প্রসঙ্গ : পরকীয়া – দ্বিতীয় পর্ব

প্রসঙ্গ : পরকীয়া – প্রথম পর্ব

চার
যেসকল পুরুষ পরকীয়াই শুধু না, একটিভ পরকীয়ায় জড়ান, তাঁরা প্রধানতঃই হলেন: সফল, দায়িত্ববান, সুখি দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন যাপনকারী।
এদের কেন পরকীয়ার দরকার পড়ে?
প্রচলিত ধারণাগুলো হলো: ১) আসলে লুইচ্চা ছিল, এখন সুযোগ পেয়ে সেটা প্রকাশিত হয়েছে, ২) পুরুষ মাত্রই এরকম, বহু নারীতে আগ্রহী ৩) বউ পুরান হয়ে গেছে, নতুন কিছু চায়। ইত্যাদি।
আমাদের দেশে এ নিয়ে কোনো গবেষনা হয়েছে বলে দেখি নাই।
বিদেশে হওয়া গবেষণায় উঠে আসা বেশ কিছু ব্যাপার আমাদের জন্যেও একইভাবে প্রযোজ্য বলে আমার মনে হয়েছে।
কারনগুলোর মধ্যে প্রধানতমটিই হচ্ছে, ব্যক্তিগত যৌনতা নিয়ে যেকোনো ডিফিকাল্টির কথা অন্য কারো সাথে আলাপ করায় পুরুষের অনীহা।
কারন, প্রচলিত ধারণা হলো,
পুরুষ মাত্রই “সদা সর্বত্র রেডি ফর সেক্স”, আসলে ঘটনা তা না।
আবার পুরুষের সেক্স বিষয়ক যেকোনো জটিলতা তাঁর জন্য পৌরষহানীকর।
বাস্তবে যেটা ঘটে, তা হলো, পুরুষ তাঁর পার্টনারের কাছে নিজেকে সবসময় অল পাওয়ারফুল হিসাবে উপস্থিত থাকতে চায় যা বাস্তবে সবসময় সম্ভব না।
সময়ের সাথে সাথে এ নিয়ে জটিলতা হয়ই। আর যখনই তা হয়, সেটা নিয়ে পার্টনার তো নয়ই, অন্য কারো সাথেও তাঁরা আলাপ করে না। নিজে নিজেই এর সমাধান করতে গিয়ে যারা অন্যত্র চেষ্টা করে দেখাটাকে একটা অপশন হিসাবে নেয়, এদের সংখ্যা খুব কম না।
রেগুলার পার্টনারের বাইরে এধরনের চেষ্টা নানা কারনে উপভোগ্য মনে হলেও মূলত দুইটা কারনে তাঁরা এতে বারবার ফিরে যায়: ১) দোষটা তখন স্ত্রীর উপর চাপিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া (যাক আমি ঠিকই আছি। ডিফিকাল্টিটা তাহলে হচ্ছিলো তাঁর কোনো দুর্বলতা বা চাহিদার কারনেই) ২) দৈনন্দিন চাহিদা মিটে যাওয়ায় কেয়ার ফ্রী থাকা যায়।
অথচ, এই ডিফিকাল্টির ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করতে পারলে খুব সহজেই বিশ্বস্ত সম্পর্কের মধ্যেই এর সমাধান করা যেতো।
নিজ যৌনতা নিয়ে আলাপচারিতায় অনীহা পুরুষের পরকীয়ায় ঝোকার পিছনে প্রধান কারন হলেও একমাত্র কারন না। অন্যান্য কারনের মধ্যে আছে
– প্রতিশোধ পরায়নতা যা ব্যক্তিত্ব বা অন্য কোনো দ্বন্দ্ব উদ্ভুত হতে পারে।
– সুযোগের সদ্ব্যবহার যা হঠাৎ পাওয়া সুযোগের ক্ষেত্রে হয়। পুরুষ এধরনের সুযোগ নিলে কম ঝুঁকি বোধ করে বলে তাঁদের এটা নেয়ার হার অনেক বেশী।
– আনফুলফিলড ফ্যান্টাসি যা রেগুলার পার্টনারের সাথে পুরন করা যাচ্ছে না, তা মেটাতে।
– কেবলই মেল ইগোর ডেমোনেস্ট্রেশন করার জন্য। ইত্যাদি।

এই পর্যন্ত পড়ে যদি কারো মনে হয়, আমি এসব কথা বলে পুরুষের পরকীয়ার মত একটা বাজে কাজকে র‍্যাশনালাইজ করার চেষ্টা করছি, তাহলে আমি দুঃখিত।
আমি কখনোই সেরকম কোনো চেষ্টা করছি না।
আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি যে গুটি কয়েক স্টেরিওটাইপিং-এ ফেলে এই অবস্থাটা বোঝাটা সম্ভব না। তাই সমাধানও পাওয়া যাবে না।
সমাধান পেতে ব্যাক্তির জন্য প্রযোজ্য সুনির্দিষ্ট কারনটা খুজে বের করতে হবে।
তারপর দেখতে হবে সেটা নিরাময় করা সম্ভব কিনা।
ব্যক্তিগত ডিফিকাল্টি কমুনিকেশনে অনীহা হলো সেরকম একটা সহজ নিরাময়যোগ্য কারন যা অনেকক্ষেত্রেই পার্টনারের সাথে ওপেন হয়েও সমাধান করা যায়। আর এটাই পরকীয়ার কারন হিসাবে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় বলে এটা দূর করাটা হবে প্রথম প্রায়োরিটি।
কেউ যদি এটাকে পুরুষের জন্য একটা শেইমিং ইস্যু না ভেবে সমাধানের চেষ্টা করেন, দেখা যাবে একটিভ প্যাসিভ – সব ধরনের পরকিয়াই সংখ্যায় অনেক কমে যাবে।
পুনশ্চ:
অন্যান্য কারনের বেশিরভাগই নিজেরা না হলেও রিলেশনশীপ কাউন্সেলরের সহায়তা নিয়ে নিরাময়যোগ্য।
আর কোনো কারন যদি একান্তই সমাধানের অতীত মনে হয়, তাহলে তো সম্পর্ক নিয়ে অকারণ এক্সপেকটেশনে না থেকে সংশয় মুক্তভাবে একটা কিছু ফাইনাল ডিসিশন নেয়ার পথ খোলা থাকছেই।
সেটাই কি ভাল না?

পাঁচ
এরকম একটা সেন্সিটিভ ইস্যুতে খুব একটা কোনো প্রশ্ন পাবো, আশা করি নাই।
পেলাম তো বটেই, তা আবার খুবই রেলিভেন্ট এবং গুরুত্বপুর্ন। আজ সেসব নিয়েই বলি।

প্রথম প্রশ্নটা তাঁদের সম্পর্কে, যারা জেনেশুনে একজন বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়েন।
কেমন মানুষ এঁরা?
তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনিতে উল্লেখ আছে এক বিবাহিত উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে তাঁর প্রেমের নিবিড় বর্ননার।
প্রেমিকের স্ত্রী প্রায়ই তাঁকে ফোন করে বকাঝকা অথবা অনুনয় বিনয় করতেন “নারী হয়ে আরেকজন নারীর ঘর না ভাঙ্গতে”।
তসলিমার অবস্থানটা ছিল “আমি তো তোমার বরকে জোর করে টেনে আনি নাই। পারলে আটকাও তাঁকে। আর কার বর, কিসের পরিবার – আমার তাতে কি আসে যায় যদি ভাল লাগার একজন মানুষ আমাকেও ভালবেসে চায়। আমি কেন অন্যের কথা ভেবে নিজের প্রাপ্য ছেড়ে দেবো?”
কথাগুলা বললাম এজন্য যে যখন আমরা কাউকে এভাবে চিহ্নিত করি, “এই সেই মেয়ে, যে একটা বিবাহিত পুরুষের সাথে প্রেম করে, তাঁর সংসার ভাঙ্গছে বা ভেঙ্গেছে…” – সেখানে মেয়েটির একধরনের ভিলেনিয়াস ক্যারেক্টারাইজেশন করা হয়।
কিন্তু সেটা কতটা ঠিক?
এই মেয়েটিরও তো ভালবাসার প্রয়োজন আছে। অধিকার আছে একজন মনের মানুষ থাকার। এই মানুষটা নিশ্চয়ই কোনো র‍্যান্ডম কেউ না। যেকোনো ভাবেই হোক, যাকে তাঁর মনে ধরলো, সে যদি বিবাহিত হয় এবং তাঁর নিজের যদি বিবাহিত অবস্থায়ও মেয়েটিকে প্রেম দিতে সম্মতি থাকে, তা নিতে মেয়েটির অসুবিধা কোথায়? অপরাধ কিসের??
আমার তো মনেহয় না এতে মেয়েটির কোনো অপরাধ আছে…
যা বলতে চাচ্ছি, তা হলো, একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে পারষ্পরিক সম্মতিতে স্বেচ্ছায় প্রেমের সম্পর্কে যে কেউই জড়াতে পারে। এটা আপত্তির কিছু হওয়া উচিৎ না। এখানে আপত্তির যদি কিছু থাকে, তা হলো, মেয়েটির এক্সপ্লয়েটেড হওয়ায়, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়। আর এসব হলে সে ই কিন্তু তখন ভিক্টিম।
তাঁকে পরকিয়ার জন্য দায়ি ভাবাটা তাই এক অর্থে ভিক্টিম ব্লেমিং-এরই সমতূল্য।

এবার আরেকটা প্রসঙ্গে আসি।
আগে বলে গেছি, পরকীয়ার একটিভ ফ্ল্যার্টিং-এ অনেক নারীই টার্গেটেড হন, ট্র্যাপড হয়ে প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়েন। এটুকু শুনে মনে হতে পারে, আহা কি অভাগাই না মেয়েটি! আজ একজন জানালো, এভাবে যখন একটা প্রেম হয়েই যায়, আর মেয়েটি যখন তা উপভোগ করে, ঐ টার্গেট করা ট্র্যাপ করাটা তাঁর কাছে অসম্মাজনক কিছু তো নয়ই বরং উপোভোগ্য বলেও মনে হতে পারে।
মনে হতে পারে, “আহ্‌ কতই না ভালবাসে সে আমায় যে বিবাহিত হয়েও কত কত ঝুঁকি মাথায় নিয়েও এত এত এফর্ট সে আমার জন্য দিয়েছে!” তাই শুরুতেই এইসব টার্গেট করার ট্র্যাপ করার কথা শুনে কাউকে করুনা করাটা ঠিক না।
ভালবাসা আসলেই অদ্ভুত এক ফেনোমেনা। পরিচিত কত কিছু না বদলে দেয় তা।
এই যেমন ধরুন, আপনাকে কেউ ফলো করছে, আপনার উপরে স্পাইং করছে, খুজে খুজে আপনার অতিত-বর্তমানের সব হাড়ির খবর কেউ বের করছে (কখনো দারোয়ান-টারোয়াওনদের ঘুষটুষ দিয়ে হলেও) এসব শুনলে তাঁকে উত্যক্তকারী মনে না হবার কোনো কারন আছে কি?
না নাই।
অথচ এই কাজটাই যদি আপনার প্রেমিক করে, হয়তো দেখবেন, কি এক অবর্ননীয় আনন্দের সিক্ত হয়ে যাবেন এটা ভেবে যে, “আহ্‌ এত খিয়াল তাঁর আমার জন্য? নিজের বউ-বাচ্চা আছে, তারপরেও আমি কখন কোথায় কেমন থাকছি, কি কি করছি – এসব নিয়ে ভেবে ভেবে তাঁর দেখি ঘুমই হয় না!!!”
হ্যাঁ, এরকমও হয়, প্রেমে পড়ে যারা, সেই সব নারীদের।
কারন তাঁদের কাছে সেগুলো তো পরকীয়া নয়, কেবলই প্রেম।
নিরেট প্রেম ছাড়া আর কিছুই না…
হলোই বা প্রেমিক বিবাহিত, হলই বা সমাজ-সংসারের কাছে তারা হ্যাপিলি ম্যারেড কাপল, কিন্তু সে তো জানে প্রেমটা শতভাগই তাঁর উপর।
একবার অর্জন করার পর, নিজের উপরে থাকা এই প্রেম কোনো অজুহাতে উপেক্ষা করার কি কোনো অর্থ হয়???
(চলবে…)

প্রসঙ্গ : পরকীয়া – তৃতীয় পর্ব
প্রসঙ্গ : পরকীয়া – চতুর্থ পর্ব
প্রসঙ্গ : পরকীয়া – পঞ্চম পর্ব
প্রসঙ্গ : পরকীয়া – ষষ্ঠ (শেষ) পর্ব

৫,৬৯৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।