আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ১
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ২
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেম সম্পর্কিত জটিলতা – ৩
আট (ক)
আমি এখন এই লেখাটার জটিলতম অংশে আছি।
এতক্ষন যা যা লিখেছি, তা ছিল মূলতঃ আত্মপ্রেমীদের নিয়ে।
যারা আত্মপ্রেমী নন, তাঁরা তাতে নিজেকে সরাসরি খুব একটা খুজে পান নাই।
এবার অনেকেই তা পাবেন।
এবার বলবো তাদের কথা, যারা আত্মপ্রেমী নন কিন্তু তাদের সঙ্গিরা আত্মপ্রেমী।
কি হয় এরকম সম্পর্কে? কি তাঁর পরিনতি?
যারা আত্মপ্রেমী নন, তাদের একটা কিতাবি পরিচয় আছে।
এদের বলে এমপ্যাথ যার বাঙ্গলা হওয়া উচিৎ ছিল “সমব্যাথি”। কিন্তু আমার মনেহয়, এমপ্যাথ দিয়ে যা বুঝানো হয়, আমরা বাংলায় সমব্যাথি বলতে ঠিক পুরোপুরি তা বুঝি না।
তাই আমি ঠিক করেছি, এমপ্যাথ ও সমব্যাথি দুইটা শব্দই দরকার মত ব্যবহার করবো যারা আত্মপ্রেমি নন, তাদেরকে বুঝাতে।
আত্মপ্রেমীদের যেমন মাত্রা আছে, এমপ্যাথদেরও কিন্তু মাত্রা আছে। একজন এমপ্যাথ হতে পারেন উচ্চ, মধ্যম বা নিম্ন মাত্রার। মাত্রানুযায়ি তাদের প্রতিক্রিয়ায় যে ভিন্নতা দেখা যায়, এটা মনে রাখাটা জরুরী।
এটুকু বলে আজকের আলোচনা শুরু করি: “একজন উচ্চমাত্রার এমপ্যাথের সাথে একজন উচ্চমাত্রার আত্মপ্রেমীর সম্পর্ক দ্রুতই একটি টক্সিক রিলেশনে পরিনত হতে বাধ্য”।
কারনগুলো পরে ব্যাখ্যা করছি।
এমপ্যাথির মাত্রা এবং আত্মপ্রেমের মাত্রার ভিন্নতার কারনে সম্পর্কে বিষময়তা ঢুকতে ধীরতা বা দ্রুততা ঘটতে পারে কিন্তু সাধারনভাবে দেখা যায়, একটা সময় এধরনের সব সম্পর্কই টক্সিক বা বিষময় সম্পর্কে রূপ নেয়…
আট (খ)
সমব্যাথিদের হৃদয় থাকে উন্মুক্ত কিন্তু আত্মপ্রেমীরা বসবাস করে এক বদ্ধ হৃদয় নিয়ে।
তাই আত্মপ্রেমিদের সব উদ্দেশ্যই থাকে কেবলই পাবার কিন্তু বিনিময়ে যথাসাধ্য কিছুই না দেবার।
সমব্যাথিরা সবকিছু উজার করে দিতে পারে। বিনিময়ে কিছু চায় না তবে যখন কোনো প্রতিদান আসে, তাদের দেয়াটা আরও উৎসাহিত হয়।
আর এই দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে।
কিন্তু শুধুই একতরফা গিভিং নির্ভর যে সম্পর্ক, একসময় সেটায় ভাটা পড়া শুরু করে।
আত্মপ্রেমীরা কি কিছুই দেয় না? তা যদি হবে, সম্পর্কের শুরুটা তাহলে একতরফাভাবে হচ্ছে কি করে?
গুড কোয়েশ্চেন!
সম্পর্কের শুরুতে আত্মপ্রেমীরা প্রশ্রয় বা সম্মতি হলেও কিছু একটা তো অবশ্যই দেয়, কিন্তু সমস্যা হলো, তাঁরা যা দেয় তা সম্পর্কটাকে গভীরতা দেয়ার উদ্দেশ্য থেকে দেয় না।
তাদের উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে প্রশান্তি দেয়া নিজের দেয়ার ক্ষমতা উপভোগ করা।
তাই একবার কিছু দিলে তা নিয়ে তাঁরা একটা আত্মতৃপ্তির অবস্থানে পৌছে যায় এবং গিয়ে ভাবে, “অনেক তো হলো, আর কি?”
অথচ সমব্যাথিদের দেয়াটা হলো নতুন নতুন দেয়া-নেয়ার উপলক্ষ তৈরীর জন্য।
তাই আজ সে যা দিচ্ছি, কালকের জন্য তাঁর পরিকল্পনা থাকে আরও বড় কিছু করার। আরও বড় কিছু দেবার।
আর আত্মপ্রেমীর ঘটনা হয় উল্টো।
আজ সে যা দেয়, সাথে সাথে এই প্রস্তুতিও সে নেয় যে কাল থেকে সে আর কিছু দেবে না।
এই মিসম্যাচগুলিই সমব্যাথি-আত্মপ্রেমীর মধ্যে থাকা সম্পর্কটাকে ভারসাম্যহীন করে দেয়।
আগামী পর্বে কিছু উদাহরণ দেয়ার ইচ্ছা রইলো…
আট (গ)
ধরা যাক ক একজন আত্মপ্রেমী নারী বা পুরুষ।
ক নিশ্চিত যে, সে লাভ মেকিং-এর সময় এমন একটা মুভ জানে যা সে তাঁর পার্টনারের উপর প্রয়োগ করলে পার্টনারটি পুলকে “কাঁটা মুরগির মত ছটফট” করবে।
ক যখন পার্টনারের উপরে এটা প্রয়োগ করবে, দেখা যাবে তাঁর সম্পুর্ন মনোযোগ সে দিচ্ছে, “কাঁটা মুরগির মত ছটফট” করার ঐ কাঙ্খিত দৃশ্যটি দেখতে। তাঁর পার্টনার কতটা উপভোগ করছে, আদৌ করছে কিনা, এসব দেখা অথবা এসব দেখে সেই অনুযায়ী নিজের পারফরমেন্স এডজাস্টের কোনো প্রয়াস তাঁর কাছে নিতান্তই গৌন।
এতে করে ফলাফল যেটা হয়, তা হলো, তাঁর লক্ষ অর্জনের পর এই পুরো ব্যাপারটা তাঁর কাছে হয়ে পড়ে ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে একটা এক্সাসাইজ। দেখা যায় ঐ পার্টনার চাইলেও সেটার পুনরাবৃত্তিতে তখন তাঁর আর কোনো আগ্রহ থাকে না।
আত্মপ্রেমীরা কোনো এডভেঞ্চারাস কিছু যে করে না, তা না, কিন্তু দেখা যায় সেগুলার থেকে আনন্দ বের করে আনার চেয়ে তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের সামর্থের প্রদর্শনিটি।
এমপ্যাথদের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটে একেবারেই উল্টো।
তাঁরা যা খুব ভাল পারে, সেটাকে পার্টনারের চাহিদানুযায়ি এডজাস্ট করা ও সেই অনুযায়ী ক্রমে ক্রমে আরও উপভোগ্য করার কত কত পদ্ধতি বের করা যায়, সেটার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা করে যেতে থাকে। আর এই কারনে কখনোই তাদের মধ্যে এক্সপেরিমেন্টেশনে কোনো ক্লান্তি আসে না।
আত্নপ্রেমীদের মধ্যে আরেকটা সেলফিস আচরন লক্ষ্য করা যায়।
তাঁরা নিজের চাহিদা পুরোনে এতই মনোযোগী থাকে যে পার্টনারের তাতে সম্মতি আছে কিনা, পার্টনার তা থেকে উপভোগ্য কিছু পাচ্ছে কিনা, সেটা তাদের জন্য গৌণ হয়ে পড়ে। আর দিন দিন এইভাবে পার্টনারের উদারতার অপব্যবহার একসময়ে পার্টনারের জন্য বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়।
আত্মপ্রেমী-সমব্যাথি সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, সমব্যাথি আত্মপ্রেমীকে তার অবস্থান থেকে এতটুকু সরাতে পারে না। কিন্তু আত্মপ্রেমীর ধারাবাহিক স্বার্থপরতা সমব্যাথিকে দিনে দিনে আত্মপ্রেমে উদবুদ্ধ করতে থাকে।
একসময় সেও আত্মপ্রেমের কুফল অর্থাৎ কারো সান্নিধ্যই আর উপভোগ না করার শিকার হয়ে পড়তে থাকে……
আট (ঘ)
আত্মপ্রেমী-সমব্যাথি সম্পর্কের উপর লিখা পর্বটার এইবার ইতি টানবো।
একটু বড় হয়ে গেল কারন এতে এফেক্টেড মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি বলেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললাম কথাগুলো।
অন্য এক দৃষ্টিকোন থেকেও আত্মপ্রেমী-সমব্যাথি সম্পর্কটা ভিন্ন ধরনের।
দুই আত্মপ্রেমীর সম্পর্কে যে দ্বন্দ্ব, সেখান তাঁরা দুজনেই একসময় বোঝে সেটার সোর্স বা উৎস কি। কারন, সেখানে উপেক্ষার বিনিময়ে উপেক্ষা চলে। আবার উভয়েই উভয়কে আঘাত দিচ্ছে – এটা ভেবে, কষ্টের মধ্যেও তাদের একটা সান্ত্বনা পাবার সুযোগ থাকে। কিন্তু আত্মপ্রেমী-সমব্যাথি সম্পর্কে কোনো রিটালিয়েশন ছাড়াই সব কষ্ট ঘুরে ফিরে আসে সমব্যাথির গায়ে । আর আত্মপ্রেমীর জন্য তা তৈরী করে পুলকিত হবার বাড়তি উপলক্ষ।
আত্মপ্রেমী-আত্মপ্রেমী সম্পর্কে খেয়াখেয়ি থাকলেও সেটার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে। কিন্তু আত্মপ্রেমী-সমব্যাথির সম্পর্কে খেয়াখেয়িটা একতরফা ভাবে পুরো চেপে বসে একজনের উপরেই।
এরকম একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়াটা তাই কেবলই হয়ে দাঁড়ায় সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তা বয়ে বেড়াতে হলে তা হয়ে পড়ে নিদারুণ কষ্টের, যন্ত্রণার।
এই পর্যায়ে যা ঘটে তা হলো আত্মপ্রেমীকৃত এবিউজ। আর যার উপর এটা ঘটে, সে পরিনত হয় আত্মপ্রেমীকৃত এবিউজের শিকারে যাকে Narcissistic Abuse Victim বলে।
দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অবস্থার শিকার যারা হয়, তাঁরা নিজেরা আত্মপ্রেমী নন, বরং তাঁরা একজন আত্মপ্রেমী দ্বারা এবিউজের শিকার একজন এমপ্যাথ বা সমব্যাথি মানুষ……
(চলবে………)
পুনশ্চ:
Narcissistic Abuse Victim-দের আরও কিছু পরিচয় আছে। সেগুলো হলো:
– Narcissistic Victim Syndrome (NVS),
– Trauma-Associated Narcissistic Symptoms (TANS), or
– Post Traumatic Narcissism Syndrome (PTNS) ইত্যাদি।
পরের কোনো এক পর্বে এদের সিম্পটমগুলো নিয়ে আলাপ করার ইচ্ছা রইলো…
“একজন উচ্চমাত্রার এমপ্যাথের সাথে একজন উচ্চমাত্রার আত্মপ্রেমীর সম্পর্ক দ্রুতই একটি টক্সিক রিলেশনে পরিনত হতে বাধ্য”।- অসাধারণ পর্যবেক্ষণ!