ফিরে দেখা

গলায় ঝুলে থাকা গামছাটাকে কষে মাথায় বেঁধে ক্ষেতের আলের উপর বসে পড়েন আজিজ মিয়া। হাত বাড়িয়ে মাটিতে পড়ে থাকা হুক্কাটাকে তুলে সুড়ুক সুড়ুক করে টান দেন তিনি। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে ক্ষেতে হাল ধরে থাকা ছেলে রহমানের দিকে তাকিয়ে হাঁক দেন।

“চোখ কান খুইলা রাখিস রে রহমান, ওরা যে কোন সময় আয়া পড়তে পারে।”

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কোমল হয়ে আসে তার। গরীব কৃষক তিনি, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ছেলেকে কখনো বেশি কিছু দিতে পারেননি। তবু ওকে নিয়ে অনেক গর্ব তার। মানুষের বাড়িতে জায়গীর থেকে থেকে বি এ পাস করেছে কিছুদিন আগে। এখন গ্রামের হাই স্কুলে মাস্টারি করায়, রোজগার পাতি খারাপ না। হাটের বড় মাছটা বেতন পেলে বাপের জন্য নিয়ে আসে ছেলেটা। অথচ এক বছর আগে কি ভয়টাই পেয়েছিলেন তিনি। এক বছর আগে মানে সংগ্রামের সময়। ছেলে বাড়ির কাউকেই কিছু না বলে চলে গেল মুক্তি হতে। শীতের শুরুতে, সংগ্রামের শেষদিকে ছেলেটা ফিরে আসে আবার গ্রামে। পাক বাহিনী তখন পালিয়েছে। দেশ স্বাধীন হলেই কি না হলেই কি, তার কিছু এসে যায় না এতে। তিনি জানেন, তিনি যে চাষা আজিজ সেই আজিজই থেকে যাবেন। তবু ছেলেটা অক্ষতভাবে ফিরে এসেছে দেখে বাড়ির মসজিদে এশার নামাজের পর মান্নত করা ২০ রাকাত নফল নামাজ আদায় করেছিলেন, আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করেছিলেন ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ায়।

সেই দিনগুলোর কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। কি দিনই না গেছে! রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকজনদের কি তেজ তখন। দেখা হলে সালাম দিতে হত, বাড়ির মুরগিটা, মুরগির ডিমটা, মাঝে মধ্যে নধর হৃষ্ট-পুষ্ট খাসিটা নিজে বয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের বাড়িতে দিয়ে আসতে হতো, তারা মেজবানী করতো পাক বাহিনীর ভুমষো জোয়ানগুলোকে খাইয়ে। শুধু যদি এগুলোতেই শেষ হতো এদের কান্ড কীর্তি, তবে তো বিপদ অল্পের উপর দিয়েই যেত। কিন্তু ধরে নিয়ে গিয়ে মানুষ খুন করে ফেলা কোন কারণ ছাড়াই আর গায়েঁর সোমত্ত মেয়েগুলোকে পাক জোয়ানদের হাতে তুলে দেওয়া গাঁয়ের সাধারণ লোকজন কিছুতেই মানতে পারেনি। ভিতরে ভিতরে সবাই রাগে ফুঁসলেও জানের ভয়ে সবাই চুপ ছিল। তিনি নিজেও ভয়ে ভয়ে ছিলেন, মুক্তির বাপ হিসাবে কোনদিন যে আবার তাকে নিয়ে ধরে গিয়ে গুলি মেরে দেয়। আবার এদিকে তার নিজের জ্ঞাতিভাই হাবি মেম্বর ছিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। হাবি মেম্বরের সাথে সম্পর্ক কোনকালেই ভালো ছিল না তার, দেখতে পারেন না দু’চোখে। সংগ্রামের মাঝের সময়টাতে যখন পাখির মতো মানুষ মরছে, তখন ভেবেছিলেন তার দিনও শেষ বোধহয়। শুধু হাবি মেম্বরের সাথে সম্পর্ক খারাপ থাকা মরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ ছিল, তার উপর মুক্তির বাপ! না, আল্লাহ বড় বাঁচা বাঁচায়ে দিয়েছেন।

সংগ্রামের শেষদিকে পাকবাহিনী পালালে মুক্তির ছেলেপেলে দখল করে নেয় আশেপাশের সব এলাকা। গ্রামের মানুষজন আর মুক্তির ছেলেপেলে তখন এতোদিনের পুষে রাখা রাগ ঝাড়ল যতো রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন ছিল তাদের উপর। কেউ পালিয়ে বাঁচল, আর কেউ খেল পিটুনি। শামসু নামের গোঁয়ার মুক্তি ছেলেটা তো দুইজন কুখ্যাত রাজাকার ধরে দিনে দুপুরে সবার সামনেই জবাই করে মেরে ফেলল। একটু ষন্ডা কিসিমের হলেও ভালো ছিল ছেলেটা। রাগের মাথায় করে ফেলেছিল এই কাজ, পরে আর সহ্য করতে পারেনি। এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আর পুরো দেশজুড়ে তাবলীগ করে বেড়ায়। মুক্তির বাপ হিসাবে তখন সবার কাছে অন্য রকম কদর। তার জানের শত্রু হাবি মেম্বর এসে পায়ে ধরে জান ভিক্ষা চেয়েছিল তার কাছে। বুদ্ধি আছে মেম্বরের, জানে রহমান খুব বাপ ভক্ত। বাপের কথা ফেলতে পারবে না। যতো খারাপই হোক তবু তো জ্ঞাতি ভাই, তাই ছেলেকে ডেকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন, মেম্বরের যেন কিছু না হয়। ছেলেও বাপের কথা শুনছিল, বন্ধু বান্ধবদের বলে দিয়েছিল মেম্বরকে কিছু না করতে। মেম্বর নিজের বাড়িতেই স্বাধীনতার পরে ঘাপটি মাইরা ছিল, শেখ সাহেব ক্ষমা দেয়ার পর আস্তে আস্তে আবার সেই আগের মতো মাতবরী ফলায়া বেড়ায়। গাঁয়ে তখন অভাবের সীমা নাই, লোকজন খেতে পায় না। শান্তিপ্রিয় লোকগুলা নিজেদের কথা চিন্তা করতে করতেই শেষ, মেম্বরের পুরানো উৎপাতের দিকে পাত্তা দেয়ার সময় তাদের ছিল না। ভুলটা মনে হয় এইখানেই হইছিল, বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ভাবেন আজিজ মিয়া।

হুক্কাটা আরো কিছুক্ষণ টানেন তিনি। দুপুর বেলার রোদটা বড় কড়া লাগে তার কাছে, কিন্তু কিছু করার নাই। আজকে যদি এই জমিটা যায়, তাহলে বাকি জমিগুলা ওদের পেটে যেতে বেশিদিন লাগবে না। ওরা মানে, হাবি মেম্বর আর তার সাংগপাংগরা। গতকাল হাটের দিন ছিল। বাজারের চায়ের দোকানটাতে বসে বসে হাবি মেম্বর ঘোষণা দিয়ে আসছে সবার সামনে, ঘাটপাড়ের এই ক্ষেতটা নাকি তার, কাল সে ক্ষেতের দখল নিতে আসবে। কেউ বাধা দিলে লাশ পড়ে যাবে। আজিজ মিয়া তেলের জ্যারিকেনটা পাশে রেখে বেশি করে দুধ চিনি দেওয়া চায়ে একটা চুমুক দিয়েছিলেন মাত্র। কিছু বলেননি, চুপচাপ হাবি মেম্বরের আস্ফালন দেখে চলে এসেছেন।

বাড়ি এসে অপেক্ষা করছিলেন কখন ছেলে রহমান আসবে। ও ঘটনা শুনে কিছু বলে নাই। তবে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝছেন, ক্ষেপেছে সে। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ধানের গোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা কিরিচটা বের করেছিল রহমান। ছেলে কিছু না বললেও বুঝে ফেলেছিলেন ছেলে কি ভাবছে। ঘরের কাজের জন্য রাখা কুড়ালটাও তিনি তাই বের করে শানপাথর দিয়ে ধার দিয়ে রেখেছিলেন। পরের দিন যদি আসলেই দখল নিতে আসে জমির, বাপ বেটা ছেড়ে কথা বলবেন না। লাশ ফেলতে তিনিও জানেন।

হুক্কাটা মাটিতে রেখে পাশেই পড়ে থাকা কুড়ালটা আলগোছে কাছে টানেন আজিজ মিয়া। দূরে উত্তর পাড়ার জংগলের বাঁকটার কাছে কতগুলো কালো ছায়া নড়ে ওঠে। বুড়ো চোখে ভালো ঠাওর করতে পারেন না। কুড়ালটা শক্তহাতে ধরে দাঁড়ান তিনি, একটু ভালো করে দেখার আশায়। হাল ছেড়ে রহমানও কোমরে বাঁধা কিরিচটা নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। বাপের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিবিয়ে বলে,

“ওরা ওইযে আইতাছে বাবা। আপনে আমার পিছে থাইকেন।”

ছেলের কথা শোনেন না আজিজ মিয়া, ওর পাশেই গিয়ে দাঁড়ান। উত্তেজনায় কুড়ালটা হাত বদল করেন, ছায়াগুলো বড় হতে হতে মানুষের আকার ধারণ করেছে ততোক্ষণে।

ছুটে আসতে থাকা মানুষগুলোর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ভাবেন, হাবি মেম্বরকে ছেড়ে দিতে বলাটা মনে হয় ঠিক হয় নাই।

৪,০৩১ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “ফিরে দেখা”

  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    আমার বাপ আর দাদার কাহিনী এইটা, কিঞ্চিত রং চড়ানো হয়েছে। আসল ঘটনায় হাবি মেম্বর আসেনি দখল নিতে, তবে আমার বাপ দাদা জমির দখল বাঁচাতে কুড়াল আর কিরিচ নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়েছিলেন। ভালো গল্প লিখতে পারি না। আমার দৃষ্টিতে খুব ভালো কিছু হয় নাই এইটা। ভালো গল্প লিখেন এমন যে কেউ এই প্লটটা নিয়ে লিখতে পারেন, খুব খুশি হব। যদি সাহায্য চান লেখার ব্যাপারে সানন্দে রাজি।

    সবাইকে ধন্যবাদ আর বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    বস বস :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:
    জটিল হইছে :clap: :clap: :clap:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    তৌফিক, তোমার দৃষ্টিতে লেখাটা খুব ভালো না হইলেও আমার দৃষ্টিতে খুব ভালো হইছে! তোমার নিজের পরিবারের কাহিনী, এটা দেখে আরো ভালো লাগল।

    এইভাবে সুন্দর সুন্দর লেখা দিয়ে যাও, এই শুভকামনা রইল।

    জবাব দিন
  4. সামিয়া (৯৯-০৫)
    ছুটে আসতে থাকা মানুষগুলোর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ভাবেন, হাবি মেম্বরকে ছেড়ে দিতে বলাটা মনে হয় ঠিক হয় নাই

    ভালো মানুষ হতে গিয়ে মানুষ কখনো কখনো ভুল করে ফেলে, এর সলিউশনটা আসলে কি?

    জবাব দিন
  5. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    লেখা খুবই ভাল হয়েছে তৌফিক ভাই। অন্তরটা ভরে গেল। আপনাকে নিয়েই গর্ব হচ্ছে। কারণ আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
    আপনার বাবা ও দাদাকে :salute: :salute:
    আজ বারবার আপনার দাদার কথাটাই মনে হচ্ছে:

    হাবি মেম্বরদের ছেড়ে দিতে বলাটা মনে হয় ঠিক হয় নাই
    জবাব দিন
  6. তৌফিক (৯৬-০২)

    সবাইকে অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

    আমার দাদা মরহুম, তাঁর জন্য দোয়া করবেন। (১৯৭০ -এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি ছাতা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে যে দুটো আসন হারিয়েছিল তার মধ্যে আমার এলাকার আসন একটা।)

    আব্বার কাছে সালাম পৌঁছানো যাবে না। যদি শোনেন তার কাহিনী নিয়ে গল্প লিখেছি আমার খবরই আছে।

    জবাব দিন
  7. রহমান (৯২-৯৮)

    তৌফিক, তোমার লেখাটা পড়ে আমার বাবা আর দাদার ঘটনাও মনে পড়ে গেল। আমার বাবা ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটাতে। চাকরীর পাশাপাশি কোয়েটা ভাসিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এপ্রিলের দিকে আমার বাব বুঝতে পারলেন, ওখানে থাকলে হয় নিজের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে নতুবা মরতে হবে। তাই মে মাসে সেনাবাহিনীর সব কাগজপত্র পুড়িয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মাতৃভুমিতে।এসে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেন জুন মাসে। খবর পেয়ে পাকি জওয়ানরা আসে আমার দাদার বাড়িতে। আমার বাবা টের পেয়ে আগেই পালিয়ে যায় বর্ডারে আমার বড় ফুপুর বাড়িতে। আমার বাবাকে না পেয়ে দাদার ২ টা ঘর আগুন দিয়ে পুড়ে দেয়, আরেকটা ঘর ভেঙে দেয় পাক হানাদাররা। আমার বৃদ্ধ দাদাকে ধরে নিয়ে যায় তারা, ৭ দিন আটকে রেখেছিল, শুয়রের বাচ্চাগুলো মাটি কাটিয়ে বাংকার বানিয়েছিল আমার দাদাকে দিয়ে। আমার বাবা ফুপুর বাড়িতে থেকেই বাকি সময়টা মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ এ আমার বাবা নতুন ভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দাদা এখন আর নেই, বাবাও এখন বৃদ্ধ। আমিও আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব বোধ করি। সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।

    তোমার বাবা, দাদা সহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি :salute:

    জবাব দিন
  8. দিহান আহসান

    সেই প্রথমে পড়েছিলাম, তখন মন্তব্য করতাম না দেখে, কিছু লিখিনি।

    অসাধারন একটা গল্প যদিও তোমার জীবন থেকেই নেয়া, তোমাকে :hatsoff:
    দাদাভাই আর চাচাকে :salute:

    ভালো থেকো ভাইয়া অনেক। 🙂

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।