অবিশ্বস্ততার খেশারত

এডালট্রি, পরকীয়া, অবিশ্বস্ততা – শুনতে একই রকম মনে হলেও পার্থক্য আছে।

এডালট্রি আইনের ভাষায় অপরাধ যেটার জন্য অভিযুক্ত হতে পারেন কেবলই একজন পুরুষ (কোনো নারী নয়), যখন তিনি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান।
শারীরিক ছাড়া অন্য কোনো (ফোনসেক্স, টেক্সট বা ভিডিও সেক্স) ভাবে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানোটা এখনো এডাল্ট্রির আওতায় আসে নাই। আবার, কোনো সিঙ্গেল নারী যদি একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান, সেটা কিন্তু আইনতঃ এডালট্রি নয়।

তবে এডালট্রি না হলেও এগুলার সবই কিন্তু কোনো না কোনো ধরনের পরকীয়া।
এমনকি, বিবাহিত নারী বা পুরুষ যদি স্বামী বা স্ত্রীর জ্ঞাতসারে বা অনুমোদন নিয়েও অন্য পুরুষ বা নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে, সেটা অবিশ্বস্ততা না হলেও পরকীয়া।

আর অবিশ্বস্ততা হলো সেই পরকীয়া যেখানে, স্ত্রী (বা স্বামী) অথবা প্রেমিকা (বা প্রেমিক)-কে লুকিয়ে যখন কেউ অন্য নারী (বা পুরুষ)-এর সাথে শারীরিক শুধু না, যে কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, সেটা।

মজার ব্যাপার হলো, প্রতিনিয়ত মানুষের নতুন নতুন নীড, মেথডের উদ্ভব হচ্ছে আর তাঁর সাথে সাথে পরকীয়ায় অন্তর্ভুক্ত ব্যাপারগুলোর সংজ্ঞা বিস্তৃত হচ্ছে।
তৃতীয় কারো সাথে শুধু ফিজিকাল না, রোমান্টিক যেকোনো ইন্টার একশনই ( হোক তা ফোনে বা অনলাইনে) এখন পরকীয়ার অন্তর্ভুক্ত যা স্পাউস বা পার্টনারের সাথে থাকা সম্পর্ককে এফেক্ট করে।
আবার ভারতে এক হাইকোর্ট রায় দিয়েছে যে কোনো পুর্ববর্তি রোমান্টিক সংশ্লিষ্টতা না থাকা অবস্থায় হওয়া আকস্মিক (ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড) যৌন সম্পর্ককেও অবিশ্বস্ততা বা পরকীয়া বলা যাবে না।

এতসব এক্সট্রা ম্যারিটাল ব্যাপার স্যাপার কেন ঘটছে, সেগুলার রিমেডি কি – সেসব ভিন্ন আলাপ। আজ জানাবো এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ কোনোটা এবং কি কি কারনে তা এত খারাপ।

ফিজিকালি হোক বা ফোনে কিংবা অনলাইনে – স্পাউস বা পার্টনারের প্রতি অবিশ্বস্ত হওয়াটা হলো সবচেয়ে খারাপ ধরনের পরকীয়া। কারনগুলো নীচে দিলাম।

১) মিথ্যাবাদিতা:
এধরনের সম্পর্ক চালাতে হলে স্পাউস সহ এত এত মানুষের সাথে আপনাকে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে হবে যে একটা সময়ে নিজেই আর খেই রাখতে পারবেন না, কাকে কোনটা সত্যি আর কাকে কোনটা মিথ্যা বলেছেন। অবিশ্বস্ততা যত বেশিদিন ধরে চলবে, এই মিথ্যার জাল ততই বিস্তৃত হবে আর আপনাকে তা আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলবে।
আপনি হয়তো “বাসায় কাজ আছে” এই অজুহাতে অফিস থেকে আগে বেরিয়ে যাবেন। আবার “আজ অফিসে জরুরী মিটিং, ফিরতে দেরী হবে” বলে বাসা থেকে সময় বের করবেন। ভাবুন তো কোনো কারনে বাসা আর অফিসের একটা ইন্টার একশন হলে আপনার আরও কত কত মিথ্যা বলা লাগবে এটা সামাল দিতে?
প্রথমবার যদিও বা দিলেন, পরের বার গুলোয় কি করবেন?

২) জানাজানি হওয়া:
যত সতর্কতাই অবলম্বন করেন না কেন, আজ হোক বা কাল, অবিশ্বস্ততার কথা আপনার স্পাউস বা পার্টনার শুধু না, অন্যান্যদের কাছেও প্রকাশিত হবেই হবে। অবিশ্বস্ত সম্পর্কটা যত দীর্ঘায়িত হবে, সেটার প্রকাশিত হবার সম্ভবনাও তত বেশী থাকবে।
আর একবার সেটা প্রকাশিত হবার সাথে সাথে আপনার চারিদিকের অনেক কিছুই ভোজবাজির মত পাল্টে যেতে শুরু করবে। সেগুলো এতটাই পাল্টে যাবে যে তার কিছু কিছু আপনি আর কখনই আগের অবস্থায় ফেরাতে পারবেন না।
আগের মত মনে হলেও একটা ক্ষত বা দাগ কোথাও না কোথাও রয়েই যাবে…

৩) সবার হতাশার কারন হওয়া:
শুধু স্পাউসই নয়, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মি-সহপাঠি, সন্তান-সন্ততি এমন কি নিজেরও হতাশার কারন হয়ে পড়বেন আপনি।
যারাই জানবে, আপনি অবিশ্বস্ত হয়েছেন, তারাই এটা অকারনে ঘটানো একটা ব্যাপার বলে ধরে নেবে কেননা সেরকম কোনো কারন থাকলে তো আপনি নিশ্চয়ই বিচ্ছেদেই ঘটাতেন। তা যখন ঘটান নাই, তাঁদের এই ধরে নেয়াটাকে অস্বীকার করবেন কি বলে?
সবার এই হতাশা কাটাতে দীর্ঘ্য সময়ও লেগে যেতে পারে…

৪) একজন খারাপ উদাহরণ হিসাবে পরিচয় পাওয়া:
আপনার অন্যান্য এচিভমেন্ট যা ই থাকুক, প্রায় সময়েই দেখবেন আপনার পরিচয় দিতে আপনার এই অবিশ্বস্ততার বিষয়টা টানা হবে। বলা হবে “ঐ যে তিনি, যিনি চিটিং কেসে ধরা খেয়েছিলেন…
এমন কি, আপনার রেপুটেশন এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যে আপনাকে যেকোনো দায়িত্বপূর্ন কাজে দেয়ার আগে কর্তৃপক্ষ দুবার ভাববে। চিটিং-এর ইতিহাসটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও খতিয়ে দেখবে।

৫) নৈতিক কর্তৃত্ব খর্ব হওয়া:
অধস্তন এমনকি সন্তানদের কাছেও আপনার অবস্থানের মুল্য হ্রাস পাবে। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চ গলায় দিকনির্দেশনা দিতে আজকাল আর তাই অনেককেই আগের মত দেখা যায় না।
“এটা শোনো, ওটা করো…” জাতিয় কথা আপনি বলতে পারবেন কিন্তু “আমার মত হও, আমার মত করো” জাতীয় কথা বার্তা বলাটা কঠিন হয়ে পড়বে।
কাছের অনেকের কাছেই আপনার শ্রোদ্ধার আসনটি আর আগের মত থাকবে না।
আপনি হয়তো আগের মতই সত্যি কথা বলা বা ন্যয়ের পথে থাকাটা চালিয়ে যাবেন, কিন্তু কেউ কেউ সেটার উপর আগের মত আস্থা আর রাখবে না…

৬) দাম্পত্যে আস্থার সংকট তৈরী হওয়া:
শুধু বর্তমান স্পাউস নয়, ভবিষ্যতেও যত স্পাউস আপনার হতে পারে, তাঁরা আপনাকে নিয়ে একটা আস্থার সংকটে ভুগবে। দেরী করে ফিরলে, আনএক্সপ্লেইন্ড এবসেন্সের ঘটনা ঘটলে, “আবার সেরকম কিছু কিনা?” এই ভাবনা একবারের জন্য হলেও এসে একটা অশান্তির মেঘ ছুইয়ে যাবেই। আর তা সারা জীবনের জন্যই…

৭) কারো কারো ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাওয়া:
ধরা খাওয়ার পর কিসের কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটার উপর নির্ভর করবে আপনার জীবন যাত্রার মান বজায় রাখাটা।
বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া, চাকুরী চলে যাওয়া, ক্যারিয়ারে আটকে যাওয়া, আদালতে ছুটাছুটি খর্চাপাতি সামাল দেয়া – এসবের মধ্যে পড়লে তা দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ভালই ক্ষতিগ্রস্ত করবে…

৮) ঘুরে দাড়াবার জন্য বছরের পর বছর লেগে যাবার সম্ভবনা:
আসলেই বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে আর্থিক ক্ষতি সামলাতেই শুধু না, মানসিক ক্ষতি সামলাতে। সামাজিক অবস্থান থেকে ছিটকে পড়া, আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠা – এসবই দেহ, মন ও আর্থিক সামর্থের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেখে যেতে পারে।

৯) বেশ কিছু আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া:
অবিশ্বস্ততা এমনই এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব করে যে সবসময় পাশে পাওয়া বন্ধুদের অনেককেই আর দরকারের সময় পাশে পাওয়া যায় না।
ব্যাপারটা সবসময় এমন না, যে তাঁরা আসতে অনিচ্ছুক, দেখা যায়, পরিবেশ পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে আপনার পাশে থাকাটা তাঁর ওয়েলবিইং-এর জন্য আর অনুকুল থাকে না।
তাছাড়াও একজন চিহ্নিত অবিশ্বস্ত মানুষের উপস্থিতি সব পরিস্থিতিতে সবার কাছে কাম্য থাকে না। তাই তাঁদের একসময়কার কাছের মানুষদের মধ্যে এড়িয়ে চলাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এতে করে অবিশ্বস্ত ব্যক্তি দিনে দিনে নিজেকে একা হতে দেখতে শুরু করেন।

১০) এসটিডির ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া:
একবার যারা অবিশ্বস্ত হন, তাঁদের অনেকেই নানা জায়গায় নির্ভাবনায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে আর কোনো কুন্ঠা বোধ করেন না।
যৌনতার ব্যাপারে এদের এই বাছবিচারহীনতায় তাই তাঁদের যৌনতা-বাহিত রোগাক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়িয়ে তোলে।
শুধু তাঁদের নিজেদেরই না, তাঁদের মাধ্যমে কোনো অন্যয় না করেও, তাঁদের স্পাউসদের এসটিডি-তে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

১১) নদীর ওকুলে সর্বসুখের সন্ধান না পাওয়া:
নদীর একুলে বসে, দূর থেকে দীর্ঘ্যশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে ওকুলকে অধিক সুখের বলে মনে হয়। কিন্তু ওকুলে পৌছানোর পর কি হয়?
দু’চারদিন হয়ত নতুনত্ব এক্সপ্লোরিং-এ উত্তেজনাকর সময় কাটে কিন্তু দিন যতই যেতে থাকে, মোহভঙ্গ হওয়া শুরু হয়ে যায়।
তখন মনেহয়, এ আর এমন কি যে জন্য ঘর-সংসার-ক্যারিয়ার-নিকটজন সবকিছুকে লাইন অব ফায়ারে চড়াতে হবে?
আবার ধরা না পড়া পর্যন্ত যা ছেড়ে এসেছেন, দেখবেন, সেটা ফিরে পাওয়ার, সেটাকে পুরোপুরি না হারাবার একটা আকাঙ্খা বা একটা ব্যাকুলতাও হঠাৎ হঠাৎ তীব্রভাবে জেগে উঠবে। এই সব ডাইলেমা সামাল দেয়া অনেক সময়েই কঠিন। খুবই কঠিন!!!

১২) উল্টোটা যে অগ্রহনযোগ্য, তা কিন্তু সবার জানা:
নিজে সুযোগ পেয়ে অবিশ্বস্ত হবার মাধ্যমে স্পাউসকে ভিক্টিমাইজ করা হয়। সেই সময় যদি ভাবা যায়, কি হতো এর উল্টোটা হলে?
আমার স্পাউস যদি এরকম কোনো সুযোগ পেয়ে সেটার সদ্ব্যবহার করে আমাকে ভিক্টিমাইজ করতো, কিভাবে নিতাম তা?
যতটা আহত তা করতো আমাকে, আমার এই অবিশ্বস্ততাও কি অন্তত ততটা আহত করবে না তাঁকে?
যার সাথে চলি-ফিরি, থাকি-খাই-ঘুমাই তাঁকে এতটা খারাপ একটা পরিস্থিতিতে ফেলাটা কি ঠিক হচ্ছে?

১৩) একটা সময়ে অনুশোচনা বোধ করা:
বেশিরভাগ মানুষেরই অবিশ্বস্ত হবার সময়টাতে সেটাকে সঠিক ও সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত বলে মনেহয়। কিন্তু একটা সময় আসেই যখন এদের বেশিরভাগেরই মনেহয়, “এটা না করলে কি আর এমন ক্ষতি হতো?”
ধরা পড়লে তো এটা আসেই, ধরা না পড়লেও অনেকেরই এটা হয়।
আর তা যদি হয়, সেটা নিজেকে নিজের কাছে অপরাধি করে দেয়।
অন্যের অপরাধ যত সহজে ক্ষমা করা বা ভুলে যাওয়া যায়, নিজের কাছে করা নিজের অপরাধে কিন্তু তা হয় না…

১৪) অর্জনের চেয়ে অনেক বেশী মূল্য দেয়া:
অবিশ্বস্ততায় কোনো অর্জন যে হয় না, তা না, কিন্তু সেজন্য এত এত বিষর্জন দিতে হয় বা দেবার ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয় যে আসলেই তা নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকে।
একটা উদাহরণ দেই।
মাত্র কয়েক ঘন্টার একটা নির্জনবাস বা কোয়াইট ডেটিং-এর জন্য দিনেরপরদিন প্রস্তুতি নিয়ে, একগাদা মিথ্যের জাল বুনে, বড় রকমের একটা খরচের ধাক্কা সামলে, ধরা পড়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, এতসব করতে গিয়ে স্ট্রেস-টেনশন বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ায় সেখানে সুখের উপলক্ষ কতটা আর কষ্টের ক্লান্তি কতটা – ভাববার বিষয়।
তাছাড়া প্রথম প্রথম নতুনত্বের আস্বাদ গ্রহনজনিত একটা বাড়তি অর্জন হয়তো থাকে, কিন্তু কিছুদিন পর সেটা যখন আর থাকে না – বরং নতুন করে আরেকটা চাপ সামলাতে হয়: “কি ব্যাপার? পুরনো হয়ে গেছি বলে কি তুমি বদলে গেলে নাকি? উৎসাহ সব উবে গেল?” তখন পরিস্থিতি আরও জটিল মাত্রা পায়।
সব মিলিয়ে অর্জনের জন্য যে মূল্যটা গুনতে হয়, তা পুরো ব্যাপারটার জন্য মোটেও সুখকর কিছু আর থাকে না।
তাই, একটা সময়ে দেখা যায়, যোগাযোগ থাকলেও দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়াটাও আর আগের মত তেমন কোনো শুন্যতা তো তৈরী করছেই না বরং উপভোগ্যই মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটা দাঁড়ায় এমন: “হলে মন্দ না, তবে না হলে তা আরও ভাল!!!”

অবিশ্বস্ততা একটা নড়বড়ে বা ইনস্ট্যাবল অবস্থা।
তাই এটার মধ্যদিয়ে যারা যায়, তাঁদের হাতে অপশন দুইটা:
১) কিছুদিন পরেই এটা থেকে বেরিয়ে আসা।
২) অন্য আরেকটা চেষ্টা করে দেখা।
যেটাই করেন না কেন, জীবন আর কখনোই বিশ্বস্ত জীবনের মত ফুলফিলিং-এর সম্ভবনাময় হবে না।
অতএব, অবিশ্বস্ত হবার আগে, ভাবুন।
আবার ভাবুন!!!

৫,৯৭৫ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।