গুড প্যারেন্টিং : জেনে নিন, কতটা ভাল আপনার প্যারেন্টিং

কে না চায়, তাঁর শিশুটি সঠিক প্যারেন্টেইং-এর মধ্য দিয়ে বড় হোক?
সবাই-ই তা চায়। কিন্তু সবাই কি আর দিতে পারে তা?
আপনি কি পারছেন?
আমি জানি, আপনি আপনার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু তা গুড প্যারেন্টিং-এর জন্য আসলেই যথেষ্ট কিনা, আপনার শিশুটির সঠিক বেড়ে ওঠায় তা যথাযথ ভূমিকা রাখছে কিনা, তা কি জানেন?
জানতে চান?
দেখুন তো, আপনার ক্ষেত্রে নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কি কি পান:

১) আপনার শিশুটি কি আপনার কাছ থেকে পাওয়া যত্নআত্তি ও মনোযোগ নিয়ে মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট ও সুখী?
শিশুর সুখী ও সন্তুষ্ট থাকাটা তার ভাল থাকা নির্দেশ করে। শিশু ভাল আছে মানেই হলো ঘরে সে এমন একটি স্থিতিশীল পরিবেশ পাচ্ছে যেখানে কখন কি হতে যাচ্ছে, তা সে সহজেই অনুমান করে নিতে পারে।

২) শিশুর সাথে আপনার পারিবারিক জীবন যাপন কি তার জন্য সহজে অনুমান যোগ্য ও স্থিতিশীল?
সহনীয় বাধাধরা জীবন ও সেটা পালনের কিছু বাধ্যবাধকতা শিশুরা সাধারনতঃ পছন্দই করে থাকে। কারন এতে করে তাঁরা নিজের পারফর্মেন্স দেখাবার ও তা দেখিয়ে কৃতিত্ব নেবার সুযোগ সে পায়। আবার একবার এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ব্যাপারটা তাঁর জন্য সহজে অর্জনযোগ্য হয়ে ওঠে। এই পুরো ব্যাপারটাই দেখা যায় তাঁর মনোনিবেশের অনুশীলন হিসাবেও চমৎকার কাজ করে। এবং এতে করে শিশুর শিক্ষন, বর্ধন ও উন্নয়ন হয়ে ওঠে তারও মনের মতো একটি প্রক্রিয়া।

৩) আপনি যে পরিবেশে শিশুটিকে বড় করছেন, সেটা কি তাকে যথেষ্ট পরিমানে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা দিতে সক্ষম?
শিশু যদি ঝগড়া-ঝাটি, মনমালিন্য, একজন আরেকজনের পিছুলাগা, অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি জাতিয় বিষাক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেটার ফল তার জন্য হয় খুব খারাপ। তাঁকে যদি কথায় কথায় দাবড়ে নিয়ে বেড়ানো হয়, চোখ রাঙ্গানো হয়, হুমকি ধামকি দেয়া হয় অথবা এতটাই ছেড়ে দেয়া হয় যে সে যা খুশি তাই করছে এবং পার পেয়ে যাচ্ছে, দেখা যায় যে তাতে করে সে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যায়। আবার তাঁকে যদি উৎসাহ দিয়ে, প্রশংসা করে, পজেটিভ ফিডব্যাক দিয়ে, ভাল ও সাহসী কাজের জন্য পুরষ্কৃত করে অভ্যস্ত করা যায় – দেখা যায়, সে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই নিজেকে নিরাপদ বোধ করতে শেখে।

৪) যা যা শেখার কথা, আপনার শিশু কি তা তা ঠিকঠাক মতো শিখছে? এবং, এই শেখা কি তাকে আরও পরিপক্ক করে তুলছে?
এটাও শিশুর ভাল থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক। অবশ্য ভাল থাকলেও কোনো কোনো শিশুর শেখায় প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, কিন্তু অধৈর্য্য না হয়ে গুড প্যারেন্টিংটা চালিয়ে যেতে থাকলে দেখা যাবে, একটা সময় শিশু শেখাটা রপ্ত করে নিচ্ছে।

৫) কে কাকে চালাচ্ছেন? আপনি আপনার শিশুকে, নাকি শিশুর কথায় আপনি নিজেই উঠবস করছেন?
কেউ একজনকে তো পরিবারের দিকনির্দেশনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেই হবে, তাই না? আপনি যদি তা না নেন, দেখবেন আপনার শিশুই তা করবে। আর সুযোগ মত আপনাকে দাবড়ে নিয়ে বেড়াবে। এতে করে আপনিও ক্লান্ত হয়ে পড়বেন আর তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাটাও বাঁধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু আপনাদের মধ্যে বড় কেউ একজন যদি এই দিকনির্দেশনা প্রদানের দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নেন, দেখবেন, তা আপনাদের সবার জন্যই হবে সহজ, সুখকর, ভারাসাম্যপূর্ণ ও স্বাস্থ্যকর।

৬) অন্যান্য শিশুই শুধু না, পরিচিত বড়দের সাথেও আপনি কি আপনার শিশুকে পরিচিত হতে ও মিশতে যথেষ্ট সুযোগ করে দেন?
শিশুর সামাজিকতা অর্জন প্রক্রিয়া আপনারও ভূমিকা রাখা দরকার। কারন এই সামাজিকতার মধ্য দিয়ে শিশুর “আমিত্ব” থেকে “আমরাত্ব”-এর উত্তরণ ঘটে যা তার ভবিষ্যত জীবনযাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। আর এটা করতে হলে, তার জন্য সামাজিকতার সুযোগ করে দেয়ার কোনোই বিকল্প নাই। এরমধ্য দিয়ে সে ভদ্রতা, শিষ্টতা, সামাজিক আচার আচরণ, গুরুজনে ভক্তি, ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা, ইত্যাদি অনেক কিছুরই অনুশীলন করতে পারে।

৭) আপনি কি শিশুকে দৈনন্দিন কাজেকর্মে স্বনির্ভরতা অর্জনের কলাকৌশলগুলো অনুশীলন করাচ্ছেন?
নিজেকে শিশুর দৈনন্দিন প্রয়োজনিয়তা মেটানোর জন্য অপরিহার্য্য করে রাখবেন না। যখনই যে কাজে সম্ভব, চেষ্টা করুন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে। কার্যকরি প্যারেন্ট হিসাবে যদি নিজেকে দেখতে চান, দরকার মত তাহলে তাঁদের পাশে থাকুন, কিন্তু কখনোই তাদেরকে আপনার উপর নির্ভরশীল করে রাখবেন না।

৮) শিশু যখন আপনার সাথে থাকে, তখন কি প্যারেন্টসুলভ দৃঢ়তার সংমিশ্রনে এক অদ্ভুত আপত্য স্নেহ ও ভালবাসার মেঘ আপনাদের ঘিরে থাকে?
শিশুরা বোঝে যে তাঁরা আদরনিয়। তারা আদর ভালবাসা শুধু পেতেই না, সেগুলোর পাবার কথা শুনতেও চায়। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হয়েও আপনি জানেন, কারো মুখে “আই লাভ ইউ” শুনতে পেলে কতটা আপ্লুত হয়ে ওঠে আপনি। আর শিশুরা বড় কারো তো বটেই, আপনার কাছে এরকম কিছু শুনতে ও দেখতে পেলে নিজের প্রতি আস্থাশিল হবে ও নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করবেই করবে।

৯) সবসময় না হোক, কখনো কখনো কি আনন্দঘন ফ্যামিলি-টাইম কাটান?
দুষ্টুমি, খুনসুটি, হুটপুটি, মজা করা – এসবই হলো মানসিক স্বাস্থ্য ও সম্পর্ক ভাল রাখাতে ধন্বান্তরি বটিকার মত কাজ করে। নানাবিধ টেনশন ও স্ট্রেস দূর করায় এগুলোর জুড়ি মেলা ভার। খুব একটা ভাল না পারলেও সময় সময় বাচ্চাদের সাথে মাঝেমাঝে হালকা সময় কাটানো, গান-কবিতা করা, জোক শোনানো – এগুলো করা উচিৎ। এতে করে বাসার পরিবেশ থেকে একঘেয়েমিপুর্ন ভাবটা দূর হয়ে যায়।

১০) কখনো জানতে চেষ্টা করেছেন কি, অন্যেরা কি ভাবছে আপনার প্যারেন্টিং-এর মান নিয়ে?
কেউ কেউ (বিশেষ করে খুব ঘনিষ্ট বা কাছের কেউ) ভাবতেই পারেন, আপনি যা যা করছেন তা আপনার শিশুকে খুব একটা ভাল প্যারেন্টিং দিচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না, যদি আপনার আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ মানুষেরই মনেহয় যে আপনার প্যারেন্টিং আসলেই খুব ভালভাবে এগুচ্ছে। লক্ষ্য করুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন যে বেশীরভাগ মানুষের কাছেই আপনার প্যারেন্টিং-টাকে প্রশংসনিয় বলে মনে হচ্ছে কিনা।

১১) প্যারেন্ট হিসাবে আপনার যে ভূমিকা, তা নিয়ে আপনি নিজে কতটা সন্তুষ্ট?
প্যারেন্টিং অবশ্যই একটা কঠিন ও স্টেসফুল কাজ। এক এক সময় এটা ক্লান্তিকরও ঠেকে। তারপরেও সাধারনভাবে এই প্যারেন্টিং-এর ব্যাপারটা আপনার কাছে শুধু একটা দায়িত্বের ব্যাপারই না বরং উপভোগ্য ব্যাপার বলেও কি মনেহয়? আপনি যদি প্যারেন্টিং উপভোগ করেন, শিশুরা কিন্তু তা বুঝতে পারবে। এবং সেটা তাঁদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু শিশুরা যদি বোঝে, আপনি এই প্যারেন্টিং-এর বোঝা মাথায় নিয়ে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত একটি জীবনযাপন করছেন, সেটা তাদেরকে অপরাধি করে দেবে। আর সেই অপরাধবোধের কারনে তাঁদের বেড়ে ওঠাটাও হয়ে উঠবে প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ।

হয়তো ভাবছেন এত্তটুকুন একটা শিশু, এত কিছু আবার ক্যামনে বুঝবে সে?
জেনে অবাক হবেন, এত্তটুকুন হলেও, কোনো কিছু না শুনেও শিশুরা পরিবেশ থেকে কত কত কি যে বুঝে নেয় এবং সেই বোঝার উপর ভিত্তি করে নিজে থেকেই নিজের কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করে নেয় তাঁর ইয়ত্তা নাই।
ধরুন, আপনি কেউ একজনকে অপছন্দ করেন। তাঁকে এড়িয়ে যান বা সামনে পড়লে, তাঁকে কোল্ড-সোলডার দেন। আপনার সেই অপছন্দের কথাটি যদি আপনার শিশুকে কখনো নাও বলে থাকেন, তাতেও কিছু আসে যায় না। কারন খুব শীঘ্রই আপনি দেখতে পাবেন, আপনার শিশু ঠিকই বুঝে নিয়েছে, কাকে আপনি কোল্ড সোলডার দিচ্ছেন। একটা সময় দেখবেন, আপনার শিশুও তাঁকে একই ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে বা কোল্ড সোলডার দিচ্ছে। তাই আপনার প্যারেন্টিংটাকে যদি গুড প্যারেন্টিং-এ পরিনত করতে চান, সেটা যথাসাধ্য সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টাও করে যান। শিশু সেটা নিজে থেকেই বুঝে নেবে এবং তাদ্বারা বেনিফিটেড হবে।
আর তা নহলে, সেজন্য কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনারই শিশু…

[ডিসক্লেইমার: এটা কোনো মৌলিক লেখা না। এখান থেকে পড়া যাবে এমন একটা আর্টিক্যালের ভাবানুবাদ এটি…]

৬,৩৮০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।