শেকসপীয়ারের “কমেডি অফ এরোর ” পড়ার কিংবা তার অবলম্বনে উত্তম কুমারের ভ্রান্তিবিলাস সিনেমা দেখার আগেই জমজ বিষয়ক বিভ্রাটের সূচনা হয়েছিলো আমার। সেটা যে সময়ের কথা জমজ বিষয়ক সাধারণ ধারণা লাভ হয়নি তখনো আমার।মার্ক ওয়াহ স্টিভ ওয়াহদেরকে দেখা হয়েছে আরো পরে।তখন আমি টু কি থ্রি তে পড়ি।তখন আমার আম্মু একটা গার্লস কলেজের শিক্ষিকা। আম্মুর কাছে অনেক আপুরাই আসতো। ম্যাডামের ছেলে হবার সুবাদে চকলেট লাভ তো হতো সেই সাথে আপুদের কাছ থেকে ন্যাকামিপূর্ণ আদরের সমাগমও হতো বিপুল।এমনি একদিনের কথা। একজন সুইট আপু আমাকে ডেকে নিয়ে খুবই আদুরে গলায় বলছেন “ভালো আছো?” আমি জবাব দেবার আগেই আরেক জনের কন্ঠে শোনা গেলো “তোমার নাম কি?” এবার দূরে বসা আপুর দিকে ঘুরে তাকালাম। ভূত দেখার মত চমকে উঠে আগের আপুর দিকে তাকালাম। এক মানুষ দুজন হয়ে গেছে। ওরে বাপ্পস !! ভূত প্রেতের আছর ঘটার বিপুল সম্ভাবনায় আমি তাদের দুজনের দিকে একবার করে তাকিয়ে দরজা লক্ষ্য করে দিলাম ভো দৌড়।
সেই ঘটনার পর অনেকদিন চলে গেছে।সময়টা আমার বুয়েটের প্রথম টার্মের কথা।কোন এক ক্লাশ টেস্টের আগে একজনের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব হলো। নাম রাহাত। খুবই মিশুক ছেলে। অল্প সময়ের মাঝেই তুমি থেকে তুই হয়ে যায় এমন সম্পর্ক। ক্লাশ টেস্ট শেষ করে বেরিয়েছি। আশেপাশে তখনো কাউকে দেখছি না। শুধু দেখি করিডোরে রাহাত পায়চারি করছে।চেনা মানুষ দেখে গদগদ করে ক্লাশ টেস্টের অংকের এনসার মিলাতে গেলাম। ছেলেটি আমাকে দেখেও খুব বেশি গদগদ হলো না দেখে একটু বিব্রত হলাম। একটু আগে যার সাথে কথা বললাম সে আমার প্রশ্ন শুনে এমন ভাব করলো যেনো আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না অথবা বুঝতে পাচ্ছে না। ” আমি আসলে এই ডিপার্টমেন্টের না।” এই জাতীয় কুৎসিত রসিকতায় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। হাতের উপর জোরে ঘুষি চালিয়ে বললাম “ব্যাটা একটু আগে এক সাথে বসে পড়ালেখা করলাম আর এখন ফাইজলামি করস”। ছেলেটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “আমি সাদাত। তুমি যার সাথে কথা বলেছো সে আমার টুইন রাহাত”। বিরাট কেলেঙ্কারি অবস্থা।ব্যাচমেট বলে সে যাত্রায় সরি বলে রক্ষা।
তবে জমজ বিভ্রাট হতে আমার মুক্তি মিলল না।এবার একদম হলে এসে আমার পাশের রুমেই ঘটে গেলো ঘটনা। আমার পাশের রুমে উঠলো জাহেদ ( হোসেন ভাই (ঝকক ৯৫-০১))। ওর সাথে মোটামুটি একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে তখন। একদিন দেখি সে রুমের উপর নাম্বার পড়তে পড়তে রুমে ঢুকছে। আমি বললাম, “কী রে জাহেদ , কী খবর। ” সে কোন উত্তর দিল না। তার রুমমেট এক কাঠি সরেস। সে বললো, আরে মিয়া দুই মাস হইলো হলে উঠলা এখনো রুমের নাম্বার গুনে রুমে ঢুকো । ব্যাপার কি?” এবারেও ও নিশ্চুপ। এবার ওর রুমমেট ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বললো, ” ঐ মিয়া মাইন্ড করলা নাকি?” “আমি জাহেদ না আমি শাহেদ।” এইবার আমাদের দুইজনের চুপ হয়ে যাবার পালা। ভাগ্যিস তার কয়েক মিনিটের মাঝে জাহেদ রুমে এসে ঘটনাটা হালকা করে নিয়েছিলো। তা না হলে অন্তত বড় ভাইয়ের সাথে ইজি হওয়াটা কঠিন হয়ে যেতো।
পরের বিভ্রাটটাও জাহেদের রুমেই ঘটে। আমাদের ক্লাশের শান্ত প্রায়ই জাহেদের রুমে আসতো। তো এমনি একদিনের কথা। জাহেদের রুমে উঁকি দিলাম। দেখি জাহেদ আর শান্ত কথা বলছে। আমি নিশ্চিত হয়ে নিলাম ওটা জাহেদ কিনা। তারপরে শান্তকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করলাম। এবার শান্ত চুপ মেরে রইলো। আমি রসিকতার ছলে বললাম, “কিরে, এখন বল তুই শান্ত না। জাহেদের মত শান্তরও জমজ আছে। আর তুই হলি সেই জমজ”। আমার উটকো রসিকতা পরক্ষণেই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। সেই ছেলে খুব শান্ত কন্ঠে বলে, “আমি সবুজ শান্তর টুইন।” ফলাফল আবারো এক টুইনদের হাতে জব্দ।
এবার আরেক টুইনের গল্প বলি। এরা আসলে টুইন না। কিন্তু কলেজে এরা টুইন হিসাবে খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলো। আমাদের ব্যাচের মোরশেদ আর মাহমুদ। গায়ের রং আর শারীরিক গড়নের কারণে তাদের বিভ্রাট নিজেদের উপরই পড়তো। একজনের ফল্টে আরেকজনের পাঙ্গা খাওয়া ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।এমনকি একজন হাসপাতালে থেকেও একবার এনসিওর কাছে রামঝাড়ি খেয়েছে হাসপাতালে এডমিট হয়ে গেমসে যাওয়ার জন্য। এই সেদিনও নাকি মেকার অনুষ্ঠানে কোন এক জুনিয়র মাহমুদকে মোরশেদ ভাই ভেবে অনেকক্ষণ কথা চালিয়ে গেছে।
শেষ করবো আরেক জোড়া জমজের কথা বলে যাদের আলাদা করতে আমার কখনোই ভুল হয় না। এরা হলো আমার ভাগ্নে। এদের মা আমার ফুফাতো বোন। ঠিক কাজিন হলেও সম্পর্কে আপন বোনের মতই। ছেলেবেলায় খুব কাছাকাছি বড় হওয়ার কারণে আপুকে আমি আপন বোনের মতই দেখতাম। আর এই জমজের জন্মের আগেই তাদের ঘিরে আমাদের মাঝে একধরণের জল্পনা কল্পনা উত্তেজনা ছিলো। ছেলে টুইন হবে জানাই ছিলো। তাদের নাম জাদীদ – সানিব আপুই ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু জগতের অনেক সুন্দর জিনিসের আগমন ঘটে বড় কিছুর বিনিময়ে। তাই হয়ে যায় জাদীদ সানিবের জন্মের বেলায়। ওদের জন্ম দেবার আগে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন আপু।এক সাথে কিডনী লিভার ব্রেইনে মাল্টি অরগান ফেইলুর। ওদের জন্ম নেবার প্রক্রিয়া আপুকে ঠেলে দেয় মেডিক্যালি ডেড কন্ডিশনে। আপুর জন্মদিন ২৩ শে জানুয়ারি আর উনার ছেলেদের ২৪ শে জানুয়ারি। নিজের মাঝে তিলে তিলে বড় করে তোলা সন্তানদের একবারের জন্যও দেখার সুযোগ হয়নি আপুর। আর জাদীদ সানিবেরও সুযোগ হয়নি তাদের জন্মদাত্রী জননীকে অথবা হবে কখনো ছবিতে।
সেদিন বসে আমি আবিষ্কার করি আমি বয়সে আপুকে ছুঁয়ে ফেলেছি। হয়তো ছাড়িয়ে যাবো এ বছরেই। আপু কখনো বুড়ো হবেন না। তিনি বেঁচে থাকুন সন্তানদের মাঝে । তার সন্তানরা বেঁচে থাকুক অনেক বছর…… বয়সে ছাড়িয়ে যাক তাদের মাকে….
২৮ টি মন্তব্য : “জমজ বিভ্রাট”
মন্তব্য করুন
......১ম নাকি? 😀
ওই মিয়া তোমার সমস্যাটা কি? শেষে এসে মন খারাপ না করাইয়া দিলে হয় না?
ঠিক আছে বস, এরপর থেকে শুরুতে মন খারাপ করায়া নিমু 😀 😀
হালকা চালে মজা নিয়ে পড়ছিলাম। বুঝিনি শেষে এসে এমন মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে। ভাল থাকুন আপা। জাদীদ, সানিবের জন্য অনেক অনেক আদর।
লেখাটা তো মজা নিয়েই লেখা 🙂 🙂
দিলাতো শেষে মনটা খারাপ করে।
🙁 🙁 🙁
এত মজা করে পড়তছিলাম, আর তোরে একটু পচানি দিয়া কমেন্ট ভাবছিলাম মনে মনে, কিন্তু শেষে এসে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। জাদীদ সানিব অনেক বড় হোক এই দোয়া করি।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ইসস !! এখন তো মনে হইতেসে শেষ প্যারা না লেখাই ভালো ছিলো।
মাঝে মাঝে ওদের জন্য অকারণেই মন খারাপ হয় 🙁
মন খারাপ হয়ে গেলো শেষের অংশটুকু পড়ে।
যে রাহাত-সাদাতের কাহিনী লিখেছো, তারা আমার মামাতো ভাই।
পৃথিবীটা দেখি আসলেই ছোট
আমাদের ব্যাচে ছিল রুবেন আর রাব্বানী, জমজ। কত কান্ড যে হইতো এইদুইটারে নিয়া 😀
এক বছরের মাথায় আমরা অবশ্য ঠিকঠাক বুঝে ফেলতাম কোনটা রুবেন আর কোনটা রাব্বানী, তখন মনে হত এদের মধ্যে এত পার্থক্য, তারপরও লোকজন ভুল করে কেন 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই আপনেই খালি আমার লেখাটা মজা নিয়ে পড়লেন। 😀
জমজ বিষয়ক বিভ্রাট বরাবরই সেইরকম জমে। 🙂 🙂
না আমিন, মজাও পেয়েছি, কস্টও পেয়েছি। কিন্তু কস্টটা শেয়ার করিনি আরকি।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
:thumbup: বন্ধু,বরাবরের মতই সিরাম হইছে,কিন্ত শেষে মন টা খারাপ করে দিলা
থ্যাঙ্কু 🙂
আমাদের ছোট দুই খালা জমজ। দুইজনেরই বিয়ে-বাচ্চা সব কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। নানা বাড়ীতে ঈদে তারা দুইজন বেড়াতে আসলে সবথেকে বড় মজা হতো তাদের বাচ্চাদের নিয়েঃ পিচ্চিগুলা একবার একদিকে তাকিয়ে একজনকে দেখে মা' ভাবত, আবার আরেকদিকে তাকিয়ে আরেকজনকেও মা' ভাবত। তারপর ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত :)) ।
লেখার শেষটা এভাবে না করলে হতো না.........
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:)) :)) :))
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মাহমুদ, তোমার খালাতো দুলাভাইরা কি করতো? তারাও কি ভ্যাঁ করে কাদত? 😀
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
=)) =)) =))
=)) =)) =)) =))
:khekz:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মাহমুদ ভাই, এই ব্যাপারটা যে আগে ভাবিনি তা নয়।আমাদের এক ফর্ম মিস্ট্রেস একটা কথা বলতেন, আনন্দ সবার সাথে শেয়ার কর তাতে আনন্দ গুণ আকারে ছড়িয়ে যাবে, আর দুঃখও সবার সাথে শেয়ার কর তাতে ভাগ হয়ে দুঃখের বোঝা কমিয়ে দিবে। সেই অণুপ্রেরণা থেকেই মনে হলো এভাবে শেষ করা ঠিক আছে।
কিছু লেখা পড়ার সময় মন ভাল হতে হতেই আবার খারাপ হয়ে যায়, এটা সেরকম একটা লেখা
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
পড়লাম। "আমিন সাহেব" মার্কা কিছু লিখতে চাইছিলাম, সেইটা হলো না। রাশেদের সাথে সহমত।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
হোসেন ভাই আর শাহেদ ভাইকে নিয়ে আমিও একবার কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। কুমিল্লাতে ঢাকা ভার্সিটির ইকো ডিপার্টমেন্টের পিকনিক ছিল। সেখানে গিয়ে হোসেন ভাই-এর জমজ ভাই শাহেদ ভাইকে গিয়ে "আরে হোসেন ভাই কেমন আছেন খবর-সবর কি" বলে সারা!
শেষটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল...
@ রাব্বী ভাই , রাশেদ , মেহেদী, মন খারাপ করার জন্য সরি। আড় কিছু বলার নাই।
@আদনান, এই পেয়ার আসলেই খুব কনফিউজিং। অনেকদিন এক রুমে থাকার পরও আমাদের কনফিউশন হতো।