মামা এবং দ্যা গিনিপিগ

অন্তুমামা আমাকে এপর্যন্ত যেসমস্ত উপহার দিয়েছেন তারমধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল আপ্রিয়া নামক গিনিপিগটি। ইঁদুরজাতীয় ছোট্ট স্তন্যপায়ী এই গৃহপালিত প্রাণীটির আপ্রিয়া নামটি অন্তুমামার আর আমার প্রিয়া নামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রাখা হয়েছিল। সে সময়টায় আমার ভেতরে ভুতের ভয় ছিল অনেক বেশি আর প্রাচীন মানুষের ধারনা ছিল যে, গিনিপিগ অশুভ আত্মাকে দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ। এই কারণে, মজারু অন্তুমামা আমার বারোতম জন্মদিনে আমার জন্য আপ্রিয়াকে উপহার হিসেবে এনেদেন।

শুরু হলো আমার এক নতুন জীবন। আপ্রিয়া আর আমি সময়ের সাথে দুজনই বড় হতে লাগলাম। তুল-তুলে নরম আপ্রিয়াকে যেই দেখে, সেই তার হাতে তুলে নিয়ে আদর করে। মামা বলেছেন, সামাজিক প্রাণী হিসেবে গিনিপিগদের সুনাম রয়েছে আর এরা খুবই বন্ধুবৎসল। আমার আব্বু আপ্রিয়ার জন্য সুন্দর একটি খাঁচা বানিয়ে দিয়েছে। আপ্রিয়ার খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব আমি নিজেই নিয়েছি। তবে আমি সকালে যখন স্কুলে থাকি তখন আমাদের কাজের বুয়ার মেয়ে রাফিজা আপ্রিয়াকে খাওয়ায়। আপ্রিয়ার প্রধান খাবার কঁচিঘাস আর খড়। এগুলো প্রতিদিন সকালে রাফিজা তার সাথে করে নিয়ে আসে। এর পাশাপাশি আমি মাঝে-মধ্যে আপ্রিয়াকে দুধ, বিস্কুটসহ এটাসেটা খাওয়াই।

অন্তুমামার একটা মজার বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা হলো মামার পকেটে সবসময়ই দশ-বারোটা করে ওষুধ থাকে। আমি শুনেছি, মামা ওষুধ তৈরি করেন আর মানুষকে খাওয়াবার আগে উনি তা গিনিপিগদেরকে খাইয়ে সে ওষুধের গুনাগুন পরীক্ষা করেন। এটা শোনার পর থেকেই আমার একটা গিনিপিগ নেবার মনে-মনে শখ জাগে। যেটা কিনা মামা আমার জন্মদিনে পুরা করেন। এতো সুন্দর একটা প্রাণীকে যে মামা কিভাবে নির্দয়ের মতোন করে ওষুধ নামক কষ্টকর জিনিসটা খাওয়ান আমি তা ভেবে পাইনা। মামা বলেন, গিনিপিগরা তার ওষুধ নিয়ে গবেষণার একটি নমুনামাত্র। মানুষের কল্যানের জন্যই একে ব্যবহার করা হয়। প্রতিবছর প্রায় কয়েক মিলিয়ন গিনিপিগ পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহৃত হয়। এদের বংশবৃদ্ধির হারও অগণিত।

আজ বেশ কয়েকদিন ধরেই রাফিজা আমার আপ্রিয়ার জন্য কঁচিঘাস আর খড় নিয়ে আসছে না। তার মায়ের নাকি বুকে ব্যথা হয়েছে তাই হাসপাতালে ভর্তি আছে। বাসাতে কাজের মানুষ না আসলে সবাইকেই কষ্ট পোহাতে হয়। অন্তুমামার সাথেও বেশ কিছুদিন হয়ে গেল দেখা হচ্ছে না। একদিন হটাৎ করে সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি অন্তুমামা আমাদের বাসায় এসে হাজির। আর বাসার সবার ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। শুনলাম মামার চাকরিটা চলে গেছে। আরও একটা খারাপ খবর শুনলাম। সেটা হলো যে, রাফিজার মা মারা গেছেন।

রাফিজা আমাদের বাসাতে সেদিন এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করছিল সে। তার মা হারানো বেদনার শান্তনা কিভাবে দিতে হয় সেটা বোধ হয় কারোরই জানা ছিল না। স্কুল পড়ুয়া মেয়ে রাফিজার ভবিষ্যৎতটা নষ্ট হতে বসেছিল। সেদিন রাফিজার মুখ থেকে তার মায়ের মৃত্যুর যে ভয়ানক কথা শুনেছিলাম তা আমার আজও মনে আছে। রাফিজা বলেছিল, বুকে ব্যথা অনুভব করায় সেদিন তার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা অনেক গরীব মানুষ তাই সাধারণত হাসপাতালে চিকিৎসকের দেখা পেতে তাদের দীর্ঘ লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সেদিন চিকিৎসক তাদেরকে আগে-আগে দেখলেন আর অনেক দামী ওষুধ দিলেন। হাসপাতালে গেলে মাত্র দশটাকাতে একটি রসিদ দেওয়া হয়েছিল তাদেরকে। চিকিৎসকেরা তাকে বলে, তারা আরও এক লক্ষ টাকা দামের ওষুধ দেবে। বেশি দামের ওষুধের বাকী অর্থ সরকারি তহবিল থেকে জোগানো হবে। কিন্তু রাফিজা তখনও বুঝতেই পারেনি যে তার মায়ের ওপর ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ওষুধের পরীক্ষা চালাচ্ছে চিকিৎসকেরা। ওই ওষুধ সেবনের পর তার মায়ের হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান তিনি।

এটি নাকি একটি গোপন বিষয়। আর এমন হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গোপন বিষয়টি চোখে পড়েছিল আমার মামার। এ নিয়ে মুখ খোলায় ওষুধ কারখানা থেকে মামার চাকরিটা চলে যায়। মামা বলছিল, আজকাল বিভিন্ন হাসপাতালে গোপনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা নতুন ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সেসব পরীক্ষায় গিনিপিগের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের দেশের নিম্নশ্রেণীর হতদরিদ্র মানুষকে। এর মধ্যে পরীক্ষায় ব্যবহৃত মানুষের অধিকাংশই শিশু। তারা চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকেই বিভিন্ন জটিলতার শিকার হয়েছে এবং মারাও গেছে।

গরিব বলেই তারা গিনিপিগ ভেবেই রীতিমতো গা শিউরে উঠেছিল আমার। কী ভয়ানক ব্যাপার, ভাবাই যায় না! সভ্যতার চরম উৎকর্ষে এসে এ ধরনের নিষ্ঠুরতা সত্যিই হতাশাজনক ও দুঃখজনক। এই মানুষগুলোর অপরাধ কী একটাই যে তারা দরিদ্র ও অসহায়? পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে এই দরিদ্র মানুষদের যারা ব্যবহার করছে, তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

বেশ কিছুদিন পরের কথা। অন্তুমামার আবার নতুন একটা চাকরী হয়েছে। দেখলাম সকাল সকাল কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে মামা আমাদের বাসায় এসে হাজির। রাফিজার মা মারা যাবার পর থেকে রাফিজা এখন আমাদের বাসাতেই থাকে। তার পড়ালেখার দায়িত্বও আমার বাবা-মা নিয়েছে। সবার মাঝে মামার নতুন চাকরির মিষ্টি বিতরণ চলছে। রাফিজাও মিষ্টি মুখ করেছে। তাকে বলা হলো আপ্রিয়ার সামনে একটুকরা মিষ্টি রাখতে। আপ্রিয়ার ভাগ্যটাই ভালো যে সে গিনিপিগ মানে একটি প্রাণী হয়েও আমার মামার চাকরির মিষ্টি খেতে পারছে। আপ্রিয়া যেন আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য। যখন রাফিজা আপ্রিয়ার সামনে মিষ্টি রাখছিলো তখন হঠাৎ আমার মনেমধ্যে একটা প্রশ্ন জাগলো যে, আসলে গিনিপিগটা কে, আমার পোষা প্রাণী আপ্রিয়া নাকি রাফিজার মা যাকে কিনা ওষুধের গবেষণার জন্য গিনিপিগের মতোন ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয়েছিল?

-সমাপ্ত-

 

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।