বিবিধ উপলব্ধি – দ্বিতীয় পর্ব

বিবিধ উপলব্ধি – প্রথম পর্ব

ছয়
একাধিক অসফল বিবাহের ট্রমা কাটিয়ে নতুন সম্পর্কের প্রচেষ্টায় থাকা এক নারী সম্পর্কে জনৈক ভদ্রমহিলার কটুক্তিতে আহত হয়ে ফেসবুকে পাবলিক স্ট্যাটাস দিয়েছেন একজন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ধারণকারিণী।
স্ট্যাটাসদাত্রীর মূল চাওয়া হলো, ভালবাসা খুজে ফেরা নারীর প্রতি যেন সহানুভুতি দেখায় অন্যেরা।
এই চাওয়াটা অমায়িক কিন্তু তা পুরন করতে গিয়ে তিনি কটূক্তিকারী ভদ্রমহিলাকে যেসব প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন, তা ভাবালো।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, আমার কাছে, কটূক্তিকারী ভদ্রমহিলার কথাগুলো খুব অস্বাভাবিক লাগে নাই।
বরং মনে হয়েছে, নিজের চামড়া বাচাতেই তিনি সোশালি একসেপ্টেড এই অবস্থানটি নিয়েছেন।
একটি ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধু পুরুষদেরই না, নারীদেরও শেখায় কিভাবে কতটা নারীবিদ্বেষ লালন করতে হয়, সুযোগ মত তা ছড়াতে হয়।
আর তা না করলে, কিভাবে তাদের ডিসিপ্লিনিং করতে হয়।
ধরে নেই, ভদ্রমহিলা যদি মেয়েটির পক্ষাবলম্বন করতেন মানে তার একাধিক বিচ্ছেদের পরেও সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টাটিকে প্রশংসনিয় ভাষায় বর্ননা করতেন – কি হতো তাঁর অবস্থাটা?
এই স্ট্যাটাসদাত্রী হয়তো তা শুনে খুশি হতেন, কিন্তু অন্য এমন হাজারটা মুখ চারপাশে খুজে পাওয়া যেতো যারা তাঁর ঐ বক্তব্য শুনে নীচের কোনো একটি বলতেন:
ক) নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা নিজে খুব অসুখি, তাই অসুখি নারীর পক্ষাবলম্বন করেছেন।
খ) উনি নিজেই ডিভোর্স নিতে আগ্রহি। মুখে বলতে পারছেন না বলে এইভাবে আকারে ইঙ্গিতে বলছেন।
গ) (আরও হার্ডলাইনার হলে) আসলে মহিলার ঘুরে ঘুরে মধু খাওয়ার খুব সখ। নিজে পারছেন না, তাই সেরকম মধু খাওয়াদের পক্ষাবলম্বন করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন।

এইসব যখন সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, কে যাবে আগ বাড়িয়ে, সোশাল স্টিগমা ভেঙ্গে, “ডিভোর্সি” – নামক অভিশাপে জর্জরিত কারো পাশে দাড়াতে? সহানুভুতি জানাতে?

অন এ ডিফারেন্ট নোট, এইসব ক্ষেত্রে সহানুভুতি দেখানো ব্যাক্তিটি একজন পুরুষ হলে তাঁর জন্য কি কি স্টেরিওটাইপিং অপেক্ষা করে থাকে, তাও একবার ভেবে দেখা যাক:
১) ব্যাটা একটা লুইচ্চা। ডিভোর্সি দেখলেই লালা ঝরে। বাজায় দেখতেছে, এই সম্পর্কটা ভাঙ্গার পর নিজের জন্যেও লুইচ্চামির একটা চান্স আসে কিনা…
২) ডিভোর্সি একটা মেয়ে যখন, নিশ্চয়ই তার কিছু দোষ আছে। তাঁর পক্ষ কেন নিতে হবে? নিশ্চয়ই লোকটার নিজেরও কোনো সিরিয়াস ক্রাইসিস আছে। এবং তা হলো, ব্লা ব্লা ব্লা………
৩) (মেয়েটি নিজেও একটা সময় যা ভাবতে বা বলতে পারে) কি ব্যাপার, চারিদিকে এত এত মেয়ে থাকতে, এই লোকটার, আমার জন্য এত মমতা ক্যান? নিশ্চয়ই ব্যাটা একখান বিরাট ধান্দাবাজ-ধুর্ত-ধুরন্ধর। নইলে এত কিছু করার থাকতে আমার মত এক ডিভোর্সিরে নিয়ে পড়ছে কোন আক্কেলে? ভাবতেই তো তাঁর উপর থেকে “মন উঠে যাচ্ছে”………

এমনিতেই তো নারীর নাকি কোনো দেশ নাই, সেখানে ডিভোর্সি ট্যাগ খাওয়া নারীর শুধু দেশ না, পায়ের নীচে কোনো মাটিও থাকে না অনেক অনেক সময়!!!

সাত
বহুগমনের ব্যাপাটা জেন্ডার ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
তারমানে, নারী-পুরুষ নির্বিষেশে যেকেউই বহুগামি হতে পারে।
তবে সমস্যা হলো, নারীর বহুগমনের বিষয়টা জানাজানি হলে কাছের বা দুরের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সেই বহুগামি নারী সম্পর্কে যে যে সব প্রকাশের অযোগ্য বিশেষণ প্রয়োগ করে, তার কোনোটাই ঐ নারীর জন্য আর সুখকর তো থাকেই না, জীবন বিষিয়ে দেয়ার সমতুল্য হয়ে ওঠে। অথচ হতে পারে, সেই সব সম্পর্কগুলো হয়তোবা মেয়েটির কাছে ছিল খুবই কাঙ্খিত ছিল। ছিল পারষ্পরিক সম্মতির। ছিল উপোভোগ্য ও আনন্দের।
কিন্তু চরিত্রহরন কালে বা কটূক্তি করার সময় কেউই নারী সেই অবস্থানগুলিকে ধর্তব্যে নেয় না।
বহুগামিতায় অভ্যস্ত পুরুষদের পরিস্থিতি সেইক্ষেত্রে বেশ ভিন্ন। যদিও তাদেরকে দুর্জনেরা “লুইচ্চা”, “মাগিবাজ” – ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত করার সুযোগ পায় কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় সুজনদের কাছে তাঁরা আবার “প্লেবয়”, “এযুগের ক্যাসানোভা”, “ব্যাডা একখান” ইত্যাদি প্রশংসাসুলভ শব্দে-পদে অলঙ্কৃতও হয়।
কোনো কোনো আগ্রহি নারীদের কাছে বিনোদন-সামগ্রি হিসাবে “নাদান-বালকদের” চেয়ে আবার এইরাম অভিজ্ঞ ও অলঙ্কৃত পুরুষদের বাড়তি আদর পেতেও দেখা যায় অনেক অনেক ক্ষেত্রে।
তাই বহুগামীতায় আগ্রহী নারীকে কুবিশেষণ আরোপ করে যত সহজে হয়রানি করা সম্ভব, পুরুষকে তা করা সহজ না।
হয়তো দেখা যাবে, কুবিশেষণটিকেও সেই পুরুষ তাঁর মুকুটের একটি পালক হিসাবেই গন্য করছে।
আর যখন কেউ তাঁকে লুইচ্চা বা মাগিবাজ বলে সম্বোধন করছে, সে মনে মনে হাসছে, ভাবছে আবার কখনো কখনো মুখ ফুটে বলেও ফেলছে – “তাও তো আমি কিছু করে দেখিয়েছি, বড় বড় কথা যে বলিস, তোর খবর কি? মুরোদ থাকলে, আগে করে দেখা দেখি কিছু? মুরোদ নাই কিছু করার, আসছে বড় ভার্জিনিটির জয়গান করতে। দূরে গিয়ে মরগে!!!”

আট

একমাত্র বন্ধুত্বই হলো এমন এক সম্পর্ক, যার কোনো সুনির্দিষ্ট অথবা অফিশিয়াল শুরু নাই।
যার শুরুই নাই, তার শেষ হওয়াটা তাই সম্ভব না।
যদি কেউ বলে, “অমুক এখন আর আমার বন্ধু না” ধরে নিতে হবে :
– হয় তাঁরা কখনোই বন্ধু ছিল না, শুধু বন্ধুত্বের ভান করে গেছে, অথবা,
– এখনো তাঁরা বন্ধু আছে। শুধু সাময়িক কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বন্ধুত্বহীনতার ভান করে যাচ্ছে।
আমার যেসব বন্ধুরা এখন দূরে সরে সরে আছে, তাদের দিক থেকে কারন উপরের কোনটা, তা আমি জানি না।
আমি শুধু জানি, যাদের আমি বন্ধু ভেবেছি, আমার কাছে তাঁরা চীরটা কালই একই রকমের কাছের মানুষ। একই রকমের আপনজন।
পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর দেখা হওয়া কয়েকজন বন্ধুর কথা মনে পড়লো হঠাৎ করেই – এটা লিখতে বসে।
এত দীর্ঘ বিরতিতে তাদের চেনাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু যখন চেনাচিনিটা হলো, দেখলাম, এত দীর্ঘ বিরতির পরেও ওদের এমন কিছু স্মৃতি আমার নিউরোনে অথবা আমার এমন কিছু স্মৃতি ওদের নিউরোনে জমা হয়ে আছে যা আমরা নিজেরাই ভুলে গেছে সেই কবেই…
অনেক কিছুই, এমনকি নিজের একান্ত আপন কিছুও, “চোখের আড়াল হলেই মনের আড়ালে চলে যায়” – সত্য কিন্তু দেখলাম, বন্ধুত্বের ব্যাপারগুলা কিভাবে যেন মনের কোনে রয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য।
অবশ্য, বন্ধুত্বটা যদি সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয়ে থাকে।
আর আমার ধারনা, এটা হয়, কারন বন্ধুত্বের কোনো সুচনা নাই বলেই।
আসলে তো, যার শুরুই নাই, তা শেষই বা হবে কিভাবে???

৫,৬৮১ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।