মা কে নিয়ে সবাই খুব সুন্দর সুন্দর পোস্ট দেয়। আমি তো এমনেই বাজে লেখক; একটা যাচ্ছেতাই সিরিজ লিখছি, মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে অন্য পোস্ট দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা ভাই-বোন-সকল সবাইকে বলছি – খেই হারানো পোস্ট না। ক্যাডেট কলেজ ব্লগে আমার আম্মুকে নিয়ে কখনো কিছু লেখা হয়নি। এই সুযোগে দিলাম একটা।
আবেগের কথা বেশী লিখব না। ওটা লিখতে গেলে মন খারাপ হয়ে যাবে। সেই মন খারাপ সহজে ভাল হতে চাইবে না। Better আম্মুকে ঘিরে ছোট ছোট কিছু ঘটনা শেয়ার করি। ঘটনাগুলোতে মা’র আদর শাসন ভালবাসা সবই আছে যেগুলির সাথে আমার শিশুবেলার কিছু আকাম-কুকামও জড়িত আছে। মূলতঃ সেগুলিই লিখছি। অন্যান্য বিষয়-ও থাকবে চিন্তা নাইঃ–
ঘটনা ১
ছোটবেলায় একবার বাসায় আমাকে রেখে বাসার সবাই গেছে বাইরে। আমার আবার একটা ব্যাপার ছিল এরকম যে একটা খেলনা নিয়ে খেলতে থাকলে সেটা দিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতাম, এদিক সেদিক মনযোগ দিতাম না। তাই বাবা-মা নিশ্চিন্ত মনে আমাকে বাসায় রেখে বাইরে গেছে কি কাজে।
এদিকে আমি করেছি কি, বাসা রেকি করতে বেরিয়েছি। সারা বাসা ঘুরে দেখছি। একা, কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগছে। একবারের জন্যও মনে হয়নি যে বাসায় কেউ নাই আমি পুরা একা, যেটা সাধারনত বাচ্চাদের হয় এবং ভয় পেয়ে যায়। এরকম ঘুরে ঘুরে বেড়াই বাসার ভেতর, এটা ওটা নাড়ি, কিন্তু নষ্ট করি না, আবার জায়গা মত রেখে দিই। এরকম করতে করতে একসময় বাসার দুই বেডরুমের ইন্টারসেকশনে রাখা পেপার বাস্কেটটার কাছে আসলাম। কি ফালানো আছে দেখার জন্য ঊঁকি দিলাম। দেখি, আমার আব্বুর শেভিং রেজর। তুলে নিলাম। মাথায় কি খেলল জানিনা, ওটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
কি করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি সেটা তো সবাই ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন। এই ধরনের কোন বিষয়ই মাথায় আসল না যে ওটা ট্র্যাশ করা আইটেম, ময়লা-জীবাণু থাকতে পারে, অসুখ করতে পারে ইত্যাদি। আমি সুন্দর মত ওটা দিয়ে আব্বুর মত ভাব নেবার জন্য মুখের উপর চালাতে লাগলাম। আব্বুকে খেয়াল করতাম রেজর দিয়ে সুন্দর করে গোফটুক রেখে আশেপাশে দিয়ে কাটতে। আমিও সেরকমই অনুকরণ করার চেষ্টা করলাম। আর ওরকম বাঁকাত্যাড়া করে রেজর নাকের পাশ দিয়ে চালাতে গিয়ে একসময় ঘ্যাঁচ করে গেল কেটে। এবং ঠিক ঐ সময়ই বাবা-মা বাইরে থেকে ফিরলেন। আমি উ-উ-উ করে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে হাজির হলাম তাদের সামনে। তারা দু’জনই আমার অবস্থা দেখে প্রথমে স্পেলবাউন্ড হয়ে গেলেন। তার পর তো শুরু হল ছোটাছুটি। একমাত্র ছেলে তো, তাদের টেনশনের পরিমানটা-ও ছিল সেরকম। প্রথমে আম্মু জায়গাটা পরিস্কার করে সেখানে ঔষধ লাগিয়ে দিল; এবং তারপর পরিস্থিতি যখন একটু নরমাল হল, তখন মার লাগিয়ে দিল। 😛
ঘটনা ২
বাসায় একবার একটা ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের দাওয়াত। ছোটবেলার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনিন্দ্য (রাকিব CCR) আর আমি খেলাধুলা করছি বাড়িময়। ও ছোটবেলা থেকেই ছিল মহা চাল্লু। যত রকমের উদ্ভট টাইপের বুদ্ধি সব ও দিত। এ জন্য মার-ও কম খেত না তার মা’র কাছে। তো সে এবার হঠাৎ একটা বুদ্ধি বের করল যে, আমার যত খেলনা আছে সব বের করা হবে (বেশির ভাগ গাড়ি জাতীয়), সেগুলি হাত দিয়ে ভো ভো করে চালিয়ে জানালা দিয়ে ‘জাম্প’ করিয়ে দেওয়া হবে, হেব্বি একশন হবে। আমি ছিলাম এক রাম ভোদাই (এখনো আছি), আমিও খুব রাজি হলাম — তাই তো! সেরকম একশন হবে, ইংলিশ ছবির মতন! মহানন্দে আমরা একটা একটা গাড়ি বের করছি, আর জানালা দিয়ে ফেলছি। সেগুলি জানালা দিয়ে বাইরে ৪ তালার উপর থেকে পড়ে ঠাস ঠাস করে শব্দ করে চুরমার হচ্ছে, সেই আওয়াজ শুনে আমরা মনের ভেতর থ্রিল অনুভব করছি – “আরে, পুরা একশন ছবি, সাউন্ড ইফেক্ট সহ!!” বিরাট আনন্দ…
একটু পরে আম্মু যেই না বাচ্চারা কি করছে খোঁজ করার জন্য রুমে এসেছে, আর দেখে এই কান্ড! আমার যত খেলনা ছিল প্রায় ৯০% ভূপতিত, আর বাকিগুলি এখুনি সিনেমার জন্য কাস্টিং হয়ে গেল বলে!! তাড়াতাড়ি আম্মু এসে আমাদের থামালো। গৃহপরিচারিকাকে বলল নীচে গিয়ে ওগুলি উঠিয়ে নিয়ে আসতে। আনার পর দেখা গেল, সব শেষ! :(( … আম্মু তো আমাদের দু’জনকে বিশাল বকা দিল। এবং এর পর থেকে আম্মুকে আর কোনদিন কোনো খেলনা কিনে দেবার জন্য ম্যানেজ করতে পারিনি। কদিন পর অবশ্য খেলনার সখ-ই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনা ৩
এটাও আগের-টার মতই, তবে একটু সংক্ষিপ্ত। একবার আম্মুর চিরুনী নিয়ে খেলতে খেলতে কিভাবে জানি সেটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। আমি আবার ছোটবেলায় অতি ধীরে ধীরে কথা বলতাম (এখনো একটু একটু মনে করতে পারি আমার সেই স্লো ডায়ালগ থ্রোয়িং এর ধরণটা), খালারা বলত রবোটের মত কথা বলি। তো যা বলছিলাম, চিরুনী ফেলে দেবার পর আমি গুট গুট করে আম্মুর কাছে এসেছি। আম্মু তখন খুব সম্ভবত বড়ফুপির সাথে কথা বলছিল। আমার দিকে তাকালে আমি বলা শুরু করলাম (বুলেট টাইম এক্টিভেটেড): “আম্মু, আম্মু, আমি না, তোমার চিরুনীটা না, জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি… এখন কি হবে?”
আমার আম্মু অনেকক্ষণ ধরে আমার কথাটা শুনল, তারপর ঠিক আমার মত করেই বললঃ
“এ-এ-এ-খো-ও-ও-ও-ন??? এ-এ-এ-এ-খো-ও-ও-ও-ন পি-ই-ই-ই-টু-উ-উ-উ-উ-নি-ই-ই-ই হ-অ-অ-অ-বে-এ-এ-এ…… ” :))
এর পর অবশ্য পিটায়নাই… বাইচা গেসি মাইর থেইকা! :tuski:
কিছু স্মৃতি, কিছু আবেগ, কিছু ভালবাসা
প্রথম যেদিন ক্যাডেট কলেজ থেকে বাসায় ফিরি, সেদিন আম্মুর আমাকে দেখে আবেগে কান্নাভেজা চেহারা আমার ছোট্ট হৃদয়টাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। আম্মু আমাকে গেটের কাছেই অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে হু হু করে কেঁদেছিল; মনে পড়লে এখনো জানি কেমন কেমন লাগে।
ছোটবেলায় হারমোনিকা তে ব্লো করে সুর তোলার চেষ্টা করতাম, সেখানে আম্মু সবসময় appreciation দিত। কারেন্ট চলে গেলে যখন বারান্দায় বসতাম, আম্মু বলত “ঐ গানটা বাজা তো… পুরানো সেই দিনের কথা তোল তো… দেখি হায় আপনা দিল তো আওয়ারা গানটা বাজাতে পারিস কি না…” বাজানো শেষ করলে আম্মুর হাততালি শুনতে পেতাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতঃ “আমার সোনা বাচ্চা টা, আমার শাটুলি-কাটুলি টা…” অন্যরকম মজা লাগত।
আমার জীবনের প্রথম এক্যুস্টিক গিটার আমার মা’র দেওয়া, প্রথম ইলেক্ট্রিক গিটার আমার মা’র দেওয়া, দ্বিতীয় এক্যুস্টিকটাও আমার মা’র দেওয়া, আর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় (যেটি বর্তমান) ইলেক্ট্রিক গিটারটাও আমার মা’র দেওয়া। জীবনে যতগুলি গিটার ইফেক্ট প্রসেসর ব্যবহার করেছি সব আমার মা’র দেওয়া। বলতে হবে, আমার মিউজিকে প্রেরণার একটা বিরাট উৎস আমার আম্মু।
আর বেশি কিছু লিখতে পারছি না, যদিও অনেক কিছু লেখার ছিল। সবশেষে বলি, আম্মুঃ তোমাকে আমি সবসময়ই ভালবাসি, শুধু এটা মা দিবস বলে না, সব সময়। শুধু দুঃখ, সেভাবে বলতে পারিনা। আমি তো একটু চাপা স্বভাবের, তুমি তো জানোই, আবেগগুলো কখনোই এক্সপ্রেস করতে পারিনাই। যেদিন ক্যাডেট কলেজে রেখে গেলা, সেদিন হাসিমুখে বিদায় দিয়েছি, চোখের জল ফেলিনি আগে-পরে, কিন্তু একাকীত্বের অনুভবটা বুকের ভেতর ঠিক-ই হানা দিয়েছিল। যেদিন প্রথম ফিরলাম, সেদিন যে তুমি আমাকে ধরে কাঁদছিলে, তোমার সাথে আমিও কেঁদেছিলাম আবেগে, কিন্তু সেই কান্নার শারীরিক কোন বহিঃপ্রকাশ হয়নি। আরো কতবার কত সময় আমি কেঁদেছি তুমি কখনো জানতেও পারোনি। জানার দরকার নেই। মন খারাপ করায় দিতে চাই না তোমার।
… আর কিছু লিখব না, লিখতে গেলে চোখের পানি পড়ে কিবোর্ড নষ্ট হয়ে যাবে, তখন চাইলেও লিখতে পারব না। রুমে একা তো, কেউ দেখবে না; সিরিয়াস রকমের আউটবার্স্ট হতে পারে। কিছু বোঝার আগেই ক্ষান্ত দেই।
সিসিবি’র সকলের মা’দের আমার পক্ষ থেকে মা দিবসের শুভেচ্ছা।
🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আপ্নে দিকি আমার সব পোস্টেই প্রথম...
এক্ষান টিউটোরিয়াল ছাড়েন মিয়া... আম্রাও এক্টু হই-টই!!
সিক্রেট B-)
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
😀
কিছু জিনিস মিলে গেল। যেমন যে কোন কাটাছেড়ার করে ঘরে আসার পর আগে সেটায় ওষুধ লাগিয়ে এরপর ধরে মাইর।
অন্যান্য পোলাপানদের থেকে এই এক জায়গায় আমি একটু আলাদা আমি নিয়মিতই প্রকাশ করি আম্মুকে অনেক ভালবাসি।
লেখা অনেক ভাল ছিল। মা দিবসে আমি কোন লেখা ভাল করে পড়তেই পারি না। চোখে পোকা টোকা পড়ে মনে হয়।
😀
ঐ দেশেও এত পোকা উড়ে??
একদম খাঁটি কথা বলেছ। সহমত...
আমি ইনফ্যাক্ট কাউকেই কিছু প্রকাশ করতে পারিনা। :bash:
আমিও লজ্জা পাই প্রচণ্ড 🙁
আদু অসাধারণ লিখা।সাবাস বেটা!আন্টিকে আমার সেলাম :boss:
আদনান, তুই তো মাত করে দিলি রে............।। আমার চোখ দুটোও ছলছল করে উঠেছে......।
আমাদেরকে অর্থাৎ ক্যাডেটদের কে সেই ছোট বেলা থেকেই মা ছেড়ে থাকতে হয়েছে তাই মাকে নিয়ে আবেগের কোন কথা শুনলেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠে।
এবং এটার জন্য আমাদের বাবা মা রা আমাদের সবচাইতে বেশী আদর করে B-) কিন্তু আবার আমাদের ছোট ভাবে অন্যদের তুলনায়। যেমন আমি শুধু আমিনা আমাদের জাদের বাসা ঢাকায়্ সবার এই প্রব্লেম হয় যে কেউ ৯ টার পর বাইরে থাকতে পারেনা।
আর যদি দেখে ফোন বন্ধ তাইলে তো শেষ 🙁
দুঃখিত আদনান এমন সুন্দর পোস্টে কিছু বলতে পারলাম না বলে । সকল মায়েরা শান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা । সকল মা য়ের চরণে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধার্ঘ্য ।
আদনান ভাই খুবই ভাল লাগলো আপনার লেখা টা।
আদনান, লেখাটা খুব ভালো লাগল।
কখনই মাকে বলতে পারিনা তাকে কতটা ভালোবাসি। অবশ্য না বললেও মা-রা তো সব বুঝে নেন, ওরা তো সবাই অন্তর্যামী।
আমার আব্বার ধারণা আমি আব্বুকে আম্মুর তুলনায় অনেক কম ভালোবাসি 🙁
লেখাটা খুব ভালো লাগলো আদনান।
আন্টি সহ সকল মায়েদের আবারো :salute:
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
সুন্দর হয়েছে লেখাটা। তোমার সিরিজের পরের পর্ব কবে দিচ্ছ?
আমি ভাই যে ক'টা লেখা দিছি কলেজ লাইফে ম্যাগাজিন বা দেয়ালিকায়, কবিতা আর সায়েন্স ফিকশন ছাড়া কিছু নাই। এই ফাস্টাইম প্রেমের গল্প লিখতেসি। এসব তো আমার ধাতে নাই, তাই ফিলিংস আইনা আইনা লেখা লাগতেসে; একটু দেরি হইতেসে বস্!
চিন্তা কইরেন না, আয়া পড়বো তারাতারি ইনশাল্লাহ।
আপনারে নিয়া একটা পোস্ট দেওনের ইচ্ছা আছে। 😛 😛 :))