তোমায় কিছু বলার ছিল

আজ আমি বলবোই। গত তিনদিন ধরে ভেবেছি কয়েকবার এই নিয়ে, ঘুরে ফিরে একটাই জবাব এসেছে- আমাকে বলতেই হবে।

বারবার একটা দুরাশঙ্কায় মন কুকড়ে যাচ্ছে। ‘না’ শব্দটার সাথে আমার আজন্ম বৈরীতা, সেটা যেই বলুক না কেন। তারপরো এক অক্ষরের এই ক্ষুদ্র শব্দটা মাঝে মাঝেই জীবনকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। আজ যদি ওর মুখ থেকেও না শুনতে হয়, তবে ভার্সিটিতে থাকার কোন ইচ্ছে বা কারণ আর অবশিষ্ট থাকবে না। কথাগুলো রজতকে বলতেই রূপচান্দা মাছের মতো একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “শোন বৎস্য, এযাত্রায় না বললে আর কখনোই তোমার বলা হয়ে উঠবে না। আজ বাদে কাল তোর ফলাফলের কাগজে শূন্যই উঠবে। সুতরাং, ভাবিয়া করিও কাজের প্রহসনটুকু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওকে এখনি বলে ফেল, যা।” “কিন্তু ও তো আমাকে ভালোভাবে চেনেও না, ক্লাশে নিয়মিত হলে অন্তত এই ঝামেলাটুকু এড়ানো যেত।”-আমার গলায় অস্থিরতার সুর খুব গাঢ় ভাবেই প্রকাশ পেয়ে গেল। রজত অবশ্য কিছু ভুল বলেনি। আজ যদি না বলতে পারি, তবে কাল হয়তো সবকিছু বাদ দিয়ে হলের ঐ ঘুপচিতেই বসে থাকতে হবে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম, একটু আগেই মিষ্টি রোদ্দুর ছিল, আজব ব্যাপার হঠাৎ এমন মেঘলা হলো কখন?? নাহ- আকাশটাও আজ বিদ্রূপ করছে, ধুর ছাই !!!

ঐতো, ঐতো ও চারুকলার সিড়িগোড়ায় বসে আছে। আরে !!! ঐ উজবুক প্রবালটা আবার কোথা থেকে এসে জুটলো। ও ব্যাটা ক্লাউনটাকে মেয়েরা এত পাত্তা দেয় কেন, বুঝি না। কী এমন মজার কথা বলছে গর্দভটা, যে ওমন হেসে গড়িয়ে পড়তে হবে ওকে, নাহ মেয়েটা এখন একটু বোকাই মনে হচ্ছে। এসব সাত পাচ ভাবনার দোদুল্যচাল হঠাৎই দমকা বাতাসের মতো ভেসে গেল। এতদিন তো কখনো খেয়াল করিনি, হাসলে বেশ মিষ্টি একটা টোল পড়ে ওর গালে। অবশ্য খেয়াল করবো কোথা থেকে, আমি তো লেকচারগুলোতে অমাবস্যার চাদ। আজ যদি ও রাজী হয়, তবে এখন থেকে প্রতিদিন ওকে প্রাণভরে দেখবো, ওর হাসির লহরীতে মন হারাবো।

রজতের ধাক্কায় সহসা ঘোর কেটে গেল। “গোবরবাবু আপনি কী ওর কাছে যাবেন, নাকী অশ্বত্থগাছের মতো শিকড় গেড়ে এখানেই বসে থাকবেন?? দেরী করলে কিন্তু লেট হয়ে যাবে, তখন কিন্তু অন্য কারো হয়ে যেতে পারে।” “অন্য কারো হবে মানে, অলুক্ষণে কথা বলিস কেন?? কষে একটা লাগালে বুঝবি।”- ধমকে উঠলেও মনের মাঝে ততক্ষণে কিন্তু সাইমুম শুরু হয়ে গেছে। এটা তো ঘুণাক্ষরেও ভেবে দেখিনি, সত্যি বলতে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঐ ব্যাটা প্রবাল বোধহয় সেজন্যই এসে হাজির হয়েছে।

আর দেরী করাটা ঠিক হবে না; চেয়ে না পাই তাও সই, কিন্তু কখনো না বলতে পারার কষ্টে ভিতরে ভিতরে ঢুকড়ে মরতে চাই না। ঝট করে উঠে দাড়ালাম। দু’পা এগিয়ে যেতেই রজত বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিলো…।” মেজাজটা তিরিক্ষে উঠতে আর কী চাই, একেই বোধহয় বলে কারো পৌষমাস, আর কারো সর্বনাশ। অসম্ভব বিরল প্রজাতির এই সুরলহরী অগ্রাহ্য করে আমি আস্তে আস্তে চারুকলার গেটের দিকে আগাতে থাকলাম। গেটের সামনে এসে থমকে দাড়ালাম, গতবার বৃষ্টিকে বলবার সময় একটু ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছিলাম, এবার আবারো অনাকাংখিত কিছু হোক- এটা চাই না। পকেট থেকে মোচড়ানো কাগজটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। পিচ করে এক দলা থুতু ফেলে পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে চলতে শুরু করলাম। বেশ বুঝতে পারছি হাতের তালুটা ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। বিধাতা বোধহয় আর্তের সহায় হতে একটু বেশি সময় নিচ্ছেন আজ।

আচমকা প্রবাল উঠে দাঁড়িয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তুই একটু বস, আমি আসছি।” যাক বাবা বাচা গেল, ওর সামনে কিছু বলতে হবে না। ঢোক গিলে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ওর মোহময় জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপেক্ষা করে হঠাৎই গড়গড় করে বলে ফেললাম, “…………………………।” চারপাশে আমি আর কোন শব্দ পাচ্ছি না; সময় কী থমকে গেল, নাকী আকস্মিকতা আমাকে বধির করে দিয়েছে!!! মিষ্টি হাসিতে আমায় ভাসিয়ে ওর রিনিঝিনি কন্ঠের উত্তরটা কানে এলো, “স্যরি, আমার নোটগুলো তো গতকালই সুমি নিয়ে গেছে, ইশ্ তুমি কালকে চাইলেও দিতে পারতাম। সত্যিই দুঃখিত।”

অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা নিঃশ্বাসগুলো, দীর্ঘশ্বাসের ছন্দে বেরিয়ে এলো। ধন্যবাদটা বিনা খরচায় ওকে দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। দিব্যি করে বলছি, এ যাত্রা পাস করে গেলে, পরেরবার থেকে সত্যিই ক্লাশ মিস দেবো না। :bash: :bash:

৫,১৮৫ বার দেখা হয়েছে

৬০ টি মন্তব্য : “তোমায় কিছু বলার ছিল”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল শেষে একটা টুইস্ট থাকবে। হলও তাই।

    ভালো লিখেছ রকিব। লেখার হাত অনেক ভাল। :thumbup: :thumbup:

    (অফটপিকঃ কয়েকটা বানান ভুল দেখেছিলাম। ঠিক করে দিও। পড়তে আরাম লাগে।)

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    "আমাকে বলতেই হবে" আমাদের এই পিচ্চি ভাইটার লেখায় যথেষ্ট সাবালক। :thumbup: :thumbup:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    শাব্বাস রকিব... :clap:
    তোর লেখা দেখি অনেক পরিনত... :thumbup:
    এখন থেকে তোরে পাংগানোর আগে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হবে দেখছি... :dreamy:

    (অনেক চিন্তা ভাবনা করে)
    যা এবার দশটা ফ্রন্ট্রোল দে... 😛
    বেশি বেশি লিখিস না কেন??? 😡


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. সামিয়া (৯৯-০৫)

    চরম চরম, খুব সুন্দর লিখা, একটু প্যারা ভাগ করে দিলে বোধ হয় আরও ভাল হত। টুইস্টটা দারুণ ছিল।
    লিখাটা পরে মনে পড়ে গেল, আগামী টার্মে ঠিক এইরকম করে মনে হয় আমার কারুকে বলতেই হবে :bash: :bash:

    জবাব দিন
  5. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    সবাই জুনা ভাই এর মত হইতেছে নইলে আন্দালিবের মত। কেউ লাস্টে এসে ঘটনা ঘুরায় আবার কেউ কখন ঘটনা ঘুরায়,শুরু করে কিছুই বুঝিনা।
    ভাল লেগেছে রকিব লেখাটা। নিয়মিত লেইখো।

    জবাব দিন
  6. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    দারুন দারুন সব লেখায় সিসিবি পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে, এই অনুভূতিটা যে কি আনন্দের :hug:
    রকিব খুব ভাল্লাগছে, সাব্বাশ ব্যাটা :clap: :clap:
    আজকে কফি চাই বাডি :thumbup: :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।