জন্ম পদ্যের গদ্যরূপ

এই রকম একটা লেখা লেখার কোন ইচ্ছাই ছিল না,তবুও লিখছি। স্মৃতিচারণে পুরনো লেখা পড়তে জুড়ি নেই।
আজ ২৫শে মে। আমার জন্মদিন। সেই সাথে সাথে নজরুল জয়ন্তী। তবে আজ কবি নজরুলের ঢোল না পিটিয়ে নিজের ঢোল পিটানোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

তুষখালি ও আমি

আমার জন্ম এইসব কংক্রিট পাথর ইটের শহরগুলো থেকে অনেক দূরে। বর্তমান পিরোজপুর জেলার,মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালি নামক ইউনিয়নে। তুষখালি আমার মামাবাড়ি।
তুষখালি কেন নাম হোল জায়গাটার,এই প্রশ্ন করেছি বহুজনকে,কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি কারো কাছে থেকেই,এক এক জন এক এক রকম কাহিনী ফাঁদে। তবে তুষখালির কিছু বিজয়গাথা রয়েছে।

জমিদারেরা তখন শাসন করত পুরো বাংলা,কিন্তু ধীরে ধীরে এক সময় বিভিন্ন কারনে কৃষকদের সাথে জমিদারদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, এই বিরোধের পরিণামস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভ থেকে ঐ শতকের আশির দশকে জমিদার বিরোধী কয়েকটি বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এগুলোর মধ্যে একটি বড় বিপ্লব হোল তুষখালি কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫)।

এই ইউনিয়নের মানুষজন এখনও কৃষিকাজ ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে। এবং এই অঞ্চলের মানুষজনের বিদেশ যাবার হার মারাত্মক, এবং প্রথম পছন্দ তাদের মধ্যপ্রাচ্য। কুয়েত,সৌদি,কাতার,দুবাই ফেরত পাত্র এখানে সবচে দামি। এখানে অধিকাংশ পুরুষের গলার সোনার চেইন,সোনা রঙের ঘড়ি,এবং বাড়িতে বিদেশী জায়নামাজ। এখানকার মানুষের কাছে এখনও বিদেশ মানে টাকার কাড়ি,গাড়ি,বাড়ি আর ভালো বিয়ের সম্বন্ধ।

তুষখালির আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল ধানখেতে মাছ চাষ,বিভিন্ন রকম কার্প মাছ,রুই মাছের চাষ করা হয়। অনেক সময় জোয়ারের পানি অধিকবৃষ্টিতে ফুলে উঠে ঢুকে পড়ে খেতে, সাথে,কাঁকড়া,মাছ,সাপ আর ব্যাঙ। তখন এখানকার মানুষরা ছাতি,টর্চ আর হাতে ছররা( বাশের মাথায় লোহার কাটা বসানো) নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মাছ মারতে।

বাংলাদেশে গিয়েছিলাম গত জুলাইয়ে,দু মাস ছিলাম দেশে। নিজের জন্মস্থানের প্রতি নাকি মানুষের টান থাকে প্রবল। বরিশাল থেকে বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেলাম তুষখালি। নেমেছিলাম মাছ মারতেও,সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে,ঠাণ্ডা লাগিয়ে আর ভোর রাতের দিকে জলঢোড়া সাপের কামড় খেয়ে বাসার ফিরেছি। ছোট মামি আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড হাসাহাসি করলেন, রাঙ্গাদি ( নানি) বললেন
“ ছররাটা তুলে রাখ মাচায়,সামনের বছর যখন আসবি তখন মারবি আবার”

আমি খুব ফলপ্রেমী,তুষখালির প্রতি আমার ভালোবাসার আরও একটি কারণ এটা। লিচু আর জাম্বুরা গাছ প্রায় প্রতি বাড়িতে, ফল হচ্ছে দেদারছে,সাথে আম কাঁঠাল আর পেয়ারা।
যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন তাদের বাগানে আরও আছে ডাব,ছফেদা,জামরুল।
আর খাল পাড়ের গাব গাছের গাব সবার জন্য উন্মুক্ত। আকারে বড়,এবং মিষ্টি শাঁস ওয়ালা গাবকে বলা হয় বিলাতি গাব,আর ছোট,পানসে গাবকে বলা হয় দেশী কিম্বা প্যাঁচরা গাব।
নামকরনের সার্থকতা উদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম,লোকে বলে বড় গাব আংরেজ সাহেবদের মতো দেখতে,বড়সড়,লাল টকটকে আর মিষ্টি, আর পেঁচরা গাব কষ( ক্ষারীয়) । আমি মিষ্টি হেসে আমার নিজস্ব সমর্থন জানালাম,এবং অনুভব করলাম জাতি হিসেবে নিজেদের আমরা কুৎসিত ভাবতেই পছন্দ করি।
তবে যখন সিডর আঘাত করল তখন ফল গাছ প্রায় সব মুড়িয়ে দিয়ে গেছে, এখনও বেচারারা আগের রূপ যৌবন ফিরে পায়নি।

ইতিহাস

আমার নানা আর নানির কথা একটু বলি,নানা গত হয়েছেন। ক্যান্সার বাসা বেধেছিল শরীরে। নানা যখন মারা যান আমি তখন বেশ ছোট,বুঝতে শিখেছি মাত্র। এতটুকু বুঝেছিলাম নানা আর নেই,মসজিদের পাশে উচু ঢিবির নাম কবর,নানা সেখানে শুয়ে আছেন,আমার মা কাদছেন অতএব আমারও কাদা উচিত।
আমার নানা খুব সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে স্টুয়ার্ড ছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার আগের মাসে তিনি করাচী ত্যাগ করেন গোপনে,চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়েই। আমার মায়ের বয়স তখন ২ মাস। বাচ্চা ছোট তাই যুদ্ধে যেতে পারেননি পারিবারিক কারনে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানা আশে পাশের অনেক হিন্দু বাড়ির মেয়েদের নিজের ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। এলাকায় নানার প্রচণ্ড সুনাম।

শেষ বয়সে একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন,কি সব কারনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করা হয়ে ওঠেনি নানার। দেশ স্বাধীন হবার পর নানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার হন। চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মায়ের মুখে শুনেছি আমার নানা আমার নানিকে বিয়ে করবার জন্য ৭ দিন নানী বাড়ির কাছারিতে ( বসার ঘর) অপেক্ষা করেছেন,নানির বাবা শেষ পর্যন্ত এই নাছোড়বান্দা যুবকের হাতেই তার মেয়ে তুলে দেন।
নানীর বাড়ি তুষখালি থেকে নৌকায় ৬ ঘণ্টা ( যখন গিয়েছিলাম তখন নৌকায় গিয়েছিলাম,সড়ক পথের দূরত্ব জানা নেই আমার) জায়গাটার নাম চিত্রা। অসম্ভব সুন্দর এক গ্রাম,একবারই যাবার সুযোগ হয়েছিল চিত্রায়। নারিকেল গাছ থেকে নামার সময়ে আমার বুকের ছাল ছড়ে গিয়েছিল,তখন মা সহ ফিরে আসতে হয়েছিল চিত্রা থেকে।

আমার মা যখন সন্তান সম্ভবা তখন নানা নানি তাকে তুষখালি নিয়ে যান,এটা সম্ভবত আমাদের দেশের একটা ট্রাডিশন। কথা ছিল মে মাসের মাঝের দিকে মেজ মামা মাকে নিয়ে বরিশালে ফিরবেন, সেখানে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে আমার জন্ম হবে,বাবার চাকরিও তখন বরিশাল এবং আমার এক ফুপিও বরিশালে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের আর যাওয়া হোল না বরিশাল,আমি জন্ম নিলাম তুষখালিতে। যে বিছানায় মা আমাকে প্রসব করেছেন,সেই খাটটা এখনও আছে,হাত বুলিয়ে দেখেছি,যদিও জন্ম অনুভব করতে পারিনি।

নানা বড় অফিসার হওয়াতে তিনি আমার জন্মের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন সঠিকভাবে। তখন তার চাকরির পোস্টিং নড়াইলে,সেখান থেকে চলে এসেছেন তুষখালিতে। মঠবাড়িয়া হাসপাতালের ডাক্তার মাকে দেখে যাচ্ছেন নিয়মিত সপ্তাহে একবার করে,ঘোষণা দিয়েছেন কোন রকম অস্রপচার ছাড়াই মা সন্তানের জন্ম দেবেন। মাঝে একবার মাকে এসে দেখে গেলেন ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজি। উনি বিএনপি সরকারের সাংসদ,এবং ফ্রি চিকিৎসা করার কারনে তুষখালি মঠবাড়িয়াতে প্রচণ্ড প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজী আমার নানির খালাতো ভাই। মাকে দেখার পর তিনি আরও কিছু গরিব রোগী দেখেন,এবং ওষুধ লিখে দিয়ে যান।

মে মাসের ২৫ তারিখ সকাল থেকে মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়,ভোর ৬ টার সময়ে। সাথে সাথেই ডাক্তার ডেকে আনতে মঠবাড়িয়া শহরে চলে যান কয়েক বাড়ি পরের মফাজ্জল নানা আর সাথে আমার মেজ মামা। তিনি তখন বেকার,মসজিদে আজান দেন পাঁচ বেলা,আর সন্ধ্যায় মাছ বাজারে গিয়ে জুয়া খেলেন।
যাই হোক,সেই সাথে নানি ডেকে আনেন আমেনা খালাকে। তিনি আগে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করতেন,স্বামী মারা যাবার পরে ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। তার এক ছেলে ঢাকা থাকে,ব্যবসা করে এবং তাকে টাকা পাঠায়। আমেনা খালা ছাড়া তখন তুষখালিতে আর কেউ ইঞ্জেকশন দিতে পারতো না,তাই লোকে তাকে বেশ সম্মান করত।
ডাক্তার আসলেন,আমেনা খালা আসলেন,আমার ছোট মামা,মেজ মামা নানা আর নানি।

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার,বেলা ১২ টা ৪৫ মিনিটে আমার জন্ম হোল। আমেনা খালা আমাকে কোলে নিয়েছেন সবার প্রথমে,তার পর নানি। নানির হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়েছেন মেজ মামা। মাতৃগর্ভ থেকে বেড়িয়ে প্রথম চুমু পেলাম মেজ মামার কাছে,এবং তখনও আমাকে পরিষ্কার করা হয়নি। আমার মাও ধাতস্থ হয়ে এসেছেন অনেকটা। মায়ের পাশে শুয়ে আছি আমি,পাশে মামারা। জন্মদানের পর আমার মায়ের কি অনুভূতি হয়েছিল জানতে চেয়েছিলাম। মা বলেলেন
“ আমার মনে হয়েছে আমি বড় একটা গোলাপ ফুল প্রসব করেছি।”
বেশ বড়সড় আকারে জন্ম নিয়েছিলাম ওজন ছিল ৯ পাউন্ড। এই জন্যই হয়ত মায়ের এই অনুভূতি। আর সব মায়ের কাছেই তার সন্তান সুন্দর। বরিশালে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে
“হউলের পোনা,চ্যাঙের পোনা
যার রক্কে হের হোনা”
অর্থ- শোল মাছের পোনা অথবা টাকি মাছের পোনা, নিজেদের পোনা তাদের কাছে সোনা।

দেখতে কার মতো হয়েছি তখনও বলা যাচ্ছে না,সবাই উদঘাটন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মধ্যে কে যেন বলল রঙ হয়েছে নানার মতো,আমার নানা দুই গাল প্রশস্থ হাসি নিয়ে বারান্দায় বসলেন,এবং ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে চা ও নাশতার দিকে মনোযোগ দিলেন,সাথে ছেড়ে দিলেন উচ্চস্বরে রেডিও, পাকিস্তান থেকে আনা রেডিও। তখন বাংলাদেশ বেতারের যুগ। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বেতারে চলছে আবৃতি “ বল বীর……………… শিখর হিমাদ্রির”

অভাগা আমি তখন শুয়ে আছি,আমার কানে আজানের আগে ঢুকল বিদ্রোহী কবিতা। যখন বেতারে জহুরের আজানের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তখন সবার টনক নড়ল,খোজ পাঠানো হোল মফাজ্জাল নানার। তিনি তখন পুকুর ঘাটে গোসল করছেন। উনি এলেন এবং আমার কানে আজান দিলেন। কিন্তু কি লাভ!! সর্বনাশ যা হবার তো হয়েই গেছে।

ডাক্তার হিমেল সরকারকে ২০০০ টাকা নিতে বললেন আমার নানা,কিন্তু হিমেল সরকার কোন ভাবেই টাকা স্পর্শ করে দেখেননি। বহু চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে আমার নানি তার একখানা জামদানি শাড়ি উপহার দেন ডাক্তার হিমেলকে। বিবাহিত ডাক্তার সেই উপহার ফিরিয়ে দেননি।
কে জানত আমার জন্ম,জন্ম দিয়েছিল আরও একটি কাহিনীর,যার সূচনা সেই দিন থেকেই।
সে কথায় পরে আসছি, জন্মের পর মিষ্টি বিতরণ, শোনা যায় আমার নানা আশে পাশের ৪০ ঘর পর্যন্ত মিষ্টি বিলিয়েছিলেন,কারণ ইসলামে বলা আছে ৪০ ঘর পর্যন্ত সবাই প্রতিবেশী। কাহিনীর সত্যতা জানা জায়নি,কারণ অনেক ঘরই এখন আর নেই,যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি সবাই হেসে বলেছে “ তোমার জন্মের মিষ্টি খাইচি গেদু (বাচ্চা/বাবু)”

আমার বাবা তখনও আমার জন্মের কথা জানেন না,বেচারা অপেক্ষা করছেন আমার মায়ের ফেরার। তখন লঞ্চ এবং স্টিমার উভয় চলত,সেখানে সারেং এর মাধ্যমে মিষ্টি আর খবর পাঠানো হোল আমার জন্মের। পরের দিন সকালে ঢাকা থেকে এসে উপস্থিত হলেন আমার বড় ফুপি এবং ফুপা। তাঁরা অবশ্যই আমার জন্মের খবর জানতেন না,মাকে দেখতে এসেছন। বড় ফুপা নিয়ে এসেছেন এক কুড়ি ইলিশ মাছ আর এক কার্টুন কমলা। আমার রূপ চেহারা দেখে বড় ফুপি খুব মুগ্ধ হলেন,নিজের গলার চেইন খুলে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কোলে নিয়ে ফুপি আমাকে সারা বাড়ি হেটেছেন আর বলেছেন “ মনু তুই এত শাদা,তুই গিরিবাজ কইতরের লাহান শাদা”

আমাকে মা যখন এই কথা বলেন আমাকে বলেন,আমি প্রশ্ন করি “ শাদার মাহাত্ত বুঝলাম না আম্মু”
মা বলেন তিনি দেখতে শ্যামলা ছিলেন,এই জন্য সবার ধারনা ছিল বাচ্চাও কালো হবে,কিন্তু যেহেতু আমি ফর্শা হয়েছি এই জন্য সবাই মাত্রাতিরিক্ত খুশি হয়েছে। আর সেই সাথে প্রথম সন্তান ছেলে,এটা আলাদা একটা গর্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক পুরুষই এক একটা ট্রাম কার্ড। আমার হিসাবই বা তার বাইরে হবে কেন?

টুইস্টিং রোমান্স

এখন আবার একটু পেছনে ফিরে যাচ্ছি
একটা বড় খাওয়ার আয়োজন করা হোল নানাবাড়িতে, মূল উদ্দেশ্য ডাক্তারকে খাওয়ানো,এবং সেই সাথে নিজেরা ভালো মন্দ খাওয়া। গরু গরু রব উঠলেও শেষমেষ দফা রফা হয় খাশিতে। কারণ ডাক্তার হিমেল গো মাংস ভক্ষন করেন না।
খাশি জবাই করলেন মফাজ্জল নানা,চামড়া ছিলেছেন আমার নানা নিজে,বিকালের দিকে আসলেন ডাক্তার সাহেব। আমেনা খালা চলে এসেছিলেন সকাল সকাল, নানিকে পিঠা বানাতে সাহায্য করেছিলেন। মূল খাওয়া দাওয়া শুরু হয় সন্ধ্যার পর, বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল এই ভোজনপর্ব শেষ হতে। নানি টিফিন কেরিয়ারে করে মাংশ আর পিঠা দিয়ে দিলেন ডাক্তারকে। রাস্তায় অন্ধকার তখন,হ্যাজাক দিয়ে ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন আমার নানা। কিন্তু
আমেনা খালা বললেন তার কাছে টর্চ আছে, ডাক্তার সাহেবকে তিনি বড় রাস্তায় ছেড়ে,সেখান থেকে বাসায় ফিরবেন। খুবই উত্তম প্রস্তাব।
ছোট্ট ঘটনাটার সূচনা এখানে,সেই রাতে আর বাসায় ফিরে যাননি ডাক্তার সাহেব। বড় রাস্তায় বা বাজারেও তাকে কেউ দেখনি সেই রাতে,বরঞ্চ দেখেছে পরদিন কাক ডাকা ভোরে।

এর পরে তাদের দীর্ঘদিনের প্রেম চলেছে,ডাক্তারের স্ত্রী থাকতেন তার গ্রামের বাড়িতে। আমি আমার মা না থাকলেও তখন তুষখালিতে ডাক্তারের আসা পড়ত সপ্তাহে কমপক্ষে দু বার। সেইদিন গুলোতে আমেনা খালা ভালো মন্দ রান্না করেন,রসের পিঠা বানান।
সেই পর্যন্ত সেই ভালোবাসা তিক্ততায় পরিনত হয়, আমেনা খালা ডাক্তারের সাথে ঘর বাধতে চান, ডাক্তার বার বার বুঝিয়ে বলতে থাকেন আমেনা খালাকে,শেষ পর্যন্ত আমেনা খালা এলাকার কয়েকজন শাণ্ডা পান্ডা দিয়ে ডাক্তারকে চাপ প্রয়োগ করেন।

ডাক্তার তুষখালিতে ৩ কানি ধানী জমি কিনেছিলেন,তিনি আমেনা খালাকে সেই জমি লিখে দিয়ে মঠবাড়িয়া ত্যাগ করেন। আর কোনদিন তিনি ফেরেননি পিরোজপুর জেলার আশে পাশে।

ভিজিটিং আমেনা খালা

গত জুলাই মাসের শেষের দিকে এক প্যাকেট মিষ্টি আর একটা শাড়ি নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমেনা খালার সাথে। খালা এর আগে সব সময় নিজেই আমাকে দেখতে আসতেন,যতবার মামা বাড়ি গিয়েছি ঠিক ততবারই।
আমেনা খালা আমাকে দেখে খুবই খুশি হন,সেই সাথে বিদেশে থাকি জেনে তার হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমারে লেবুর শরবত আর আম কেটে দিলেন খেতে, তার কাছ থেকেই উপরোক্ত অনেক ঘটনা শোনা।

তিনি খুব রসিক কথাবার্তা বলেন। এই যেমন আমি নাকি ছোট বেলায় তার তোষকের নীচ থেকে কনডমের প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম,তারপর কনডম এর মধ্যে বাতাস ফুলিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে সেই বেলুন নিয়ে খেলা করেছি। শুনে আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল,আর খালা তখন খিক খিক করে হাসছেন। আমি সাহস করে ডাক্তারের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,তিনি হেসে বললেন “ জাইন্না তুমি কি করবা গেদু?” আমি বললাম এমনিতেই জানতে চাচ্ছি।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
“ প্রেমের ফাদ পাতা এ ভুবনে
কে কোথায় কখন ধরা পরে কে জানে!!”
খালার জন্য যে আমার সহানুভূতি উপচে পড়েছিল এটা বলব না,কিন্তু খারাপ লেগেছিল,কারণ তিনি সব জেনেই ডাক্তারমুখো হয়েছিলেন।

খালা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন, আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করি,কিছু উত্তর হয়ত জানি কিছু হয়ত জানি না। খালা বলেন “ তোমার চোখে তো রঙ লাগছে গেদু,শাদা সোনার রঙ”
আমি বুঝতে না পেরে মানে জিজ্ঞাসা করি । খালার সরাসরি উত্তর “ বিদেশী মাইয়াগো শাদা বুনি খাইছ গেদু,এখন কি আর দেশী বুনি স্বাদ লাগবো?”

উত্তর না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে আমি চুপচাপ বসে থাকি। খালা আরও বলেন ইসলামের ইতিহাসের কথা,যখন মুসলমানেরা দুনিয়া শাসন করেছেন তখনকার সময়ের শান্তির কথা। আমি হাই তুলে খালার কথা শুনি। বিদেশী মেয়েরা নাকি কুকুরের মতো পুরুষ বদলায় এমন প্রশ্নে আমি খালাকে কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না যে সেখানের সমাজ ব্যবস্থা আর আমাদের সমাজ সম্পূর্ণ আলাদা,আমি বোঝাতে পারিনা,সেখানে মেয়েদের গায়ে হাত তুললে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়,সেখানে মেয়েরা পুরুষের মতো কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে,আয় করে,সন্তান পালে। আমি বোঝাতে পারিনা সেখানের মেয়েদের ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে।
খালা আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলতে থাকেন,খালা বলেন যারা রাস্তায় চুমু খায়,পুরুষের হাত ধরে রাস্তায় হাতে,ছোট কাপড় পড়ে তাদের আবার কিসের সমাজ? কিসের ধর্ম?

আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি, পরাজিত আমি। কুশিক্ষার কাছে যুক্তির মূল্য যেখানে শূন্য।

মফাজ্জল নানা বচন

এরপর আমি শাদা লুঙ্গি আর মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যাই মফাজ্জল নানার সাথে। তিনি সদ্য শ্বশুর হয়েছেন,তাই শাদা লুঙ্গি। এই বুদ্ধি দিয়েছেন আমার ছোট মামা,তিনি আবার খুব সংসারি মামা, মালয়শিয়া ছিলেন দীর্ঘদিন,ফিরে এসে ঘোষণা করেছেন “ নানা,তাকে স্বপ্নে বলেছেন তালুকদার বাড়ির মেয়ে সীমাকে বিয়ে করতে” স্বপ্ন আর নানার কথা শুনে সবাই চট জলদি মামার বিয়ে ঠিক করে সীমা মামির সাথে। তখন কারো মনে ছিলনা যে এই সীমা মামিকেই মামা স্কুল জীবনের শেষ ভাগে আর কলেজ জীবনের প্রথমভাগে অনেক চিঠি লিখেছিলেন। বানান ভুলের কারনে মামি অধিকাংশ চিঠি আবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এবং মামি এখনও সেটা গর্ব করেই বলেন। অবশ্য মামি ইন্টার পরীক্ষায় পাশ না করতে পারার পর মামাও তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তিরস্কারের দাত ভাঙা জবাব দেন।

যাই হোক মজাজ্জল নানা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেন,বলেন আমার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে,ছোট বেলায় আমি একদম পোটকা মাছের মতো মোটাসোটা ছিলাম। সেখানে মফাজ্জল নানার বউ নিয়ে আসলেন ডাবের পানি আর চিড়ার মোয়া। ডাক্তারি পড়ছি শুনে মফাজ্জল নানা হুংকার দিলেন “ বউ,আমার ডাক্তারের কাগজটা নিয়ে আসো দেখি”
মিনিট খানেক পর কাগজ নিয়ে আসলেন মফাজ্জল নানার পুত্রবধু,আমার মতো ধামড়া একটা ছেলে হাফ প্যান্ট পড়ে লোমশ পা বের করে বসে আছে এটা দেখেই মাথার ঘোমটা লম্বা করলেন পুত্রবধু,আমার হাতে কাগজ দেবার সময় চোখাচুখি হোল তার,আমি বুঝলাম বউ ট্যাঁরা।

আমি নানাকে বললাম ডাক্তারের দেয়া ওষুধ নিয়মিত খেতে। কারণ আমি এখনও পেস্ক্রিপশন বোঝার মতো পড়াশুনা শেষ করিনি। এর পর তার জীবন কেমন চলছে জানতে চাইলাম। নানা একসময় মসজিদের ইমাম হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন তিনি রাজত্ব করেছেন এলাকার মসজিদে। কিন্তু বিপত্তি বাধায় এলাকার এক হজ করে ফেরা আলেম, এক শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর তিনি সবার সামনে প্রশ্ন করেন “ সূর্যগ্রহন ও চন্দ্রগ্রহনকালীন নামাজের নাম কি ইমাম সাহেব?”
মফাজ্জল চাচা দীর্ঘ নীরবতার পরে বলেন তিনি এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। এর পরে থেকেই মুলত নতুন ইমামের আগমন,নতুন ইমামকেও একই প্রশ্ন করেন হজ ফেরত আলেম।
নতুন ইমাম মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় “ সূর্যগ্রহনকালীন নামাজের নাম “সালাতিল ক্যুসুফি” এবং চন্দ্রগ্রহণকালীন নামজের নাম “সালাতিল খুসুফি”

হজ ফেরত আলেম সম্মতি জানান,এর পর এলাকা জুড়ে হজ ফেরত আলেম এবং নতুন ইমামের দ্বীনের সুনাম ছড়িয়ে পরে। যদিও মফাজ্জল নানা মনে করেন এই উত্তর আলেম আগেই ইমামকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া এই তথাকথিত আলেম হজে যাবার আগে অনেক খারাপ মানুষ ছিলেন। আমি জানতে চাইলাম কেমন খারাপ মানুষ?
মফাজ্জল নানা উত্তর দিলেন,এই আলেম মদখোর ছিলেন,আর পোলাখোর। ওনার কাঠ বিক্রির ব্যবসা,কাঠের গুদামের পাশে অফিস,সন্ধ্যার পর তিনি অফিসের দোতালায় বসে আকণ্ঠ মদ খান এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে বাচ্চা ছেলে ভাড়া করে এনে নাচান। পোলাখোর শব্দটার মানে বুঝতে না পেরে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম।
মফাজ্জল নানা বললেন ” হালার পুতে পোলা খেলায়,পোলা ধইরা আইনা হোগায় দেয়।” মফাজ্জল নানার কথা থেকে আমি বুঝতে পারলাম হজ ফেরত আলেম সাহেব শিশুকামী এবং বিকৃত রুচির।

মফাজ্জল নানা আরও বলেন হজ করলেই আলেম হওয়া যায় না। এই এলাকায় মফাজ্জল নানার বাবা ছিলেন প্রকৃত আলেম,তিনি ছিলেন বোম্বাই হাজি। তখনকার সময়ে যারা হজে যাবার মনস্থির করে ঘর ছাড়তেন কিন্তু বিভিন্ন কারণ বশত বোম্বে শহর থেকে ফিরে আসতেন তাদের বলা হয় বোম্বাই হাজি। তখনকার সমাজে বোম্বাই হাজিদের খুব কদর এবং খাতির করা হত।

মফাজ্জল নানা এখন আছেন ভালই,শহরের উপরে একটা পাকা মার্কেট করেছেন,দোতালায় আওয়ামীলীগের অফিস,নীচে ভাতের হোটেল আর সিডি ভিসিডির দোকান। ভাড়া দিয়ে বেশ চলে যায় তার। তবে ইদানীং একটু টেনশনে আছেন,তার ছেলের দুবাই যাবার বিষয়ে এক দালালকে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন, দালাল আজ বলে এই ঈদে পাঠবো,কাল বলে কোরবানির ঈদের পর।

ছেলের বউ খুব ধার্মিক, গুদিকাঠা নামক এক জায়গার এক নামী পীরের মুরিদ। তবে মফাজ্জল নানার বউয়ের সন্দেহ তার পুত্রবধু বাঁজা মেয়েমানুষ। প্রায় ৮-৯ মাস হয়েছে বিয়ের এখনও কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
আমি বললাম,হয়ত তাঁরা ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিচ্ছে না,মাত্রই তো বিয়ে হোল। আমাকে বলা হোল নানার ছেলে নিতে চাচ্ছে বাচ্চা,কিন্তু হচ্ছে না। অতএব বউ বন্ধ্যা।
আমি বললাম নানি,হয়ত মামার( নানার ছেলে) সমস্যা থাকতে পারে,ডাক্তার দেখালে এবং টেস্ট করলে বোঝা যাবে,কোনটা সঠিক। স্বামী স্ত্রী আমাকে নিয়ে খুব একচোট হেসে নিলেন। আমি হাসি শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলাম। হাসি শেষে নানি বললেন
“মুরোদের পো মুরোদ হয় বুঝালা গেদু, আর বউয়ের বড় বোনের বাচ্চা হয়না,ধুমসি বুড়ি হয়ে গেছে,দুই বুইনের একই সমস্যা মনে হইতাছে”
আমি নতুন অনেক কিছু জেনে,শিখে চলে আসলাম।

শেষাংশ

এই মানুষগুলোর হাতেই আমার জন্ম হয়েছিল,আজ একটু স্মৃতিচারণ করলাম তাদের নিয়ে, আমার জন্ম তাদের কাছে হয়ত আরও ১০ টা সাধারন শিশুর মতই সাধারন, কিন্তু আমার কাছে এই মানুষগুলো অসাধারণ। তাদের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে,জানতে ভালো লাগে তাঁরা কেমন আছে,কিভাবে বেঁচে আছে।
আবার আমি দেশে গিয়ে এদের সাথে দেখা করবো, আবার আমার জন্মের গল্প শুনবো। আমার সামনের বছরের জন্মদিনে আবার হয়ত এই লেখাটা বের করে পড়ব,তখন আবার আমার রক্তে রক্তে বইবে আমার জন্মস্থান,এই প্রিয় মানুষগুলি।

২৫ শে মে,২০১২
সেন্ট পিটার্সবার্গ ( লেলিনগ্রাদ)
রাশিয়া।
( কাল রাতে মুক্তমনায় প্রকাশিত)

২,৩৯৬ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “জন্ম পদ্যের গদ্যরূপ”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    হামীম,
    খুবই ভালো লাগলো লেখাটা। নিজের কথা বলেছো ঠিকই, কিন্তু কতশত প্রসংগ ছুঁয়ে গেছো এরই মধ্যে!
    তোমার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম।
    উপন্যাস লেখার কোন প্ল্যান আছে?

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাল হইছে।
    বেশ ভালো।
    আর নুপুর দা তো কইছেই যা কওয়ার।
    আমার কথা একটাই; আগে সিসিবি, তারপর বাকি দুনিয়া।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।