এদেশে কনসেনচুয়াল সেক্স বনাম রেইপ

“বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বিয়েতে অস্বীকৃতি” – এটার কি কোন আইনগত প্রতিকার আছে? থাকলে তা কি?

আইনগত প্রতিকার পাবার প্রশ্ন আসে তখনই, যখন এইজাতিয় দ্বিপাক্ষিক একটি ঘটনার পর একটি পক্ষ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্থ বলে মনে করে। সেই ক্ষতিগ্রস্থ বা ভিক্টিম পক্ষটি আইনের আশ্রয় নেন মূলত নিজের উপরে ঘটা ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে। তবে এর মধ্য দিয়ে আরও কিছু উপকার আসে। যেমন: ১) দুষ্টের দমন, ২) সুশাসনে উদাহরন সৃষ্টি, ৩) অপরাধ নিরুৎসাহিত করন।

এখন কেইস ভিত্তিক আলোচনা করি। প্রথমেই একটি ওয়াইল্ড সিচুয়েশন।

কেইস নং-১
ধরা যাক একজন ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠিত নারী তাঁর চেয়ে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা পুরুষকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলো। কিছুদিন সম্পর্কটা চালানোর পরে সে পুরুষটিকে বিবাহে অস্বীকৃতি জানালো।
প্রশ্ন: পুরুষটি কি ঐ নারীর এই আচরনের কারনে কোন প্রতিকার পেতে পারেন?
উত্তর: প্রতিশ্রুতি যে দেয়া হয়েছিল, সেটা প্রমানে সক্ষম হলেই কেবল চুক্তি আইনে কিছু ক্ষতিপুরন পেতে পারেন। কিন্তু সেই ক্ষতিপুরন হিসাব করার জন্য তার প্রকৃত ক্ষতির পরিমানই কেবল হিসাবে নেয়া হবে। কোন এন্টিসিপেটরি বা মানসিক ক্ষতি বা অপরিমাপ যোগ্য ক্ষতি হিসাবে আসবে না।
আমার তো মনে হয় কিছু রিকশা ভাড়া আর কন্ট্রাসেপ্টিভের দাম ছাড়া আর কিছুই তিনি সেক্ষেত্রে দেখাতে সক্ষম হবেন না। বরং ঐ প্রতিশ্রুতির ব্যাপারটা প্রমানে অক্ষম হলে, হয়রানি প্রচেষ্টার জন্য তাকেই উল্টো দৌড়ের উপর থাকা লাগতে পারে।
তাছাড়াও পুরুষদের এনাটমিগত কারনে, শারীরির সম্পর্ক, যেকোন কারনেই হোক তাকে ভিক্টিমের আসন দেয় না। সেটাও এইক্ষেত্রে তার প্রতিকার পাবার পথে বড় একটা প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে প্রতারনা সম্পর্কিত প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে তা আরও বেশী কঠিন।
এইবার আসি উল্টো পরিস্থিতি বা কেইস নং-২ তে
ধরা যাক এইক্ষেত্রে যেকোন একজন পুরুষ যে কোন একজন নারীকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়লেন। পরে বিবাহে অস্বীকৃতি জানালেন। নারীটি কি কি প্রতিকার পেতে পারেন? আগের মতোই প্রতিশ্রুতি প্রমান করতে পারায় তার পক্ষে প্রথমতঃ চুক্তি আইনে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। নিজেকে ভিক্টিম হিসাবে প্রমান করে সম্ভবতঃ প্রতারনার প্রতিকারও তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব।
তবে এই দুইটি প্রতিকার পেতেই তাঁকে অনেক বেশী কাঠখড় পোড়াতে হবে অভিযোগ প্রমানে। বরং, অভিযুক্তের হাতে অনেক বেশী সুযোগ থাকবে অভিযোগটিকে ভিন্নখাতে ঠেলে দেয়ার।
নারীটির জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক প্রতিকার হলো, ধর্ষনের অভিযোগ আনা। বিপিসি ৩৭৫-এ ধর্ষনের যে যে সংজ্ঞা আছে তার একটিতে কনসেনচুয়াল সেক্সও ধর্ষণ হিসাবে বিবেচিত হবে যদি তা দুটি শর্ত পুরোন করে:
১) শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো ব্যাক্তিদ্বয় ঘটনার সময়ে বিবাহিত ছিলেন না।
২) নারীটি তাঁর সঙ্গিকে স্বামী হিসাবে “বিশ্বাস” করেছেন।
দেখা যাচ্ছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পর নারীটি যদি নিজেকে ভিক্টিম বলে দাবী করে প্রতিকার চান ও এই দুই শর্তের উপস্থিতি আছে বলে মনে করেন, প্রথমতঃ এনাটমিকালি তাঁকে ভিক্টিম না মনে করার কোন যুক্তি থাকে না। আর সংশর্গটা নিকট অতিতে ঘটে থাকলে প্যাথলজিকালি তা প্রমান করাটাও অসম্ভব না।
তাঁর জন্য প্রমানেয় দুটো জিনিষ থাকে তা তিনি দাবী করেই প্রমান করতে পারেন।
তাঁর প্রথম দাবী যে “তারা ঘটনার সময় বিবাহিত ছিলেন না” – এটা ততক্ষন অপ্রমানিত হবে না, যতক্ষন অভিযুক্ত কোন কাবিন হাজির করতে পারছেন না। আর এটা না পারা পর্যন্ত প্রথম দাবীটি প্রমানিত হিসাবেই টিকে যাচ্ছে।
তাঁর দ্বিতীয় দাবীটি বিশ্বাস নির্ভর। আর কে না জানে যে বিশ্বাস প্রমানে কোন দলিলপত্র লাগে না। ভিক্টিম একটু ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদেকেটে যদি বলেন, কি কি কারনে তাঁর মনে হয়েছিল, পুরুষটি তাঁর সাক্ষাৎ স্বামী, অভিযুক্তের আর কোন ডিফেন্স থাকবে বলে মনে হয় না। এর পরিনতিতে অভিযুক্ত ধর্ষক হিসাবে প্রমানিত হওয়াটা হয়ে দাঁড়াবে কেবলি সময়ের ব্যাপার।
তাহলে কি দাড়াচ্ছে?

কেইস নং-২ এ নারীর জন্য শক্ত ও সহজ প্রতিকার আইনতঃ এভেইলেবল।
আমার কথা আসলে এটা না।
আমার কথা হলো, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এজাতিয় একটা ঘটনার পর যখন বাদানুবাদে ফেসবুক আপ্লুত, লক্ষ করলাম এক শ্রেনীর পুরুষ পোস্টদাতা “এটা কেন ধর্ষণ হবে” বা “খুব বেশী হলে প্রতারনা হতে পারে” অথবা এই জাতীয় আস্ফালন করছিলেন।
কেন যেন আমি “চোরের মনে পুলিশ পুলিশ” – একটা ভাব দেখছিলাম ঐসব আস্ফালনে।
অভিযুক্ত-বান্ধব প্রতিকারে সম্মতি দিয়ে তারা কি প্রকারান্তরে নিজেদেরকেও ঐ অভিযক্তের দলে ফেলে দিচ্ছেন না?
ভিক্টিমের সহজ প্রতিকার চাওয়াটাকে কঠিন করে দেয়ায় আর কি কি স্বার্থ উদ্ধার হবে?
সৃষ্টি করা যাবে, সুশাসনের উদাহরন?
দুষ্টের দমন কি নিশ্চিত হবে?
অপরাধ কি নিরুৎসাহিত হবে?
কোনটির উত্তরই হ্যাঁ হবার কথা না।

পুনশ্চ: পারস্পরিক সম্মতিতে প্রাপ্তবয়স্কগন শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে সেখানে একজনের জন্য তা রেইপ হিসাবে গন্য করার এই আইনটি কি যথার্থ? এটা বদলানো কি সমিচিন না?
সম্ভাব্য উত্তর: এই আইনটি বললাতে হলে আবার সংশ্লিষ্ট অন্য অনেক কিছুই বদলাবার দরকার পড়বে। সেগুলো না বদলে শুধু এই আইনটা বদলালে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হবে বলে মনে করারও যথেষ্ট কারন রয়ে গেছে।
এই আইনটা বলানোর অর্থ দাঁড়াবে বিবাহ বহির্ভুত কনসেনচুয়াল সেক্সকেও একটা লিজিটিমেট সম্পর্ক সেই স্বীকৃতি দেয়া । আর তা যদি দেয়া হয়, ঐ সম্পর্কের কারনে জাত সন্তানের অধিকারেরও স্বীকৃতির প্রশ্ন সেখানে আসবে। সেই সাথে আসবে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নটিও। দরকার পড়বে এসব সমাধানের।
কি মনে হয়, মোল্লারা সেইটা করতে দেবে?
মানে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বদলানো ব্যবস্থা কি তারা মানবে? মনে হয় না ঘটনা এত সহজে ঘটানো সম্ভব…
যতদিন এদেশে জনকল্যানের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বেশী প্রাধান্য পাবে, আইনের এইসব পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে আমার কিন্তু মনে হয় না।

১,৫৪১ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “এদেশে কনসেনচুয়াল সেক্স বনাম রেইপ”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    এই লেখার আলোচনাটা এখানেই শুরু করবো নাকি লিখা শুরু করলে আলাদা ব্লগের আকার ধারণ করবে বুঝতে পারছিনা। নাকি অপ-এডের উত্তর লিখে না ওরকম ভাবে আলাদা ব্লগ নামাবো? 😛


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লেখা পারভেজ ভাই।
    আসলে ঘটনার সকল দিক ই দেখা উচিত।
    তবে প্রেম-ভালোবাসার বিষয় এইভাবে পাবলিক হওয়াটা চোখে লাগে।
    আমাদের মিডিয়াও বলিহারি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      "তবে প্রেম-ভালোবাসার বিষয় এইভাবে পাবলিক হওয়াটা চোখে লাগে"
      আগে একটা লিখা নিয়ে আলোচনা ও মন্তব্যকালে আমরা এই বিষয়টা তুলে এনেছিলাম যে প্রেম-ভালবাসায় কি করা যাবে আর কি করা যাবে না তার সীমা ততক্ষন থাকে না যতক্ষন উভয়েই একই ধরনের বুঝ বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে তা করছে।
      কথা হলো, একই বুঝ থাকার জন্য একই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তি, মন-মানসিকতা, বিদ্যা-বুদ্ধি থাকা লাগে।
      তা যখন থাকে না, দুজনে সম্পর্কে জড়ায়ি পরে ভিন্ন ভিন্ন মটিভ নিয়ে।
      এই রকমের ভিন্ন ভিন্ন মটিভ নিয়ে যে সম্পর্কে জড়ানো হয়, সেটা কে এব-ইনিশিও কতটা "প্রেম-ভালবাসা" বলা যায় আর কতটা "জটিলতায় পরিপূর্ণ সম্পর্ক" বলা যায় - তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করাই যায়।
      কি বল?


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  3. মামুন (১৯৮৪-১৯৮৪)

    সময়োপযোগী লিখাটিতে ভালো লাগা রেখে গেলাম।
    আমাদের সমাজব্যবস্থায় এরকম প্রেম-ভালোবাসা অর্থহীন।
    অনেক কিছু জানতে পারলাম এই পোষ্ট থেকে।
    অনেক ধন্যবাদ ভাই।


    নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      সমাজ ব্যবস্থাটা তো মনুষ্য সৃষ্টিই আর তা স্থির, নির্দিষ্ট, ধ্রুব, অনড় - কিছু না।
      সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে তা বদলাবে, বদলানোটা জরুরীও।
      যে কোন পরিবর্তনের মত, একেও একদিকে যেমন পরিবর্তনের সময় নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হবে, একই সাথে ক্রান্তিকালে বিবিধ হোঁচট খেয়ে, আছাড় খেয়ে ঠিক করে নিতে হবে, কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল।
      একটা কথা কিন্তু ঠিক, পুরনো যে পন্থা আমারা পিছনে ফেলে এসেছি, সেটা তে ফিরে যাওয়া আর কখনোই কোন গ্রহনযোগ্য সমাধান না।
      একবার এগুনো শুরু করলে, সামনে এগিয়ে যেতে হবে "বাধা-বিঘ্ন ডিঙ্গিয়ে" ও অতিক্রম করে।

      তবে এইট জাতীয় ঘটনাগুলো এক একটা সুযোগ রিভিউ করে দেখার, যা যা ঘটছে তা কতটা ঠিক হচ্ছে আর কতটা ভুল হচ্ছে.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।