প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (প্রথম পর্ব)
প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (তৃতীয় পর্ব)
এগারো
ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা ঘটে দুই পর্বে:
১) প্রেমাষ্পদকে ভালবাসা (Loving) এবং
২) প্রেমাষ্পদের ভালবাসার বস্তু হয়ে ওঠা (Being Loved)।
আমরা সাধারনতঃ আশাকরি বা ধরে নেই যে, এই দুটোই যুগপৎ ভাবে ঘটবে বা ঘটে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ঘটেও হয়তো কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঘটে না।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি ভালবাসাবাসির শুরু হয় একজনের ভালবাসা প্রদানের মধ্য দিয়ে এবং তখনও অন্যজনের ভালবাসাটা শুরু হয় নাই, কিন্তু তিনি ভালবাসা পেতে শুরু করেছেন।
এই অবস্থায় তিনি যে ভালবাসতেও পারেন আবার নাও বাসতে পারেন, এটা আমরা অনেকসময়ই ভুলে যাই। এবং তিনি ভালবাসাবাসিতে কনসেন্ট দিয়েছেন, এটা দেখেই ধরে নেই যে তিনিও ভালবাসছেন।
সমস্যা হলো, শুধু এই কনসেন্ট দেয়াটা ভালবাসাবাসিতে পূর্ন অংশগ্রহন বুঝায় না।
এমন অনেকেই আছেন, যারা নিজেরা ভালবাসা পাচ্ছেন শুধু এই কারনেই ভাল না বেসেও একটা ভালবাসাবাসির সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারেন। আর তা পারেন ভালবাসা দেয়ার ভান করে, সত্যিকারের ভালবাসা না দিয়েও।
এরা স্বার্থপরের মত ভালবাসা পাবার আনন্দ পেয়ে খুশি হতে পারেন কিন্তু প্রেমাষ্পদকে ভালবাসা দেয়ার যে আনন্দ, তা থেকে বঞ্চিত হন।
এরা সাময়িক বিজয়ের আস্বাদ পেতে পারেন কিন্তু একদিন তাদের জীবনটা হয়ে পরে নিতান্তই এক্টিভিটিহীন তথা নিরান্দময়।
আবার যারা ভালবাসা দিয়েই গেলেন কিন্তু জীবনেও তা পেলেন না, একদিন তারাও হয়ে উঠতে পারেন বিরক্ত থেকে বিদ্রোহী পর্যন্ত যেকোনো কিছু।
তবে সেসব ক্ষেত্র বড়ই মধুময় যেখানে ভালবাসার আহ্ববানে সাড়া দিয়ে প্রেমাষ্পদও ভালবাসার আদান-প্রদান উভয়ই করেন।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয় তখন, যখন কেউ ভালবাসার অভিনয় করে প্রতিপক্ষের ভালবাসা অর্জন করে। এরপর সেটা অর্জন হয়ে গেলে সেটার পুর্ন সদ্ব্যবহার করতে থাকে কিন্তু নিজে ভালবাসে না অথবা নিজের ভালবাসাটা আর প্রকাশ করে না।
এই জাতীয় সম্পর্কগুলা পদে পদে নানা বিভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে এগুতে ও হোঁচট খেতে থাকে।
নিজে ভালবাসতে না পারলে অন্য কোনো অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে কারো ভালবাসার আহ্ববানে সাড়া দেয়ার আগে ভাবুন। এতে তাৎক্ষনিক বেনিফিট পাবেন ঠিকই কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা উভয়ের জন্যেই ক্ষতি ডেকে আনবে। সেখানে আপনার ক্ষতি কিন্তু বেশিও হতে পারে……
শুধু ভালবাসা পাওয়াটাই একমাত্র সুখ নয়, মনে রাখবেন, ভালবাসা দেয়াটাও অনেক আনন্দময়!!!
বারো
প্রেম ও যৌনতা একে অপরকে ধারন করতে পারে। একে অপরকে পরিপুর্নও করে।
তবে সেই ধারন করা বা পরিপুর্ন করার আবার প্রকারভেদও আছে।
মনে রাখা জরুরী যে প্রেমবিহীন যৌনতায় যেমন মন ভরে না, তেমনি যৌনতাবিহীন প্রেমও কিন্তু জমে ওঠে না।
যখন কারো প্রতি প্রেম জন্মে, তাঁর প্রতি যৌনাকাঙ্খাও জাগে। এবং, সেই যৌনতা তখন পরিনত হয় প্রেম আদান-প্রদানের এমন একটি দৌহিক মাধ্যমে যা অনেকটা ভাষার মত। প্রেমিক প্রেমিকা এই দেহজ ভাষা ব্যবহার করে একে অন্যকে তাদের প্রেমের গভীরতা জানান দেবার সুযোগ পায়।
আবার অন্যদিকে, কারো জন্য দেহজ আকর্ষণ বোধ করলে তাঁর জন্যেও প্রেম জাগে। কিন্তু সেই প্রেমটা কিন্তু ঐ রকমের কোনো ভাষা না। সেটা বরং পরিনত হয় উভয়ের কাছে যৌনতাকে সহজ ও গ্রহনযোগ্য করার উপকরনে।
যে প্রেম যৌনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে পুর্নতা পায়, যৌনসম্পর্কের অনুপস্থিতেও তা একেবারে মরে যায় না। কিছু না কিছু, কোথাও না কোথাও থেকেই যায়।
কিন্তু যে যৌনাকাঙ্খা প্রেমকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্নতা পায়, যৌনতার অনুপস্থিতিতো দুরের কথা, সামান্য অনিশ্চয়তায়ও তা ঝুলে পড়ে, হারিয়ে যায়, অথবা বিকল্পের সন্ধান করে।
দেহজ আকর্ষন (প্যাশন) দিয়ে যে প্রেমের সুচনা এবং তা থেকে যে সম্পর্কের উত্তরণ সেটা দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখাটা তাই বেশ কঠিন। উভয়পক্ষকেই প্রতিনিয়ত কন্ট্রিবিউট করে যেতে হয় তা উত্তপ্ত রাখার জন্য।
কিন্তু যে প্রেমের সুচনা পরিচিতি ও ঘনিষ্টতার (ইন্টিমেসি) ধাপ অতিক্রম করে দেহজ আকর্ষনে এসে পৌছে সেটার মধ্যে একধরনের বিল্ট-ইন উত্তাপ নিজে থেকেই জন্ম নেয়। সেটাকে উত্তপ্ত রাখতে তাই সারাক্ষনই খুববেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না।
সারকথা হলো এই যে, একটি সম্পর্কে লাভ ও সেক্স উভয়ের উপস্থিতি থাকলেই যে সেই সম্পর্কটা দীর্ঘমেয়াদে উপভোগ্য হবে, এমন না। সম্পর্কটিতে লাভের জন্য সেক্স নাকি সেক্সের জন্য লাভ – সেটা চিহ্নিত করা জরুরী। “সেক্সকে উপভোগ্য করতে প্রেমের ব্যবহার” এর চেয়ে “প্রেমকে দৃঢ় করতে সেক্সের ব্যবহার” দীর্ঘমেয়াদে বেশি শক্তিশালি এবং বেশি নির্ভরযোগ্য……
তেরো
আজ লিখবো ব্রেক আপ নিয়ে।
প্রশ্ন হলো, প্রেম সম্পর্কিত সিরিজে ব্রেক আপ নিয়ে লিখা কেন?
কারন, ম্যাথেমেটিকালি ব্রেক আপ জিনিষটা প্রেমের কাছাকাছি রকমের গুরুত্বপুর্ন।
একজন ব্যাক্তির প্রেমের সংখ্যা যদি n হয়, তাহলে তাঁর ব্রেক-আপের সংখ্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলো (n-1)
এত বড় গুরুত্বপুর্ন একটি ব্যাপার অজ্ঞতা বা অবহেলার কারনে মিস হ্যান্ডেল্ড হলে তা সব পক্ষের পরবর্তি সম্পর্কগুলির জন্যই অভিশাপ ডেকে আনতে পারে।
সে এক সময় ছিল যখন আমার এক বন্ধুর সাথে ব্রেক-আপ নামক বিষয়টা নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ হতো। আমি বলতাম, “প্রতিটা সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যেই ব্রেক-আপের একটা বীজ রোপিত থাকে। সম্পর্কে থাকা মানুষগুলোকে একদিকে যেমন সেটা এড়িয়ে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হয়, অন্যদিকে সেটা এসে গেলে কিভাবে তা সহনিয় ও শান্তিপুর্ন ভাবে ট্যাকেল করা যাবে সেই প্রস্তুতি রাখতে হয়।
তাঁর কথা ছিল, “সম্পর্কে তো জড়াচ্ছি সেটা ভাঙ্গার জন্য না। তাহলে এত কিছু ভাববো কেন? যদি ভাঙ্গে, তখন দেখা যাবে। আর তা হবে ‘টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার’ – এই তত্ত্ব মেনে”।
দেখা যেত, বন্ধুটি মাঝে মধ্যেই তুমুল সব রূপকথার মত সম্পর্কে জড়াতো আবার হঠাত করেই তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেত। আবার তা নিয়ে দুই পক্ষে চলতো দীর্ঘ কাইজা-দাঙ্গা, কাঁদা ছোড়াছুড়ি।
আমি ভাবতাম, এসব না হলেই কি নয়?
আমাদের দেশে একটা ভ্রান্ত ধারনা আছে যে সম্পর্ক ভাঙ্গাটা হলো শেষ অপশন। ভাঙ্গা মানেই সেটা রাখার উপযুক্ত ছিল না। আসলেই কি তাই?
আরেকটা ভ্রান্ত ধারনা হলো, যিনি সম্পর্কটা ভাঙ্গার প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনি সবার চোখে হয়ে পড়েন মস্তো ভিলেন।
শুধু খারাপ কিছু হচ্ছে, এজন্যই যে সম্পর্ক ভাঙ্গতে হবে – এমন কিন্তু না।
একটি সম্পর্ক যখন একপক্ষের কাছে এমন বলে মনেহয় যে তা থেকে সে তার এক্সপেকটেশন পুরনের সম্ভবনা দেখছে না, আমার মনেহয় তাঁর অধিকার জন্মে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যাবার।
শুধু বেরিয়ে যাবারই না, কোনো রকমের ভিলেনিয়াস ব্যক্তি হিসাবে জাজড না হয়েই তিনি এই সম্পর্ক ভাঙ্গার কথাটা প্রকাশ করার অধিকারও অর্জন করেন।
এই যদি অবস্থা হয়, তাঁকে ভিলেন বানানো বা সম্পর্ক রক্ষায় চাপাচাপি করাটাই তো বরং মানবাধিকারের লক্ষন, তাই না?
সম্পর্ক ভাঙ্গার ব্যাপারে শান্তিপুর্ন আচরন, ব্যাপারটাকে পার্সোনালি না নেয়া, উভয়পক্ষের পুর্ন সহযোগিতা ও কমুনিকেশন খোলা রাখা এই সম্পর্ক টারমিনেশনই শুধু ফ্যাসিলিটেট করে না, ভবিষ্যত সম্পর্ক গুলিরও ঝুঁকি কমায়। এদের সাথে ভবিষ্যতে যারা সম্পর্কে জড়াবেন, তাঁরা একদিকে জানবে, ইনি কত লজিকাল – তাই তাঁরা অযৌক্তিক কিছু যথাসাধ্য করবেনই না। আবার এটাও বুঝবেন, সেরকম কিছু করলে ইনি কত সহজেই তা থেকে বিযুক্ত হন। সুতরাং এরমধ্য দিয়ে অযৌক্তিক কিছু করার সম্ভবনাও কমে যাবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সম্পর্ক ভঙ্গের প্রস্তাব পাওয়া পক্ষটির বিচ্ছেদের ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতি থাকে না। আমার মনেহয় প্রস্তাবকারীর এইক্ষেত্রে দায় থাকে এটা সহনিয় করার জন্য নিজ থেকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার। ধরা না ধরা, প্রতিপক্ষের ব্যাপার। আর এইটা করার সহজতম উপায় হলো এটা এক্সপ্লেইন করা যে কেন অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের চেয়ে স্বাস্থ্যকর বিচ্ছেদ উত্তম।
কারন কে না বোঝে, যেনতেন ভাবে জুড়ে থাকার চেয়ে নতুন করে শুরু করাটা ভাল।
কিন্তু এই সহনিয় করার কোনো চেষ্টা না করে যদি প্রস্তাবকারিই উল্টো হস্টাইলিটি শুরু করে: দুর্ব্যবহার, কটূক্তি, কানকথা, ব্লক তথা কমুনিকেশন কাট করা ইত্যাদির মাধ্যমে – এবং তা এই আশায় যে প্রতিপক্ষ তড়িৎ বিচ্ছেদে বাধ্য হবে, সেটার পরিনতু ভাল হবার কথা ন। প্রতিপক্ষ তড়িৎ বিচ্ছেদে বাধ্য হয়তো হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের যে ক্ষতিটা উভয়পক্ষেই থেকে যাবে সেটা আর কখনোই নিরাময় করা যাবে না।
সম্পর্ক ব্যাপারটিকে সহজ ভাবে নিয়ে সেটা উপভোগ্য করার চেষ্টাই তাঁকে স্থায়িত্ব দিতে পারে। কিন্তু সেটা রাখায় জোরাজুরি করাটা সেটা ভাঙ্গার জোরাজুরি থেকে কোনো অংশেই কম গর্হিত কাজ না………