দর্শক ক্যাটাগরি নিয়ে একটি অনুব্লগ

বিশ্বকাপ নিয়ে লিখার ইতি টেনে দিয়েছিলাম। এরপরে একটা স্ট্যাটাস দিতে বসলাম ফেবু বন্ধুগনের জন্য, শেষ করে দেখি তা শুধু স্ট্যাটাস নাই, অনুব্লগে দাঁড়িয়ে গেছে।

ফাও একটা অনুব্লগ যখন পাওয়াই গেল, ভাবলাম, পোস্ট করে দেই সিসিবি-র পাঠকগনের জন্যও। আফটার অল, অনুব্লগ পোস্টিং-এ যখন কোন রেসট্রিকশন নাই…

বিশ্বকাপ এলেই দেশটা, দেশের মানুষগুলো যেভাবে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনায় ভাগ হয়ে যায়, ব্যাপারটা খুবই মজার।
ওরা আমাদের চিনুক বা না চিনুক, ওদের খেলোয়াররা আমাদের কথা জানুক বা না জানুক তার সাথে আমাদের এই দলে দলে ভাগ হয়ে কোমড় বেঁধে ঝগড়া ঝাটি করার কোন সম্পর্ক নাই।

এই ঘটনাগুলো না থাকলে বিশ্বকাপ ফুটবলটা মনেহয় সত্যিই খুব ম্যাড়মেড়ে হয়ে যেত।

এইদেশে সমর্থকদের এই দলে দলে ভাগাভাগির একটা সুস্পষ্ট প্যাটার্ন আছে। প্রথমে সাধারনগুলো বলি।

১) সার্বিকভাবে এইদেশে লাটিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতি সমর্থন ইওরোপের দেশগুলোর প্রতি সমর্থনের চেয়ে তুলনাতীত রকমের বেশী।
২) ৭৮-এর আগে থেকে যারা ওয়ার্ল্ডকাপ ফলো করছেন, তাঁদের মধ্যে ব্রাজিলের প্রতি পক্ষপাত ঈর্ষনীয় রকমের বেশী। এর পিছনে পেলের খ্যাতি ও ব্রাজিলের রেকর্ড ভূমিকা রেখেছে।
৩) ৮২ বিশ্বকাপ দেখে যারা প্রথম বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তাদের মধ্যে আর্জেন্টিনার প্রতি পক্ষপাত বিপুল। এর জন্য ম্যারাডোনার খ্যাতি ও ৭৮-এর বিশ্বকাপ জয়ের ভূমিকাই মুখ্য। এই ট্রেন্ডটা চলেছে ৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা রানার্স আপ হওয়ার সমায়টায়ও। তারমানে ৯৪ তে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ান হবার আগে পর্যন্ত।
৪) ৯৪-র পরে যারা বিশ্বকাপ সম্পর্কে জেনেছে, তাঁদের মধ্যে ব্রাজিলকে সমর্থনে বিপুল পক্ষপাত দেখা যায়। এর জন্য প্রথমতঃ ৯৪-এ রোমারিও-বেবেতো জুটির যুগলবন্দী এবং পরবর্তিতে রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, কাকা, রবিনহো-র অবদান অনস্বীকার্য।

এরই ফলোশ্রুতিতে ৮২-৯৪ সময়টাতে ব্রাজিল সমর্থকরা ছিল বেশ সংখ্যালঘু। ৯৪-এর পর থেকে সেটা বাড়া শুরু করে এবং এখন মনে হচ্ছে আর্জেন্টিনা-সমর্থকরাই মনেহয় সংখ্যালঘু হয়ে গিয়েছে।

সমর্থন বিষয়ক উপরের ঐ প্যাটার্নটা একটি সাধারন চিত্র। এর বাইরে অন্য বা উল্টো দলকে সমর্থনেরও কিছু নজির ও কারন আছে। তবে তার হার যথেষ্ট কম। কারনগুলো এইরকম:

ক) পিঠাপিঠি ভাই (কোন কোন ক্ষেত্রে বোন)-দের মধ্যে একজন যখন হাওয়া জেনে বুঝে সময়ের চাহিদানুযায়ি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা বেছে নেয় তখন সিবলিং-এনভির বিষয়টা জারী রাখার জন্য অন্যজন অকারনেই বিপরিত দলে ভীরে যায়।
খ) দম্পতিদের মধ্যে একজন যখন জেনে বুঝে সময়ের চাহিদানুযায়ি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা বেছে নেয় তখন “না বোঝা, না জানা” অন্যজন সম্পর্ক স্পাইস-আপ করার জন্য অথবা গভীর রাতের খুনসুটি জারি রাখার জন্য, উল্টো দলটাকে সাপোর্ট করে। এই ব্যাপারটা বেশ মজার । ধরা যাক হাবি ব্রাজিল আর ওয়াইফি আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল জিতলে হাবি তা সেলিব্রেট করতে উদবুদ্ধ করবে। আর আর্জেন্টিনা জিতলে ওয়াইফির জন্য সেলিব্রেশন টাইম। আবার আর্জেন্টিনা হারলে ওয়াইফির মন ভাল করাটা যেমন হাবির কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে ব্রাজিল হারলে হাবির মন ভাল করাটাও ওয়াইফির দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে। কার্যতঃ লাভ দুইজনেরই। মন্দ কি দুজনে দুদলে থাকায়? 🙂
একবার শুনেছিলাম গভীর রাতে বিশ্বকাপ দেখানো আর দুই খেলার মাঝে ব্রেক থাকার কারনে নাকি বিশ্বকাপ পরবর্তি মার্চ-এপ্রিলে দেশে একটা বেবী-বুমের ঘটনা ঘটে থাকে। জনস্বাস্থ্য-গবেষকরা আরও ভাল বলতে পারবে। 😉
গ) এর বাইরে আরও কিছু অতি সংখ্যালঘু কিন্তু সর্বজ্ঞ, সবজান্তা, ও চ্যালেঞ্জার শ্রেনীর মানুষ আছে যারা সব কিছুতে উল্টোটা করে, তারা হাওয়ার বিপরিতের দলটাকে জেনে বুঝে সমর্থন করে অজ্ঞাত কারনেই।
ঘ) এ সব কিছুর বাইরে আরও কিছু কিছু বিরল প্রকারভেদ থাকতেও পারে তবে তা আমার মতে এতই ক্ষুদ্র যে আমি আর অনুমানে যেতে চাচ্ছি না। অন্যকেউ করতে চাইলে, মোস্ট ওয়েলকাম।

এইবার মিলিয়ে দেখুন আপনি বা আপনার পরচিত জনরা কে কোন ক্যাটাগরিতে দল বেছে নিয়েছেন।

ঝগড়া চলুক!
খুনসুটি চলুক!!
সেলিব্রেশনও চলুক!!!

পুনশ্চঃ ১৯৮৩, ৮৭, ৯১, ৯৫, ৯৯, ২০০৩, ০৭, ১১ -এর মার্চ-এপ্রিলে যাদের এদেশে জন্ম, তাঁদের কেউ কেউ “বিশ্বকাপ-শিশু” হবার সম্ভবনা অতি উজ্জ্বল। 😛

বিশ্বকাপ নিয়ে আরও কিছু লিখা:

আন্তর্জাতিক ফুটবল অনুসরণ: শুরুর স্মৃতি

বিশ্বকাপ নিয়ে আরেক কিস্তি

এইবার কিছু স্মৃতিচারণ: ১৯৭৪ – ১৯৮২

আরো কিছু স্মৃতি চারন: ১৯৮৬-৯৪

২০ টি মন্তব্য : “দর্শক ক্যাটাগরি নিয়ে একটি অনুব্লগ”

  1. শাহরিয়ার (০৬-১২)

    খালি মাঠে গোল 😀
    আর্জেন্টিনা সাপোর্টাররা খুবই সংখ্যালঘূ এবং বেশীরভাগের জন্মই শুধু ব্রাজিলকে প্যারা দেয়ার জন্যে। 😛


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন
  2. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)
    পিঠাপিঠি ভাই (কোন কোন ক্ষেত্রে বোন)-দের মধ্যে একজন যখন হাওয়া জেনে বুঝে সময়ের চাহিদানুযায়ি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা বেছে নেয় তখন সিবলিং-এনভির বিষয়টা জারী রাখার জন্য অন্যজন অকারনেই বিপরিত দলে ভীরে যায়।

    এইটা সব চাইতে বেশি হয়


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)
    এর বাইরে আরও কিছু অতি সংখ্যালঘু কিন্তু সর্বজ্ঞ, সবজান্তা, ও চ্যালেঞ্জার শ্রেনীর মানুষ আছে যারা সব কিছুতে উল্টোটা করে, তারা হাওয়ার বিপরিতের দলটাকে জেনে বুঝে সমর্থন করে অজ্ঞাত কারনেই।

    হাওয়ার বিপরীতে দল বেছে নেই। সো এই ক্যাটাগরিতে পরি যদিও সর্বজ্ঞ বা সবজান্তার কোনটাই না। 😛 😛

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      তাইলে চ্যালেঞ্জার প্রকৃতির। যারা সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করে।
      আমি কিন্তু এদের পছন্দই করি।

      আমার ছাত্র-ছাত্রিরা জানে, যারা বিনা তর্কে কিছু মেনে নেয় না তাঁদের আমি কতটা সময় দেই।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    এরকম খাপে-খাপ পর্যবেক্ষণ হাহাহাহাহাহাহা! =)) =)) ৯৪ এর বিশ্বকাপ দেখা দিয়ে শুরু, ব্রাজিল মিস যায় নাই আমার খপ্পড় থেকে! 😛

    বড় ভাই বয়সে তিন বছরের বড় কিন্তু ৯০ এ পিতার মৃত্যুর ঠিক আগ দিয়ে সম্ভবত সে খেলা দেখার সুযোগ পায় নি তারপরেও আর্জেন্টিনার সমর্থক। সম্ভবত পরের দিকের কোন এক খেলোয়ারের খেলা দেখে ভালো লেগেছিল, তাই ভাইয়া কে কিছুটা ব্যতিক্রম ধরছি।

    বিশ্বকাপ শিশু নামটা একদম :gulli: :khekz:

    গুগলে world cup football Bangladesh লিখে গুগল ইমেজ সার্চ দিলে প্রথম কয়টা ছবির মাঝে একটা মজার ছবি আসে। টিনের চালের ঘর উপরে হরেক রকমের পতাকা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইটালি, পর্তুগাল। সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো খুব অদ্ভূত টাইমিং এ কদিন আগে পানশালায় ইটালির ছেলে লরেঞ্জো, পর্তুগালের মেয়ে লিওনর, আর্জেন্টিনার সেলিব্রেটি ফটোগ্রাফার নকি উপস্থিত ছিল। কথা প্রসঙ্গে ছবিটা দেখিয়ে ব্যাপক বিনোদন লাভ করেছিলাম। 😀 😀 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      কারো কোন সমর্থন নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন আপত্তি নাই যতক্ষন সে বলে যে আমার ইচ্ছা আমি যারে খুশি সাপোর্ট করবো, তোমার কি?
      খোচা খুচি করতে তখনই ইচ্ছা হয় যখন কেউ এক গাদা কারন হাজির করে "ঠিক এই এই কারনে আমি অমুক দলকে সাপোর্ট করি"
      মানেটা দাঁড়ায় এই, যারা ঐদলকে সাপোর্ট করে না তাঁদের রিজনিং-এর কোন ঠিক নাই, তারা লজিক বোঝে না ইত্যাদি।
      বিশ্বকাপ শিশু-র ঘটনা কিন্তু সত্যি। বিজয় সেলিব্রেট করতে এটা ঘটার সম্ভবনা যতটা, পরাজয় জনিত ডিপ্রেশন দূর করতে এটা ঘটার সম্ভবনা তার থেকে বেশী।
      কারনটা সিম্পল: সেলিব্রেশনের সময় মানুষ হুশে থাকে তাই প্রটেকশনের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া স্বাভাবিক। হারা জনিত ডিপ্রেসড অবস্থায় হুশ না থাকায় প্রোটেকশনের ব্যাপারটা গৌন হয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে।
      আর তার ফল: বিশ্বকাপ শিশুর আগমন / শুভেচ্ছা স্বাগতম।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আমার ছোট ভাই ব্রাজিল থেকে ফিরে এসে বলেছিলো : দাদা, মেয়েগুলো বিব্রত হবার মত সুন্দর। ব্রাজিল পছন্দের দল হবার পর দেখলাম -- এ দেশের ফুটবলটা আসলে উন্মাদনা আর শিল্পের একটা প্যাকেজ। আর কোন দলকে সাপোর্ট করা কি সম্ভব আমার পক্ষে?

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।