রেপ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে ভাবনা (শেষ পর্ব)

রেপ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে ভাবনা (প্রথম পর্ব)

তৃতীয় অংশ
এডাল্ট ভিক্টিমের ক্ষেত্রে এখনো রেপের সবচেয়ে প্রচলিত সংজ্ঞা হলো “the carnal knowledge of a woman when achieved by force and against her will by a man who was not her husband”.
জানা যায়, এই সংজ্ঞার অরিজিন হলো প্রাচিন ইংলিশ আইন।
আর সেই আইনের বেসিস ছিল ততকালিন বৃটিশ সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নারীকে পরিবারের সম্পত্তি জ্ঞান করা হতো।
অবিবাহিত অবস্থায় সে ছিল পিতার সম্পত্তি আর বিবাহের পর স্বামীর সম্পত্তি।
বিবাহকে মনে করা হতো সম্পত্তি হস্তান্তরের শান্তিপূর্ন অর্থাৎ বৈধ উপায় আর রেপ ছিল সেই সম্পত্তি বলপূর্বক অর্জনের অবৈধ পন্থা। উপমহাদেশের অসুর-বিবাহ নামক প্রথাটিও আসলে তাই।
এ থেকে রেপের সাথে ট্যাবু যুক্ত হওয়াটা অনুমান করা যায়। আবার কঠোর শাস্তি আরোপ করে রেপ নিরুতসাহিত করার চেষ্টাটাও এই প্রেক্ষাপটের সাথে মেলে।
এই সংজ্ঞার দুর্বলতা হলো, এখানে বলপ্রয়োগের বিষয়টার উপরে যে অকারণ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটা ভিক্টিমের জন্য মোটেও সুখকর না। একটা সময় বিচার্য্য হিসাবে এটার উপরে গুরুত্ব অনেক বেশি দেয়া হতো আর এজন্য বেশিরভাব ভিক্টিম সুবিচার বঞ্চিত হতেন।
এখন বলা হচ্ছে: “rape is best understood as an act of unwanted bodily invasion that need not involve force”.
তাই নতুন ডেফিনিশন বলছে, “penetration, no matter how slight, of the vagina or anus with any body part or object, or oral penetration by a sex organ of another person, without the consent of the victim”
বলপ্রয়োগের বিষয়টা পুরোপুরি বাদ দিয়ে সম্মতি থাকা না থাকাটাই এখন মূল বিচার্য্য।
এরপর থেকে সম্মতির বিষয়টা নিয়ে নানা আইনি জটিলতা শুরু হলে ক্যালিফর্নিয়ায় যে “affirmative consent standard” বিষয়ক আইনটি হয়, সেটা রেপের প্রতিকার একটা মাইলস্টোন হিসাবে গন্য করার মত।

বিস্তারিত লিখছি পরবর্তি অংশে…

চতুর্থ অংশ
রেপের প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পর থেকেই বিচার্য্য হিসাবে যে প্রশ্নগুলা বারবার মোকাবেলা করতে হয় তা হলো, কিসের সম্মতি? কতটা সম্মতি?
যদিও আইনে সেক্স বলতে পেনিট্রেশন কথাটার উপরে জোর দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক বিষয়টার একটি অতি সরলিকরন প্রচেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু মামলা চলা কালে দেখা যায় সেক্স অর্থে শুধু পেনিট্রেশন বুঝায় না।
সেক্সের নিম্নক্তো তিনটা ডিস্টিংক্ট ও ধারাবাহিক ধাপ আছে যেগুলার প্রতিটার জন্যই আলাদা আলাদা কনসেন্ট থাকাটা জরুরী।
– প্রথম ধাপ : প্রি-লাভ প্লে যাতে কেয়ারজিং, কাডলিং, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
– দ্বিতীয় ধাপ : ইন্টারকোর্স যাতে পেনিট্রেশন অন্তর্ভুক্ত।
– তৃতীয় ধাপ : ইজাকুলেশন যা হতে পারে ইন্টারনাল কিংবা এক্সটারনাল।
তৃতীয় ধাপের জন্য সম্মতিটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সম্মতি বলে গন্য করা গেলেও প্রথম ধাপের সম্মতি যেমন দ্বিতীয় ধাপের অটোমেটিক সম্মতি বুঝায় না, তেমনই দ্বিতীয় ধাপের সম্মতিও তৃতীয় ধাপের সম্মতি বোঝায় না।
এটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায় বৃটেনে চলতে থাকা একটি রেপচার্জের বিচার প্রক্রিয়ায়।
সেই কেসে অভিযোগকারিনীর সম্মতিতে পেনিট্রেশন ঘটেছিল, এটা জানার পর ট্রায়েল কোর্ট তা ফেরত পাঠায়।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগকারিনী আপিল করেন কারন তাঁর অভিযোগ ছিল ইন্টারনাল ইজাকুলেশন সম্পর্কে যা তাঁর বিনা সম্মতিতে ঘটেছিল। আপিলটি গ্রহন করে ট্রায়েল কোর্টকে বিচার চালিয়ে যেতে আদেশ দেয়া হলে এটা এসটাবলিশ হয়ে যায় যে ইন্টারকোর্স ও ইন্টারনাল ইজাকুলেশন শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুইটা পৃথক ধাপ যেগুলার প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে।
সম্প্রতি জুলিয়ান এসেঞ্জের বিরুদ্ধে সুইডেনে দুই নারী যে সেক্সুয়াল মিসকন্ডাক্টের অভিযোগ এনেছিলেন সেগুলাতেও অসম্মতি সত্তেও ইন্টার্নাল ইজাকুলেশনই ছিল সেই অভিযোগের ভিত্তি। যদিও তাঁরা দুজনেই জানিয়েছিলেন তাঁদের সাথে এসাঞ্জের শারীরিক সম্পর্কগুলি পারষ্পরিক সম্মতিতেই ঘটেছিল। কিন্তু ইন্টার্নাল ইজাকুলেশনে তাঁদের দুজনেরই অসম্মতি ছিল। এবং তাঁরা তা এসাঞ্জকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়েওছিলেন।
এবার বলি ক্যালিফোর্নিয়ার এফার্মেটিভ কনসেন্ট স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কিত আইন নিয়ে।
এই আইন বলে “It is the responsibility of each person involved in the sexual activity to ensure that he or she has the affirmative consent of the other or others to engage in the sexual activity.” অর্থাৎ পার্টনারের কনসেন্ট থাকার বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে জানা ও বোঝাটা ব্যাক্তির দায়িত্ব। পার্টনারের দায়িত্ব না সেটা জানানো বা বোঝানো। এর অর্থ হলো, পার্টনার যদি কনসেন্ট না থাকার অভিযোগ তোলে, সেটা প্রমানের দায়িত্ব বর্তাবে অভিযুক্তের উপরে, অভিযোগকারীর উপরে না।
এরপর আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে কি কি ক্ষেত্রে “সম্মতি ছিল” – এটা ধরে নেয়ার সুযোগ নাই:
– Lack of protest or resistance does not mean consent,
– nor does silence mean consent.
এরপরে বলা হয়েছে, একবার সম্মতি দিলেই সেটা চুড়ান্ত কিছু না। পার্টনার ধাপে ধাপে সেটা দিতে পারেন আবার একবার দেয়া সম্মতিটা যেকোনো সময় প্রত্যাহার করার ক্ষমতাও তিনি রাখেন।
“Affirmative consent must be ongoing throughout a sexual activity and can be revoked at any time.”
এসব বুঝে শুনেই একজনকে শারীরীক সম্পর্কে এগুতে হবে।
আর এ থেকে ব্যত্যয় ঘটলেই সেই শারীরীক সম্পর্কটা আর স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকবে না, বরং রেপ-এ পরিনত হয়ে যাবে…

উপসংহার
দেখা যাচ্ছে, ধর্ষনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলার বেশিরভাগেরই ঘটার পিছনে মূল কারন সম্মতির ব্যাপারটাতে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেয়া।
সম্মতির ব্যাপারটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ন, সেটা যদি পর্যাপ্ত পরিমানে প্রচারণার মাধ্যমে অথবা যৌনশিক্ষাকালে সবাইকে জানানো হয়, দেখা যাবে এ সম্পর্তিত সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
আর এই সচেতনতা সবার মধ্যে সৃষ্টি হলেই কেবল রেপ জনিত অপরাধ প্রবণতা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব…
(সমাপ্ত)

৫,৮৫৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “রেপ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে ভাবনা (শেষ পর্ব)”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার সময়োপযোগী পোষ্ট। তবে শেষ লাইনটার সাথে দ্বিমত পোষন করছি। শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রবণতা কমিয়ে ফেলা সম্ভব বলে মনে করি না এই মুহূর্তে। সেখানে পৌছাতে আমাদের আরো পথ পাড়ি দিতে হবে সম্ভবত।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      একটা অপিনিয়ন দেবো, আর তাতে দ্বিমত থাকবে না, তাকি হয়?
      বুঝতে পারছি, আমার বলাটার মধ্যে ঘাটতি আছে।
      রিফ্রেজ করে দেবো।
      তবে যেটা বলেছি, সেটাও কিন্তু ফ্যাক্ট বেইজড।
      দেখা গিয়েছে উন্নত দেশে যে কেসগুলা রেপ হিসাবে রিপোর্টেড হয়, সেগুলার প্রায় ৯০%-ই টিপিকাল বাই ফোর্স করা কিছু না।
      বরং কনসেন্টের ব্যাপারটা না বোঝার বা সেটাতে গুরুত্ব না দেয়ার কারনে।
      এবং যেখানে যেখানেই এই ব্যাপারে মেজার নেয়া হয়েছে, এই অর্থে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে যে কনসেন্ট সমস্যা দূর হয়ে টোটাল রেপ নাম্বার কমে গেছে।
      "নো মিনস নো" - এই ছোট্ট একটা স্লোগানই যে রেপের সংখ্যা কত কমিয়ে আনতে পারে, তা নিয়ে আমাদের কোনো ধারনাই নাই......


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম, পিঙ্ক নামের। একই বিষয় নিয়ে। দারুণ ছিল গল্প এবং অভিনয়, বিশেষ করে অমিতাভের। শেষের শ্লোগানটা ত অমিতাভেরই একটা ডায়ালগ, তাই না? (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।