ব্রেকআপ_ম্যানেজমেন্ট

অনেকদিন হলো, এপাড়ায় আসা হয় না।
আজকাল যেসব ফরমেট বিহীন কথাবার্তা লিখি, তা না গল্প, না কবিতা, না ব্লগ।
তাই পোস্ট করতে আসা হয় না।
অন্য অনেক কিছু পড়ে পড়ে সময় ফুরিয়ে যায় বলে এখান পড়তেও আসা হয় না খুব একটা।
আজ এলাম এই লেখাটা আর্কাইভ করতে।
মনে হলো, তিন পর্বের এই লেখাটা আর্কাইভিং-এর জন্য উপযুক্ত…


“প্রতিটা ব্রেকাপই কষ্টকর।
সেটা যে কারণেই ঘটে থাকুক না কেন।”
– এটা ছিল আমার গতকালের একটা ফেবু স্ট্যাটাসের কমেন্ট।
একটা ব্রেক-আপ সাধারনতঃ হঠাৎ করে হয় না।
দীর্ঘদিনের অনুভব, প্রস্তুতি, উপলব্ধি ও সম্পর্কটা ওয়ার্কেবল করার সব চেষ্টা ব্যার্থ হবার পরেই যখন আলাদা হওয়াটাকে একসাথে থাকার চেয়ে শ্রেয়তর বলে একজন ভাল রকমের কনভিন্সড হন, তখনই তিনি এই ব্রেক-আপের পথে হাটেন।
কষ্টটা তাই প্রস্তুতি হীনতার নয়। (প্রোস এন্ড কনস ভেবে সময় নিয়েই সিদ্ধান্তটা নেয়া)
কষ্টটা তাই একাকিত্বের নয়। (ব্রেক-আপের পর একা হতে হবে, সেটা তো জানাই)
কষ্টটা তাই সুখের সময়গুলো মিস করার নয়। (অনেক বেশী দুঃখের সময়ও থাকে)
কষ্টটা তাই ব্যার্থতারও না। (অনেক চেষ্টা করেও যখন নিশ্চিত হওয়া যায়, “কিছুই আর ঠিক হবে না, এবং এতে আমার কোনো দোষ নাই” তখনই সাধারনতঃ ব্রেক-আপ ডিসিশনটা নেয়া হয়)
তাহলে কষ্টটা কিসের?

এক্সপার্ট অপিনিয়ন হলো, এই কষ্টটা আসলে একটা ফ্যান্টাসির!!!
সম্পর্কে থাকা প্রতিটা মানুষই নিজেদের সম্পর্কের সুন্দর অংশগুলো প্রকাশ্যে আনে।
সেগুলো দেখে জটিলতায় থাকা অন্যদের মাঝেও একটা ফ্যান্টাসির তৈরী হয় যে ঐ ঐ ‘ব্যাপারগুলো’ ছাড়া আমরাও অমন সুখি হতে পারতাম।
একটা সময় সেইসব ‘ব্যাপারগুলো’ মনে মনে মুছে একই মানুষকে নিয়ে কল্পনার এক সুখের জগতে বসবাসের অভ্যাস গড়ে তোলে সম্পর্ক-জটিলতায় থাক মানুষ গুলো।
বাস্তব জগতে ফিরে এলে দোষে ভরা যাকে একমুহুর্তের জন্য সহ্য করা যায় না, দেখা যায় কল্পনায় তাকেই দোষ মুক্ত করে তাঁর সাথেই চলে নিরবিচ্ছিন্ন সাত আসমান ভ্রমন।
ব্রেক-আপের অন্য সব কষ্টের উৎস প্রস্তুতি দিয়ে, সাপোর্ট নিয়ে তাৎক্ষণিক না হলেও দ্রুত অতিক্রম করা যায়।
কিন্তু কল্পনার মিঃ বা মিজ পারফেক্টের সাথে এই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া কল্পনার সাগরে অবগাহন সহজে অতিক্রমনিয় নয়।

একটি ব্রেক-আপ যত যুক্তিসঙ্গত কারনেই হোক না কেন, যত প্রয়োজনিয়ই হোক না কেন, যত দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে তা ঘটুক না কেন – যতক্ষণ না একজন এই ফ্যান্টাসি থেকে বেরুতে পারছেন, ব্রেক-আপ জনিত কষ্ট থেকে তাঁর কোনোই মুক্তি নাই!!!


আগের পর্বের সারকথা ছিল, ফ্যান্টাসি সম্পর্কিত, যেটা আসলে রিয়েল কিছু না।
পুরোটাই মস্তিষ্কজাত।
বিচ্ছেদ জনিত কষ্টের উপাদান হিসাবে এটা স্থান-কাল-পাত্রভেদে সবক্ষেত্রই প্রযোজ্য।
বিচ্ছেদের প্রতিক্রিয়া অসহনিয় করতে আমাদের দেশে নারীদের জন্য অবশ্য এর বাইরেও আরও কিছু অতিরিক্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথমতঃ “সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে” জাতিয় কথা বলে বলে অসুখি সংসারের যাবতিয় দায়ভার নারীদের উপরে চাপানোর একটা পরিবেশ শুরু থেকেই তৈরী করে রাখা হয়। এরপর আসে নারীদের কাজের অবমূল্যায়নের প্রসঙ্গটা।
নারীর দৈনন্দিন সাংসারিক কাজগুলো যত কঠিন ও জটিলই হোক না কেন, সেগুলাকে “সামান্য সংসার দেখাশুনা” বলে অবিহিত করার মধ্য দিয়ে নিপিড়নের আরেকখানা পরিবেশ তৈরী করে রাখা হয়।
এই দুইয়ের চাপে নিষ্পেশিত, নিগৃহিত নারীকে পুরুষ ও তার পরিবারের উপর এমনভাবে নির্ভরশীল করে রাখা হয় যে সেই নারীর পক্ষে দরকার মনে হলেও একাকী বেরুনোর কথা ভাবাটাই সম্ভব হয় না।
তারপরেও যদি কেউ তা ভাবে, একাকী নারীর উপর আইন দিয়ে সন্তান দেখাশোনার একটা ভার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাপিয়ে রাখা তো হয়ই আবার সেটা সে যেন সহজে করতে চাইতে না পারে সেইজন্য তাঁর বাড়িভাড়া নেয়া, কারো আশ্রয়ে থাকা – এইসবকে যার-পর-নাই জটিল করে রাখা হয়।
এসবও যদি কেউ কোনোভাবে অতিক্রম করে, তখন আবার আসে মুখ ঝামটা দেয়া, কটূক্তি করা।
“মেয়ে হয়ে এত দেমাগ দেখানো ভাল না” বা “নিশ্চয়ই তাঁর কোনো দোষ আছে, নইলে সংসার ভাঙ্গবে কেন?” – কোনো একাকী নারীকে এসব শুনতে দেখে নাই, এমন মানুষ খুজে পাওয়া ভার।
মজার ব্যাপার হলো, এসব কথা যারা বলে, তাঁরা সবাই যে খুব ভাল থাকছে বলে এগুলো বলে, এমন কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না। বরং দেখা যায়, নিজেরা একই রকমের গঞ্জনা সহ্য করেও অতিকষ্টে ও ভয়ে ভয়ে বিচ্ছেদ এড়িয়ে আছে বলেই এসব কথা বলে মনের দুঃখ হালকা করে।

এই যে নারীর উপরে বিচ্ছেদের যাবতিয় দায়ভার চাপানো, তাঁর জন্য “তালাকপ্রাপ্তা” নামের একখানা পরিচয় তৈরী করা আর সেই পরিচয়টাকে একটি কু-বিশেষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা – এই সব দৃশ্যমান প্রতিকুলতাও এই দেশে একজন নারীকে বিচ্ছেদে নিরুৎসাহিত করার ঘোর ষড়যন্ত্র।
সখ করে কেউ যখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় না তখন বিচ্ছিন্নতার সিদ্ধান্ত নেয়া একজন নারীকে হাতিঘোড়া বুঝিয়ে তা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টাকে কোনো সাফল্য হিসাবে গন্য করার কোনো সুযোগ নাই।
বরং এটা হলো এমপ্যাথিহীনতা কারন এরমধ্য দিয়ে পরিষ্কার ভাবে তাঁর অবস্থানটা বুঝতে না পারা ও নিজের মনগড়া যুক্তি খাওয়ানোর প্রচেষ্টা ফুটে ওঠে।

নারীর সমস্যা বুঝতে ও তার সমাধান খুজতে আরও বেশী এমপ্যাথি নিয়ে এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নাই…
(আগের পর্ব থেকে পাওয়া একখানা কমেন্ট পড়ার পর তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই পর্বটা লিখমান। কমেন্টটি যিনি করেছেন তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ)


আগের দুই পর্ব পড়ে মনে হতে পারে, “ব্রেক-আপ কি তাহলে এতটাই কঠিন, যা করা যাবে না?”
না। সেকথা বলতে চাই নাই।
বলতে চেয়েছি, ব্রেক-আপে যে ডিফিকাল্টি আছে, তা তো আছেই। কিন্তু যখন তা করতে হচ্ছে, জেনে রাখুন, কি কি কঠিন পরিস্থিতি আপনাকে সামাল দিতে হতে পারে, নিজে কোনো দোষ না করেও।
কখনো কখনো বলা হয়ে থাকে, “অচেনা বন্ধুর চেয়ে চেনা শত্রু ভাল”। এটা সেই শত্রু চেনার মতই একটা এক্সাসাইজ।
কাউকে ব্রেক-আপ করতে বলছি না।
কিন্তু কখনো যদি তা করতেই হয়, অন্যসব প্রস্তুতির পাশাপাশি ফ্যান্টাসির ব্যাপারটা কিভাবে হ্যান্ডেল করবেন, সে ব্যাপারে সচেতন করছি।

এবার আসি বিচ্ছেদ-বিরোধী পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানটা নিয়ে।
পরিবার থেকে “আরেকটু চেষ্টা করে দেখ” (যেন আপনি কোনো চেষ্টা ছাড়াই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন) জাতিয় কথাবার্তা আপনাকে শুনতেই হবে।
এটা প্রত্যাখ্যানে কঠোর মনভাব বজায় রাখার কোনো বিকল্প নাই।
মনে রাখবেন, একবার চেষ্টা করার অনুরোধে রাজী হবার অর্থ হলো আবারো নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হওয়া যার শেষ পরিনতি বিচ্ছেদই।
যে বিচ্ছেদ হবারই, তা ডিলে করে আবার কেন এই যন্ত্রণা মেনে নেয়া?
তাছাড়া একবার যদি অনুরোধের ঢেকি গেলেন, বারবার এরকম অনুরোধ আপনার কাছে আসতেই থাকবে। আর তা না নিলে, আপনি চিহ্নিত হবেন “ঘাউরা” হিসাবে।
মনে রাখবেন, আপনার প্রতিবার ফিরে যাওয়া আপনার প্রতিপক্ষের কাছে আপনাকে আরও দুর্বল হিসাবে উপস্থাপন করবে।
দেখবেন, এতে করে সে নতুন নতুন অত্যাচারের অজুহাত নিয়ে আবির্ভুত হবেন প্রতিবারই এবং তা চলবে ততক্ষন, যতক্ষণ না আপনি সম্পুর্ন বিধ্বস্ত হচ্ছেন।
সেটার কি কোনো দরকার আছে?

বিচ্ছেদের পর আপনি বাড়িভাড়া নিতে সমস্যায় পড়বেন, ডিভোর্সি নামে আখ্যায়িত হবেন, কর্মস্থলে নানা ইঙ্গিত-বিদ্রুপের সম্মুখিন হবেন – এগুলো সত্য। কিন্তু মনে রাখবেন, সেগুলোর কষ্ট অসুখি ও অত্যাচারিত থেকেও সুখি সুখি ভাব করা বা অভিনয় করার চেয়ে বেশী হবে না।
তাছাড়া একটা সম্পুর্ন নতুন জিনিষ কিন্তু আপনি আবিষ্কার করবেন আপনার এই অনিশ্চিত একাকী জীবনে।
যাদের আপনি খুব ভাল বন্ধু ভাবতেন, দেখবেন, তাঁদের অনেকেই আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সবাই যে নিজের ইচ্ছায় তা করেছে, তা না। হয়তো অনেকেই তা করেছে অন্যকাউকে খুশি করতে। কিন্তু তাঁরা যে তা করছে, আপনি তা টের পাবেন।
এত গেল বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রকৃত বন্ধু নয়, সেটা চেনার পর্ব। আবার ভাল অভিজ্ঞতা পর্বও আছে।
দেখবেন, আউট অব নো হয়ার, এমন কেউ কেউও সামনে এসে যাবেন, আপনাকে সব রকমের সাহায্য করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করবেন এবং তা কোনো কিছুর বিনিময়ে না।
এঁরা যে শুধু আশ্বস্ত করবেন, তাই না, দেখবেন দরকারে এঁরা আসলেই আপনার জন্য ঝাপিয়েও পড়বেন।
অদ্ভুত এক গল্প শুনেছিলাম একজনের কাছ থেকে।
মধ্য বয়সে অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যখন তিনি একা হলেন, মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুত হয়ে গেলেন, বাকিটা জীবন ব্রহ্মচারী জীবন যাপনে।
হঠাৎ একদিন তিনি তাঁরই মত একাকী এমন এক সহকর্মির ফোন পেলেন, যার সাথে খুব একটা ব্যক্তিগত বা ইন্টিমেট আলাপ কখনো হয়নি।
সহকর্মি কোনো ভনিতা না করেই সরাসরি জানতে চাইলেন, “হাউ ইজ ইওর সেক্স লাইফ গোইং?” না সহকর্মি পুরুষ না, সমকামিও না।
এই জানতে চাওয়াটা তাই সহমর্মি হয়ে। আউট অব এমপ্যাথি।
জানা গেল, উনি একাকী হবার পর কারো কাছ থেকে এই সহমর্মিতা পেয়েছিলেন বলেই আজ তা রেসিপ্রোকেট করছেন।
প্রশ্ন পেয়ে সদ্য একা হওয়া ভদ্রমহিলা তো আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, “একা মানুষের আবার সেক্স লাইফ আসবে কোথা থেকে?”
উত্তর পেলেন, “আপা, আপনাকে ক’দিন ধরেই লক্ষ করছি। প্রতিদিনই আপনি একটু একটু বেশী মনমরা হয়ে যাচ্ছেন। আমি জানি, নিজেকে বঞ্চিত রাখার জন্য এটা হয়। আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না। একটু ধৈর্য্য ধরেন, আমি আপনাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবো। আর একা থাকলেই যে বঞ্চিত জীবন যাপন করতে হবে, এরকম কোনো কথা নাই। নারী ছাড়া পুরুষদের চলে না। স্বমেহনেও কোনো না কোনো নারীকে তাঁদের কল্পনায় দরকার হয়, কিন্তু আমরা নারীরা কোনো পুরুষ ছাড়াও, পুরুষের কল্পনা ছাড়াও শুধু নিজেকে ভালবেসে একটা যথেষ্ট ফুলফিলিং জীবন যাপন করতে পারি”।

নানা সময়ে আউট অব নো হয়ার এরকম অনেক অনেক বন্ধু দেখবেন আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে।
হ্যাঁ, কারো কারো হয়তো বদ মতলবও থাকবে, কিন্তু তাঁরা সবাই যে বদ মতলব নিয়ে আসবে, এমন না। এমন অনেককেই পাশে পাবেন, যারা কেবলই আপনার হিতাকাঙ্খি হিসাবে পাশে এসে দাঁড়াবে।
তবে একটা দল সম্পর্কে সবসময় সতর্ক থাকবেন, তাঁরা যদি আপনার খুব ঘনিষ্ট কেউ বা বন্ধুও হয়, তবুও।
তাঁরা হলো সেই দলভুক্ত, যারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, “কারো তো হয় না, তোর ডিভোর্সটা কেন হলোরে?” – যেন আপনিই এর জন্য দায়ি, আর অন্যরা সবাই ঠিক!!!
অথবা বলবে, “কি বলিস, তোর স্বামী মারতো? আহারে। আচ্ছা, কেন মারতো?” – যেন আপনি ঐ ঐ কাজ না করলে সে আর মারতো না। ঐ ঐ কাজ করে মার খাওয়ার দায় তাই আপনারই। মার দেয়ার জন্য তার যেন কোনোই দোষই নাই…

সারকথা হলো এই যে “একা হয়ে যাবেন অথবা কষ্ট পাবেন এই জন্য বিচ্ছিন্নতা আটকাতে যাবেন না। লোকে কি বলবে, অথবা কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে – এগুলো ভেবেও পিছ পা হবেন না। মনে রাখবেন, একটাই জীবন আপনার, অন্যের চোখে ভাল সেজে সেই জীবনটা কষ্টে না কাটিয়ে, অন্যের চোখে যা খুশি হয়েও তা একা একা শান্তিতে কাটানো ঢেঁড় ঢেঁড় ভাল………

৫,৪৩৯ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “ব্রেকআপ_ম্যানেজমেন্ট”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।