একটি না-গল্প: সার্ভিস চার্জ

মিড-লেভেল কর্পোরেট কামলা থাকা কালে ইনি এক সন্তানসহ একা হয়ে পড়েন।
তাতে কি? কর্পোরেট কামলার ব্যস্ত জীবন, ক্যারিয়ার তৈরীর প্রানান্তকর সংগ্রাম, পাশাপাশি সন্তানের বেড়ে ওঠা, মানুষ করার দায়িত্ব – সব মিলিয়ে একাকি জীবনটাকে তার কখনো বোঝা মনে করার কোন সুযোগই হয় নি।
মধ্য চল্লিশে পৌছে তিনি যখন শীর্ষ পর্যায়ে পৌছেছেন, হেড অব সামথিং, দেখলেন আগের সেই ব্যস্ততা আর নেই। অফুরন্ত অবসর নিজের জন্য। সন্তানটিও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যত্র চলে গেছে। তার সাথে নেই। অফিসের সময়টা যাও সবার মাঝে কাটে একরকম, সন্ধ্যায় শুনশান গৃহকোনে ফিরতে মন টানে না একদমই।
একটা সময়ে, ছুটির পর লিফটে ওঠা নামার ফাঁকে প্রায়ই চোখাচোখি হয় পনেরো-কুড়ি বছরের ছোট সুদর্শন এক তরুনের সাথে। ভদ্র নম্র ছেলেটা সবসময়ে সালাম দেয়। ম্যাডামকে লিফট ছেড়ে দিয়ে নেমে যেতেও উদ্দত হয়। উনি নিষেধ করেন। চোখাচোখির এই পরিচয়টা সহনীয় হয়ে এলে একদিন তিনি জানতে চান, এখনেই কাজ করে কিনা ছেলেটি?
উত্তরে জানলেন, সে বিভিন্ন চুক্তি ভিত্তিক কাজ করে থাকে। আপাতত এই ভবনে অন্য এক অফিসে কিছু একটা প্রিন্টিং এর কাজ করছে। কাজ শেষের দিকে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই অফিসের পাট চুকবে। তিনি বললেন: ও, আচ্ছা।
বাড়িতে এসে মায়া হলো। কাজ শেষ মানে তো আবার এক ধরনের বেকারত্ব। এত ভদ্র, ভাল – ছেলেটা এইভাবে বেকার হয়ে আবার কাজের সন্ধানে পথে পথে ঘুরবে? ভাবলেন, নেক্সট দেখায় ওকে কোথাও নিয়ে ভাল-মন্দ খাইয়ে আনবেন।
দু তিন দিন পর আবার লিফটে দেখা। কথাটা পাড়লেন এইভাবে:
– কাজ তো প্রায় শেষ, তাই না?
– জ্বী ম্যাডাম, আর দিন দুই।
– তারপরে তো আর তোমার সাথে দেখা হবে না। কবে ফ্রি আছো? চল, তোমাকে একটা ফেয়ার ওয়েল ডিনার করাই।
– ম্যাডাম কি যে বলেন?
– না না, কোন অসুবিধা নাই। চাইলে আজও যেতে পারো। বাসায় ফিরে ডিনার তো করতেই হবে, সেটা করেই না হয় গেলাম। কি বল?
আর কিছু বলতে হয় না। এই নিমন্ত্রন উপেক্ষা করার সাধ্য নাই ছেলেটির।
কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় ভদ্রমহিলা আর ছেলেটা মোটামুটি অভিজাত কোন এক রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছেন। দীর্ঘ্য সময় নিয়ে স্ন্যাক্স, ডিনার, ডিসার্ট খেয়ে রাত দশটার দিকে ছেলেটিকে তার থাকার জায়গার কাছে নামিয়ে দিয়ে আসেন ভদ্র মহিলা।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয় না। দুদিন পর উনি যখন নামছেন। দেখেন ছেলেটি নীচে দাঁড়ানো। বল্লো, ম্যাডাম, কাজ শেষ। বিল পেয়ে গেছি। চলেন আজ আমি আপনাকে কফি খাওয়াই।
আবার তারা গেলেন এবং একইভাবে বাড়ি ফিরতে রাত গভির হয়ে গেল।
নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় হঠাত তার মনে হলো, অফিস শেষে এতটা আনন্দময় সময় তিনি অনেকদিন কাটাননি। ফোন নাম্বার আগেই নেয়া ছিল। দু-চার দিন পর পর তার ছেলেটির সঙ্গ পেতে ইচ্ছা হয়। হলেই ফোন করেন।
– নতুন কোন কাজ পেয়েছো?
– না ম্যাডাম এখনো পাই নাই। আপনি যদি একটু রেফার করতেন।
– ফ্রি থাকলে চলে আস। ডিনার করতে করতে আলাপ করি।
এরপরে কয়েক ঘন্টা কোন দিক দিয়ে কেটে যায় ঠাহর করতে পারেন না তিনি। একজন নির্দিষ্ট মানুষের এটেনশন পাওয়ায় যে এতটা আনন্দ থাকতে পারে তিনি আসলে ভুলেই গিয়েছিলেন।
যতই দিন গড়াতে থাকে তিনি ঠিক ঠিকই বোঝা শুরু করলেন, রাতে ওকে ছেড়ে যেতে তাঁর আর ভাল লাগে না। ইচ্ছা হয়, সাথে করে বাড়ি ফিরতে। আরও কিছু খুনসুটি চালিয়ে যেতে। হাত ধরা ধরি করতে, চাই কি আরও বেশী কিছু, যদি তার সম্মতি থাকে।
এসব ভেবে এই মাঝ বয়সেও তাঁর কেমন একটা শিহরন হয়। জেগে উঠতে চায় শরীর।
আবার কি ভাববে ছেলেটা, এটা ভেবে সংশয়ও জাগে মনে। একদিন তিনি সব সংশয়, সব দ্বিধা ঠেলে নামানোর সময় বলেই ফেলেন,
– তোমাকে এইভাবে ছেড়ে দিতে ভাল লাগে না।
– জ্বী ম্যাডাম, আমি জানি। তবে সেটা কিন্তু কস্টলি হবে। আমি এসকর্ট সার্ভিসও দেই। সাধারনতঃ উইক এন্ডে। তবে আপনি চাইলে অন্য দিনও আসবো। ঐটার জন্য কিন্তু লাঞ্চ-ডিনার না সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। ফোন নাম্বার তো আছেই। ঠিকানা বলে দেবেন। চলে আসবো।
********************
গল্পটা এখানেই শেষ। সত্যিটা এরপরেও আছে।
আমি আর আমার এক প্রবাসি বন্ধু ক্লাবের বারে বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ ফোন এলো ওর। উঠে গিয়ে কথা বলে এসে জানতে চাইলো, “মেল এসকর্টদের সার্ভিস চার্জ কত, জানা যাবে কিভাবে?”
আন্দাজে বললাম, ডিপেন্ডস অন ক্লায়েন্টস স্ট্যাটাস এন্ড এবিলিটি। স্ট্যাটাস এন্ড এবিলিটি জানতে গিয়ে পুরো ঘটনাটা জানলাম।
উনি তাঁকে আসতে বলেছেন – বাড়িতেই। অনভিজ্ঞতার কারনে কত পেমেন্ট করলে সঠিক হবে বুঝতে চাইছেন। আফটার অল উনি এখন সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে সার্ভিস নেবেন। মার্কেট রেইট জানা না থাকায় ঠকতে রাজি নন। বন্ধু বলে এসেছে, জানি না। আমি জানবো ক্যামনে?
আমি আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম। বললাম, দু হাজার অফার করতে বল। পরে জেনেছি, আন্দাজটা খুব খারাপ ছিল না। সে হৃষ্ট চিত্তেই দু হাজার নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে আবারও সার্ভিস দিয়েছে। ঐ দু হাজারেই।
এখন সপ্তাহের একটি দিন তিনি নিয়ম করে দু হাজার টাকা সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে সঙ্গ ও আনন্দ কেনেন। মাঝে মাঝে বাড়তি টিপস দিয়ে বাড়তি সার্ভিসও নেন। আজকাল তাঁর আর একা একা লাগে না। যেকোন কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলে মানুষ কিভাবে যেন মানিয়ে নিতে শিখে যায়!!! অদ্ভুত এক প্রানি। কোন সংজ্ঞায় পড়ে না…

আরও কিছু না-গল্প:

আরেকটি না-গল্প: বেল্ট কাহিনী

না-গল্প তিন: তোড়ার জন্য

না-গল্প চার : আড়াইখানা ব্রেক-আপ কাহিনী

না-গল্প পাঁচ – তোড়ার কথা

২,৪৯৪ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “একটি না-গল্প: সার্ভিস চার্জ”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ভালো লাগলো পারভেজ। সরাসরি আগেই বলেছি। সিসিবিতে লগইন করলাম আবার বলার জন্য।

    (ফুটনোট না দিলে বুঝতেই পারতাম না, "ইহা সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত"!)


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      লাভলু ভাই, এই প্রথম আপনার কমেন্ট পেলাম। আর পেয়ে সত্যিই আপ্লুত হলাম।
      গল্পটি সত্যাশ্রিত তবে পুরোপুরি যে সত্য, তা কিন্তু ঠিক না। কিছু অলংকরন তো থাকতেই হবে।
      সত্যটা কাছাকাছিই তবে কতটা কাছাকাছি, তা বলতে চাইছি না।
      কমেন্ট করায় অসংখ্য ধন্যবাদ।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    গতবার যখন দেশে ছিলাম এমন উশকো খুসকো কিছু গুজব শুনেছি, মেল এস্কর্ট এর ব্যপারে। তবে আমি মনে করি পেশা হিসাবে এটা যথেষ্ট কঠিন কাজ, পরিপাটি থাকা, চোখে পরা, বিছানায় ভালো হওয়া সব মিলিয়ে ২০০০ টাকা খুব বেশি না। আমি শুনেছি আরো বেশি মূল্যে এরা কাজ করে থাকেন।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।