১
ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় প্রোফেশনাল হেলপ লাগবেই – এমন একটা প্রায়ই বলে থাকি।
শুরুতেই ব্যাখ্যা করি, কেন তা বলি।
ডিপ্রেশন কথাটা দিয়ে আমরা যা বুঝাই তা হলো কোনো এক ধরনের “ডিপ্রেসিভ ডিজ-অর্ডার”-এ আক্রান্ত হওয়া।
বেশীরভাগ মানসিক সমস্যার মতই ডিপ্রেসিভ ডিজ-অর্ডারে আক্রান্ত হবারও একটা ট্রিগার অনেক সময় থাকে। কিন্তু একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে ট্রিগারের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় সেটা থেকে মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলি ও এর কারনে ঘটা শারীরিক উপসর্গগুলি।
আক্রান্ত ব্যক্তি ট্রিগার দ্বারা কতটা এফেক্টেড, তাঁর মস্তিষ্কের কেমিক্যালে কতটা পরিবর্তন ঘটেছে এবং তিনি শারীরিক ভাবে কতটা আক্রান্ত – এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রথমেই আক্রান্তের ডিপ্রেসিভ ডিজ-অর্ডারটির ক্লাসিফিকেশন করা হয়। এরপর সেই অনুযায়ী চিকিৎসা বাতলানো হয়।
বোঝাই যাচ্ছে, এই কাজটি প্রোফেশনাল ছাড়া অন্য কারে পক্ষেই করা সম্ভব না।
তাছাড়া, যেভাবেই ডিপ্রেশনের শুরুটা হোক না কেন, এটার ডিপ্রেসিভ ডিজ-অর্ডারে পরিনত হওয়ার মানেই হলো ব্রেনের কেমিকাল চেঞ্জ ঘটেছে। এই চেঞ্জের রিভার্সাল ছাড়া ডিপ্রেশন থেকে বেরুনো তখন আর সম্ভবপর থাকে না। ট্রিটমেন্ট করতে হলে এইটা মনে রাখতেই হবে।
ডিজ-অর্ডার ব্যাপারটা কি, সংক্ষেপে একটু বলে রাখি।
যেকোনো মানসিক ডিজ-অর্ডার হলো মানসিক সমস্যার কারনে এমন এক পরিস্থিতিতে পৌছানো যা দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায় আর নিজে নিজে তা থেকে উত্তরনের যে চেষ্টাই করা হোক না কেন, দেখা যায় তা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে।
দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানো বলতে বুঝানো হয়েছে : আহার, নিদ্রা, যৌনতা, সম্পর্ক, কাজ, দায়িত্ব, আগ্রহ-উৎসাহ, ইত্যাদি সব কিছুই এতটাই বদলে যাওয়া যা ব্যক্তির জন্য কন্টিনিউয়াস সাফারিং এর সোর্স হিসাবে কাজ করে।
২
কারো ডিপ্রেশনের কথা জানার পর কি বলা যাবে আর কি বলা যাবে না – তা নিয়ে এইবার একটু আলাপ করি।
প্রথমে একটা কেসস্টাডি:
মেয়েটির ডিপ্রেশনের ট্রিগার হলো নিজেকে “ট্র্যাপড ইন রং এ বডি” মনে হওয়া থেকে।
পিউবার্টির আগেও নিজের শরীর নিয়ে তাঁর কোনো বিরূপ মনভাব ছিল না।
কিন্তু পিরিয়ড শুরুর পর থেকে এত এত সামাজিক ও পারিবারিক বিধি নিষেধের বেড়াজালে সে বন্দি হয়ে পড়ে যে তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ে তাঁর সদ্য প্রস্ফুটিত হতে থাকা নারী দেহটির ওপরে।
সেই দেহ, যা সে ভালও বাসে। সাজায়, যত্ন নেয়।
অথচ একই সাথে সেই দেহটি যখন তাঁর যাবতিয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তাঁকে ভয় পাওয়ায় “কখন কি হয়ে যাবার” – সে তাঁকে নিজের আপন ও ব্যক্তিত্বের জন্য সঠিক বলে মানতে পারে না।
এই মানতে না পারা থেকে প্রথমে তাঁর মধ্যে নিজের দেহ নিয়ে এক ধরনের বিরক্তি শুরু হয়। আর একসময় তা তাঁর মধ্যে বিষন্নতার সুত্রপাত করে।
বিষন্নতাটা যখন শিকড় গেড়ে বসে, সে এটার প্রতিশোধক হিসাবে খুজে পায় খাদ্য গ্রহন। খাবারে এই আগ্রহ ধীরে ধীরে তাঁর খাদ্যাসক্তি তৈরী করে আর সে কারনে এক সময় স্থুলতায় আক্রান্ত হতে থাকে সে।
এই স্থুলতা তাঁকে আরও বিষন্ন করে তোলে।
বিষন্নতা তাঁকে একাধিকবার সুইসাইড এটেম্পট নিতেও উদ্বুদ্ধ করে।
আমি যখন তাঁর এই নিজ দেহ ও নারী জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণার কথা জানলাম, তাঁর কাছে নারী-জীবন গ্লোরিফাই করা কিছু লিখা পাঠালাম।
জানালাম, “নারী জীবন কতই না মধুর মাতৃত্বের সক্ষমতায়, কেয়ারিং হবার সামর্থে, ইত্যাদি।”
আমার পাঠানো লিংকগুলি মেয়েটি পড়লো। পড়ে ভান করলো যেন সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পরে একটা সময় বুঝলাম, কিছুই ঠিক হয় নাই। কারন:
যে অপছন্দের নারীদেহে থাকা নিয়ে তাঁর এত ক্ষোভ, সেটার মাতৃত্ব সক্ষমতা, সন্তানের জন্মদান ও স্তন্যপ্রদানের সামর্থ এসব সে ততদিনে করে টরে এক্সপার্ট হয়ে গেছে।
তাছাড়াও যৌন আচরনের সময় নারীদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সঙ্গীকে কিভাবে হাতের পুতুলে পরিনত করা যায় – সেসবের অভিজ্ঞতাও সে অর্জন করে ফেলেছে।
কোনো লেখা না পড়েও এখন সে তাঁর নারীদেহের গ্লোরি বুঝতে পারে।
তবুও একসময় যে দেহের কারনে সে স্বাধীনতা হারিয়েছিল, যে দেহ কোনো না কোনো একভাবে তাঁর বিষন্নতার কারন হয়ে উঠেছিল তাকে অপছন্দ করা থেকে আর সে বেরুতে পারে না।
আমার পাঠানো লেখাগুলির লিংকগুলো ফাঁকা বুলির মত বিধে তাঁর কানে।
একজন বিষন্নতায় আক্রান্তের বিষন্নতার পিছিনে কি কারন, কখনো সেটা নিজে থেকে খুজতে যাবেন না। সে যদি নিজে থেকে কিছু বলে, সেটা শুনুন, সেটাকে উপযুক্ত কারন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি সমব্যাথি হোন।
কারনটির উপযুক্ততা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলবেন না। “এইটা কোনো কারন হৈলো, মন খারাপ করবার” – এই জাতীয় কথা বলে তা উড়িয়ে দেবেন না। এটা করলে আপনি তাঁর আস্থা হারাবেন চিরটা কালের মত।
সমব্যাথি হয়ে আস্থা অর্জন করুন এবং সেটা করতে পারলে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করুন প্রফেশনাল হেলপ নেবার জন্য…
মনে রাখবেন, একজন সুহৃদ হিসাবে একজন বিষন্নতা আক্রান্তকে প্রোফেশনাল হেলপ নিতে সম্মত করাটাই হলো তাঁর জন্য সর্বোচ্চ কল্যান নিশ্চিত করা।
বাকি কাজ ঐ প্রোফেশনালকেই না হয় করতে দিন………
৩
প্রোফেশনাল হেলপ ছাড়া ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে বড় যে অন্তরায় সম্ভবতঃ সেটা হলো এই যে প্রায় ক্ষেত্রেই ডিপ্রেশন জিনিষটা আক্রান্তের জন্য এমন একটা অশুভ চক্র হিসাবে আবির্ভুত হয় যা থেকে আক্রান্তের মুক্তি তো মেলেই না বরং দেখা যায় যে, নিজে নিজে নেয়া মুক্তি প্রচেষ্টাটি ডিপ্রেশনের আরও বড় উপলক্ষ তৈরী করে ফেলে আক্রান্তের জন্য।
নিজে নিজে কয়েকবার এরকম উদ্যোগ নিয়ে বিষন্নতার সাথে আরও বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাবার কারনে বিষন্নতাক্রান্তগণ অনেক সময়ই আরও বেশি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। কখনো কখনো হোপলেস অনুভব করার পরিস্থিতি এতটাই বিরূপ মনে হয় যে তাঁরা তখন আত্মহত্যা প্রবনও হয়ে ওঠেন।
আগে চক্রটার একটু ব্যাখ্যা দিয়ে নেই, তারপর উদাহরণ দেবো কিভাবে এটা বিষন্নতা থেকে বেরুনোর প্রচেষ্টাকে আরও বেশি বিষন্নতায় নিমজ্জিত করে।
একটি ইভেন্ট ট্রিগারড বিষন্নতায় যারা আক্রান্ত হন, তাঁদের এটা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না যে, যে জীবন তাঁরা যাপন করছেন তা কোনো স্বাভাবিক জীবন না। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে যে উৎসাহটা নীজের ভিতরে অনুভত করা উচিৎ, বিষন্নতার কারনে প্রাথমিক ভাবে তাতে ঘাটতি বোধ করেন তাঁরা।
একটা সময় এই নির্জীব জীবনে ক্লান্তি ধরে যায় তাঁদের।
সমস্যা বাধে তখনই, যখন এই ক্লান্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরুতে একটা সময় তাঁরা কিছু একটা ডেসপারেট এটেম্পট নিয়ে বসেন।
আর দুর্ভাগ্যর কথা হলো এই যে বিষন্নতাক্রান্ত মানুষগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব বেশি অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই ডেসপারেট এটেম্পটগুলো নিয়ে বসেন।
এতে করে দেখা যায়, কখনো কখনো তাৎক্ষনিক কিছু নিরাময় হয়তো হয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আরও বেশি জটিলতার সৃষ্টি করে যা তাঁদের মধ্যে থাকা বিষন্নতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে একটা পর্যায়ে তাঁরা নিরাশার (হোপলেসনেসের) শেষ সীমানায়ও পৌছে যান কখনো কখনো।
এবার উদাহরণ দেই।
বিষন্নতাক্রান্ত থাকা কালে কর্মোদ্দিনা হারিয়ে ফেলা, সামাজিকতা থেকে দূরে সরে থাকা, সম্পর্ক-প্রেম-যৌনতা : এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, ইত্যাদি ঘটাটা খুবই স্বাভাবিক।
কিছুদিনের মধ্যে এসব অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারাও খুব কঠিন কিছু না।
এইসময় যখন একজন বিষন্নতাক্রান্ত মানুষ যদি হঠাৎ করেই কর্মচাঞ্চল্য দেখাতে চেষ্টা করেন, সেখানে ভুল হবার সম্ভবনা থাকে অনেকবেশি। হয়ও তা।
একই ঘটনা ঘটতে পারে কোনো এক সোশাল গ্যাদারিং-এ। ওখানে তো আর ভুল হয় না ঠিক কিন্তু দেখা যায় ওখানে, আচরনগত কোনো না কোনো বাড়াবাড়ি, এই যেমন অকারণ বচসায় লিপ্ত হওয়া কিংবা বেশি পানাহার করে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি ঘটিয়ে ফেলেন এঁরা দীর্ঘ অনভ্যাসজনিত কারনে।
সম্পর্ক-প্রেম-যৌনতায় বেশি এডভেঞ্চারাস হতে গিয়ে ভুল সময়ে ভুল সঙ্গি নির্বাচন করে তাঁর সাথে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে যাবার মত ঘটনা ঘটে যায় অবলিলায়।
সমস্যা হলো, এগুলো করার সময় এঁরা ফলাফল নিয়ে সচেতন থাকেন না। বরং ভাবেন “বাহ, এইতো বেশ কাটিয়ে উঠছি সব!!!” কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারেন যে আভ্যন্তরীন বিষন্নতার কারনে কাজটায় ভুল হয়েছিল, কিংবা অনুষ্ঠানে তিনি বিষন্নতার কারনেি অত্যুৎসাহ দেখাতে গিয়ে বা মাতলামি করে নিজেকে হালকা বা হাস্যষ্পদে পরিনত করেছিলেন, অথবা, অসম, অনিরাপদ বা অসম্ভব সম্পর্ক-প্রেম-যৌনতায় জড়িয়ে অসুস্থ্য বা পাপবোধে ভোগার মত পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলেন।
দেখা যায়, এইসব ভুলভাল করা ও অনুশোচনা বা পাপবোধে ভোগার কারনে আরও বড় এক বিষন্নতার চক্র তাঁদের গ্রাস করে ফেলে।
বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে নতুন কোনো চক্রে ঢোকা থেকে নিরাপদে থাকা দরকার।
আর সেটা নিশ্চিত করার জন্য যেটা খুবই জরুরী, তা হলো, যথাশীঘ্র সম্ভব একজন পেশাদার সহায়তাকারীর সরনাপন্ন হওয়া।
৪
বিষন্নতা কোনো সাধারন অসুস্থ্যতা নয়।
এটা হলো এমন এক অবস্থা যা আক্রান্তের জন্য একধরনের ডিজএবিলিটি তৈরী তো করেই এমনকি বিষন্নতার কারনে তিনি মৃত্যঝুকির মত পরিস্থিতিতেও থাকেন।
বিষন্নতার যে কোনো ঘটনাই তাই অবহেলা না করে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নেয়াটাই হলো বাঞ্চনিয়……