খেরোখাতা -আমার সাদামাটা দিন

বয়স বাড়ার ব্যাপারটা আমার কাছে খুব বিভ্রান্তিকর মনে হয়। আমরা জন্ম তারিখকে কন্সট্যান্ট রেখে বয়সের হিসাব করি। আচ্ছা এমন যদি হয়, জন্মের সময় আমরা কোন ভাবে জেনে গেলাম কবে আমি মারা যাব, আর বয়সের জন্য মৃত্যুর দিনকে কন্সট্যান্ট রেখে হিসাব করা শুরু করলাম। একটা করে দিন যাবে, আর বয়স ধীরে ধীরে কমে যাবে। লিমিটের মত, আস্তে আস্তে তা জিরো হবে। তাই যদি হত, তাহলে দিনগুলো কি এত সাদামাটা ভাবে আমি কাটাতে পারতাম। নাকি প্রতি মুহুর্তে নতুন ভাবে দেখতে চাইতাম জীবনের স্বাদকে। কি জানি। হবে হয়ত।

শৈশবের কিছু কথা, কিছু স্মৃতি মনকে খুব নাড়ায়। আমার দাদু আর নানু বাড়ি যেতে হত গরুর গাড়ি করে, মেঠোপথে। “ওহ্ কি গাড়িয়াল ভাই” কে তাই আমার খুব কাছ থেকে দেখা। ম্যান্দার গাছের পাশ দিয়ে খলিল ভাইয়ের “হট হট হট”, মাঠের মধ্যে বড় ব্যাঙের ছাতার দিকে অবাক তাকিয়ে থাকা, লম্বা তালগাছের মগডালে বাবুই পাখির কুড়েঘর, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো, শীতের শুরুতে পুকুর সেচে মাছ, ভাপা পিঠা, খেজুরের রস, অমাবশ্যার রাতে তাল গাছের পাতার সর সর শব্দ শুনে ভয়ে কেপে কেপে উঠা, কিংবা সন্ধ্যা হলেই তেতুল তলার ধারে কাছে না যাওয়া, এইসব রোমাঞ্চের জন্য আমার গল্পের বইএর দরকার হয়নি কখন। আমার শৈশবের একটা বড় অংশ জুড়েই আছে এইগুলোর বসতবাড়ি।

কিশোর যেহেতু একসময় ছিলাম, অনেক কিশোরী ছিল আশেপাশে। যদিও প্রেম বা ভালবাসা নিয়ে আমার উল্লেখ্যযোগ্য কোন স্মৃতি নেই। তবে অনেক না বলা কিংবা বলতে না পারা কথা মনে উকি দেয় ঈদানীং, এবং কেন জানি এও মনে হয়, আমাকে নিয়ে অনেকের না বলা কথা হয়ত তার মনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে ফিরে ফিরে আসছে।

গ্রাজুয়েশনের সময়টা অনেক চুপচাপ কাটিয়েছি দুটি কারনে, এর একটা ছিল পরিবেশগত, অন্যটা ব্যক্তিগত। তবে প্রথম বছরটা কেটেছে টালমাটাল অবস্থায়, পলিটিক্যাল কারনে প্রভোষ্ট বের করে দিতে চেয়েছিলেন হল থেকে, নানামুখি কারনে পেরে উঠেননি। কদিন আগে একটা ম্যাগাজিনে দেখলাম, তিনি এখন ভিসি হয়েছেন, তার একটা লম্বা সাক্ষাতকার ছাপিয়েছে পত্রিকাটি।

জীবন এখন অনেক সাদামাটা। অফিসের কিছু ডিসিসান ঝুলে আছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এর একটা কারন। নতুন কোন টার্গেট নেই। অফিসে আসি, পেপার পড়ি, টুকটাক ডিসিসান দিতে হয়, সিসিবিতে ঢু মারি, বউ বাচ্চার সংগে ফোনে কথা বলি, ইদুর সমস্যা নিয়ে ভাবি, পেষ্ট নেই, চাল কিনতে হবে, গত সপ্তাহের মাছটা পচা ছিল, জনসনের কিছু বেবি আইটেম কিনতে হবে বাচ্চাটার জন্য, আমার জন্য অলিভ অয়েল, ড্রাই কেকটা মনে হয় শেষ হয়ে গেছে, পাড়ার দোকানি দু’ টাকা পাবে, দিব দিচ্ছি করে আজ ৭ দিন হয়ে গেল, দেয়া হয়নি। ঈদে রংপুর যাব, শ্বশুর বাড়িটাও ঘুরে আসব আশা করি, দাদু বাড়ি, নানু বাড়ি সব, এইসব প্ল্যান করি।

যদিও গরুর গাড়িটা আমি চাইলেও আর পাব না।

ভাইজান উপজেলা ইলেকশনে দাঁড়াবে বলেছিল, ভাইয়া এম,পি নমিনেশন নিব নিচ্ছি করছে একটা বড় দল থেকে, মানা করেছি, যদিও আমার নিষেধ সে শুনবে এটা ভাবার কোন কারন নেই।

জীবন কেটে যাচ্ছে, নতুন কোন আইডিয়া ছাড়াই… তবে ঠিক কিছু একটা করে ফেলবো, এই বিশ্বাস মনে ঘাই মারে প্রতিনিয়ত।

এদিকে শীত আসব আসব করছে, যদিও লেপ কম্বল দরকার পড়ছে না, ফ্যানটা কমিয়ে দিতে হয় রাতে, বাকী কাজ কাথা দিয়েই সেরে ফেলি।

মনটা উদাস লাগলে গান শুনি, বারী সিদ্দিকীর একটা গান থাকে পছন্দের একদম উপরের দিকে।

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

“>

৫,৭৯৩ বার দেখা হয়েছে

৫৮ টি মন্তব্য : “খেরোখাতা -আমার সাদামাটা দিন”

  1. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    আমার শৈশব গ্রামেই কেটেছে। সুতরাং....

    এইসব রোমাঞ্চের জন্য আমার গল্পের বইএর দরকার হয়নি কখন।

    লেখাটা আমার নিজের লেখা হিসেবেই ধরছি। ধন্যবাদ বস :salute:


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ফয়েজ ভাই ভালো হইছে :clap: :clap: :clap:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    বয়সের জন্য মৃত্যুর দিনকে কন্সট্যান্ট রেখে হিসাব করা শুরু করলাম।

    সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমে রে।
    আমি বলি কমে।

    জীবন কেটে যাচ্ছে, নতুন কোন আইডিয়া ছাড়াই… তবে ঠিক কিছু একটা করে ফেলবো, এই বিশ্বাস মনে ঘাই মারে প্রতিনিয়ত।

    ভাইজানের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করাই দিতে হইলে আওয়াজ দিয়েন।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. তানভীর (৯৪-০০)
    আচ্ছা এমন যদি হয়, জন্মের সময় আমরা কোন ভাবে জেনে গেলাম কবে আমি মারা যাব, আর বয়সের জন্য মৃত্যুর দিনকে কন্সট্যান্ট রেখে হিসাব করা শুরু করলাম। একটা করে দিন যাবে, আর বয়স ধীরে ধীরে কমে যাবে। লিমিটের মত, আস্তে আস্তে তা জিরো হবে। তাই যদি হত, তাহলে দিনগুলো কি এত সাদামাটা ভাবে আমি কাটাতে পারতাম। নাকি প্রতি মুহুর্তে নতুন ভাবে দেখতে চাইতাম জীবনের স্বাদকে।

    ফয়েজ ভাই, কেমন যেন ধাক্কামত খেলাম এই লেখাটা পড়ে।
    কেমন যেন মন উদাস করা লেখা।
    বস্, আপনাকে ~x( :salute:

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    আমার এক কোর্সমেট তার ডায়রীতে লিখে রেখেছিল,

    "মানুষ নিজের জন্মদিন পালন নিয়ে এত আয়োজন কেন করে বুঝে পাই না।
    একটা জন্মদিন পালন করা মানে তো মৃত্যুর দিকে একটা বছর এগিয়ে যাওয়া"।

    আমি এই কথাটা আমার প্রিয় মানুষদের জন্মদিনে কোট করি 😐 ।

    ফয়েজ ভাই,
    গ্রামের স্বাদ আপনার মতোন করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি না করতে পারলেও প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর একবার করে যেয়ে মাসখানেক থাকা হতো। সেই সময়ের কিছু ক্ষুদ্র স্মৃতি আমাকে এখনও আপ্লুত করে। আমি একটু একটু জানি দিগন্ত বিস্তৃত শরিষার ক্ষেত কিরকম, খেজুর রসকে জ্বাল দিলে আস্তে আস্তে কেমন করে খয়েরী হয়ে ওঠে, খড়ের গাদার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে আকাশ কেমন দেখা যায়, মটরশুটি গাছের ঠান্ডা ঠান্ডা স্পর্শে কেমন শান্তি শান্তি লাগে - ভাবতে ভালো লাগে যে এক চিমটি পরিমাণ হলেও এমনটা অনুভব করার সুযোগ হয়েছিল।

    আপনার এই লেখায় সবগুলো স্মৃতি কেমন যেন হুড়মুড়িয়ে সামনে চলে এলো। খুব ভালো লাগল :clap: :boss: :salute: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    শীতকালে জমি থেকে তুলে মটরশুটি পুড়িয়ে খেয়েছো কখনো?? আহ, কি সেইসব দিন!! ১৯৭১ সালে বয়স ছিল ৯। পুরো নয়মাস গ্রামে ছিলাম। অখন্ড স্বাধীনতার সেইদিনগুলো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      মটরশুটি না, আমরা খেয়েছি মিষ্টি আলু (গ্রামে শেকআলু বলে) আহা আগুনে পুড়িয়ে গুড় দিয়ে খেতে কি মজা। আর ধান কাটা হয়ে গেলে আমরা মাঠে গিয়ে শীষ কুড়াতাম। সব গুলো শীষ কুড়িয়ে চাল বের করে পিকনিক করতাম রাতের বেলা সবাই মিলে, হ্যাজাকের আলোয় ঘাসের উপর বসে সে এক অন্যরকম খাওয়া।

      মাথার উপর শুধু আকাশ আর তারা।

      কই গেল সেইসব দিন।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  7. সামি হক (৯০-৯৬)

    ফয়েজ ভাই , জটিল লাগলো লিখাটা। কিন্তু সবাই যা বলছে মন উদাস করা একদম। লিখা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আসলেই মনে কত কিছু ঘাই দেয়, কিছু একটা করে ফেলবই হয়তো।

    জবাব দিন
  8. সরি ফয়েজ ভাই,অনেক দেরি কইরা ফালাইছি,হ্যা ঠিকই ধরছেন। কলেজ আর হাউসও ঠিক আপনারটাই। যাই হোক,অনেক ভাল লিখেন আপনি। ভাল থাইকেন।

    জবাব দিন
  9. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ছন্নছাড়া, তোমাকে এই নামে ডাকতে ভাল লাগে না। তোমার নাম জানতে চাই, আরও জানতে চাই নিজেরে লুকাই রাখছ ক্যানো? রেজিট্রেশন করে ফেল তুমি, কেন ফেলে রাখছ? আমাদের কি আপরাধ?

    ক্যাডেট সমাজ জানতে চায়।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  10. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)
    দেখছ কান্ড আপ করতে চাই না, তাও ক্যামনে ক্যামনে আপ হইয়া যায়। যাক হইয়া যখন গ্যাছে, ছাড়ি তো দিতে পারি না।

    ফয়েজ ভাই, আরেকটা ব্লগে আপনের এই কমেন্ট পৈরা খুবি মজাক পাইছি।সাবধানতা অবলম্বনের কারণে ঐখানে না কমেন্টাইয়া এইখানে কপি পেস্ট মার্লাম।
    অফ টপিক-সিনিয়ররা খ্রাপ হইয়া যাইতাছে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।