এক
অনেক ছোটবেলায় একটা জেমস হিলটন নামে এক লেখকের সাই-ফাই গল্প পড়েছিলাম ‘হারানো দিগন্ত’ (The lost Horizon) নামে। ইউরোপ এবং আমেরিকান চারজন মানুষের অপরহণের রোমাঞ্চকর গল্প দিয়ে শুরু হয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেই অপহরণের মোটিভ বুঝা যেতে শুরু করে। শাঙরি লা নামক এক মঠ ছিল তার উপজীব্য। সেই শাঙরি লা মঠের বাসিন্দারা নিজেদের যৌবন ধরে রাখেন দীর্ঘ সময় কোন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া স্থানীয় তিব্বতীদের চেয়ে ইউরোপীয়ানদের উপর বেশি ফলপ্রসু- এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে গিপিপিগ হিসাবেই অপহৃতদের ধরে আনা হয়। তারপরে সেটা নিয়ে আরো অনেক গল্পই বিস্তার লাভ করে শাখা প্রশাখা ধরে। যাই হোক, সেই উপন্যাস আমার লেখার উপজীব্য না। তারপরেও লেখার শুরুতে সেই উপন্যাসের নাম নেয়া মূলত সেখানকার একটা কোটকে স্মরণ করতে। সেই উপন্যাসের নায়ক হিউ কনওয়ের সাথে মঠের প্রধান লামার কথোপকথনের এক পর্যায়ে প্রধান লামা বলেন, ” বৎস, আমি জানি তুমি হয়তো তোমার হারিয়ে ফেলা পরিববারের জন্য কষ্ট পাচ্ছ, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই কষ্ট মিইয়ে যাবে, অত:পরতা অতীতের চমৎকার ছবি হিসাবে মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিবে।” কথাটা খুব করে মনে করে বিভিন্ন সময়ে, যখন শোকের ঘটনাগুলো একটু একটু করে অতীত হয়। লামার কথামত অবশ্য তা মধুর স্মৃতিতে পরিণত হয় না। তবে, টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার– কথাটা খুব খাটে কখনো কখনো। আমাদের পথচলার মানুষগুলো অতীত হয়ে গেলেও তাদের সাথে কাটানো সময়ের মিষ্টি স্মৃতি আটকে থাকে স্মৃতির পাতায়। সেই স্মৃতিগুলো গোছানো হয় না শুরুতে। অল্প অল্প ছাড়া ছাড়া ভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফেরত আসে মনের পাতায় সময়ে অসময়ে। হারিয়ে যাওয়ার দিনটির বিশেষত্ব না থাকলেও তাই সেই দিনটিতে মানুষটি হাজির হয় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
দুই
শৈশবের স্মৃতি সব মানুষের খুব আপন। সেই কারণেই হয়তো শৈশবের মানুষগুলোর প্রতি যে টান তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। শৈশবের কাছের মানুষগুলো, ভালো লাগার মানুষগুলো ভালোবাসার মানুষগুলো আস্তে আস্তে খুন হয় সময়ের বিবর্তনে। সময় বদলে দেয় আমাদের সবাইকেই। তার পরেই খুন হওয়া মানুষটির সেই পুরাতন অবয়বটিকেই আমরা খুঁজি তার বর্তমান সময়ের প্রেতায়িত অস্তিত্বে।অলস মুহূর্তে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সেই মানুষটিকে বের করে আনা যায় স্মৃতির পাতা থেক। কিংবা প্রতায়িত অবয়বই থেকেই হয়তো কখনো উঁকি মারে সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটি। সব শেষে শৈশব তার নিজ রঙে থাকে তার স্নিগ্ধতা নিয়ে। ফিরে দেখলে শৈশবের আকাশকে মায়াময় মনে হয়, সেই সময়গুলোকে ঘোর লাগানো মনে হয়। শৈশবের মেঘ করা কোন দিনে বারান্দায় কিংবা জানালার ফাঁক গলে নৌকা বানিয়ে জমাটবদ্ধ পানিতে ছেড়ে দেয়া কিংবা দল বেঁধে চোর পুলিশ খেলবার সময়গুলো ঝাপি থেকে বের হয়ে আসে। কিংবা দল হয়ে বসে গল্প কবিতা পড়া অথবা শেষ বিকালে “নোনতা বল রে” কিংবা ‘বরফ পানি’র নেশায় বুদ হয়ে যাওয়ার স্মৃতিগুলোকেও সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। শৈশবের আসলে দুরকমের স্মৃতি থাকে — একটা হলো যা ঘটেছে, আরেকটা হলো যা ঘটতে পারতো কিংবা বলা যায় আমরা মনে করে করি যা ঘটেছে-অর্থাৎ মিথ্যা স্মৃতি। মিথ্যা স্মৃতি ফেলনা হয় না। নিজেদের জগতের আনন্দে আমরা বুদ হয়ে থাকি নিজেদের মত করেই। ভালো থাকুক শৈশব এবং শৈশবের খুন হয়ে যাওয়া মানুষ গুলো।
তিন
মানুষ মরে গেলে আসলে কোথায় যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুগে যুগে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। জীবনের শেষের একটা কানাগলিকে তারা মেনে নিতে পারেনি। সেই প্রভাব আমরা দেখতে পাই আমাদের লোক আচরি ও ধর্মবিশ্বাসেও। নিজের অনুভূতির প্রশান্তির জন্যই হয়তো অবিনশ্বর আত্মা জনপ্রিয়তা পায়। আমাদের অনুভূতিতে তাই মানুষ মরে গেলেও তার আত্মা থাকে আমাদের মস্তিষ্কের অণুরননে। ভালো লাগা মানুষগুলো তাই আমাদের অনুভূতিতে আসে ফিরে ফিরে। জীবনের ওপারে চলে যাওয়া মানুষেরা বয়সে বাড়ে না, বরং থেমে থাকা বয়স নিয়ে অট্টহাস্য করে জীবিত মানুষগুলোকে। জীবিত মানুষগুলো নিজেদের মত করে সাজায় হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। নানান যুক্তির কিংবা বলা ভালো প্রবোধ দিয়ে হারানো মানুষটির স্বর্গ লাভ হয়েছে এমন জিনিস নিশ্চিত করে। অথচ, যে হারিয়ে গেছে তার বর্তমান অবস্থানের শূন্যতাই আসলে চরম সত্য। হারিয়ে যাওয়া মানুষের পূর্ণতা তার স্মৃতিতে তার যাপিত জীবনের ছাপে।
চার
প্রতিদিন আমরা অনেক অনেক মানুষ দেখি, অল্প কিছু মানুষই হয়তো পরিচিত। পরিচিতদের চাইতে অপরিচিতদের ব্যাপারে এক ধরণের কৌতুহল কাজ করে রহস্যময়তার জন্য। অথচ সময়ের অভাবে পরিচিত মানুষদেরও জানা হয় না। প্রতিদিন কাউকে দেখতাম, দেখা হলে বলতো’কেমন আছিস’? উত্তরে বলতাম ভালো আছি। তারপরে, চুপ করে বসে থাকতাম। কথা হতো কিনা মনে করা কষ্টকর কিংবা বলা যায় কথা বলার বিষয় খুঁজে পাওয়া যেত না। প্রতিদিন দেখা হলেও হয়তো কোন মানুষকে কাছে থেকে দেখেও জানা হতো না তাকে। তার ভালো লাগা কষ্ট যাপিত জীবনের ধারাবাহিক বিবরণ। অথচ হারিয়ে গেলে সেই মানুষটিকেই নিজেদের মত করে সাজাই। তার অস্তিত্বের পূর্ণ রূপ আসলে জানা হয় না। যা জমা হয় তা হলো তাকে মহিমান্বত করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা কিছু মিথ্যা স্মৃতি। মানুষকে নিয়ে ভাবনা আমাদের যত দুর্বলই হোক আমরা তার বিদায়ে শোকগ্রস্ত হই। এই শোকের মাঝে থাকে না কোন ভণিতা কিংবা কোন মিথ্যা স্মৃতি কিংবা মহিমার কলেবর।
পাঁচ
হুমায়ুন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকটা আমার খুব প্রিয় মূলত তার রম্য ধাঁচের জন্য। অথচ সেই নাটকের মাঝেই এক ধরণের গভীর বিষাদবোধ লুকিয়ে আছে হাসির আড়ালে সময়ে অসময়ে। এমনি একটি দৃশ্য ছিলো মূলত একজন কিশোরীর জন্মদিন নিয়ে। তার জন্মদিন তার মায়ের মৃত্যুদিন, আর সেই কারণে সেই দিনটিতে বাড়ির মাঝে এক ধরণের গুমোট ভাব কাজ করে। নিজের জন্মদিনে নিজেকে অভিশপ্ত ভেবে একটা মেয়ে কষ্ট চেপে বড় হয়। সেই মেয়ের জন্মদিন অবশেষে পালিত হয় শকের চাদরকে ছিড়ে ফেলে। শোককে পিছনে ফেলে সময়কে রাঙিয়ে তোলার ছবিটা কষ্টের। নাটকের এই অংশে আসলে চিরন্তন বিতর্কের উত্তর খোঁজা হয়েছে যেন। হারানোর ব্যথায় কষ্ট পেয়ে নতুনকে দূরে ঠেলার কোন মানে নেই — এই বোধকে যেন অনুভব করতে পারি কাছ থেকে।
ছয়
আমার দুজন জমজ ভাগ্নে আছে। আপন ভাগ্নে না হলেও সম্পর্কটা আপনের মতই। তাদের জন্মদিন তাদের মায়ের জন্মদিনের একদিন পরে। ফুটফুটে রাজপুত্তুরের মত ভাগ্নে দুটোর পৃথিবীতে আগমণ ঘটার আনন্দময় উপলক্ষের জন্য আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু জগতের অনেক সুন্দর জিনিসের মত তাদের আগমনের সাথে জড়িয়ে ছিলো বিষাদ। তাদেরকে জন্ম দেয়ার পরেই তাদের মা গভীর কোমায় চলে যান। অত:পর দশদিন সংগ্রামের পর তিনি চলে যান জীবন নদীর ওপারে। দশদিন আগে আমার ভাগ্নেদের জন্মদিন পালনের সময় ‘আজ রবিবার’ময় অনুভূতিগুলো কাজ করছিলো মাথার ভিতরে। মৃত্যু, কষ্ট, শোক ছাপিয়ে তারা তাদের মায়ের শূন্যতা পূরণ করে দিক তাদের আপনজনদের। আর তাদের আপনজনেরাও তাদেরকে ভুলিয়ে রাখুক কখনো না দেখা মায়ের জন্য জমা হওয়া কষ্টকে।
ভালো থাকুন শৈশবের সময়ে রাঙিয়ে দেয়া কাছের মানুষগুলো জীবন নদীর এপারে বা ওপারে।
পরথম :awesome:
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খেয়ে নাও। 😛
::salute::
শৈশবের স্মৃতিগুলোই মানুষের জীবনের সবচে বড় সম্পদ। সেই সময়ের কাজ কর্ম এবং তার পরিণতি গুলোই আমাদের বয়সকালে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন করে তোলে। (সম্পাদিত)
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
পড়বার জন্য কৃতজ্ঞতা।
তোমার সাথে সেইভাবে ইন্টার এ্যাকশন হয় নাই। আমি আমিন :)। অনেক আগে ব্লগাইতাম। হা হা হা । (সম্পাদিত)
কে বলছে ইন্টার্যাকশন হয় নাই??? আমি আপনার অনেক লেখা পড়ছি। লেখার মাধ্যমেই তো লেখককে চেনা যায়। তাই না??? 😛 আপনি তো চতুর্মাত্রিকেও লেখেন???
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
আমিন ভাই, দিলেন তো মন টা খারাপ করে 🙁 শৈশবের ঘটনাগুলো চোখের সামনে সিনেমার মত আসা শুরু করেছে ।
হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিস করি বাবাকে। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে বাবা ফিরে আসেন। এবং আমার সর্ব প্রথম যে প্রশ্নটা থাকে, বাবা এতোদিন কোথায় ছিলে?
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াটা তখন অভিশাপ মনে হয়। যদি এমন ঘুম আজীবনের জন্য দেয়া যেত, যেখানে বাবা আছে!
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
মন খারাপ করানোর জন্য দুঃখিত।
হারানো মানুষেরা অনুভবে সব সময়েই থাকেন। আরো বেশি থাকেন স্বপ্নে এবং কল্পনায় একাকী দুর্বল মূহুর্তে।
আমিন ভাই বহুদিন পর লেখা পেলাম, আসেন পরিচিত হই, আমি হামীম 😛
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
ব হুত দিন পরে তোমার এই কমেন্ট পড়লাম। হুম পরিচিত হই। 😛
যাপিত জীবনের দার্শনিকতা :gulli2: :gulli2: :gulli:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
পড়বার জন্য বিনীত কৃতজ্ঞতা ভাইয়া।
মন খারাপ করা লেখা, তাও দারুন লাগলো :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
থ্যাঙ্কু দোস্ত পড়বার জন্য।
বন্ধু ব্লগে মোটামুটি নিয়মিত হবার পর আজ প্রথম তোর লেখা পড়লাম। ভাল লাগলো ।
আব্বা মারা যাবার ১০ বছর পর কেদেছি। ভাল লাগে না।
The Bond Cadet
দোস্ত, তুই ব্লগে আছস এইডাই জানতাম না। অনেকদির পরে আসলাম আসলে।
তোরে দেইখা খুব ভালো লাগলো।