যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – তৃতীয় পর্ব

যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – প্রথম পর্ব
যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – দ্বিতীয় পর্ব

সাত
আজ আলোপ করবো, নারীর যৌনতায় অংশগ্রহন সম্পর্কিত ভুল ধারণা বা ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে।
অল স্ট্যাগ হ্যাং আউট গুলোতে যেসব গাইজ-টক হয়, সেখানে নারী সম্পর্কিত নানা আলাপ সালাপ হয়ই।
প্রায়ই এসব আলাপে দেখা যায়, এমন কোনো কোনো নারীর বিষয় উঠে আসে, যিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরুষের সাথে এমন সম্পর্কে ছিলেন, যেটা শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্তও গড়িয়েছে।
এধরনের নারীদেরকে সাধারনতঃ “বেশ সস্তা মেয়ে মানুষ” হিসাবে বর্ননা করতে গিয়ে “ওমুক তো দিয়ে বেড়ায়” বা এই জাতিয় কথাবার্তা বলাটা খুবই কমন।
ভাবখানা এমন, যে সেই নারীটি সারাক্ষনই প্রস্তুত একখানা সেরকম প্রস্তাবের অপেক্ষায়। আর এজন্য যেন তাঁর মতামত বা পছন্দ-অপছন্দের কোনো বালাই ই নাই!!!
বলাই বাহুল্য যে এই ধারণাগুলা মারাত্বক ভুলে ভরা, সেক্সিস্ট, ডিমিনিং!!!
একজন নারীর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরুষের সাথে যদি দৈহিক সম্পর্ক সম্বলিত কোনো সম্পর্ক হয়েও থাকে, সেটা কখনোই এজন্য নয় যে এ ব্যাপারে তাঁর কোনো অপিনিয়ন নাই, তাই সে যে কারো যে কোনো প্রস্তাবেই প্রস্তুত। বরং তা এই জন্যই যে তিনি ঐ ঐ পুরুষদের ভালবেসে, বিশ্বাস করে, পরম আস্থায় নিয়ে এমন সম্পর্কে ঢুকেছেন যেখানে তাঁর জন্য শারীরিকভাবে জড়ানোটাও আপত্তিকর কিছু মনে তো হয়ই নাই বরং কাংখিতই ছিল।
মনে রাখতে হবে, নারীর যৌনতা আর পুরুষের যৌনতার ধরনে ও ইনভলভমেন্টে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই পার্থক্য ওভারকাম করে একজন নারী যখন এগিয়ে যান, সেখানে ছোটখাটো না, বিশাল ভাললাগা, ভালবাসা, কমিটমেন্ট, আকর্ষন, আবেগ, অনুভুতি, নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস, আস্থা, শ্রোদ্ধা, ধরে রাখার ইচ্ছা, ইত্যাদি কাজ করে।
ক্রুড ভাবে বললে, পুরুষের যৌনতা যেখানে শরীরের বাড়তি একটা অংশের একটি কাঙ্খিত সাময়িক আশ্রয় গ্রহন, নারীর যৌনতায় সেখানে একটি ফরেন ম্যাটেরিয়ালকে পরম যত্নে নীজের শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল, নাজুক অংশে আশ্রয় দেয়া, ধারণ করায়ই শুধু সীমাবদ্ধ না, এর পরবর্তি ফ্লুইড এক্সচেঞ্জের ও সে সম্পর্কিত যাবতিয় ঝুঁকি (যার মধ্যে মৃত্যু-ঝুকিও অন্তর্ভুক্ত) বয়ে বেড়ানো পর্যন্তও বিস্তৃত।
এতটা শারীরিক ও মানসিক ইনভলবমেন্ট যে কাজটিতে জটিত, সেটাকে “দিয়ে বেড়ানো” বা “সস্তা কাজ” মনে করতে হলে একজনের মধ্যে গুরুতর মানসিক বৈকল্য থাকতে হয়।
ভালবেসে একজন নারী তাঁর পছন্দের কোনো পুরুষের সাথে পূর্ন সম্মতিতে কতটা ঘনিষ্ট হবেন, আদৌ হবেন নাকি হবেন না – এগুলো সবই তাঁর একান্ত নিজেস্ব বিষয়, ভাললাগা প্রসুত বিষয়। কিন্তু একথা জেনে, অন্য কেউ যদি তাঁকে ছোট মনে করে, সেটা বরং তাঁরই মানসিক দৈনতা। এই দৈনতার দায়, ঐ নারীটির না বরং কথায় কথায় যারা এত নীচে নামে, তাদের।

আমরা পুরুষেরা “গাইজ-টক” করতে গিয়ে এসব কথাবার্তা বলে নিজেদের আর কত ছোট করবো?
এসবের মধ্য দিয়ে নিজেদের অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ও অবদমনে বাধ্য হবার হতাশা আর কত প্রকাশ করবো???

আট
এখন লিখবো কমুনিকেশন সম্পর্কিত প্যারাডক্স নিয়ে।
এই সিরিজের শুরু থেকেই কমুনিকেশনের গুরুত্ব নিয়ে আলাপ করে যাচ্ছি।
একটি সম্পর্কে কমুনিকেশন যে খুবই ইম্পর্টেন্ট, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কমুনিকেশনের ব্যাপারগুলো এত বেশী কালচারালি বায়াসড যে সেখানে এক কথা বললে, অন্য মানে খুজে বের করার সুযোগ থাকে প্রচুর।
সেক্সুয়ালিটিও এর থেকে মুক্ত না।
এদেশে নারীদের জন্য কালচার সেট করা আছে, “বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না” – তাই নারী যদি আগ বাড়িয়ে তাঁর প্রেফারেন্স জানায়, সমুহ সম্ভবনা সেটাকে মিস ইন্টারপ্রেট করার।
এরকম একটা গল্প শুনেছিলাম একবার।
সেমি সেটেল্ড একটি ম্যারেজের নতুন বৌটি নেট থেকে সেক্সুয়ালিটির নানা টিপস নিয়ে বরকে উৎসাহিত করেছিল সেগুলা ট্রাই করার জন্য। বোকা বর তো গভীর ভাবনায় পড়ে গেল, বৌয়ের এত জ্ঞানের বহর দেখে।
ঘটনা এতটাই জটিল আকার ধারণ করলো যে শেষ পর্যন্ত সেটা ডিভোর্সে গড়ায়…
এর উল্টো ঘটনাও আছে।
নবপরিনিতা স্ত্রীর কাছ থেকে ভালবাসার ছলাকলা সম্পর্কিত টিপস পেয়ে বর যখন বিপুল উৎসাহে সেগুলা সদব্যবহারে উদ্যত হলো, বউ ব্যাচারা তো তা দেখে তীব্র সংশয়ে পড়ে গেল। “এর এত উৎসাহ কেন? তবে কি সে আগে থেকেই অভ্যস্ত? এখনো যোগাযোগ আছে সেসব পার্টনারের সাথে? তা আর থাকবে না কেন? এসব অভ্যাস কি আর কখনো যায়?”
এই সম্পর্কটার শেষ পরিনতি কি হয়েছিল, জানি না, কিন্তু বউটি যে দীর্ঘ্যদিন খুব একটা ভাল ছিল না, এটা নিশ্চিত…

আবার কোনো কিছু কমুনিকেট না করে বসে থাকার ফল তো আগেও দেখেছি, যেখানে “পুরুষকে বুঝে নিতে হবে, তাঁর নারীর কি চাহিদা” এই যখন থাকে এক্সপেকটেশন, কি হয় তাঁর পরিনতিতে?
অর্ধেক নারীই যে অর্গাজম বিবর্জিত জীবন যাপন করেন, তাঁদের বেশিরভাগই যে এই কারনে, এমনি এমনি না সেটা সহজেই বোঝা যায়। এই “বুঝে নিতে হবে” বলেই কিন্তু সেই বোঝাটা আর হয়ে ওঠে না।
এরকম আরও অনেক কমুনিকেশন ব্যারিয়ারই ঘটে রিয়েল লাইফে।
যাকে প্রেমিক বা প্রেমিকা হিসাবে নিতে চাচ্ছেন, সে যদি তাঁর লিমিটেশন নিয়ে সত্যি কথা বলে, প্রতিপক্ষ ধরে নেয়, ” নাহ, তাঁর নিশ্চয়ই উৎসাহে ঘাটতি আছে। নইলে এখনই এসব বলবে কেন?”
অথচ সে ই যদি একগাদা মিথ্যা প্রমিজ করে, যা সে কোনোদিনও পুরন করবে না, ইনফ্যাক্ট সেসব পুরনের কোনো সাধ্যই তাঁর নাই, দেখা যায়, প্রতিপক্ষ কি খুশি! কি খুশি!!
আর তা এই ভেবে যে “বাহ! কি সিনসিয়ার? কত কিছুই না তাঁর করার ইচ্ছা আমাকে নিয়ে!! এরকম উৎসাহি (কার্যতঃ ভন্ড) একজনকেই তো চাই আমার সঙ্গি হিসাবে।”
ফলাফল যা হবার, একসময় তা ই হয়, সৎ প্রার্থি তো আগেই বিদায় হয়ে গেছে আর অসতের অসততা বুঝতে যতদিন লাগে, এরপর সেও বিদায় হয়। তারপর, আগের যেই একাকিত্ব আবারো তাতেই ফিরে যাওয়া…

কমুনিকেশনের সুফল পেতে হলে, সম্পর্কের শুরুতেই তাই এগ্রিমেন্টে আসাটা জরুরী যে “আমরা যতটা বলবো, তাঁর চেয়ে বেশী কোনো মানে দুজনেই খুজে বের করার চেষ্টা করবো না…”
এটা নিশ্চিত করা গেলে কমুনিকেশন নিয়ে বাড়তি জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
খুবই সম্ভব!!

নয়
নারী ও পুরুষের যৌন চেতনায় বিরাট একটা পার্থক্য আছে তাঁদের এসেক্সুয়ালিটি নিয়ে।
এসেক্সুয়ালিটি হলো একটি সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন যা ১% এর কাছাকাছি নরনারী LGBTQ-এর মতই জন্মগত ভাবে পেয়ে থাকে।
এদের বৈশিষ্ট হলো, এঁরা কোনো জেন্ডারের প্রতিই সেক্সুয়ালি এট্রাকটেড ফীল করে না।
এঁরা ইম্পটেন্ট নয়, শারীরিক ভাবে যৌন মিলনে খুবই সক্ষম, এঁরা ব্রহ্মচারীও নন আবার, একই বা বিপরীত লিঙ্গিয় বন্ধু বান্ধবীও এদের থাকে। কিন্তু এঁরা তাঁদের কারো সাথে যৌনতা ইনক্লুসিভ কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ান না বা জড়াতে পারেনই না।
এত কিছু বলছি কেন?
বলার কারন, সম্প্রতি জানলাম, একজন পুরুষ জন্মসুত্রে এসেক্সুয়াল না হলে তাঁদের জন্য আর কখনোই এসেক্সুয়াল হওয়া সম্ভব না। অথচ জন্মসুত্রে এসেক্সুয়াল নন, এমন একজন নারীর জন্য জীবনের একটি পর্যায়ে সেক্সুয়ালি একটিভ জীবন যাপন করার পরেও অন্য একটি পর্যায়ে এসেক্সুয়াল হয়ে যাওয়া মোটেও অসম্ভব না।
জন্মগত ভাবে এসেক্সুয়াল নন, এমন একজন নারী বৈধব্য বা বিচ্ছেদজনিত কারনে একা হয়ে পড়ার পর, যদি স্থায়ীভাবে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন, এজন্য, প্রথম প্রথম কিছুদিন হয়তো যৌনতা বিবর্জিত জীবনে কিছু সমস্যার মুখোমুখি তাঁরা হন, কিন্তু কিছুদিন এভাবে চলবার পর তাঁরা নিজে থেকেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন এবং এই এসেক্সুয়ালিটিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে বাকিটা জীবন তাঁদের জন্য এই এসেক্সুয়াল জীবনযাপনে আর কোনো সমস্যা হয় না।

এখানেই সমস্যার সূত্রপাত টিপিকাল পুরুষ মানসিকতার কারনে।
আমরা পুরুষরা এরকম একটা এসেক্সুয়াল জীবনযাপন যে সম্ভব, সেটা বুঝতেই পারি না। আমাদের নিজেদের জন্য তো নয়ই, নারীদের জন্যেও সেটা বোঝার কোনো সামর্থ আমাদের থাকে না।
আর এটা থাকে না বলেই দেখা যায়, পূর্বে যৌন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সিঙ্গেল কোনো নারীকে দেখলেই আমরা তাঁর প্রতি যতটা না ভালবাসা বসত, তারচেয়ে অনেক বেশী করুনা বসত তাদেরকে বিয়ে করে হোক বা বিবাহ বহির্ভুত ভাবেই হোক, যৌনতায় আগ্রহী করতে উদ্যত হই।
আমরা ভেবেও দেখি না, উনি কি তাঁর অযৌন জীবনটা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়ে তাতে থিতু হয়েছেন কিনা।
তিনি তা যদি হয়েই থাকেন, এই অনাকাঙ্খিত আমন্ত্রনগুলি তাঁর জন্য যে কতটা বিরক্তির, কতটা অনভিপ্রেত, সেটা আমরা, এরকম করা পুরুষেরা কখনোই হয়তো বুঝবো না।
তাহলে কি একা হয়ে পড়া নারীকে প্রনয় নিবেদন না হোক, অন্ততঃ পুনঃবিবাহে আগ্রহী কিনা, তা জানতে চাওয়া যাবে না?
সেটা অবশ্যই জানতে চাওয়া যাবে, ইন প্লেন এন্ড সিম্পল টার্মস, কীপিং ইন মাইন্ড যে তিনি এসেক্সুয়াল জীবনে অভ্যস্ত হয়েও থাকতে পারেন।
একাকী হয়ে পড়া একজন নারী যদি বিবাহ বা প্রনয়ের প্রাথমিক অনুসন্ধানে আগ্রহ না দেখান, তাঁকে এ নিয়ে পিড়াপিড়ি করাটা হবে অত্যন্ত গর্হিত একটা কাজ। এবং এটা কোনোক্রমেই উত্যক্ত করার চেয়ে কম কিছু নয়……

বলাই বাহুল্য যে, অতি দরদি সেজে হোক বা দরদ নিয়েই হোক এদেশে সিঙ্গেল হয়ে পড়া নারীদের ক্রমাগত এরকম উত্যক্ত করার মত মানুষের কোনোই অভাব হয় না। এঁরা হতে পারে, তাঁদের আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব, সহপাঠি, এমনকি সহকর্মীরাও।
আপনি যদি সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার যেটা করনীয়, তা হলো তাঁর কোনো আগ্রহ থাকলে সেটা আপনাকে জানাতে বলে রাখা। এর বেশী কিছুই না।
জানবেন, যিনি অযৌনজীবন বেছে নিয়ে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁর জন্য এরচেয়ে বেশী কিছু করাটা তাঁকে হয়রানি করার সমতুল্য কারন নারীর সেক্সুয়ালিটি ও পুরুষের সেক্সুয়ালিটির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে।
নিজে সেক্সুয়ালি একটিভ নারী হয়েও যখন স্বেচ্ছায় অযৌনজীবন বেছে নেয়া কোনো নারীর যৌন চাহিদা অনুমান করাটা যেখানে ঠিক না, সেখানে নিজে পুরুষ হলে, নিজের যৌনানুভুতি দিয়ে একজন নারীর যৌনানুভুতি বা চাহিদার বিচার বা অনুমান করতে চাওয়াটা হবে মস্তো বড় ভুল………

যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – চতুর্থ পর্ব
যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – পঞ্চম পর্ব
যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – ষষ্ঠ পর্ব
যৌনতা সম্পর্কিত নানা ভুল ধারনা – সপ্তম (শেষ) পর্ব

৬,১৪৪ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।