কলেজে পা রেখেই যে কয়েকটি চমকপ্রদ কথা শুনেছি তার মধ্যে একটি হচ্ছে “ ক্যাডেট সব পারে”। অবশ্য স্যার ম্যাডামদের মুখে এই কথাটা অনেক সময় ব্যাঙ্গাত্মক রূপে উচ্চারিত হত। যাই হোক, ক্যাডেট দ্বারা তেমনই একটি অসাধ্য সাধিত ঘটনা আমি সবাইকে জানাতে চাই। ছোট্ট একটি প্রমাণ দিতে চাই , আসলেই ক্যাডেট সব পারে।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সম্ভবত আমাদের এস এস সি পরীক্ষা ছিল। তাই সম্ভবত অক্টোবর বা নভেম্বরে আমাদের টেস্ট পরীক্ষা হয়েছিল। আমাদের ব্যাচের মানবিক বিভাগে সর্বমোট ছয় জন ছিল। মানবিক বিভাগের সকলেরই কেন জানি সাধারণ গণিতের প্রতি একটা বৈরীভাব ছিল। ওদের মধ্যে ২/১ জন টেষ্ট পরীক্ষার আগেও সাধারণ গণিতের কণ্টকময় পথের কাটা সরাতে পারছিল না। তাই ওরা খুব চিন্তায় ছিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সেই কয়েকজনের জন্য সেই ভয়াল পরীক্ষা। সাধারণ গণিত পরীক্ষার হলে ঢুকার আগে ওদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। যথারীতি পরীক্ষা শুরু হলো। আমি আমার যে বন্ধুটির ঘটনা বলছি তার নাম এখানে উল্লেখ করছি না। এক্ষেত্রে তার ছদ্দ নাম দিচ্ছি X। এর পরীক্ষার হলে গিয়ে তো আত্মারাম খাচা ছাড়া। ডিউটিতে পড়েছে সব চাইতে কড়া স্যার বাংলার আবু মহম্মদ রইস। প্রশ্ন পাবার পর দেখা গেল ও কেমন ছটফট করছে। একবার ডানে তো একবার বামে। পরীক্ষা শুরু হবার ১০ মিনিটের মাথায় ধরা খেয়ে গেল। স্যার এসে বললেন দেখি তোমার খাতা। একি ১০ মিনিট চলে গেছে এখন তো তুমি খাতায় কলমের একটা আচড়ও দাও নি। কি ব্যাপার। ও তো ভয়ে শেষ। এখনই বুঝি কিছু উত্তম মধ্যম পড়বে গালের উপর। কিন্তু না কেন যেন স্যার দয়া পর্বশ হয়ে ওকে মারলেন না। বললেন তুমি যখন কিছুই লিখনি তাই শাস্তি স্বরূপ ২ নম্বর কর্তনা করা হলো। খাতার উপর লাল কালি দিয়ে -২ কথাটা লিখে দিলেন বড় করে। পরবর্তি ৩ ঘন্টা দেখলাম X অনেক কিছুই লিখল খাতায়। আমরা ভাবলাম এবার হয়তো পাশ করবে। টেষ্ট পরীক্ষা বলে কথা। পরীক্ষার পর জিজ্ঞাসা করলাম দোস্ত কেমন হলো? ও কিছু বলল না। ভাবলাম হয়তো খুব একটা ভালো না হলেও খারাপ হয়নি মনে হয়। যথারীতি আমরা পরবর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। যতদূর মনে পড়ে পরের দিন কোন পরীক্ষা ছিল না। তাই ঘুম থেকে একটু দেরী করেই উঠেছিলাম। তবে ঘুম থেকে ওঠাটা একটু অস্বাভাবিকই ছিল। জাহাঙ্গীর হাউসে কিছুটা হট্টগোল শুনতে পেলাম। সবাই একে একে বারান্দায় বেরিয়ে এলো। যখন জিজ্ঞাসা করলাম তখন জানতে পারলাম যে আমাদের বন্ধু X রুমে নেই। সে চলে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না কেন সে কলেজ পালালো। এটা কোন সাধারণ পালানো নয়। তাহলে তো অন্তত ব্রেকফাষ্টের আগে চলে আসত। ধীরে ধীরে কলেজের প্রতিটি লোক এই ঘটনা জেনে গেল। তার পর যা হবার তাই। বিশেষ তদন্ত আদালত গঠন, রমমেটদের জবান বন্দি গ্রহন, এবং বিভিন্ন ভাবে ঘটনার রহস্য বের করার প্রচেষ্টা কলেজের শিক্ষক কাম ফেলুদাদের। তবে সবাই সেখানে ফেলুদা কিন্তু তাদের কোন সহকারী ছিলেন না। এভাবে ২/৩ দিন যাওয়ার পর যখন সাধারণ গণিতের খাতা নিয়ে তাজুল স্যার ক্লাসে এলেন তখন ঘটনাটা অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো। আমাদের সেই বন্ধুটি সাধারণ গণিতে পায়েছে ১০০ তে -২। আমরা তখন বাকরুদ্ধ, হতবাক। এ কি করে সম্ভব??????!!!!!!!! তারপর স্যার ব্যাখ্যা করলেন হাসতে হাসতে এভাবে যে, সে অনেক গুলো অঙ্কই করেছে পরীক্ষার খাতায় কিন্তু একটিও হয় নি। আর খাতার উপরে যে নম্বর কর্তন হয়েছে সেই হিসাবে সে পেয়েছে এই নম্বর। যথার্থই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা। সযারের হাসি দেখে আমাদের খুব রাগ লাগছিল। কিন্তু কি করব? এদিকে X এর বাসায় সংবাদ দেয়া হলো কিন্তু সেখানেও সে যায় নি। তাহলে সে কোথায়? তারপর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হলো ফিরে আসার জন্য। কয়েকদিন পর আমরা জানতে পারলাম তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে সেনাসদর থেকে বলা হয়েছে। আমাদের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। আমরা তখন ভাবছিলাম তাহলে কি ও পরীক্ষাটা এ বছর দিতে পারবে না? তাও আবার অধ্যক্ষ তখন ভূ-গোলের দেলোয়ার স্যার। যিনি কি না মির্জাপুরে রইস উদ্দিন স্যারের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। যিনি কি না আমাদের কলেজে অভিভাবক তলব করা, বেতন বৃদ্ধি, জরিমানা ইত্যাদি অপসংস্কৃতির প্রচলন করেছিলেন। তাই আমরা আরও চিন্তায় ছিলাম। এই লোক কি X এর পরীক্ষার জন্য সেনাসদরে সুপারিশ করবেন? কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে খবর এলো আমাদের বন্ধুটি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবে ঠিকই কিন্তু তাকে সাদা পোষাক পরিহিত অবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে। আমরা খুব খুশি হলাম। অবশেষে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। X রংপুরেই এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে পরীক্ষাগুলো দিচ্ছিলো। সে সকালে আসত আর পরীক্ষার পর চলে যেত। সেবারই মনে হয় শেষবার কলেজে পরীক্ষা হয়েছিল। যা হোক খুব কম সময়ের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কারণ পরীক্ষার ৩ দিন পরই ছিলো ঈদ।তাই আমরা ব্যাবহারিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য ঈদের পর আবার কলেজে এসেছিলাম আর তখন শুধু আমরাই ছিলাম আর কেউ না। যা হোক যেদিন ব্যাবহারিক পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরছি। সেদিন রংপুর রেল ষ্টেশনে X কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম দোস্ত তুমি যদি কোনরকমে ষ্ট্যান্ড করে ফেল তাহলে কলেজ একটা ভাল জবাব পাবে। সে হাসতে হাসতে বলেছিলো দোস্ত বলা যায় না করেও ফেলতে পারি। আমি তখন অনেকটা ভদ্রতার খাতিরেই বলেছিলাম ইনশাল্লাহ দেখিস তুই খুব ভালো রেজাল্ট করবি। সেই যাত্রাই X এর সাথে শেষ যাত্রা। ধীরে ধীরে ফলপ্রকাশের দিন ঘনিয়ে এলো। সবাই নিজেদের ফল জানার পর আর সবার খবর নিচ্ছিল। পত্রিকায় ফলাফল দেখলাম। বিজ্ঞান থেকে ২ জন আর মানবিক থেকে ৫ জন পর্জন্ত দেখে আর দেখলাম না। হিসাব করলাম ৭ জন। আর অন্য কলেজের ক্যাডেটদের সাথে ফলাফল নিয়ে আলোচনা করছি। ২ দিন পর জাহিদদের বাসায় গিয়ে যখন বলছিলাম যে মানবিকে গেলেই ভালো করতাম। দেখ ৬ টার মধ্যে ৫ টাই ষ্ট্যান্ড করেছে। সে আমাকে বলে ৫ জন কে বলেছে ৬ জনই তো করেছে। আমি ভাবলাম ফান করেছে। একটু পর সে আমাকে পত্রিকা এনে দেখালো ৬ জনের নাম। এবং ৬ষ্ঠ ব্যাক্তি হিসেবে যার নাম দেখলাম সে আর কেউ নয় আমাদের বন্ধু X। মানবিক বিভাগ থেকে সে ১৬ তম স্থান অধিকার করেছে। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটা কি করে সম্ভব?????? যে ছেলে পরীক্ষার আগে ১ মাস পড়াশুনাই করতে পারে নি, কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়ে গেলো, পরীক্ষা দিতে পারে কি না তার নাই ঠিক সে ষ্ট্যান্ড করেছে। এর চাইতে বড় মিরাকেল কি হতে পারে!!!!!!! আমি নিজের ফল জেনে যতটা খুশি হয়েছিলাম তার চাইতে কোন অংশে কম আনন্দিত হইনি X এর ফলাফল দেখে। খুশিতে আমি কেদে ফেলেছিলাম। আর মনে পরছিল তাজুল স্যারের ব্যাঙ্গাত্মক হাসিমাখা মুখটা। আর কষ্ট লাগছিল এই ভেবে যে কলেজ জীবনের বাকী ২ টা বছর আমরা X কে আমাদের আনন্দমাখা মুহুর্তগুলোতে পাব না।
মেনে নিচ্ছি এটা সৃষ্টি কর্তার কোন এক লীলাখেলা। কিন্তু এই লীলা খেলার যোগ্য খেলনা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন একজন ক্যাডেটকেই। এই জাতিটার উপর মনে হয় সত্যিই সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দৃষ্টি আছে। তাই ক্যাডেট এর দ্বারা অনেক অসাধ্যই সম্ভব। ক্যাডেট কলেজ চিরজীবি হোক।
৫৫ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট সব পারে”
মন্তব্য করুন
🙂
হুম।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
X ভাইয়ের রেজাল্টে আমরাও অবাক হইছিলাম। X ভাই :thumbup:
চমৎকার। :thumbup:
আরে দোস্ত বিয়াপক লাগছে। 😀 😀
:hatsoff:
:hatsoff: X ভাইয়ার জন্য
সাব্বাস :thumbup: :thumbup:
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
:clap:
আররে মুহিব তুইইইইইইই 😀
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহসান তুইইইইইই......
আরে মুহিব অ্যান্ড আহসান তুই.........।
আরে স্যার আপনি!!!
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মামুন স্যার এতদিন কোথায় ছিলেন ? নাটোরের...............
নাম গোপন না করলেও চলত কারণ এক্স ভাইয়ের কাহিনী কোন লজ্জার কাহিনী না,বরং উনার অদম্য মনোবলের গল্প যা আমাদেরকে উৎসাহ যোগাবে।ভাইয়াকেও এখানে আনা যায়না?
নামটা গোপন থাকাই ভাল। ওকে বলে দেখব আসে কি না?
:boss: :boss: :boss:
এক্স তো পাথরায়... ওকে :salute: :salute:
পোষ্টের শিরোনামই সব কিছু বলে দেয়। :salute:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
:salute: X ভাই ।
মুহিব্বুল ভাই কেমন আছেন ?
আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছ? কোথায়?
এক্স ভাইরে :hatsoff:
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
:hatsoff:
Life is Mad.
:boss: :boss:
:boss:
:boss: :boss: :hatsoff:
@ মুহিবঃ তোয়ার লেখা এককথায় অসাধারান।
@ এক্সঃ :hatsoff: :boss: :salute:
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ধন্যবাদ ভাইয়া। :tuski: :party: :tuski:
:hatsoff: :hatsoff:
দোস্ত কেমন আছিস?
তোদের সবার সাথে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। কেমন আছেরে সবাই? মির্জাপুরের দিনগুলা মনে পড়ে হকির?
দোস্ত আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। বর্তমানে আইভোরিকোষ্টে আছি। মির্জাপুরে হকির সেই দিনগুলো কোনদিনই মনে হয় ভুলবো না। সেই থ্রি সি সি উল্লাস আরও কত কি। এইটা নিয়া একটা ব্লগ লিখে ফেলতে পারিস।
তুই দ্রগবার দেশে? 🙂
কলেজআউটের মতো চরম শাস্তি বন্ধ হওয়া উচিত.......টিন-এজার ছেলেমেয়েদের সামলাতে না পারার কোন কারন বা সুযোগ-ও নেই
X... সাবাশ ব্যাটা বাঘের বাচ্চা...
মুহিব,
লেখা সুন্দর হইছে...
এইখানে একটা ভুল info দেয়া হইছে। X ১০০ তে ৩ পাইছিল এবং ৫ কর্তন করা হইছিল। 🙂
ভাই আমার একখান অবজেকশন আছে। হেই কালে "বদনা" দেলওয়ার প্রিন্সিপাল ছিল না, লে. ক. মোকাররম ছিল প্রিন্সিপাল।
X ভাই :salute: :salute:
X ভাই এখন কোথায় আছেন?
সেই এক্স ভাইয়া এখন লন্ডনে পড়ালেখা করে অইখানেই সেটল
Islam, CCR (1996-2002)
:boss:
মেনে নিচ্ছি এটা সৃষ্টি কর্তার কোন এক লীলাখেলা। কিন্তু এই লীলা খেলার যোগ্য খেলনা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন একজন ক্যাডেটকেই। এই জাতিটার উপর মনে হয় সত্যিই সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দৃষ্টি আছে।
মুহিব্বুল ভাই, :salute: :salute:
এক্স ভাই :salute: :salute:
মারহাবা :clap:
থ্যাঙ্কস।
Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet
:clap: :boss:
:boss: :boss: এক্স ভাই
হা হা, ক্যাডেট কলেজের ডাইনিং এর ডালে জাদু আছে......
:thumbup: :))
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
=))
Arts পাটি :goragori:
hhhhhmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmmm
আপনাদের ক্যাডেট কলেজের ঘটনা জেনে খুব মজা লাগল। তবে turnout এর সিস্টেম বন্ধ করা উচিত।
::salute:: ::salute::
:just: ::salute::
I wsh i cld b cadet jst lke X bhaia...HATS OFF BHAIA..
ভাই ক্যাডেট আসলেই সব পারে 😛
arts পইরা এখন PGCB এর tender e technical biding করতে হচ্ছে =))
::salute:: ........ X VAIA
=))
:boss: :boss: ::salute:: ::salute::