আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ১
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ২
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৩
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৪
নয়
এই পর্বে আত্মপ্রেমীদের জন্য সহানুভুতি জানিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছি।
এটাও লিখা দরকার, কারন, কেউ কিন্তু স্বেচ্ছায় আত্মপ্রেমী হয় না।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে হয় এবং একবার হয়ে গেলে অন্যের জন্য তো বটেই, নিজের জন্যেও তাঁরা নিদারুণ দুর্ভোগ টেনে আনেন।
তারা নিজেদের জন্য যে দুর্ভোগগুলো টেনে আনেন সেগুলোর প্রধান উৎস হলো নিজে জন্য একটা ডঃ জ্যাকল ও মিঃ হাইড টাইপের পরিস্থিতি তৈরী করা।
এটা ঘটে, কারন নিজেদের কিছু সামর্থের উপর ভিত্তি করে তাঁরা ক্রমে ক্রমে দৃঢ়চিত্ত, কখনো কখনো ঔদ্ধত্যপূর্নও, শক্ত-পোক্ত, কঠোরতায় পরিপূর্ন একটা ইমেজে নিজেদের উন্নিত করেন। আর এজন্য অন্যদের চোখে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকার একটা অভ্যাসও তাঁরা গড়ে তোলেন। আবার একই সাথে নিজের অন্যান্য দুর্বলতার কারনে নিজের এই অবস্থা ধরে রাখা নিয়ে একটা অনাস্থায় বা উৎকণ্ঠায়ও সারাক্ষণ ভোগেন।
দুইয়ের মিথোস্ক্রিয়ায় তাঁরা প্রকাশ্যে যত দৃঢ়ভাব বজায় রাখুন না কেন ভেতরে ভেতরে তাঁরা থাকেন খুবই ভঙ্গুর এক নাজুক অবস্থার মধ্যে।
দেখা যায়, দিনে যে আত্মপ্রেমী নারী বা পুরুষ জনারন্যে দাঁড়িয়ে সবাইকে দাবড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, রাতে গৃহকোনে সেই একই নারী বা পুরুষ একাকী বসে অবসাদ বা উৎকণ্ঠায় যন্ত্রণাক্লীষ্ট হয়ে বেদনার্ত-অশ্রু বিষর্জন করছে।
প্রশ্ন হলো, এ থেকে তাদের কি কোনো নিষ্কৃতি নাই?
হ্যাঁ আছে।
কাউন্সেলিং জাতিয় কিছু সাইকোথ্যারাপির কথা ডিএসএম-৫ এ উল্লেখ করা আছে যার সঠিক প্রয়োগ একজন আত্মপ্রেমীর কোয়ালিটি অব লিভিং অনেক উন্নত করে তাঁর জীবনকে অর্থপূর্ন ও অন্যের জন্য ঝুকিমুক্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু সেগুলো নিতে হলে তো আগে তাঁকে বুঝতে হবে যে তাঁর পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক নয় বরং নিরাময়যোগ্য।
আমিতো মনে করতে পারি না, আমার দেখা আশেপাশের এমন কোনো আত্মপ্রেমী আছেন যারা নিজেদের এই প্রকাশ্য দৃঢ় কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর পরিস্থিতিটাকে একটা স্বীকৃত সমস্যা বলে মেনে নেবেন।
তবুও আমার এই লেখালেখি প্রচেষ্টা, যদি কোনোদিন তাঁরা কেউ তা বুঝতে পারেন, সেইজন্যই………
দশ
“কেউ স্বেচ্ছায় আত্মপ্রেমী হয় না” – একথা বলে আত্মপ্রেমীদের প্রতি যত সহানুভুতিই দেখাই না কেন, এটাও ঠিক যে তাঁরা আনট্রিটেড থাকলে সে দায়টা পোহাতে হয় অন্য অনেককেই।
যাদেরকে তা পোহাতে হয় তাঁরা কিন্তু ঐ আত্মপ্রেমীর প্রিয়জনদেরই কেউ একজন। তিনি হতে পারেন প্রেমাষ্পদ বা জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী থেকে শুরু করে পিতা-মাতা-সন্তান জাতীয় রক্তসম্পর্কিয় যেকেউ।
এরা আত্মপ্রেমীর ক্রমাগত এবিউজের শিকার হয়ে যে পরিনতিতে গিয়ে পৌছান, সেই অবস্থার নাম হলো : নারসিসাস্টিক ভিক্টিম সিনড্রোম।
যেসব ভিক্টিম এতে আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে নীচে দেয়া অনেকগুলো লক্ষনই দেখা যায়:
– যন্ত্রণাদায়ক অতীত ও আচরনের স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া সম্পর্কিত জটিলতা।
– নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অতিরিক্ত আশঙ্কার মধ্যে থাকা।
– বাধ্যবাধকতায় আটকে চাপে থাকার একটা উচ্চমাত্রার অসহায় অনুভুতি হওয়া।
– কোনদিক থেকে পরবর্তি বিপদটি এগিয়ে আসছে, সেটা ভেবে ব্যতিব্যাস্ত থাকা।
– বিষন্নতা, বিরক্তিবোধ এবং অপরাধবোধে আক্রান্ত হওয়া।
– বহুবিধ শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত হওয়া।
– কখনো কখনো নিজেকে আহত করতে প্রবৃত্ত হওয়া।
– প্যানিক এটাক হওয়া।
– হঠাৎ হঠাৎ বাকরুদ্ধ হওয়া, শকে চলে যাওয়া।
– স্মৃতিশক্তি ও মনযোগ ব্যাহত হওয়া।
– মাঝেমাঝেই অস্থির হয়ে নিজেকে পাগল পাগল বোধকরা।
– নিদ্রাহীনতা ও দুঃস্বপ্নাক্রান্ত হওয়া।
– বিভিন্ন বাতিকগ্রস্ততা যেমন সুচিবায়ু, সন্দেহবাতিক, ইত্যাদি ও খাদ্যাভ্যাসের জটিলতায় আক্রান্ত হওয়া।
– অবদমিত ক্রোধের সৃষ্টি হওয়া, কারো প্রতি মনেমনে ক্ষোভ পুষে রাখা।
– মাঝেমাঝেই অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ ও সামাজিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।
– আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দেয়া।
– সারাক্ষণ নানা বিক্ষিপ্ত বিকল্প ভাবনায় ডুবে থাকা।
– সহজ সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাগ্রস্ততায় ভোগা।
আত্মপ্রেমীর করা এবিউজের থেকে তৈরী হওয়া নারসিসাস্টিক ভিক্টিম সিনড্রোম যখন জটিল হয়ে পড়ে, তা পরিনত হয় : Complex Post Traumatic Stress Disorder (C-PTSD)-এ।
C-PTSD আক্রান্তগন বাড়তি যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হন, তা হলো:
– তাদের মনেহয়, তাঁরা যখন তখন যেখানে সেখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পারেন,
– তাদের কাছে নিজেকে অন্যের জন্য অনোপযুক্ত বলে মনে হয়,
– নতুন করে কোনো সম্পর্ক বিনির্মানে তাঁরা আশঙ্কায় নিমজ্জিত হন,
– ছোটখাটো কাজগুলো করতে গিয়েও তাঁরা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন,
– যেকোনো কিছুতে মনোনিবেশ করার ব্যাপারে সারাক্ষণই মনগড়া নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হন।
সময় যতই গড়ায়, দেখা যায়, এই ভিক্টিমগন ততই নতুন নতুন সমস্যায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। যেগুলোর মধ্যে আছে: ক) ইটিং ডিজ-অর্ডার বা খাদ্যাভ্যাসে জটিলতা, খ) অবসেসিভ ডিজ-অর্ডার বা সূচিবায়ুগ্রস্ততা, গ) ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা, ঘ) হাইপার ভিজিল্যান্স বা সন্দেহ বাতিকগ্রস্ততা, এমনকি, ঙ) সাবস্ট্যান্স এবিউজ ও কো-ডিপেন্ডেন্স অর্থাৎ এক বা একাধিক আসক্তিতে জড়িয়ে পড়া, ইত্যাদি।
দেখা যাচ্ছে, আত্মপ্রেম ও এই সম্পর্কিত জটিলতা শুধু ব্যাক্তিটিকেই নয়, এক নিরব ঘাতক হিসাবে অবতির্ন হয়ে তাঁর উপর নির্ভরশীল অন্য অনেককেই শেষ করে দিতে থাকে।
এরপরেও কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো?
প্রতিরোধ বা নিরাময়ের কোনোই উদ্যোগ নেবো না?
(আপাততঃ শেষ……)
পুনশ্চ:
পাঠকের দু’টি প্রশ্ন ও তার উত্তর:
১) একজন আত্মপ্রেমীর সাথে কিরকম আচরন করা উচিৎ?
এই প্রশ্নের সরাসরি এর উত্তর না দিলেও পরোক্ষ উত্তর কিন্তু এই লেখায় আছে।
নিজে থেকে না চাইলে এরা যেহেতু ঠিক হয় না, তাই ভিক্টিমকে একটা চয়েস মেইক করতেই হয়। সেটা যে কি, আমি তো তা বলে দিতে পারবো না। আমি শুধু চয়েসটার পক্ষ বা বিপক্ষের সম্ভাব্য চিত্র দিতে পারবো। আর তাছাড়া ব্যাপারগুলা কেইস টু কেইস বেসিসে বিবেচিত হতে হবে। এর কোনো আমব্রেলা সলুশন কিন্তু নাই…
২) একজন আত্মপ্রেমীকে কিভাবে বোঝানো যাবে যে সে যা করছে তা ভুল। তাছাড়া, তাদের কর্মকান্ড যে অন্যান্যদের জন্য নির্যাতনের সামিল – সেটা বোঝানোর পদ্ধতিই বা কি? কিভাবে এদের কাউন্সেলিং-এর আওতায় আনা যায়?
এই প্রশ্নেরও কোনো আমব্রেলা সলুশন নাই। কেইস টু কেইস বেসিসে সলুশন ভাবতে হবে।
যেকোনো ভাবে তাঁকে তাঁর অবস্থাটা জানাতে হবে।
সমাধানে রাজি কিনা, তাঁর কাছ থেকে সেটাও জেনে নিতে হবে।
রাজী না হলে রিলেশন ডিসকন্টিনিউ করা ছাড়া কোনো সমাধান নাই।
মনে রাখতে হবে যে, জোড়াতালি দেয়া সমাধান কোনো সমাধান না।
:clap: :clap:
চুপিসারে তোমার সব ক'টি পর্বই এসে পড়ে গেছি, ভাইয়া। সব সময় জানান দিতে পারি নাই, ক্ষমা করো আমার আলস্যপরায়ণতাকে। যে কথাটি না বললেই নয়, বিষয় নির্বাচনে এবং বিষয় বৈচিত্র্যে তোমার মতো আর কেউ নাই সিসিবিতে। তোমার লেখালেখি চলতে থাকুক!
বেড়ানোতে ব্যাস্ত ছিলাম বলে বেশ ক'দিন সিসিবিতে ঢোকা হয় নাই।
একটা মন্তব্য এতদিন আনএটেন্ডেড থাকাটা ঠিক হয় নাই।
পড়েছো, জেনে খুব ভাল লাগলো।
এই লিখাগুলোতে তথ্য ব্যবহারে সঠিকতা নিয়ে সতর্ক ছিলাম।
এগুলো যদি কারো কোনো কাজে লাগে, সেটাই হবে সার্থকতা।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্য করে উৎসাহ দিয়ে কত কত কথা লিখবার জন্য।
ভালো থেকো। 🙂 🙂 🙂
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আপনার লেখাটি বেশ কয়েকবার পড়েছি। আমি একজন আত্মপ্রেমীর এবিউজের শিকার। বলতে পারেন ভিক্টিম। যখন সমস্যাগুলোর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখনই আপনার লেখাটি খুঁজে পাই এবং শতভাগ মিল পেয়েছি।