন যে ছোট বেলায় রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর আক্রান্ত হয়েছিলেন, আর সে সম্পর্কিত জটিলতাই যে শেষ পর্যন্ত তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠাটার পথে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল, সেটা জানার পর একধরনের অসহয়াত্বই বোধ করছিলাম। আর তা খুবই ব্যক্তিগত এক কারনে।
সে প্রসঙ্গে আসছি পড়ে।
তার আগে সংক্ষেপে ববি ডারিনের কিছু পরিচয় তুলে ধরি, আমার মতই যারা তাঁকে জানতেন না, তাদের জন্য…
পঞ্চাশোর্ধ পলির সপ্তদশ বর্ষিয়া কন্যা নীনা যখন হঠাৎ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে তখন পলি আরে নীনা মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে, সন্তানটি বেড়ে উঠবে পলির সন্তান – এই পরিচয়ে। আর মা হয়েও নীনাকে সে জানবে বড় বোন হিসাবে।
১৯৩৬ সালের ১৪ই মে নীনার কোল জুড়ে যে সন্তান এলো, তাঁকে পলির পুত্র পরিচয়ে বেড়ে ওঠার জন্যেই পলির পৈত্রিক পদবী ওয়াল্ডেন তার ফার্স্ট নেইম আর ইতালিয় নানার (বাবা পরিচয়ের কারনে) কাসোত্তো হলো তার পদবী। পুরো নাম দাড়ালো ওয়াল্ডেন রোবের্টো কাসোত্তো।
এরপর ৩২ বছর ধরে ওয়াল্ডেন জানতেই পারলো না যে নীনা তার বোন নয়, মা।
বত্রিশ বছর পর যেদিন সে এই কথা জানলো, ততদিনে কত কিছুই না বদলে গেছে তার।
তার ঐ জন্মকালীন নাম আর কেউ জানে না।
ততদিনে সে সফল গায়ক ও অভিনেতা এবং তা ববি ডারিন, এই নামে।
সহশিল্পি সান্ড্রা ডি তার সহধর্মিনি। আর তাদের ছ’বছরের পুত্র ডোডকে নিয়ে জমজমাট সংসার তাদের।
কিন্তু এই বয়সে মা-নানীর ঐ পরিচয় গোপন করাটা দারূন ভাবে নাড়িয়ে গেল ববিকে।
শুধু সেই পরিচয়ের লুকোচুরিই না, ছেলেবেলায় বারবার আক্রান্ত হওয়া “রিউম্যাটিক ফিভার” ততদিনে কামড় বসিয়েছে তার হার্টের ভালবে।
এইজন্যই বললাম, সময়টা আসলে তার অনুকুলে ছিল না। পেনিসিলিনে সংবেদনশিলতাই হোক অথবা চিকিৎসার অবহেলায়ই হোক, আনট্রিটেড বাতজ্বর উদ্রেককারী ব্যাক্টেরিয়া ববির দুটো ভালব এমনভাবে অকেজো করে দিয়েছে যে তার শল্য চিকিৎসা ছাড়া অবস্থার উন্নতির আর কোন উপায় থাকলো না।
ববি ডারিনের গল্প এই পর্যন্ত জানার পর আমার নিজের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এবার সেটাই শোনাই।
তখন আমি কলেজে এবং সবে ক্লাস এইটে উঠেছি। লক্ষ করলাম, কেমন একটা জ্বর জ্বর থাকে। আর নানা জয়েন্টে ব্যাথা।
সিক রিপোর্ট করলে এপিসি নামে কি একটা ঔষধ দেয় আর সাথে রেস্ট বা পিটি গেমস এক্সকিউজ।
ছুটিতে বাসায় এসে মা কে জানালাম।
উনি খুব সিরিয়াসলি নিলেন ব্যাপারটা। কারন বাতজ্বর নিয়ে সে সময় কোথায় যেন পড়েছেন। আমার অসুস্থতাটা তার কাছে বাতজ্বরের মতই মনে হলো।
আর তাই আমাকে দ্রুত নিয়ে গেলেন ওনার সহকর্মির ডাক্তার হাজবেন্ডের কাছে।
থ্রোট সোয়াব পরীক্ষা করতে দিলেন ঐ ডাক্তার আঙ্কেল।
রিপোর্ট নিয়ে দেখাবার পর কি কি যেন এন্টিবায়োটিক আর একগাদা এসপ্রিন প্রেসক্রাইব করেছিলেন উনি।
মাস তিনেক এন্টিবায়োটিক ও বছর দুই ঐ এসপ্রিন খেয়ে সেই যে ভাল হলাম, আর কখনো বাতজ্বরে পায় নাই আমাকে।
কিন্তু ববি ডারিনের ভাগ্য অতো সুপ্রসন্ন ছিল না। আর ছিল না বলেই তাকে মধ্য ত্রিশে ভালব রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি নিতে হয় সেই সত্তর দশকের গোড়ায়।
এরপর দুবছর যেতে না যেতেই আবার ইনফেকশন ও তা থেকে সেপসিস হয়ে লাগানো ভালবগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপসিসোত্তর দুর্বল শারীরিক অবস্থায় তার জীবন বাঁচাতে আবার যখন ওপেন হার্ট সার্জারী করা হয়, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পোস্ট অপারেটিভ থেকে আর জ্ঞান ফিরে আসে নাই তার। দিনটি ছিল ২০শে ডিসেম্বর ১৯৭৩।
অথচ এই সাইত্রিশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে কি করেন নাই তিনি?
চৌদ্দটি সফল চলচ্চিত্রে অভিনয়, একটি গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার, সাতটি হীট এলবাম যা লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে – সবই ছিল তার দখলে।
এর বাইরে শত শত গান লিখেছেন তিনি। পেয়েছিলেন একাধিক গ্র্যামী এওয়ার্ডও।
এসবের বাইরে রাজনীতি ও সমাজ সচেতনও ছিলেন তিনি। আততায়ির হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থি বব কেনিডির সাথে রাজনৈতিক ভাবে খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন তিনি।
শো-বিজ ক্যারিয়ারের পাশাপাশি উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও ছিল তার। আর তা সেই তরুন বয়সেই। ছাত্র হিসাবেও তিনি ছিলেন তুখোড়।
এবার শুরুর কথা দিয়েই শেষটা টানি।
বলেছিলাম, “ভুল সময়” তাঁর কিংবদন্তি হওয়াটা রুখে দিয়েছিল। সময়ের ভুলটা কি ছিল?
তিনি যে সময়ে যে যে অসুস্থ্যতার মুখে পড়েন, চিকিৎসার যে যে অবহেলার শিকার হন, আজকের দিনে সেগুলি ভাবাই যায় না।
চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ যেখানে এসেছে, তার ছিটে ফোঁটাও সেদিন থাকলে, ববি ডারিনের মত গুনি একজন মানুষকে এভাবে হারাতে হতো না আমাদের।
তাছাড়া জন্ম বিষয়ক লুকোচুরিটা না থাকলেও তার জীবন হতে পারতো আরও মসৃণ।
পলি আর নীনা, শুধু ববির জন্ম পরিচয়ই না, বাবার পরিচয়ের গোপনিয়তা রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিলেন। জন্ম পরিচয়ে গোপন রাখার প্রতিশ্রুতিটা তাঁরা ৩২ বছর রক্ষা করলেও, কে যে ববির প্রকৃত বাবা, আজও জানে না কেউ। নীনা সেকথা জানিয়েছিল একমাত্র তার মা পলি কেই, অন্য কাউকে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পলি তা আর কাউকে জানায়নি।
আর ১৯৮৩ সালে ৬৭ বছর বয়েসে নীনার মৃত্যুর পর সেকথা আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব রইল না।
আর মাস দেড়েক পর ববি ডারিনের মৃত্যুর ৪২ তম বার্ষিকি হবে। এই লিখাটা শুধু তার প্রতিই এক শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়, আমার সেই বন্ধুর প্রতিও এক কৃতজ্ঞতা যার কারনে ববি ডারিনের মত গুনি এক মানুষের কথা আমি জানতে পেরেছি।
আর সাথে সাথে বাতজ্বর রোগের চিকিৎসা বিষয়ে সকল অভিভাবককে সচেতন করার এই সুযোগটা নিলাম।
ভাল থাকবেন সবাই।
ববি ডারিনের দুটি গান:
১) আন অফিশিয়াল ফ্লাওয়ার্স:
২) ম্যাক দ্যা নাইফ:
“কাম সেপ্টেম্বর” চলচ্চিত্রে ববি ডারিন ও সান্ড্রা লী
১৯৫৯ সালে ববি ডারিনকে নিয়ে প্রচারিত টিভি প্রামান্য চিত্র –
দিস ইজ ইওর লাইফ-এর প্রথম খন্ড
দিস ইজ ইওর লাইফ-এর দ্বিতীয় খন্ড
দিস ইজ ইওর লাইফ-এর তৃতীয় খন্ড
সব শেষে দিচ্ছি “কাম সেপ্টেম্বর” চলচ্চিত্রের এই থীম সংটি। শুনে দেখুন তো পরিচিত লাগে কি না?
হ্যাঁ, অনেকের কাছেই খুব পরিচিত এই সুরটি ববি ডারিন-এরই করা ছিল…
:clap: :clap: :clap:
ভালো লেগেছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আজকাল মন্তব্যে যে আলসেমি সবার, তাও কিছু লিখেছো দেখে প্রীত, কৃতজ্ঞ...
অনেক ধন্যবাদ...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
:))
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
ববি ডারিনের ছবি দেখে আবার মন্তব্য করবো ভাই।
আসলে চাপে আছি।
নিজের ও বেশ কিছু লেখা জমে আছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
Beautiful
থ্যাংক ইউ স্যার.....
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
কিংবদন্তী ... আর আমদের আবেগ ...
এসবের রঙ যেনো যাচ্ছে পালটে সবেগ ...
ভালো লাগলো :clap: :clap:
বাহ! দারুন জমাট্টি মিল দেখি একখানা....
মুগ্ধ!!!!!
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.