প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (তৃতীয় পর্ব)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (প্রথম পর্ব)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (দ্বিতীয় পর্ব)

আট
ভেবে দেখলাম, প্রেমের সাথে বিবাহের কোনো কনফ্লিক্ট নাই।
কারন, প্রেম করলেই যে বিয়ে করতে হবে, এমন কোনো কথা যেমন নাই, ঠিক তেমনি, বিয়ে করলেই যে প্রেম করা লাগবে, সে রকমের কোনো কথাও কিন্তু নাই।
মনে রাখতে হবে, বিবাহ একটি সামাজিক ও আইনি পরিচয়।
প্রেম একটি মানসিক অবস্থা।
যদিও এই দুইটার যুগপৎ উপস্থিতি সম্ভব ও কাম্য কিন্তু তা যে হতেই হবে, তা কিন্তু না।
হলে ভাল। খুবই ভাল। কিন্তু না হলেও সেটা মন্দের ভাল।
কিন্তু খারাপ নয়। কেন, তা বলছি…

বিবাহিত যুগল যদি নিজেদেরকে প্রেমিক-প্রেমিকা রূপে আবিষ্কার করেন, তখন তাদের পরিচয় হয়: (স্বামী + প্রেমিক) এবং (স্ত্রী + প্রেমিকা) হিসাবে।
এটা হওয়া খুবই ভাল।
কিন্তু তাঁরা যদি আবিষ্কার করেন যে তাদের মধ্যে প্রেম নাই, তখন তাদের মধ্যে যে শুন্যতাই থাকুক, তারপরেও তাদের একটা পরিচয় থাকে কেবলই স্বামী ও স্ত্রী হিসাবে।
এটা ভাল না হলেও মন্দ যে নয় তা বোঝা যায় অন্য বিকল্প কি হতে পারে, সেটা বিবেচনায় নিলে।
একটি দম্পতির সম্পর্কে শুধু ভালবাসা আছে কি নাই, এতেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
এর বাইরেও দুজনের মধ্যে পরষ্পরের প্রতি: ঈর্ষা, ক্ষোভ, লোভ, সন্দেহ, ঘৃনা, হিংসা, উপেক্ষা, অবহেলা, দখলদারিত্ব, ইত্যাদি আরও অনেক কিছুও থাকতে পারে।
সে সবের কোনো কোনোটা যখন থাকে, তখন তাঁরা কেবলি স্বামী-স্ত্রী থাকেন না, এর পাশাপাশি শাসক-শোসিত রূপেও আবির্ভুত হন।
যদিও নারীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শোসিতের ভূমিকায় থাকেন কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষদেরও শোসিতের ভূমিকায় দেখা যায়।

আমাদের মেনে নেয়া উচিৎ যে বিবাহ পরবর্তিকালে দম্পতির মধ্যে নীচের তিন ধরনের অবস্থার যে কোনোটি পাওয়া যেতে পারে।
আসলে কোনটা আছে, সেটা জেনে বুঝেই আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বা না রাখার পক্ষাবলম্বন করা উচিৎ।
১) অপশন-১ (স্বামী + প্রেমিক) এবং (স্ত্রী + প্রেমিকা) : খুব ভাল!! ওয়াও!!!
২) অপশন-২ (কেবল স্বামী) এবং (কেবল স্ত্রী) : মন্দের ভাল। কন্টিনিউ করবে কি করবে না, সেটা তাদের ডিসক্রিশন। অন্যদের রোল হবে নন ইন্টারফেয়ারিং। শুধু জানিয়ে রাখা যায় যে সামাজিক পরিচিতির বিনিময়ে তাঁকে বা তাদেরকে প্রেমহীন জীবন যাপন করে যেতে হবে।
৩) অপশন-৩ (স্বামী + শাসক বা শোসিত) এবং (স্ত্রী + শোসিত বা শাসক) : এইটা খুবই ইন্সট্যাবল অবস্থা। কেউ এই অবস্থা টেনে চলতে চাইলে তাঁকে ঝুকিগুলা বুঝিয়ে বলা ও সতর্ক করা উচিৎ। আর কেউ এ থেকে বেরুতে চাইলে তাঁকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করা উচিৎ। বুঝতে হবে যে, জোর করে তাদের একসাথে থাকতে বাধ্য করা হলে অবস্থার উত্তরোত্তর অবনতি ঘটবে। আর এ থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাঁর দায় তখন উৎসাহ দানকারী সকলের উপরেই বর্তাবে।
**********

নয়
এমন এক দিন ছিল, যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমন ছিল যেখানে কোনো কারনে সর্বশান্ত হয়ে পড়া মানুষগুলোর টিকে থাকার উপায় ছিল ক্রীতদাস প্রথা মেনে নেয়া।
তাই ক্রীতদাস প্রথা তখন মানবাধীকারের পরিপন্থী ছিল না।
সেই রকম সময়ে যুদ্ধবন্দিদের সাথে খেয়াল খুশি মত আচরনও হয়তো সেসময়কার স্ট্যান্ডার্ডে গ্রহনযোগ্য আচরনই ছিল।
দিন বদলেছে। শুধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোই নয়, অপরিবর্তনিয় ভাবে বদলে গেছে রাজনৈতিক কাঠামোও। এখন তাই, ক্রীতদাস প্রথা টিকিয়ে রাখা ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে যথেচ্ছা আচরন কেবলই অপ্রাসঙ্গিক নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।

এমন একটা দিন ছিল, যখন বিভিন্ন সমাজে নারীদের এমনভাবে অবরুদ্ধ রাখা হতো যে বয়ঃপ্রাপ্তির পর দীর্ঘ্যদিন পুরুষদের জন্য বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া আর কোনো নারীর সাথে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ থাকতো না। নারীদেরও ছিল একই অবস্থা।
আর সঙ্গত কারনেই, সেই স্ত্রী বা স্বামীটিকেও বেছে নেয়ার কোনো সূযোগ থাকতো না কারোই। পারিবারিক সিদ্ধান্তে যার জন্য যে নারীকে স্ত্রী হিসাবে বরাদ্দ করা হতো, তাকেই জীবন সঙ্গিনি হিসাবে মেনে নেয়াটা পুরুষদের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক।
নারীর জন্য তো তা ছিল আরও বাধ্যতামূলক।
ভিন্ন কোনো অপশন খুব একটা কারো থাকতো না।
সেই সময়ে এরেঞ্জড ম্যারেজের সাফল্যের হার উচ্চ থাকার পিছনে সেই সময়কার সেই সোশাল অর্ডারের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
ঐ সোশাল অর্ডারটা এখন আর নাই।
এমন ভাবে তা ভেঙ্গে গেছে, যা আর গড়ে তোলা সম্ভব না।
দিনে দিনে তা আরও বেশি ভাঙ্গবে।
এটা যত বেশি ভাঙ্গবে, এরেঞ্জড ম্যারেজ তত বেশি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
একটা সময়ে ইতিহাসবিদগন হয়তো লিখবেন, “সে এক দিন ছিল, যখন এরেঞ্জড ম্যারেজ নামে একটি অমানবিক প্রথা এই ভুখন্ডে প্রচলিত ছিল। বর্তমান সময়ের বিচারে তা মানবাধিকারের পরিপন্থি একটি আচরন………”

এরেঞ্জড ম্যারেজ হলো সেই ব্যবস্থা, যেখানে সঙ্গি পছন্দে পাত্র-পাত্রীর ভুমিকা থাকে নগন্য। সম্পর্কের সাকসেস সেখানে একটা র‍্যান্ডম ইভেন্ট। আবার সেটার কৃতিত্ব দাবী করেন অভিভাবকগন। কিন্তু সেটার ফেইলিওরের পুর্ন দায় পড়ে নিজেদের ওপর অর্থাৎ প্রায় অচেনা যুগলটির ওপর।
দুজন প্রায় অপরিচিত নর-নারীকে একটি ঘরে বন্দি করে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সুখি হবার জন্য এই চাপ দেয়াটাকে যদি মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলা হয়, সেটা কি কোনো অত্যুক্তি বলে গন্য হবে???
************

দশ
সম্পর্কে স্ট্যাবিলিটির জন্য ব্যালান্সটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ, এমনকি একটি পক্ষ যদি প্রকাশ্যে বলেও, “না, আমার কিছুই চাই না”, তখনও।
সম্পর্ক মানেই হলো, সেখানে কমপক্ষে দুটো পক্ষ থাকবে।
আর এই পক্ষ দুটোর মধ্যে নানা “কিছু” আদান-প্রদান চলবে, চলতে থাকবে।
“জিনিষ” না বলে “কিছু” বললাম, কারন, এগুলো শুধু “ক্যাশ বা কাইন্ড”-ই নয়, হতে পারে পারে “নৈর্ব্যক্তিক কোনো কিছু”-ও।
এই যেমন: আস্থা, আশ্বাস, আগ্রহ, কেয়ার, উদ্যাম, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সময়, ইত্যাদি……
উমম, সময় না। ওটা তো আবার কাইন্ডও।

মোট কথা দু’জনের মধ্য একটা আদান-প্রদানের ব্যাপার থাকতেই হয় যেটা দুইপক্ষকেই অবজেক্টিভ ভাবে যে দিতে হবে, এমন না। একজন অবজেক্টিক আর অন্যজন সাবজেক্টিভ ভাবে দিলেও চলবে। কিন্তু যখন এই আদান-প্রদানটি আর থাকবে না, সম্পর্কটা অচীরেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
পড়বে, কারন তা হয়ে যাবে ইনস্ট্যাবল। আর প্রকৃতি ইনস্ট্যাবিলিটি অনুমোদন করে না।
সম্পর্কে ব্যালান্স থাকলে তা উভয়ের জন্যই হয় বন্ধুত্বপূর্ণ ও পার্টিসিপেটিভ। কিন্তু যে সম্পর্কে ব্যালান্স থাকে না তা থেকে তখন প্রথমেই বন্ধুত্ব পালায়। আর তাই তা হয়ে পড়ে, হয়:
– বাবু বনাম রক্ষিতার সম্পর্ক, না হয়তো,
– রাণী বনাম হাবসীর সম্পর্ক।

আর কে না জানে যে এই সম্পর্কগুলা একদিকে হেলে থাকতে থাকতে একসময় তাদের যাবতিয় উত্তাপ হারিয়ে ফেলে। তখন তা ঝেড়ে ফেলাই হয়ে পড়ে প্রায়োরিটি।
একজন শুধু দিয়েই যাবে, আর অন্যজন শুধু নিয়েই যাবে, এটা দেখে মনে হতে পার, একসময় গিভার বুঝি তিতিবিরক্ত হয়ে তাঁর হাত গুটিয়ে নেবে।
হ্যাঁ, তাতো নিতেই পারে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।
যদি সামান্য ব্যক্তিত্ববোধ থাকে, অথবা নিতান্ত ছোটলোক না হয়, অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, টেকারও একসময় নিতে নিতে ক্লান্ত বোধ করে। হাপিয়ে ওঠে।
তাই, যদি কেউ ভাবে, “আমি তো দিয়েই খুশি, বিনিময়ে কিছু পেতে চাই না, তবুও কেন সম্পর্কটা ভাঙ্গলো?” – সেটাও ভুল।

যেকোনো সম্পর্ক, বিশেষ করে তা যদি প্রেমের সম্পর্ক হয়, পক্ষগুলির এটা বুঝে নিতে যত্নবান হওয়া দরকার যে তাঁরা কি পাচ্ছে আর কি দিচ্ছে।
এবং এই দেনা-পাওনার মধ্যে পক্ষগুলোর এক্সপেকটেশনগুলো মিট করার মত যথেষ্ট উপকরন আছে, নাকি নাই।
শুধু, “আমিতো আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি…” এই অজুহাত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।
মনে রাখতে হবে, যেকোনো অজুহাতই উল্টোদিকের মানুষটার ঘটে যাওয়া সাফারিং কমায় না। কিন্তু তাঁরা যদি অজুহাতটি মেনে নেয়, এটা ভাবার কারন নাই যে সব ঠিক হয়ে গেছে। বরং ধরে নিতে হবে যে, তাঁরা সেটা করেছেন অজুহাত প্রদানকারীর অবহেলা বা অপারগতা জনিত গিলটি ফিলিংটা কমানোর জন্য।

অজুহাত প্রদানকারী অজুহাত দেয়ার মধ্য দিয়ে “সব ম্যানেজ করে ফেলেছি” জাতীয় আত্মপ্রসাদ নিজে পেতে পারেন, কিন্তু তাতে কাউন্টার পার্টের উপরে ঘটা ড্যামেজ কিন্তু এতটুকুও কমে না………

(চলবে………)

প্রেম ভালবাসা ও সম্পর্ক নিয়ে কিছু টুকরো ভাবনা (চতুর্থ পর্ব)

৪,৭৫০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।