গন্তব্য

এক

তিন টাকা দামের চা আর দুই টাকার ঠোঙা চিনাবাদামের দিন ফুরিয়ে গেছে, এককাপ চায়ের দাম এখন পাঁচ টাকা। অথচ সেই অনুসারে আয় বাড়েনি, রিক্সা ভাড়া বেড়েছে, সবজী-মাংস-মাছের দাম বেড়েছে, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে এমনকি পতিতার রেটও বেড়েছে।
সিগারেটে টান দিতে দিতে দেশ ও জাতির জন্য দিল-দরিয়া ভেবে ছারখার করে দিল আলম। উরুর ফাঁকায় আপতত চুলকাচ্ছে, অথচ সামনে একজন হুজুর বসে বসে চা খাচ্ছেন, হুজুরের সামনে উরুর ফাঁকায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে চুলকে নিলে শালীন হবে কি ব্যপারটা? অথচ শালীন বেশালীন মানে না চুলকানী, উঠে দাঁড়িয়ে দোকানে পয়সা দেবার সময় লুঙ্গির কুঁচি ধরে উপর থেকেই হালকা উরু চুলকে নিল আলম।
দিনাজপুরে যখন ছিল তখন এসব চুলকানীর ব্যারাম ছিল না, ঢাকার পানিতে চুলকানী বেড়েছে, মাথার চুল কমে গেছে, নানা রকম উপসর্গ। ভালোয় ভালোয় কাজ সেরে অন্য শহরমুখী হতে পারলেই বাঁচা যায়।

রিকশা নিয়ে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের উত্তর গেটে চলে আসে আলম, দু”তালার হোটেল মরিয়মের ২০৬ নাম্বার রুমে ঊঠেছে বেশ কয়েকদিন হল, দিনে ঘোরে ফেরে, রাতে খোদাই করে, হোটেলে আপাতত খাওয়া দাওয়া, সিঙ্গেল ব্যাচেলর জীবন। কাজটা ঠিকমত নেমে গেলে একটা যায়গায় থিতু হওয়া যাবে।

হোটেল মরিয়ম দুতালায় হলেও নীচ তলায় মার্কেট, আরও একটু নিশ্চিত করে বললে হোটেল মরিয়মের ২০৬ নাম্বার রুমের ঠিক নীচেই ফাতেমা জুয়েলার্স। ফাতেমা জুয়েলার্সকে রেকি করছে আলম গত একমাস ধরে, আরেক দোকান থেকে সোনার কানের দুল কিনে ফাতেমা জুয়েলার্স এ পালিশ করিয়েছে, সিলিং এর ফ্যানের পজিশন দেখেছে, দুই ফ্যানের মাঝখানের দূরত্ব দেখেছে, ভেন্টিলেটর, এসির ফুটো দেখেছে।

হোটেলের রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে জিরিয়ে নেয় আলম, খাটটা টেনে রুমের মাঝে নিয়ে এসেছে সে, পাশে সরিয়ে দিয়েছে টেবিল। খাটের নীচে চলছে খোদাই, প্রতিদিন ৩ ইঞ্চি করে খোদাই করলে সামনের সপ্তাহে একটা ছোটখাট গর্ত হবার কথা, তবে কাজ করার সুযোগ সবসময় আসে না, শব্দ হয় প্রচন্ড মানুষ একবার জানতে পারলে এক পিস আর থাকবে না আলম, কয়েক পিস হয়ে যাবে। তবে আজ একটি ভালো দিন, সামনের রাস্তায় কাজ চলছে, ইট ভাঙার মেশিন চলছে, প্রচণ্ড শব্দ, এই সুযোগে ছোট ড্রিল মেশিন দিয়ে গভীর কয়েকটা অগভীর ফুটো করে ফেলল মেঝেতে আলম, এমন ভাবে করল যাতে ফাতেমা জুয়েলার্স এর সিলিং ভেদ না হয়, এবারে ফুটোর চারপাশে হাতুড়ী বাটাল দিয়ে ইট বালি সিমেন্ট তোলার কাজ, সামনে রড পরলে এডিয়ে যাচ্ছে, পাশ থেকে খুঁড়ছে, রড কাটতে গেলে অনেক সময় লাগবে,এত সময় হাতে নেই। বিকেল তিনটে পর্যন্ত কাজ করল আলম। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো, অনেকগুলো কাজ হয়েছে আজকে, এভাবে আগালে কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। আপাতত খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।

রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরালো সে, মুখ ভর্তি দাড়ি তার, চুলও বড় বড়, একটা নামযী লেবাস এসেছে, এর লেবাসের সাথে সিগারেট আসলে ঠিক যায় না, সিগারেটটা ফেলে দিল সে।
– ভাইজান স্লামালাইকুম
– অলাইকুমসালাম
– আপনাগো রাস্তার কাম কাইলকে চলবো?
– হ, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কইছে সাত দিন চলবে।
– কয়টার সময় শুরু হইবো?
– তা দিয়ে আপনার কাম কি?
– যখন শুরু করবেন, তার আগে ঘুম থেকে ঊডুম, এই মেশিন চললে ঘুমান যায় না।
– সকাল নয়টার সময়ে শুরু হইবে।

পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হল আলম, হেঁটে হেঁটে পুরানা পল্টনের দিয়ে গেলো, যেখানে থাকা হয় তার আশে পাশে ভাত খাওয়া ঠিক না, লোকজনের চোখে যত কম পরা যায় ঠিক ততই ভালো। পুরানা পল্টনে কাবুল বাবুর্চির দোকানে ঢুকে গেলো আলম, খাবার দোকানে ঢুকে সরাসরি পাতিলের ঢাকনা তুলে কি খাবার আছে এটা বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় কিনা, এটা আলমের জানা নেই।
পোমা মাছের দো-পেয়াজু আছে, আছে আলু দিয়ে মুরগির তরকারী, আমের কুচি দেয়া ডাল, আর কয়েকপদের ভর্তা।
শাদা ভাত, ভর্তা, ডাল আর পোমা মাছের দো-পেঁয়াজু দিয়ে আশেয়ী একটা আহার শেষ করে ম্যাচের কাঠি ভেঙ্গে টা দিয়ে দাত খিলাল শুরু করলো আলম, ঢেঁকুর উঠছে, ঢেঁকুরের সাথে আম কুচির ঘ্রান, দাঁতের ফাকে আটকে থাকা খাবারের টুকরো গুলো বের করে ফেলল আলম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, এখন সেগুলো থুতুর সাথে বাইরে ফেলা যাবে কিনা সেই নিয়ে টেনশনে পরে গেলো আলম, এক ভদ্রমহিলা বোরকা পরে ভাত খাচ্ছেন, নিকাব তুলে তুলে মুখে ভাতের লোকমা মুখে তুলছেন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আলম দাঁতের ফাকা থেকে বের হওয়া খাবার অংশ আবার গিলে ফেলল।

বাইরে বের হয়ে ভ্যানের উপরের দোকান থেকে একবাটি পেঁপের টুকরো কিনলো সে, খুব মনযোগ দিয়ে সবটুকু শেষ করলো। মানুষ যতই সভ্য নিজেকে দেখাতে চায় না কেন, আসলে প্রথমে পেট, এরপর থাকার যায়গা আর এরপরেই যৌনতার চাহিদা অনুভব করে। বিয়ে থা, প্রেম বড্ড মেকি মনে হয়, শরীর তো চাইতেই থাকে, কিন্তু শরীরের কাছে পরাজিত হয়ে কারো সাথে বাঁধা থাকার মানে হয় না, এর থেকে টাকার বিময়ে মজিনার শরীর ঘাঁটা অনেক বেশি স্বস্তিকর।

ফকিরাপুল পৌঁছুতে বেশ দেরী হয়ে গেলো, মজিনাকে পাওয়া গেলো না, মজিনা ইদানীং এস্কর্ট করে বলে শুনেছে আলম। বেটীর দাম বেড়েছে, বেছে শুনে খদ্দের বাছে, ব্যবহারও খারাপ হয়েছে, তবু মজিনাকে না পেয়ে মনটা একটু খারাপ হল আলমের। মজিনা সামান্য ঢং করে, একটু গান বাজনা গায়, শরীরে হাত দিলে লজ্জা পায়, কাপড় খুলতে গেলে বাসার মেয়েছেলের মতো হু হু করে ওঠে, বাঁধা দেয়, বাঁধা দেওয়া তাহাকে জিতে কাপড় খুলে নেবার এই খেলাটা বেশ ভালো লাগে, হোক না ঢঙ কিম্বা মেকিত্ব, তবু পুরুষ মনে বিজয়ীর আবহ আসে।

ঢঙ্গী মজিনাকে না পেয়ে, অন্য একটা মেয়েকে রুমে ডেকে নিলো আলম, পুরু পাউডারের আড়ালে চামড়া ঢাকা পরে গেছে, কানে এক জোড়া বিশাল দুল, শাড়ির নীচে অপুষ্ট বুক, তবে কম বয়স্ক মেয়ে দেখে আলমের মন খুশির দোলে দুল।
– কাজ ফুল নাইট করবেন? ঘন্টা? নাকি একবার?
– একবার
– ৫০০ টাকা দিতে হইবে, টাকা কাজের আগে।
– আরেহ যাহ, এস্কর্ট মজিনার রেটই তো ৪০০ টাকা, তোরে ৫০০ কেন দিতে হইবে?
– ঠিক আছে, ৪০০-ই দিয়েন।
– ৩০০ টাকা পাবি, এর বেশি এক পয়সাও না, হইলে কাছে আয়।
– ছ্যাপ দিতে পারবেন না, আর দাত লাগাইতে পারবেন না।

এই বলে মেয়েটি শাড়ি খুলে ফেলে, সায়া আর ব্লাউজ পরে আলমের কাছে আসে, ব্লাউজটাও খুলে ফেলে, আলম একটা ১০০ টাকার নোট দিয়ে তাকে বিদায় করে দেয়, যে সব দিয়ে দেবার জন্য এলো তার কাছ থেকে নেবার মত আর কি থাকতে পারে। একটু নাটক, গাল গল্প, হাসি তামাশার জন্য আলমের মন আকুল হয়ে ওঠে।

দুই

শুক্রবার সকাল থেকেই আলমের মন খুশি খুশি গত চারদিনে দুই হপ্তার কাজ হয়েছে। টং এর দোকানে চা খেতে খেতে মুখের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে গেলো। আজকে চায়ের দামের জন্য মেজাজ খারাপ হচ্ছে না, উরুর ফাকেও চুলকাচ্ছে না, মনটা বড় শান্ত জ্ঞান হয়।
– ভাইজান আজকে জুমার জামাত কয়টায়?
– দেড়টায়।

ঠিক একটা বিশ মিনিটের সময় আলমের হাতুড়ির বাড়ি ফাতেমা জুয়েলার্স এর সিলিং ভেদ করে উঁকি দিল। উঁকি দেখবার জন্য ফাতেমা জুয়েলার্স এর মধ্যে কেউ ছিল না। শুক্রবার মার্কেট বন্ধ, মার্কেটের ভিখারীটাও পর্যন্ত নেই, নামা্যে গেছে, দারোয়ানটা আরো আগেই গেছে। শাটার নামানো ফাতেমা জুয়েলার্স এর সিলিং এর ইট সুরকি ধীরে ধীরে খসে পরতে থাকে। দুই হাত ঢুকাবার মতো গর্ত করে থামে আলম। চক চক করছে নীচের কাচের সারিতে সাজানো গয়না। দড়িতে বেঁধে ঝোলা আর আরেক হাতে লাঠি নামিয়ে দিলো সে সিলিং থেকে, লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গহনা গুলো ঝোলায় ফেলে তুলে নিলো, এক ঝোলা পূর্ন হতে খ্যামা দিলো আলম, অতি লোভে তাতী নষ্ট।

নিজের জিনিসপত্র এর মধ্যে গহনার ঝোলা ভরে রাস্তায় নেমে এলো আলম, হোটেলের টাকা আগেই মেটানো ছিল, দলে দলে মানুষ জুমার নামাজ থেকে বের হয়েছে, নামাজী মানুষের মধ্যে মিশে গেলো আলম, পল্টনের সেলুন থেকে চুল ছাট দিল, দাড়ি কামিয়ে ফেলল, প্রচুর সময় হাতে, শনিবার সকাল ১০টার আগে কে ফাতেমা জুয়েলার্স এর শাটার খুলবে না, জানতেও পারবে না। রিক্সা নিয়ে ফকিরাপুলের উদেশ্যে রওনা হয় আলম, আজ মজিনাকে ৯ টা থেকে ১০ বুক করে রাখা হয়েছে। মন মেজাজ ভালো থাকলে মজিনা একটু গান বাজনাও করতে পারে। আলমের মনে খুশির চড়ুই ফুড়ুৎ করে যায়গা বদল করে।

তিন

– মজিনা
– বলেন
– তোমার গলাডা খুব মিষ্টি
– আপনার মনডা খুব ভালো।
– মজিনা তুমি আমার সাথে চলো দিনাজপুর
– গিয়ে কি করবো? ভাত রান্না করব?
– ঘর সংসার করবা আমার সাথে।
– শোনের আমার জীবনে অনেক কষ্ট, আমার চাচা আমারে ঢাকা এনে দালালের কাছে বিক্রি করে দিছিলো, আমি ভাত কাপড় পাই নাই, এখন অনেক ভালো আছি, শরীরটার অভ্যাস হয়ে গেছে, মানায়ে নিছি, আর কষ্ট লাগে না, ভাত কাপড়ের কষ্ট আর করতে পারবো না। আপনি চলে যান এখান থেকে, আর কখনো আইসেন না।
– তুমি এইগুলা কি বলতেছ?
– ঠিক কইতেছি, এখনি চইল্লা যান, আমার দোহাই লাগে

গভীর রাতে বাসের জানালা থেকে সবচেয়ে সুন্দর গলার হারটা ছুঁড়ে দেয় আলম, একবার ঝিলিক দিয়েই হারটা হারিয়ে যায়। আলম বিড়বিড় করে বলে ওঠে- “এইটা তোমারে দিবার মন করছিলাম মজিনা, অভাগা যেদিকে চায়, সাগরের পানিও টাইনা যায়”
অন্ধকার চিরে বাস চলে, শো শো করা বাতাস আলমের চোখের পানি গালেই শুকিয়ে দেয়, আলমের আপাতত নিজের গন্তব্য জানা নেই।

২,৬১৬ বার দেখা হয়েছে

২৭ টি মন্তব্য : “গন্তব্য”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    এপিক লেভেলের একটা ছ্যাঁকা খাইয়া ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করলাম! :brick: নাহ (ড্যান) মজিনা খুব খারাপ! :((


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এজন্যই মনির খান বলেছেন, "জোর করে ভালবাসা হয় না..."

    দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো, ভাল লাগলো :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    ইচ্ছা করেই দেরি করে পড়লাম আপনের লেখা। ভাল খাবার যেমন একটু রয়েসয়ে খেতে হয়, ভাল লেখার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
    অপেক্ষা করে পড়া সার্থক হইছে 😀 😀
    দেশে আসলে জানাইয়েন, বাইতুল মোকারমের সামনের টং এ বসে চা খামু একলগে।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।