প্রসঙ্গ : চাইল্ডহুড ওবেসিটি

এক
শিশুদের শৈশবকালিন স্থুলতা তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য হয়ে উঠতে পারে বিশাল সমস্যা। বয়ে আনতে পারে প্রিভেন্টেবল অনেক অনেক দুর্ভোগ।
এই ব্যাপারে আপনি কতটা সচেতন?

আগে জেনে নিন, আপনার সন্তানটি চাইল্ডহুড ওবেসিটিতে আক্রান্ত কিনা।
প্রথমে, এই লিংকটিতে থাকা চাইল্ডহুড ওবেসিটি ক্যালকুলেটর-এ ঢুকুন।
এরপর পরিমাপের ইউনিট (ব্রিটিশ অথবা মেট্রিক) নির্বাচন করুন।
এরপর একে একে পাচটি চাহিদাকৃত তথ্য সরবরাহ করুন।
১) জন্ম তারিখ
২) আজকের তারিখ
৩) লিঙ্গ
৪) উচ্চতা (নিকটতম ০.১ সেমি বা ১/৮ ইঞ্চি পর্যন্ত একুরেসিতে)
৫) ওজন (নিকটতম ০.১ কেজি বা ০.২৫ পাউন্ড পর্যন্ত একুরেসিতে)
এবার “ক্যালকুলেট” লিখা বোতামটি চাপুন এবং ফলাফল দেখুন।

এই ক্যালকুলেটর অনুযায়ী আপনার সন্তান যদি ৮৫-৯৪ পার্সেন্টাইলের মধ্যে থাকে, ফলাফলে তাকে ওভার ওয়েট হিসাবে দেখাবে।
আর যদি সে ৯৫ পার্সেন্টাইল বা তাঁর উপরে থাকে, তাঁকে ওবেইস ঘোষনা করে ফলাফলটি আসবে।
কিন্তু মনে রাখবান, আমরা জিনগত ভাবে “সেন্টার হেভী” টাইপের অন্তর্ভুক্ত।
তাই আমাদের সন্তানের জন্য ৯০ পার্সেন্টাইলের উপরে গেলেই সেটাকে ওবেইস বা স্থুলতা হিসাবে ধরাটা বাঞ্ছনিয়।
আর ৮০ পার্সেন্টের উপরে থাকলে সেটাকে ওভার ওয়েট গন্য করা উচিৎ।

আপনার সন্তান ওভার ওয়েট বা ওবেইস হলে কি কি সমস্যা তাঁর হতে পারে, এখন কি কি করনিয়, ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে নীচে আলাপ করবো।
তবে তাঁর আগে, ওপরের লিংকে গিয়ে জেনে নিয়েছেন তো, আপনার সন্তানের স্থুলতা আছে কিনা, থাকলে তা কতটা…

দুই
যদি আপনার সন্তানের চাইল্ডহুড ওবেসিটি থেকে থাকে, তার সামনে বেড়ে ওঠার সময়টাতে বাড়তি অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ এসে যাবে। এগুলো হলো:
– আর দশটা শিশুর মত দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি করে বেড়াবার সুযোগ তাঁর খুব একটা থাকবে না।
– নিজেকে সে দলছুট ভাবতে শুরু করবে, অনেকের মাঝে থাকলেও তাঁর মধ্যে একটা একাকিত্ব বোধ কাজ করবে।
– কথায় কথায় শুধু সমবয়সি না, অনেক অসচেতন বড়দের কাছ থেকেও “মোটা” “বাল্কি” – এসব শুনে শুনে সে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকবে। হিনমন্যতায় ভুগবে।
– এই অনাকাঙ্খিত একাকিত্ব তাদের জন্য শৈশবকালিন বিষন্নতা এবং খাদ্যাসক্তি তৈরী করে দিতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে তাঁরা দিনে দিনে আরও বেশী স্থুলতায় আক্রান্ত হয়ে উঠবে।
– এদের জয়েন্টে পেইন সহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। টাইপ টু ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যার ঝুকিও বেড়ে যায়।
– এঁরা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ঘরকুনো হয়ে ওঠে। কোনো সৃষ্টিশীল কাজে এঁরা উৎসাহ দেখায় না। অলস জীবন যাপনে আগ্রহী হয়ে পড়ে।
– বেশির ভাগই শৈশবের স্থুলতা থেকে আর বেরুতে পারে না। তারমানে সারাজীবন এই স্থুলতাটা বয়ে বেড়াতে গিয়ে এদের গড় আয়ু কমে যায়। অনেক কম বয়স থেকেই এঁরা নানাবিধ বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়ে বড় হয়।
অথচ শুরু থেকেই একটু সচেতন থাকলে তাঁদের আর এতটা জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো না।
চাইল্ডহুড ওবেসিটি চিকিৎসার সবচেয়ে বড় সমস্যা বাঁধে, এদের খাদ্য নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে।
বেশী বেশী খাবার খেয়ে এঁরা যে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটায় যখন ছেঁদ পড়ে, এঁরা তা নিয়ে খুবই মনঃকষ্টের ভেতর দিয়ে যায়।
তাছাড়া চিকিৎসাটা হয় দীর্ঘ্য মেয়াদি।
তাই এতদিন এইভাবে বঞ্চিত থেকে ধৈর্য্য রাখাটাও তাঁদের জন্য হয়ে পড়ে কঠিন।
শিশুমনে এর চাপ পড়ে অনেক গভীর ভাবে।
আপনার সন্তান যদি অবেসিটিতে আক্রান্ত হয়েই যায়, চিকিৎসকের পরামর্ষ নিয়ে তাঁকে তা থেকে বের করার চেষ্টা করুন।
আর যদি সে বর্ডার লাইনে থাকে, কঠোর ভাবে তা মোকাবেলা করুন যেন সে নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে পারে।
সে যদি নিরাপদ পার্সেন্টাইলেও থাকে, তারপরেও উদাসিন না হয়ে তাঁর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যান………

তিন
গত অধ্যায়ে বলেছিলাম আপনার শিশুটি চাইল্ডহুড ওবেসিটি-তে আক্রান্ত হয়ে থাকলে সেটা সমাধানে নিজে নিজে পদক্ষেপ না নিয়ে চিকিৎসকের সরনাপন্ন হবার জন্য।
আজ জানাচ্ছি, কোন কোন ধরনের চিকিৎসকের সরনাপন্ন হবেন, তা।
প্রথমে তো অবশ্যই একজন পেডিয়েট্রিশিয়ন কনসাল্ট করবেন।
ওবেসিটির কারনে তার অলরেডি ডিফর্মিটির কোনো লক্ষন দেখা যাচ্ছে কিনা, কোনো কিছু করনিয় আছে কিনা – উনি সেটা ভাল বলতে পারবেন। শিশুটির হরমোনাল কোনো সমস্যা আছে কিনা সে ব্যাপারেও তাঁর কাছ থেকে জানতে পারবেন। অথবা এ ব্যাপারে কোনো এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট কনসাল্ট করার দরকার আছে কিনা, সে ব্যাপারেও উনি উপদেশ দেবেন।
তাছাড়া ওবেসিটির কারন যা ই হোক, একটা চিকিৎসা তথা ব্যবস্থাপত্রও কিন্তু উনি দেবেন।
উনি যে উপদেশই দেন না কেন, সেটা ফলো করা শুরু করে, একটা সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য হলেও একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (সম্ভব হলে পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) কনসাল্ট করা খুব ভাল।
এরপরে যদি উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে একজন ডায়েটিশিয়ান বা নিউট্রিশনিস্টের সাথে কনসাল্ট করে শিশুটির জন্য চিকিৎসকের উপদেশ মত ক্যালরী ও প্রোটিন পাওয়া যাবে সেরকম এমন একটা খাদ্য তালিকা তৈরী করে নিতে পারেন, যা শিশুটির স্বাভাবিক মেন্যুর সাথে মেলে।
এটা যদি তাঁর স্বাভাবিক ইনটেকের চেয়ে পরিমানে বেশি ভিন্ন বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে সেটা এডমিনিস্টারের আগে সন্তানকে একজন চাইল্ড সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেনিং এর জন্য নিন।
দেখবেন, কিছু কাউন্সেলিং-এর পর চিকিৎসকের উপদেশ অনুযায়ী ডায়েটিশিয়ানের বানানো চার্ট ফলো করতে তেমন একটা অসুবিধা আর থাকবে না।
তাছাড়া হরমোনাল সমস্যা বা ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স নিয়ে কোনো সমস্যা যদি থাকে সেগুলির সমাধানতো পেডিয়েট্রিশিয়ন বা এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট দিয়ে দেবেনই।
আর ডিফর্মিটি হয়ে থাকলে সেটার জন্যেও কোনো একজন পেডিয়াট্রিক অরথোপেডিস্টের কাছেও তারাই রেফার করবেন।
মোটামুটি ভাবে, সপ্তাহ খানেক একটু ছোটাছুটি করে এইভাবে আপনি আপনার শিশুর সারাজীবনের জন্য একটা সমাধান কিন্তু পেয়ে যাবেন…
আজ এই পর্যন্তই।
পরের অধ্যায়ে শোনাবো, কি কি করনিয় যাতে করে আপনার শিশু চাইল্ডহুড ওবেসিটিতে আক্রান্ত না হয়।
সাথে থাকুন…

চার
আজকাল শিশুরা এত বেশী নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বন্দি যে তাঁদেরকে ওবেসিটি থেকে মুক্ত রাখার জন্য কিছু একটা পদক্ষেপ নিতেই হয়।
তবে সুখের কথা হলো, খুব বেশী কিছুর করার অবশ্য দরকার পড়ে না।
মূলত দুইটা কাজ করা লাগে: ১) ব্যালান্সড খাদ্য গ্রহন, আর ২) কিছু এক্টিভিটি।
ব্যাস, এই দুইটাই একটু মনযোগ দিয়ে করলেই হলো…

ব্যালান্সড খাদ্য গ্রহনের জন্য যেটা করবেন, তা হলো,
ক) প্রতি বেলায় প্রচুর শাক-সবজি, ফলমূল খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। মাছমাংস, ডিম-দুধ, ভাত-রুটি – এসব তো থাকবেই, প্রচুর শাক-সবজি, ফলমূলও যেন থাকে এটা লক্ষ করবেন,
খ) পাঁচটা বেলায় খাবারটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাঁর মতামত অনুযায়ি পরিমানে খাওয়াবেন, অর্থাৎ কোনো জোরজুরি করবেন না,
গ) ইনবিটুইন মিল দেবেন না,
ঘ) জাংক ফুড, সফট ড্রিংক্স, এসব যথা সম্ভব কম খাওয়াবেন,
ঙ) পর্যাপ্ত পানি খেতে উৎসাহ দেবেন।

একটিভ থাকার জন্য যা যা করবেন, তা হলো,
ক) দিনে কোনোক্রমেই দুই ঘন্টার বেশী টিভি দেখা, কম্পিউটার গেম খেল্‌ ফেসবুকিং ইত্যাদি বসে বসে করা কাজ থেকে বিরত থাকা।
খ) কিছু দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি, লাফালাফিতে সময় ব্যয় করা।
গ) এমন সব খেলা বা খেলার সামগ্রিতে আগ্রহ জাগানো যেগুলাতে একটভিটি থাকে যেমন: বাইসাইকেল চালনা, স্কিপিং, সাতার, ইত্যাদি…
ঘ) একটিভিটির আর কোনো উপায় না থাকলে, নিজে হাটাহাটি করার সময় তাকেও আপনার সাথে যোগ দিতে বলুন…

এর ফাঁকে ফাঁকে চাইল্ড ওবেসিটি ক্যালকুলেটরে দেখে নিন, তাঁর ওজন-উচ্চতা-বয়স অনুযায়ি কত পার্সেন্টাইলে অবস্থান করছে সে।
এটা যদি একতরফা ভাবে বাড়তে থাকে, তখন চিকিৎসকের সরনাপন্ন হয়ে পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
কিন্তু যদি একই জায়গায় আটকে থাকে অথবা বাড়া-কমার মধ্যে থাকে, তাহলে চিন্তার কিছু নাই…

৫,৬৫৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।