পলেন, ভাল থাকিস দোস্ত


ম্যাবসে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা। দেখা মানে শুধুই দেখা। কথা বার্তা হয়নি। মেয়েদের সাথে কথা বলার চেয়ে তাদের টিজ করার প্রতিই আমার অত্যাধিক আগ্রহ ছিল তখন। পলেন সেবারই প্রথম ম্যাবসে আসে। তার সুন্দর মুখশ্রীটা সবসময় কেমন যেন বিষন্নতার আড়ালে ঢাকা থাকত। ক্লাস টেন এ পড়ি তখন আমরা। গার্লফ্রেন্ড বাছাইয়ের উপযুক্ত সময়। পলেনকে পাওয়া মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়ল অনেকে। সখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলেও আমাদের কলেজের প্রতিনিধিত্ব করল দর্পন চাকু। ছুটি ছিল মাত্র ১৮ দিনের। দর্পনের শুধু পলেনের দিকে তাকিয়েই দিনগুলো পার করতে হল। কলেজে ফিরে আসলাম। অল্প বয়সে প্রেম গজাঁলে যা হয় আরকি। চাকুটার একমাত্র কাজ ছিল ডায়রিতে একশবার পলেনের নাম লেখা, তারে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা, পরবর্তী ছুটিতে প্রেম সফল করার জন্য কি কি প্রকল্প হাতে নেয়া যায় তার চিন্তা করা এবং সারাদিন পলেন পলেন করে আমাদের কান ঝালা-পালা করে দেয়া। বেচারার জন্য সবচেয়ে দীর্ঘ টার্ম মনে হয় ছিল সেটা।

পরের ছুটিতে পলেনের বন্ধু হবার জন্য ব্যাটা এক মারাত্মক প্ল্যান বের করে ফেলল। ক্লাস শেষে পলেন চলে যাচ্ছে। এমন সময় দর্পন দৌড়ে গিয়ে ওর হাতে ন্যাকামিতে পরিপূর্ণ ডায়রিটা তুলে দিল। ভাবখানা এমন আমার আর কিছু বলতে হবে না। ওখানেই সব লেখা আছে। কিন্তু জীবন তো আর হুমায়ুন আহমেদের বই না। নায়িকা তাই ডায়রির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে বাসের দিকে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন। ওদিকে আমরা প্রস্তুত। শুরু হয়ে গেল ফাটা খাওয়া প্রেমিকের টিজ খেয়ে তার মূল্য পরিশোধ পর্ব।

“দুই বছর পর”

১২ই ফেব্রুয়ারি। আমরা তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে। প্রি-টেস্ট পরিক্ষা চলছে। রাতের বেলা উপরের হাউসে গেলাম। তৌহিদের রুমে ঢুকে দেখি ও আর সুফিয়ান মন খারাপ করে বসে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করলাম। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে গেল। পলেন মারা গিয়েছে। কলেজের বাথরুমে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায়। আহারে! এই সেইদিনও ওরে দেখলাম আর এখন নাই। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কি এমন দুঃখ ছিল ওর যে কাউকে না বলে এভাবে চলে যেতে হবে। দুনিয়াতে একটা মানুষও কি ছিলনা, যার কাছে ও দুঃখগুলো ভাগাভাগি করতে পারতো। ওর সাথে আমার পরিচয় ছিলনা বললেই চলে। তারপরও খুব কাছের একজন ছিল কিন্তু এখন নেই, এমন কষ্টকর একটা অনুভূতি আমাকে গ্রাস করেছিল। ও মারা গিয়েছিল ১১ তারিখ। খবরটা বরিশাল আসতে আসতে রাত ১ টা। তিনটা বছর পার হয়ে গেল। আজকে ওকে নিয়ে লিখতে বসে সব ঝাঁপসা হয়ে আসছে। কথা খুঁজে পাচ্ছিনা। ভাল থাকিস দোস্ত। যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস।!!!

লেখাটা পলেন এর মৃত্যু দিবসে সচলায়তনে লিখেছিলাম। ওকে নিয়ে লেখার কোন যোগ্যতা তো আমার নেই, তাই এখানে দেই নাই। পাছে কেউ কিছু বলে….

১,৮৭০ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “পলেন, ভাল থাকিস দোস্ত”

  1. ইন্টারনেটে পেপার পড়ার সময় নিউজটা চোখে পড়েছিল। ক্যাডেট কথাটা লিখা থাকলেই চোখ সেদিকে যেতে বাধ্য। সবসময় ভালো নিউজই থাকে কিন্তু এই নিউজ পড়ে খুবই খারাপ লেগেছিল। আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। কিছুদিন আগের। আমাদের ব্যাচের মির্জাপুরের আলম। ছিনতাইকারীর গুলিতে মারা গিয়েছিল। এনগেজমেন্ট হয়েছিল ওর। শ্বশুরের সাথে ছিল সাথের টাকা বাঁচাতে চেয়েছিল আলম। সেই নিউজ পড়ে আমি মনে মনে বলেছিলাম কি দরকার ছিল দোস্ত এতটার। কলেজে ডেয়ারিং হলে সবাই বাহবা দেয়। এখন যে তোকে খুব গালি দিতে ইচ্ছা করছে।

    জবাব দিন
  2. কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

    এই মৃত্যুটা কি আত্মহত্যা না খুন? এটা আজো জানা যায় নি। হাঁটুবাহিনী ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছে। এতবড় একটা ঘটনা নিয়ে তেমন কোন আলোড়ন হল না এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়।

    জবাব দিন
  3. পলেন মারা যাওয়ার পর অনেক কলেজে অনেক কিছুই হয়েছে। আমাদের কলেজে বোধহয় একটু বেশি। কিন্তু সেসব আলোচনা করে এখন কোন লাভ নেই।

    এখন আমরা এটাই চাইতে পারি যে পলেনের বাবা-মা তাদের অভাবটা পূরণ করে নিতে সক্ষম হোক, তার ছোট বোনকে দিয়ে।

    অবশ্য তার বাবা-মা খুবই আপসেট হয়ে গিয়েছিলেন। তারা খুনের মামলা করেছিলেন। আমি ডিটেল কিছু জানি না। তবে শুনেছি আর্মির প্রভাবের কারণেই সে মামলা ঠিক ট্র্যাকে এগুতে পারেনি। এমনকি পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট আদালতে হাজির করা হয়নি।

    মৃত্যুর একমাস পর তার লাশ কবর থেকে আবার তোলা হয়েছিল পুলিশের তত্ত্বাবধানে। সেবারও পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট প্রকাশ করতে অনীহা দেখান ঢাকা মেডিকেল কলেজের জনৈক ডাক্তার। আর্মির কারণেই।

    খুব জানতে ইচ্ছা করছে, তার বাবা-মা 'র এখন কি অবস্থা।

    জবাব দিন
  4. কলেজ থেকে বলা হয়েছে, এটা আত্মহত্যা ছিল। পলেনের ক্লাসমেটরাও শুনেছি এ ব্যপারে নিশ্চিত যে, সেটা আত্মহত্যা ছিল। যদিও আত্মহত্যার কোন কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

    তাই এটা মেনে নেয়াই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত।

    জবাব দিন
  5. ওর মাবাবা যে খুব একটা ভালো নাই সেটা তো বোঝাই যায়, বিশেষত আন্টি। উনি মেন্টালি খুব খুব ডিস্ট্রেসড। ডিস্ট্রেসড কথাটা দিয়ে আসলে আমি বুঝাতে পারছি না উনার অবস্থাটা।

    এই অনুভূতিটা অনেক দিনই লিখার চেষ্টা করেছি- সম্ভব না। দুঃখিত।

    জবাব দিন
  6. কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

    গার্লসের পোলাপান সবাই এই একটা ব্যাপারে মুখে তালা দিয়ে রাখতেছে কেন আমি বুঝতেছি না। অনেকগুলা গার্লসের পুলাপানরে জিগাইছি, একজনও কয় নাই। বলতে চায় না, নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

    রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।

    জবাব দিন
  7. কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

    কই বেশি ঘাঁটাঘাটি হইল? আমি তো কিছুই দেখলাম না।

    একটা ক্লাসমেট মারা গেল, আর তার সব ক্লাসমেট চুপ, এটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক না।
    ধন্যবাদ।

    জবাব দিন
  8. আমিও এই বিষয়ে আর ঘাটাঘাটি করছি না। তবে বিষয়টা উত্থাপন করেছিলাম কেবল একটি কারণে:

    এ ব্যাপারটিতে কারোই স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। ক্যাডেট কলেজ সম্বন্ধনীয় সব বিষয়ে সবার ধারণা পরিষ্কার করে দেয়াও তো ব্লগের একটি লক্ষ্য। ব্লগের ধরণ-ধারণ দেখলেই যে কেউ বুঝবেন। সেখানে সকল বিষয়ে স্বাধীন পদচারণার ক্ষেত্র গঠিত হয়। আমরাও তাই সেরকম একটি ব্লগের আশা করি। ধন্যবাদ সবাইকে।

    জবাব দিন
  9. সরি, ঘাটাঘাটি শব্দটা আমি এখানের জন্য ব্যবহার করি নাই। পলেনকে নিয়ে সবার কৌতূহল এত বেড়ে গিয়েছিলো, যে আমরাই প্রতিদিন এক একটা নতুন কাহিনী শুনতাম। সবার মাঝে কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে মিথ্যা-এইটাই বাইরের মানুষ বুঝতে চাইত না।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।