১
বাংলার মুসলিম কৃষকসমাজের উদ্ভবের পেছনে যেসব নিয়ামক কাজ করেছে, তা’র সবগুলোই বঙ্গীয় ব-দ্বীপটির বর্ধিষ্ণু অংশের পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে সড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই প্রক্রিয়ায় পূর্বদিকে ক্রমাগতভাবে কৃষিজমি গড়ে ওঠায় উত্তর ও পশ্চিম বাংলার তুলনামূলক কম উর্বর এলাকা থেকে কিছু মানুষ পূর্বে মাইগ্রেট করেছে। সেই সাথে স্থানীয় আধা-জংলি আদিবাসী মৎস্যজিবী এবং জুমচাষি গোষ্ঠীসমূহ ক্যারিসম্যাটিক ও পাইওনিয়ার মুসলমান উদ্যোক্তাদের নের্তৃত্বে স্থায়ী কৃষিসমাজ গড়ে তোলে। নিবিড় ধানচাষ এই অঞ্চলে আগের তুলনায় প্রচুর পরিমাণে উদ্বৃত্ত ফসল ফলানো সম্ভব করে, যা’র স্বাভাবিক পরিণতিতে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। এইসব কিছু ঘটে ভৌগলিক দিকে থেকে গঙ্গার দিক পরিবর্তন করে পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গে সড়ে যাওয়া আর রাজনৈতিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের মাধ্যমে বাংলার বহির্বিশ্বের সাথে সংযুক্তির প্রক্ষিতে। ব্যাপক পরিসরে ঘটে যাওয়া এইসব ধীর পরিবর্তনকে ভালো মত উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে ক্ষুদ্র স্থানীয় পর্যায়ে এগুলো কিভাবে কার্যকর ছিল তা আলোচনা করা জরুরী। ঈটনের মতে সেই স্থানীয় ক্ষুদ্র আঙ্গিকের কেন্দ্রে ছিল মসজিদ এবং মাজার।
বর্তমান গ্রামীণ সমাজেও মাজার এবং মসজিদের গুরুত্ব সকলেই উপলব্ধি করেন। অধুনা দেশে ধর্মীয় চরমপন্থার উদ্ভবের প্রেক্ষিতে কেউ কেউ এই বিষয়টিকে নতুন মনে করলেও আদতে মসজিদের এই গুরুত্ব বাংলার গ্রামীণ কৃষীসমাজের উদ্ভবের শুরু থেকেই। প্রকৃতপক্ষে, এই গ্রামীণ সমাজের উদ্ভবই হয়েছে মসজিদ এবং মাজারকে কেন্দ্র করে যেখানে মুসলমান ‘পীর’ এবং ‘উলেমা’রা স্থানীয়দের আদিবাসীদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বনভূমি কেটে কৃষিজমি উদ্ধার এবং চাষাবাদ চালু করেছেন। কিভাবে তারা এই প্রক্রিয়া সম্পাদন করেছেন তা’ সরকারি নথি এবং লোক সাহিত্যের আলোচনার মাধ্যমে ঈটন বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলার ক্ষেত্রে।
মুঘলরা ১৬৬৬ সালে আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করার আগে এটি ছিল একটা দূর্গম এবং দূর্ভেদ্য জংলাকীর্ণ এলাকা। এখানকার অধিবাসীরা না ছিল হিন্দু আর না মুসলমান। তারা জুম চাষ করতো, মা-বাবা ও সন্তান ছাড়া আর সকল সম্পর্কের মধ্যে বিয়ের রীতি অনুসরণ করতো, নিজেদের আধ্যাত্মিক বা ধর্মগুরুর আনুগত্য করতো।
সুবেদার শায়েস্তা খানের আমলে তার ছেলে বুজুর্গ উমিদ খান ৬৫০০ পদাতিক সৈন্য এবং ২৮৮টি রণতরী নিয়ে একমাস ধরে জঙ্গল পরিষ্কার করে করে পথ তৈরি করে চট্টগ্রাম পৌঁছেন এবং আরাকানিদের পরাজিত করেন। মুঘল সুবেদার চট্টগ্রাম নগরে একজন ফৌজদার (সেনাপতি) এবং একজন আমিল (প্রধান রাজস্য কর্মকর্তা) নিয়োগ করেন। মুঘল বাহিনীর সাথে আগমন করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু রাজকর্মচারী এবং অর্থ লগ্নিকারী। মুঘল সেনাসদস্য এবং রাজকর্মচারিদের মধ্যে অধিকৃত ভূমি নিষ্কর হিসেবে বণ্টন করে দেওয়া হয়। পরবর্তিতে এদের উত্তরসূরিরাই এ অঞ্চলে জমিদার হিসেবে অবির্ভূত হয়। এরা নিজেরা বন কেটে চাষাবাদ শুরু করেনি। ইনফ্যাক্ট, এরা চাষাবাদে নামেইনি। বরং এরা স্থানীয় আদিবাসীদেরকে জঙ্গল পরিষ্কার এবং চাষের কাজে নিয়োগ করত। এই চাষীরা কালক্রমে রায়ত হিসেবে এইসব চাষের জমিতে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।
ঈটন মুঘল আমলে ১৬৬৬ সাল থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত সময়কালে চট্টগ্রাম জেলায় সর্বমোট ২৮৮টি নিষ্কর জমিদানের সরকারি সনদ খুঁজে পেয়েছেন। এগুলোর মাধ্যমে মুঘল সরকার জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করার জন্য অধিনস্তদেরকে গড়ে (এখনকার মাপকাঠিতে) প্রায় ২৫ একর করে বনভূমি দান করেছিল। এসমস্ত জমির ৯১% প্রাপক ছিল মুসলমান এবং মাত্র ৯% হিন্দু। এইসব সনদের মাধ্যমে সরকারি জমি ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার প্রক্রিয়াটা বোঝার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের একটা সনদের বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করছিঃ
“সরকার ইসলামাবাদ পরগণার মুৎসুদ্দি (কেরানী), মুয়ামিল (আমিন বা ভূমি জরিপকারী), চৌধুরী, কানুনগো (হিসাবরক্ষক) এবং রায়তগণ,
শাহ জয়নাল আবেদীন এই মর্মে আবেদন করেছে যে, তার পরিবারে অনেক পোষ্য আছে এবং সে একটা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে যেখানে অনেক ফকির এবং অন্যান্যরা আসা যাওয়া করে। কিন্তু সেই মসজিদ পরিচালনার জন্য তার কোন আয় রোজগার নাই। তাই সে আশা করে যে সরকার তাকে কিছু জমি দান করবে।
উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে তদন্ত করে কর বিভাগ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তাকে নয়াপাড়া গ্রাম এবং পরগনা হাভেলি চট্টগ্রামের অন্তর্গত এবং করভূক্ত জমির পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে ৬ শাহী দূন এবং আট কানি (বর্তমানের হিসেবে ১৬৬.৪ একর) জমি দান করা হবে। এই জমি মসজিদ এবং উপরুল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্য দান বলে গণ্য হবে। যখন এই জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা হবে, তখন তা’তে উৎপন্ন ফসল দ্বারা মসজিদ পরিচালনা এবং তার (শাহ জয়নাল আবেদীন) নিজের, তার উত্তরাধিকারীদের এবং পোষ্যদের চাহিদা পূরণে ব্যয় করতে হবে। অতঃপর সে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করবে।
সে এবং তার উত্তরাধিকারীগণ এই জমির জন্য ভূমিকর, জনপথ কর, সেতুকর এবং প্রশাসন ও দেওয়ানী বিভাগকর্তৃক আরোপিত সকল প্রকার করের আওতামুক্ত থাকবে। এই সনদ ফি বছর নবায়ন করতে হবে না। এই আদেশ পালনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। তারিখ- ২ রবি, ১০৭৭” (পৃ-২৪৬)।
উপরের সনদের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো- এক, একজন মুসলমান পাইওনিয়ার একটা মসজিদ স্থাপন করার পর সেটাকে ভিত্তি করে সরকারি নিষ্কর জমির জন্য আবেদন করেছে; দুই, সরকার তাকে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদের জন্য জমিদান করেছে এবং সেই জমির ফসল দিয়ে মসজিদ এবং নিজের পারিবারিক ভরনপোষণের নির্দেশ দিয়েছে; তিন, সরকার তাকে সাম্রাজ্যের দীর্ঘায়ু জন্য প্রার্থনা তথা সরকারের প্রতি সমর্থন দাবী করেছে। দুই নম্বর পয়েন্ট সরকারের বনভূমি কেটে কৃষিকাজ শুরুর মাধ্যমে আর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। আর তিন নম্বর পয়েন্ট মাঠ পর্যায়ে সাম্রাজ্যের অনুগত সমাজ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে। সেসময়কার প্রায় সবগুলো সনদের দুই এবং তিন নম্বর পয়েন্ট উল্লেখ ছিল। আর প্রথম পয়েন্ট পল্লীসমাজে ইসলাম ধর্মের প্রসারে সাম্রাজ্যের ভূমিকা নির্দেশ করে। এইক্ষেত্রে ইসলাম প্রসারে সাম্রাজ্যের ভূমিকা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় অনেকগুলো সনদে জমির আয় থেকে মসজিদের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, মুসল্লি, মিলাদ পরিচালিনাকারী এবং পরিচ্ছন্নকর্মীর ব্যয় নির্বাহ করার নির্দেশে।
১৭৭০ সালের এক বৃটিশ রিপোর্ট উল্লেখ করে যে, চট্টগ্রাম জেলার মোট কৃষিজমির প্রায় দুই-তৃয়াংশই এভাবে নিষ্কর সনদের আওতায় চলে গেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই জমিগুলো মসজিদ এবং মাজারের নামে দান করা হলেও এগুলো ওয়াকফ নয়, বরং বংশ পরম্পরায় প্রাপকের উত্তরাধিকারীদের ব্যক্তিমালিকানায় চলে যেত। ফলে দুই বা তিন প্রজন্মের মধ্যেই মূল প্রাপকের সন্তানরা এই জমির মালিক হয়ে যেত, যারা স্থানীয় পর্যায়ে পাতিজমিদারে পরিণত হতো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এরা নিজেরা জমি পরিষ্কার এবং চাষাবাদে জড়িত হতোনা, বরং স্থানীয়দেরকে সেসব কাজে নিয়োগ করত। পর্যায়ক্রমে এই শ্রমিকরা তাদের অধীনস্ত প্রজা বা রায়তে পরিণত হতো।
মুঘল আমলে জঙ্গল পরিষ্কার করে যে কৃষিসমাজ গড়ে ওঠে, তা’র সর্বোচ্চ স্তরে থাকে জঙ্গল পরিষ্কারের প্রক্রিয়ার বাইরের জমিদার এবং সরকারের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত উচ্চ পদস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীরা; এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ছিল। মধ্যমস্তরে থাকে স্থানীয়ভাবে কিছুটা প্রভাবশালী লোকেরা যারা উল্লিখিত জমিদারের কাছ থেকে সনদ নিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করে জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন কৃষিজমি তৈরি এবং আবাদের কাজ করত; এরা প্রায় সকলে ছিল মুসলমান। সর্বনিম্ন স্তরে ছিল স্থানীয় আদিবাসীরা যারা সরাসরি জঙ্গল পরিষ্কার এবং চাষাবাদে নিয়োজিত ছিল। সনদে উল্লিখিত মধ্যমস্তরের স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে ছিল শেখ (২৩), চৌধুরী (১১), খন্দকার (৯), হাজী (৮), তালুকদার (৭), শাহ (৪), ফকির (৪), সৈয়দ (৩), দরবেশ (৩) এবং খান (৩)। এখানে দেখা যায় যে, এই মধ্যশ্রেণীতে কারো কারো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সামন্ত শ্রেণীর হলেও (যথা, চৌধুরী, তালুকদার ও খান) অধিকাংশের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ইসলাম ধর্মীয়।
২
আমাদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা এই যে, বাংলার মুসলমানরা নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। এই অনুমানের ভিত্তিতে থাকে আর্যসভ্যতায় সমাজকাঠামোর মূলভিত্তি স্বনির্ভর গ্রামসমাজ। প্রধানতঃ বর্তমানের উত্তরভারতে দৃশ্যমান এইসব গ্রামের অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় জাতি ও বর্ণের ভিত্তিতে একটা নিরেট, তুলনামূলকভাবে অনড়-অচল পল্লীসমাজে বাস করে। সামাজিক বিজ্ঞানের কোন প্রকার গবেষণাই বাংলায় ওইরূপ গ্রামসমাজের অস্তিত্বের প্রমাণ পায়নি। এমনকি আজ থেকে মাত্র ৪৫ বছর আগে করা নৃতাত্ত্বিক গবেষণাও আমাদের গ্রামসমাজের সুস্পষ্ট কাঠামো খুঁজে না-পেয়ে একে বলেছে ‘অধরা গ্রাম’ (Elusive Villages: social structure and community organization in rural east Pakistan; Bertocci, 1971)। এখন যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে এই গ্রামসমাজ উদ্ভবের প্রাক্কালে যে আরও অধরা, আরও নমনীয় এবং ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, তা সহজেই বোঝা যায়। তাহলে সেই সমাজের কাঠামো কিরূপ ছিল?
আলোচনার আগের অংশে দেখেছি যে, এই গ্রামীণ কৃষীসমাজ গড়ে উঠেছে স্থানীয় আদিবাসী গোত্রসমূহের জুমচাষভিত্তিক আধা-জংলি সমাজ থেকে আবাদী জমিতে স্থায়ীবসতি স্থাপনের মাধ্যমে। এরা একেক বছর একেক এলাকায় জুমচাষের জন্য ক্রমাগত যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও নিয়মশৃংখলা পালন করতো ‘প্রবিত্র আত্মা’ বা আধ্যাত্মিক নেতার অধীনে। কৃষিসমাজে এসে এইসব জনগোষ্ঠী তাদের আবাদী জমির পাশে স্থায়ী বসতি গাড়ে। আর এইখানে পূর্বের গোত্রের স্থলে সমাজকাঠামোর কেন্দ্রে উপস্থিত হয় মসজিদ বা মাজার। এইসব গ্রামের প্রত্যেকটির উৎপত্তি হয়েছিল একটা মসজিদকে (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাজার) কেন্দ্র করে। আর এসব গ্রামীন সমাজের নের্তৃত্বে আগেকার আধ্যাত্মিক নেতাদের স্থানে আসে মসজিদের নের্তৃত্ব তথা ইমাম, মোল্লা এবং অন্যান্য মুসলিম ধর্মীয় নের্তৃত্ব।
নবীন এইসব পল্লীসমাজের ধর্মীয় নের্তৃত্বের ভিত্তি ছিল প্রধানতঃ তিনটি। এক, কিছু কিছু স্থানীয় আধ্যাত্মিক নেতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজ গোত্রের সমাজে মসজিদভিত্তিক নের্তৃত্বে অন্তর্ভূক্ত হয়। দুই, বাইরে থেকে আগত মুসলিম ধর্মীয় নেতা আরও গুরুত্বপূর্ন হয়ে পীর বা সূফী হিসেবে স্বীকৃত হয়। তিন, আরেকদল পাইওনিয়ার মুসলিম নেতা সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগত বলে গৃহীত হয়। চট্টগ্রামের আদিবাসীরা তাদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা তথা আধ্যাত্মিক নেতার আনুগত্য অনুসরণ করে বহিরাগত এইসব মুসলমানদেরকে নবীন এইসব কৃষিসমাজের নের্তৃস্থানীয় হিসেবে ক্রমান্বয়ে আত্মস্থ করে নেয়।
গ্রামের নের্তৃস্থানীয় মুসলমানদের ক্ষমতার রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল ভূমিদান সনদের মাধ্যমে সরকারি স্বীকৃতি। জমিগুলো ওয়াকফ না হয়ে এইসব পাইওনিয়ারদের ব্যক্তিগত সম্পতিতে পরিণত হওয়ায় তাদের ক্যারিসম্যাটিক নের্তৃত্ব ক্রমান্বয়ে উত্তরাধিরের মধ্য দিয়ে একধরণের সামন্তশ্রেনীভিত্তিক সমাজকাঠামোর রূপ পরিগ্রহ করে। অর্থ্যাৎ, সমাজে সামন্ত ভূস্বামী এবং তার অধীনস্ত কৃষক-প্রজা শ্রেণীর উদ্ভব হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এই নের্তৃত্বের প্রকাশ মূলতঃ ইসলাম ধর্মভিত্তিক। সম্ভবতঃ একারণেই সামাজিক পরিমণ্ডলে এই ‘পৃষ্ঠপোষতার বিনিময়ে আনুগত্যমূলক’ (patron-client) সম্পর্ক মুঘলদের অফিসিয়াল ফারসি ভাষার মধ্য দিয়ে পীর-মুরীদ সম্পর্ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য যে, এইসব মুসলমান নের্তৃত্বের প্রায় কারোরই, এমনকি বাগেরহাটের প্রখ্যাত পীর খান জাহান আলীও, সূফীবাদের সাথে সামান্যতম যোগসূত্রও ছিলনা! ম্যাক্স ওয়েবারের ‘rationalization of charismatic authority’ তত্ত্ব প্রয়োগ চট্টগ্রামের দরবেশ শেখ মানিকের ঘটনা বিশ্লেষণ করে ঈটন দেখিয়েছেন কিভাবে মুসলিম পাইওনিয়াররা যুগ পরিক্রমায় পীরের মর্যাদায় আসীন হয়।
অধুনা হাটহাজারি থানাধীন পরগণা ফতেহপুরের জমিদারি নথি থেকে পাওয়া যায় যে, ১৭১৫ সালে পশ্চিমপাতি গ্রামে জনৈক মানিক শেখ একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে এবং তার পরিচালনার জন্য বনভূমি পরিষ্কার করে জমি আবাদ করার জন্য সরকারি আনুমোদনের আবেদন করে। সরকার সেই মসজিদের পার্শ্ববর্তী ৫৪.৫ একর বনাঞ্চল নিষ্কর জমি হিসেবে দান করে এবং তাকে সেই মসজিদের রক্ষক হিসেবে সনদ প্রদান করে। চল্লিশ বছর পর, অর্থ্যাৎ ১৭৫৫ সালে গিয়ে দেখা যায় যে, শেখ মানিকের পুত্র জাফর মুহাম্মদ তার বাবার কবরের উপর একটা মাজার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নিজে সেই মাজারের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছে। মাজারটি একটি স্বতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে এতোটাই স্বীকৃতি পেয়েছে যে, মাজারের যাবতীয় কাজে ‘শেখ মানিকের মাজার’ উল্লিখিত নিজস্ব সীলমোহর ব্যবহার করা হতো।
চট্টগ্রামের মতো সিলেট জেলাতেও মুসলমান কৃষিজীবি সমাজের অভ্যুদয় হয়েছে মুঘল আমলে। এর আগে সিলেট ছিল একটা স্থানীয় হিন্দু রাজবংশের অধীনে আধা-স্বাধীন ক্ষুদ্র স্থানীয় রাজ্যবিশেষ। এর দক্ষিণভাগ এবং ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত অথবা হাওড়-বাওড়ে নিমজ্জিত। এসব এলাকা বন্য জন্তু এবং বিষাক্ত শাপে পরিপূর্ন ছিল। অধিবাসীরা ছিল অনার্য মৎস্যজীবি সম্প্রদায়, প্রধানতঃ কৈবর্ত গোষ্ঠীর। উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে মুঘলদের কাছে পরাজিত হয়ে বাংলার তৎকালীন আফগানরা ক্রমশঃ ভাটি তথা ময়মনসিংহ আর সিলেট অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এদের বিরুদ্ধে মুঘলরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৬১২ সালে এবং সিলেটকে আকবরের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে।
চট্টগ্রামে যেভাবে মুঘল শাসন শুরুর সাথে সাথেই জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সিলেটে তা হয়নি। বরং এখানে এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রামের সাথে সিলেটের আরেকটা পার্থক্য ছিল এই যে, বিদ্যমান স্থানীয় হিন্দু রাজ্যকে কেন্দ্র করে এখানে আগে থেকেই একটা উদীয়মান হিন্দু সমাজ ছিল। তবে সরকারি সনদের মাধ্যমে জঙ্গলা ভূমি পরিষ্কার করে চাষাবাদের জন্য তৈরি করার এবং সেইসাথে গ্রামীণ কৃষীসমাজ পত্তনের প্রক্রিয়া চট্টগ্রামের মতোই ছিল। ফলে সিলেটের ভূমিদানের সনদগুলোতে দেখা যায় মসজিদ ও মাজারের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু মন্দির এবং পূজার মণ্ডপ সরকারি নিষ্কর জমি পেয়েছে। এমনকি মুঘল যুগের প্রথমদিকে সংখ্যার হিসেবে হিন্দুদের প্রাপ্ত সনদ মুসলমানদের থেকেও বেশি। পরবর্তীতে অবশ্য মুসলমানদের প্রাপ্ত সনদসমূহ ক্রমশঃ সংখ্যায় এবং আয়তনে হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে যায়। এই সনদগুলোকে গ্রহীতার ভিত্তিতে যেসব ভাগে বিভক্ত করা হয় তা হলো- ব্রাহ্মণোত্তর (গরীব ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত জমি), দেবোত্তর (কোন দেবতার মন্দিরকে প্রদত্ত জমি), বিষ্ণোত্তর ( দেবতা বিষ্ণুর মন্দিরকে প্রদত্ত জমি), শিবোত্তর (শিব দেবতা মন্দিরকে প্রদত্ত জমি), মাদাদ-ই-মাস (মুসলমান এবং হিন্দু পাইওনিয়ারকে প্রদত্ত জমি) এবং শিরাজি (মুসলমানদের মাজারকে প্রদত্ত জমি)।
চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সরকারি জমির গ্রহীতা প্রায় সকলে মুসলমান হওয়ায় সেখানে গড়ে ওঠা কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজ মুসলমান প্রধান। আর সিলেটে মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা নিষ্কর জমি লাভ করায় দেখা যায় যে, এখানকার গ্রামগুলো হিন্দু এবং মুসলিম প্রধান হিসেবে গড়ে উঠেছে। কারণ, এইসব পাইওনিয়ার মুসলমান হলে উদীয়মান সেই পল্লীসমাজের কেন্দ্রে থাকত মসজিদ, আর হিন্দু হলে মন্দির। সম্ভবতঃ এজন্যই চট্টগ্রাম জেলাতে মুসলমানরা প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট হলেও সিলেট জেলায় হিন্দুপ্রধান পল্লীসমাজও দেখা যায়।
কিন্তু সরকারি নিষ্কর জমির প্রাপ্তি এবং ফলশ্রুতিতে হিন্দু ও মুসলমান পল্লীসমাজের উদ্ভবের এই প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা খুব দ্রুতই হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে যায় দুটো কারণে; এক, ১৭০০ সাল লাগাদ দেখা যায় যে, সরকার প্রদত্ত সনদে মুসলমানদেরকে দেওয়া জমি আয়তনে হিন্দুদেরকে দেওয়া জমির তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে মুসলমান প্রধান পল্লীসমাজও আকারে এবং সংখ্যায় হিন্দু পল্লীসমাজের থেকে বৃহত্তর। দুই, মুসলমানদেরকে প্রদত্ত সনদ প্রায়শঃই মসজিদের ব্যয় এবং প্রাপকের পোষ্যদের ভরণপোষণ ব্যয়ের পাশাপাশি আদেশ দিত ইসলামি প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার। যেমন, জনৈক মৌলভি মোহাম্মদ রাব্বীকে প্রদত্ত সনদে মসজিদের পাশাপাশি গ্রামবাসীদের ইসলামি শিক্ষার জন্য একটা কুরান স্কুল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঈটন উল্লেখ করেছেন যে, সিলেট জেলায় মুসলমানদেরকে প্রদত্ত ভূমিদান সনদের বেশিরভাগেই মসজিদ ও মাজারের পাশাপাশি এরূপ ইসলামি প্রতিষ্ঠান তৈরির নির্দেশ ছিল। কিন্তু হিন্দুদেরকে প্রদত্ত সনদের কোনটাতেই এমন নির্দেশ পাওয়া যায়না। ফলশ্রুতিতে, মুসলমান সমাজ দ্রুত বিকশিত হয়, আর হিন্দু সমাজ ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়ে।
সিলেটের প্রেক্ষিতে দেখতে পেলাম যে, শুমাত্র মুসলমানরাই নয়, বরং হিন্দুরাও মুঘলদের সময় নিস্কর জমি পেয়েছিল এবং সেখানে বন পরিষ্কার করে কৃষিসমাজ গঠন করেছিল। আজকের নোয়াখালী জেলার অভ্যন্তরে একটি খ্রিষ্টান চার্চের উল্লেখ করে ঈটন দেখিয়েছেন যে, এমনকি রাজসমর্থন ছাড়াও বাংলায় অন্যান্য ধর্মভিত্তিক কৃষিসমাজ গড়ার নজীর ছিল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন রাজসমর্থন থাকায় মুসলমানরা পুরো বদ্বীপ জুড়ে দ্রুত ইসলামি পল্লীসমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
উপরের আলোচনায় দেখলাম কি প্রক্রিয়ায় মূল নদীর গতিপথের সাথে ভৌগলিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মুঘল রাজশক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ একত্রে পূর্ববাংলার মুসলিমপ্রধান কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজের উদ্ভব ঘটিয়েছে। কিন্তু কেবলমাত্র রাজশক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সমাজের সংস্কৃতি বা ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ নির্ধারণ করতে পারে না। তাহলে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম কিভাবে সিংহভাগ গ্রামবাসীর ধর্ম হয়ে উঠল? তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, ইসলাম প্রসারে মুঘল রাজের সরাসরি ভূমিকা ছিল বলেই ইসলাম প্রধান ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু প্রজাসাধারণ ত রাজশক্তির আদেশ-নির্দেশ মেনে নেয়ার পাশাপাশি নিজেরাও সক্রিয়ভাবে সেগুলোকে নিজেদের যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করে, বাস্তবায়ন করে নিজেদের জন্য উপযোগী করে। তাহলে, পূর্ববাংলার পল্লীসমাজ কোন প্রক্রিয়ায় ইসলামকে আত্মস্থ করে মুসলিম প্রধান হয়ে গড়ে উঠল?
৩
In the midst of the dramatic socioeconomic changes taking place in premodern Bengal, Islam creatively evolved into an ideology of “world-construction”- an ideology of forest cleaning and agrarian expansion, serving not only to legitimise but to structure the very socioeconomic changes taking place on the frontier. On the one hand, Islamic institutions proved sufficiently flexible accommodate the non Brahmanazed religious culture of premodern Bengal. On the other, the religious traditions already present in Eastern Bengal made accommodation with the amalgam of rites, rituals and beliefs that were associated with the village mosques and shrines then proliferating in their midst. In the process, Islamic and Bengali worldview and cosmologies became fused in dynamic and creative ways (p.267).
অর্থ্যাৎ, প্রাক-আধূনিক বাংলায় নানান আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিসমাজ গড়ার মতবাদ হিসেবে ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে। এই মতবাদ একই সাথে উক্ত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে সম্ভব করেছে এবং জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এই করতে গিয়ে একদিকে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো নমনীয় হয়ে স্থানীয় অ-হিন্দু আদিবাসীদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছে, অপরদিকে বিদ্যমান স্থানীয় ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলো মসজিদ ও মাজারভিত্তিক ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসকে গ্রহণ করেছে। এইভাবে বিভিন্ন পরিবর্তনশীল এবং অভিনব উপায়ে ইসলাম এবং আদি বাঙালির বিশ্ববিক্ষা ও জগৎ সম্পর্কিত ধারণাগুলো একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে।
মুঘল সাম্রাজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রামবাংলার মসজিদ এবং মাজারগুলো ছিল বনভূমির স্থলে কৃষিসমাজ প্রতিষ্ঠা আর সেইসাথে ক্ষুদ্র মাঠপর্যায়ে সাম্রাজ্যের আনুগত্য আদায়ের মাধ্যম। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একই প্রতিষ্ঠানগুলো এদের প্রভাবাধীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে আসে ইসলামিক আধ্যাত্মিকতা ও আচার-ব্যবহার। যেমন, ১৭০০ সালের দিককার সরকারি নথিপত্রে শুক্রবারে নিয়মিত জুম্মার জামাত ছাড়াও ফাতিহা-পাঠ (তথা মৃতের নাযাত প্রার্থনার উদ্দেশ্য মিলাদ মাহফিল), নবীর জন্ম ও মৃত্যবার্ষীকী পালন, আশুরা (কারবালায় ইমাম হোসেনের হত্যাকাণ্ড স্মরণ করে দোয়া মাহফিল), দরবেশের মাজারে ওরশ মাহফিল, ইত্যাদি ইসলামি অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এইসব নানান আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলার উদীয়মান পল্লীসমাজে ধীরে ধীরে আল্লাহ ও অন্যান্য ইসলামি স্বত্বার পরিচয় ও প্রভাব বিস্তার ঘটে। বাংলায় ইসলামের এই প্রসারকে আমরা সাধারণভাবে বলে থাকি Conversion বা ধর্মান্তর। কিন্তু এটা একটা ভুল ধারণা। কেননা, ধর্মান্তর বোঝায় এমন প্রক্রিয়া যেখানে মানুষ অকস্মাৎ তার বর্তমান ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে আরেকটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। বাংলার কোন এলাকায় এমনটি ঘটেছিল বলে কোন প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, বাংলায় ইসলামের প্রসার ঘটেছে অত্যন্ত ধীর গতিতে প্রায় ১০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে। এই প্রক্রিয়াটি এতোটাই ধীরে ও সূক্ষ্মভাবে ঘটেছে যে, অনেকক্ষেত্রে এই পরিবর্তন থেকে গেছে দৃষ্টির আড়ালে।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে, ধর্ম হচ্ছে একটা সমাজের মধ্যে প্রচলিত সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ও আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির সাথে অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বার যোগসূত্র। তাহলে, বাংলায় ইসলামাইজেশনের অর্থ হচ্ছে perception বা জ্ঞানের পর্যায়ে আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ভারতীয় অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বার স্থলে বাইরে থেকে আগত ইসলামি অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বার আগমন আর ব্যবহারিক পর্যায়ে পুরনো আচার-অনুষ্ঠানের স্থলে ইসলামি আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন। ঈটন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে তিনটি আলাদা পর্যায় চিহ্নিত করেছেন যেখানে ইসলামি এবং ভারতীয় অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বাসমূহের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কে বিদ্যমান ছিল। এগুলো হলো গ্রহণ (inclusion), আত্মীকরণ (identification) এবং বর্জন (displacement)।
গ্রহণ (inclusion) বলতে তিনি বুঝিয়েছেন আদিবাসীদের মাঝে আগে থেকে প্রচলিত ভারতীয় অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বার (যেমন, বিভিন্ন দেবদেবী, ভূতপ্রেত, ইত্যাদি) পাশাপাশি একইসাথে ইসলামি অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্বসমূহকে (যেমন, আল্লাহ, নবী-রাসূলগণ, ফেরেস্তা, জ্বীন, ইত্যাদি) উদীয়মান বাঙালি পল্লীসমাজের বিশ্ববিক্ষায় অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া। যেমন, ১৬৮৬ সালে রচিত রায়মঙ্গল কাব্যে বনের দেবতা হিসেবে একইসাথে দেখা যায় স্থানীয়দের দক্ষিণ রায় আর মুসলমানদের বদি গাজি খান। আর কনসেপচুয়াল লেভেলে এদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মীমাংসা করতে শ্রীকৃষ্ণ বা নবী মুহাম্মদ নয়, বরং এমন একজনকে কল্পনা করা হয় যা’র অর্ধেক শ্রীকৃষ্ণ আর অর্ধেক নবী মুহাম্মদ। একইভাবে, পালাগানের শুরুতে বন্দনার মধ্যেও দেখা যায় যে, পল্লীকবি ও গীতিকারেরা আদিবাসীদের দেবতা, হিন্দু দেবতা এবং মুসলমানদের আল্লাহ, নবী ও পীরদের প্রশংসা দিয়ে পালা শুরু করে। একসাথে উল্লেখ করলেও এইসব অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বাকে কবি বা পালাগানের শিল্পীরা এক করে না-দেখে আলাদা ভাবেই বিবেচনা করতো।
উপরের বর্ণনায় আমরা ভূমিদানের সনদ থেকে মসজিদ ও মাজার স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লীসমাজের উদ্ভবের বয়ান জেনেছি। কিন্তু সেইসব পল্লীসমাজের আমজনতার বয়ান জানতে হলে আমাদেরকে দেখতে হবে পল্লিসাহিত্যে, যথা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা, ইত্যাদি। ময়মনসিংহ গীতিকার একটা পালা ‘কঙ্কা ও লীলাবতী’ থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করছিঃ
“একদা গ্রামে এক মুসলমান পীর আগমন করলেন। তিনি গ্রামের প্রান্তসীমায় একটা মসজিদ তৈরি করলেন এবং সারাদিন একটা ডুমুর গাছের নিচে বসে কাটিয়ে দিলেন। পুরো জায়গাটা তিনি এতো নিপুণভাবে পরিষ্কার করলেন যে, সেখানে একটা ঘাসের অবশিষ্ট ডগাও থাকল না। তার সুখ্যাতি দ্রুত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে তার গোপন ক্ষমতার কথা বলাবলি করতে লাগল। কোন অসুস্থ ব্যক্তি তার কাছে সাহায্যের জন্য গেলে তিনি ধুলো ফু দিয়ে বা সামান্য ছুঁয়ে দিয়েই আরোগ্য করে ফেলেন। কেউ মুখ খোলার আগেই তিনি সকলের মনের অন্তস্থ গোপন কথাগুলোও জেনে ফেলেন এবং বলে দেন। তিনি মাটির চেলাকে চিনির বলে পরিণত করে তার চারপাশে জড়ো হওয়া ছেলেমেয়েদেরকে দান করে অবাক করে দেন। তারাও সেসব প্রসাদ পেয়ে আহ্লাদিত হয়। শত শত নারীপুরুষ তাকে শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হন। চাল, ফলমূল, অন্যান্য সুস্বাদু খাবার, খাসি, মুরগী, ইত্যাদির সমাহার ঘটে তার দরজায়। পীর উৎসর্গীকৃত এসবের কোনকিছু থেকে একবিন্দুও নিজে গ্রহণ করেননা, বরং সমস্তই গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন” (ঈটন, ১৯৯৩; পৃ, ২৭৩)।
এখানে উলেখ্য যে, গ্রামবাসীর মধ্যে পীরের প্রাধান্যের উৎস হলো তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার উপরে গ্রামবাসীর বিশ্বাস; অথচ সরকারি ভূমিদানের সনদ অনুযায়ী এই উৎস হল রাষ্ট্রীয় অনুমোদন। সরকারের কাছে তিনি মূলতঃ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সীমাবিস্তারের মাধ্যম (agent) হলেও গ্রামবাসীর দৃষ্টিতে তিনি ধর্মীয় নেতা। উপরন্তু, গ্রামবাসীর দৃষ্টিতে এই পীর বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী যা’ দিয়ে তিনি গ্রামবাসীর নানা রকম বালা-মুসিবত দূর করতে সক্ষম।
এই পর্যায়ে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, সেসময়কার ইসলাম আর এখনকার ইসলাম এক নয়। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম বলতে আমরা এখন যে সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সমন্বিত একটা ব্যবস্থাকে বুঝি, বাংলায় তা’র উদ্ভব ঘটেছে উনিশ এবং বিশ শতকের সংস্কারবাদী সামাজিক আন্দোলনের (যথা, ফরায়েজি আন্দোলন, তরিকতে মুহম্মদিয়া আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন, ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে। সতের শতকে ইসলাম আর অ-ইসলামের মধ্যকার সীমা ছিল অস্পষ্ট, নমনীয় এবং সতত পরিবর্তনশীল। একারণে তখনকার মানুষও বাইরে থেকে আগত ইসলামিক ধ্যান-ধারণা এবং ধর্মীয় নেতাদেরকে (তথা, পীর) সহজেই গ্রহণ করত নিজেদের ইহ- এবং পারলৌকিক সমস্যা সমাধানের জন্য। অন্য ধর্মের প্রতি তাদের এই যে বস্তুবাদী উদার মনোভাব, এটি নৃতাত্ত্বিকেরা আফ্রিকাসহ আরও অনেক সমাজেই লক্ষ্য করেছেন।
অর্থ্যাৎ, সেসময়কার বাংলার পল্লীসমাজে ধর্মের সীমানা ছিল উন্মুক্ত এবং নিজেদের প্রয়োজনে তারা বহিরাগত ধর্ম বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে যথাযথ সম্মানের সাথে গ্রহণ করত নিজেদের ধর্মকে বিসর্জন না-দিয়েই। এর ফলশ্রুতিতে আমরা সেসময়ে রচিত সাহিত্যে অ-ইসলামি (তথা, ভারতীয়) এবং ইসলামি অতিপ্রাকৃত স্বত্বার সহাবস্থান দেখি।
গ্রহণের পরবর্তী পর্যায়কে ঈটন বলেছেন আত্মীকরণ (identification) যেখানে অ-ইসলামি সত্ত্বা আর ইসলামি স্বত্বা শুধু পাশাপাশি থাকা নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক হয়ে পড়ে। যেমন, কবি হাজী মুহাম্মদ আল্লাহকে বর্ণনা করেন গোসাই হিসেবে, সৈয়দ মুর্তজা নবীর কন্যা ফাতেমাকে বর্ণনা করেন জগজ্জননী রূপে এবং সৈয়দ সুলতান আদম, ইব্রাহীম ও মুসার স্রষ্টাকে (তথা, আল্লাহ) উপস্থাপন করেন প্রভু বা নিরঞ্জন রূপে। এমনকি, আঠারো শতকে এসেও দেখা যায় যে কবি আলী রাজা আল্লাহকে নিরঞ্জন, ঈশ্বর ও কর্তা রূপে উপস্থাপন করছেন।
সেসময়কার মুসলমান কবি ও গীতিকারদের রচিত সাহিত্যে এভাবে দেশীয় দেবদেবীদের রূপে ইসলামি সত্বাসমূহকে উপস্থাপন করার মূল কারণ ছিল প্রায়োগিক। তৎকালীন সমাজে মহাভারত, রামায়ণ, প্রভৃতি আর্য সাহিত্য এবং বৈদিক দেবদেবী পরিচিত ছিল। মুসলিম কবিগণ তাই জনতার পরিচিত চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়েই ইসলামি স্বত্বা তথা আল্লাহ, নবী-রাসূল এবং অন্যান্য স্বত্বা ও কাহিনী বর্ণনা করেছেন যাতে লোকে সহজেই সেগুলো বুঝতে পারে। এজন্য দেখা যায় যে, পারস্যের ইউসুফ জুলেখার কাহিনী বর্ণনায় বাংলার মুসলমান কবি জুলেখার যে রূপ বর্ণনা করেন, সেখানে সকল উপমা বাংলার রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর রাধার সাথে হুবহু এক। অর্থ্যাৎ, জুলেখা রাধা হয়ে দেখা দেয়। এভাবে তৎকালীন মুসলমান কবি-সাহিত্যিকরা দেশীয় কাঠামো (form) ব্যবহার করে ইসলামি স্বত্বা ও কাহিনী উপস্থাপন করতে গিয়ে ইসলামি ও অ-ইসলামি স্বত্বাগুলোকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপন করতেন। ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা এই দুইয়ের মধ্যে যে আলাদা আলাদা উপস্থিতি দেখি, তা’ ক্রমশঃ পরস্পরের মিধ্যে বিলীন হতে শুরু করে এবং বহিরাগত ইসলামি স্বত্বা বাঙালি বিশ্ববিক্ষার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
এখানে একটা বিষয়ে আলোকপাত করা দরকার। অনেকে উপরের এই প্রক্রিয়াকে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয় বলে অভিহিত করেন, যেমনটি সত্যপীরের কাহিনী ব্যাখ্যায় ডঃ দীনের চন্দ্র সেন করেছেন। কিন্তু ঈটন এই সমন্বয়ের ধারণাকে নাকচ করে দেন। কারণ, এই ব্যাখ্যায় ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের বর্তমান রূপকে তিনশ বছর আগের সমাজে আরোপ করা হয় যা’ ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসেবে ভুল ও অগ্রহণযোগ্য। উপরন্তু এখানে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মকে ধরে নেওয়া হয় একেকটা অনড়, অচল এবং সেইসাথে সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে। অথচ আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রামথিক পর্যায়ের ইসলাম এবং বাংলার স্থানীয় ধর্মগুলো ছিল এখনকার থেকে একেবারেই আলাদা- নমনীয়, উন্মুক্ত এবং পরিবর্তনশীল। একারণে মুঘল আমলে বাংলার উদীয়মান পল্লীসমাজে দুই বা আরও অধিক ধর্মের সমন্বয়ের ধারণাটি ভ্রান্ত এবং অগ্রহণযোগ্য।
পূর্ববাংলার পল্লীসমাজে ইসলামাইজেশনের তৃতীয় দিকটি হলো বর্জন (displacement) যার মধ্য দিয়ে আদিবাসী বাঙালির বিশ্ববিক্ষা থেকে অ-ইসলামি ধর্মীয় স্বত্বা বিলুপ্ত হয়ে সেখানে অবস্থান নেয় শুধুমাত্র ইসলামি স্বত্বা। এই প্রক্রিয়া সবথেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় উনিশ শতকে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকের ফরায়েজী আন্দোলন এবং তরিকতে মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের প্রক্ষিতে। এই আন্দোলনগুলো গ্রামবাংলার ইসলামকে যাবতীয় আদিবাসী ধ্যানধারণা এবং আচার-অনুষ্ঠান থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহ এবং তার রসূলের অনুগামী করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।
ফরায়জী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৯৯ সালে মক্কায় হজ্ব করতে যান। সেখান দীর্ঘকাল ইসলাম শিক্ষা শেষে তিনি ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে বাংলার ইসলাম ধর্মের মাঝে অসংখ্য শিরক ও বিদআত লক্ষ্য করেন, যথা মাজার পূজা, ফাতিহা বা মিলাদ মাহফিল, মোল্লাদের ভুল ফতোয়া, ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মকে সংস্কার করার জন্য তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং সকলকে শিরক ও বিদআত বাদ দিয়ে ফরজসমূহ (যেমন, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রোজা, যাকাত, ইত্যাদি) পালনের আহ্বান করেন। একইভাবে মৌলভি কেরামত আলী সূচনা করেন তরিকতে মুহাম্মদিয়া আন্দোলন। তার প্রভাবেও অনেক দেশীয় বিশ্বাস ও আচার ধর্ম থেকে পরিত্যাক্ত হয়। যেমন, নোয়াখালী অঞ্চলের মাঝি সম্প্রদায় যারা এতদিন দরবেশ বদর এবং পাঁচপীরের কাছে প্রার্থনা করত, তারা সেসব ছেড়ে দিয়ে নামাজ-কালামে মনোনিবেশ করে। একইসাথে এইসব ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রভাবে বাংলার মুসলমানরা আরবী নামকরণ শুরু করে। যেমন, ১৯১১ সালের নোয়াখালীর ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার স্থানীয় জনগণকে প্রধানত আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের নামের শেষাংশে চাঁদ, পাল ও দত্ত ছিল বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু ১৯৫৬ সালের গেজেটিয়ার উল্লেখ করে যে, সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলোর প্রভাবে মুসলমান সমাজে দেশীয় নাম প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে তদস্থলে আরবী নামের প্রচলন শুরু হয়েছে।
বাংলার মুসলমান পল্লীসমাজে ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পেছনে কারণ হিসেবে ঈটন উল্লেখ করেছেন ভারতবর্ষে খ্রিষ্টান মিশনারিদের দ্বারা ইসলামের উপর আক্রমণ, মুদ্রণ শিল্পের কল্যাণে সংস্কারবাদী প্রকাশনার ক্রমবিকাশ, ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বাষ্পীয় জাহাজের মাধ্যমে হজ্বে গমন সহজ হয়ে ওঠা।
উপরে উল্লিখিত বর্জন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য ঈটন পূর্ব বাংলার পল্লীসমাজে নারীর অবস্থানের ক্রমবিবর্তনকে পর্যালোচনা করেছেন। ১৪১৫ সালে চীনের মিং রাজার দূত বাংলা ভ্রমণকালে ধানক্ষেতে নারী ও পুরুষকে একসাথে কাজ করতে দেখেছেন। ১৫৯৫ সালে চট্টগ্রামের বর্ণনায় আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন যে, পুরুষ ও নারী উভয়েই মাত্র একটা কাপড় পড়ে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় (অর্থ্যাৎ, বেপর্দা হয়ে) বাইরে যায়। ১৭০০ সালের দিকে যে রোমান্টিক পালাগানসমূহ রচিত হয়, সেখানেও লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাগ এবং নারীদেরকে গৃহবন্দী করার রীতি অনুপস্থিত। যেমন, দেওয়ান মদিনা কাহিনীর এক পর্যায়ে দেওয়ানের মৃত্যুশোকে মদিনা বিলাপ করার সময় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে সে কিভাবে স্বামীর পাশে থেকে ধানক্ষেতে চাষ, চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান কাটা ও মাড়াই কয়রা পর্যন্ত সমস্ত কাজে অংশ নিত (পৃ, ২৯৯-৩০০)। পরবর্তিতে, বিশেষ করে বিংশ শতকে এসে ইসলামের সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলোর প্রভাবে এবং কুরান-হাদিস শিক্ষার ক্রমবর্ধমান প্রসারের সাথে সাথে পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম সমাজের মতো নারীকে গৃহাভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় এবং পর্দাপ্রথায় প্রচল শুরু হয়। ইসলাম ধর্মের প্রভাব না-থাকায় এখনো পশ্চিম বাংলায় এবং জুমচাষী সম্প্রদায়গুলোতে নারী ও পুরুষ একত্রে ঘরের বাইরে ফসলের মাঠে কাজ করে।
৪
শেষকথা
এই সিরিজের শুরু করেছিলাম বাংলাদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পল্লীসমাজের উৎপত্তি হল কিভাবে সেই প্রশ্ন দিয়ে। অধ্যাপক রিচার্ড ঈটন প্রচলিত সব মতবাদ (যেমন, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তর, বাইরে থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মাইগ্রেট করে বাংলায় আসা, সূফীদের ধর্ম প্রচার এবং মুসলমান শাসকদের জবরদস্তির মাধ্যমে ধর্মান্তর) তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে বাতিল করে ঐতিহাসিক তথ্য ও লোকসাহিত্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামাইজেশনের একটা নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বাংলায় ইসলামের প্রসার ঘটেছে মুঘল আমলে এই অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজ গড়ে ওঠার কালে।
ঈটন প্রথমে দেখিয়েছেন যে, পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজের ভৌগলিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ১৪শ ও ১৫শ শতকে গঙ্গানদ গতি পরিবর্তন করে পদ্মা হয়ে পূর্ববঙ্গের মধ্যে সড়ে আসার পর। সেই সময়ে মুঘলরা বাংলার স্বাধীন সুলতানদের এবং বারো ভুঁইয়াদের পরাজিত করে এঅঞ্চলকে ভারতীয় মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে। মুঘলদের সাথে পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করে বিশাল সেনাবাহিনী, প্রশাসনিক কর্মচারীবহর এবং হিন্দু অর্থলগ্নিকারীগণ। মুঘলদের ভূমি সম্প্রসারণ নীতি ও মুসলমান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মিলিত প্রয়াস এবং আদিবাসী শ্রমিকদের সহায়তায় পাললিক ভূমি থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করে ধানচাষের আবাদ শুরু হয়। সেই সাথে মসজিদকে (এবং মাজার) কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কৃষিজীবিদের গ্রাম। মসজিদের পৃষ্ঠপোষক এবং নের্তৃত্ব হয়ে ওঠে কৃষকসমাজের নেতা। এদের উপরে জমিদার হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলমান ও হিন্দু সেনা এবং রাজকর্মচারীগণ এবং হিন্দু ব্যবসায়ীগণ। আর সকলের নিচে থাকে আধা-জঙ্গলি জীবন ছেড়ে কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে নেওয়া বাংলার আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহ।
নতুন পল্লীসমাজের আর্থ-সামাজিক গঠন প্রভাবিত করে এর সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যা গ্রামবাসীর ধর্মে সবথেকে বেশি দৃশ্যমান। মাঠ পর্যায়ে সমাজের কেন্দ্র মসজিদ এবং নের্তৃত্বে মুসলমানরা থাকার ফলে কালক্রমে ইসলাম এই সমাজের প্রধান ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইসলাম বিকাশের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এই সমাজ নিজের গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ইসলামকে আত্মস্থ করেছে। অর্থ্যাৎ, বাংলার পল্লীসমাজ নিজের স্বতন্ত্র্য পরিচয় (identity) নির্মান করতে গিয়ে ইসলামকে অবলম্বন করে। এই জন্যই ইসলাম ধর্মের সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলোও শেষ পর্যন্ত পল্লীসমাজের আর্থ-সামাজিক অধিকার আদায়ের দাবীতে গিয়ে ঠেকে। যেমন, ফরায়েজী আন্দোলন ইসলামের ফরজ পালন নিয়ে শুরু হলেও এটি জমির উপর আল্লাহর মালিকানার ভিত্তিতে কৃষকের উপর জমিদারের কর আরোপের অধিকারকে অবৈধ ঘোষণা করে। ইংরেজ আমলে গণতান্ত্রিক শাসন সূচনার প্রাক্বালেও এই পল্লীসমাজ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ইসলামের ভিত্তিতেই নিজেদেরকে সংগঠিত করে। অর্থ্যাৎ, বাংলাদেশে আমরা আজ যে পলিটিকেল ইসলামের উত্থান দেখি, তা ইসলামি মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা নয়, বরং ইসলামকে হাতিয়ার বানিয়ে পল্লীসমাজেরই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হওয়া। এখানে কর্তা বাংলার পল্লীসমাজ, আর ইসলামি পরিচয় তার রাজনৈতিক হাতিয়ারমাত্র। এটি নতুন কিছু নয়, বরং বাংলাদেশের পল্লীসমাজের বেড়ে ওঠার একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা।
ধন্যবাদ মাহমুদ। তিনটি পর্বই পড়লাম। সন্ধিৎসু ও তথ্য সমৃদ্ধ রচনা।
আমার একটি প্রশ্ন ছিল- জেনেটিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করো বাঙালি মুসলমানের শেকড় কি কখনো সন্ধান করা হয়েছে? এমন কোনো লেখা আছে?
ণৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আমরা কি- সেটা জানা প্রয়োজন। (সম্পাদিত)
ভাইয়া ধন্যবাদ। তবে মূল কৃতিত্ব রিচার্ড ঈটনের।
ঢাবির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়ের 'আদি বাঙালি নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ' (১৯৯৭) বইয়ে এই নিয়ে কয়েকটা অধ্যায় আছে (পৃ, ৬৩-১১৯)। বইটা সংগ্রহ করেছি। মনোযোগ দিয়ে পড়ার কাজটাও সেরে ফেলবো শিগগিরই 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আজকেই গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি রিপোর্টে দেখলাম লিখেছে, ব্রিটেনে নাকি তিন বছরের ব্যবধানে নিজেদের ধর্মহীন দাবীকারির শতকরা হার ২৫% থেকে বেড়ে ৪৮% -এ উন্নিত হয়েছে।
এরজন্য সাইলেন্ট মাস কনভার্শানের জন্য কিন্তু কোনো প্রচার প্রচারণা করা লাগে নাই।
তথ্য উন্মুক্ত থাকায় মানুষ নিজ থেকেই ওগুলো জেনে বুঝে নিজের সুবিধানুযায়ি বিশ্বাস বদলে ফেলেছে।
সম্ভবত একটা ফাক্টর এটাকে তরান্বিত করে থাকবে, আর তা হলো, বর্তমান বিশ্বাসে থেকে যাওয়ার কোনো এক্সটারনাল প্রেশার তাদের ছিল না।
কথাটা পাড়লাম এটা বুঝাতে যে, এই ভুখন্ডেও এমনটা ঘটার সম্ভবনা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।
এখানে বর্ননা করা প্রক্রিয়ায় যখন মসজিদ বা মাজার কেন্দ্রিক একটি মুসলমান গ্রাম-সমাজ যখন গড়ে উঠেছে, আসেপাশে থাকা অন্য ধর্মাবলম্বিদের অনেকেই সুবিধাজনক হবে ভেবে তার সাথে তাল মিলিয়ে সেটার অংশে পরিনত হয়েছে।
আর এটা করতে তারা হয়তো কোনো স্থানীয় কোনো বাধার মুখেও পড়ে নাই।
যাহোক, অনেক কিছু জানলাম। পরিশ্রমি লিখা।
ভাল লেগেছে পড়ে ও এত কিছু জেনে!!!
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.