নীল ছবি

১৯৯৮।
টাইটানিক নামের একটা ইংরেজি সিনেমার নাম খুব শোনা যাচ্ছে তখন। বিল্লাহ বলত এই ছবিতে নাকি অনেক ”সীন” আছে। ”সীন” বোঝার অবস্থা তখনো আমার হয় নি। ছবিতে মাঝে মধ্যে নায়ক নায়িকার হাত ধরাও আমার কাছে কম্পিউটারের কারসাজি! হাত ধরাই অনেক কিছু। এর চেয়ে বেশি কিছু হলেই মাথা আপনা আপনি নিচু হয়ে যেত। কখনো কখনো দেখেও ফেলতাম। রাস্তার পাশে স্টুডিওতে কোন হিন্দী নায়িকার উদার কোন ছবিতে মাঝে মধ্যে চোখ পড়ে যেত। বুকের মধ্যে অদ্ভূত সে শব্দ তখন মাত্র জানান দিয়ে উঠছে… আমি আসছি।
তখন আমাদের স্কুল বাস করে বাড়ি ফেরার দিন। একটা মাইক্রোবাস। কোন কোনদিন পেছনের অংশে মেয়েরা আর সামনের ভাগ ছেলেদের জন্য। আবার কখনো এর উলটো। এই সিটে বসা নিয়ে কিংবা অন্য কোন কারণে ছেলেদের আর মেয়েদের মধ্যে খুনসুটি লেগে থাকত। খুনসুটি তো নয়! তখন সে রীতিমত ঝগড়া-ই ছিল। গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়ে রাঁধুনী হয়ে যাওয়া মেয়েরা আজ ক্লাসের সবাইকে হয়ত রান্না করে খাইয়েছে। স্কুলের গাড়ি মুরাদপুর সিগন্যালে থামলে ইমরান ঠিক ঠিক মুখ দিয়ে একটা শব্দ করবে। বলবে…
– আজকে কী খাওয়াইল? এখন তো বমি আসতেছে।
এই কথায় পেছনের সীটে বসে থাকা কেউ- হয়ত আফরিন, হয়ত নাবিলা খেপে উঠত। বমি আসলে নিজেরা রান্না করে খাও না! ঢং করার কী দরকার?
এরপর বিল্লাহ বলত…
– আমরা রান্না করতে যাবো কেন? আমরা কী গার্হস্থ্য বিজ্ঞান পড়ি? আমরা কী রান্না শিখি?
হয়ত আফরিন- হয়ত নাবিলা অথবা অন্য কেউ থামতো না।
– তোমরা তো কৃষি শিক্ষা পড়। চাষ কর না ক্ষেতে গিয়ে… হি হি হি।
কী সেই হাসির গুণ! অকারণেই হয়ত। বড় মাপের কোন কৌতুক হয়ত হয় নি। তবুও হাসো। হাসতে হাসতে স্কুল বাসের কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দাও। আমরা এক কোণায় চুপ করে বসে থাকা মুখচোরা ছেলে কিংবা ঐ যে পেছনে গুটি মেরে থাকা মেয়েটা – আমরাও হাসির ভাগ নিই। এমন অকারণ হাসি দেখতেও তো আনন্দ- মাইরি!

বাস ছুটে যায়। ডিসি হিল – মুরাদপুর- ষোলশহর। টাইগার পাস। পাশে সারি সারি পাহাড়। আমার – আমাদের নাকে চোখে পাহাড়ের গন্ধ। এরই মাঝে একসময় বিল্লাহ টাইটানিকের গল্প শুরু করে। বড় অদ্ভূত সে গল্প! বিল্লাহ কণ্ঠ নীচু করে বলে…
– এই ইমরান টাইটানিক দেখছিস?
বিল্লাহ্‌র কণ্ঠে এমন আকর্ষণ থাকে! আমাদের কান আপনা আপনিই খাড়া হয়ে যায়। ইমরানও ধৈর্য্য দেখায় না তেমন একটা। অদ্ভূত সেই গল্প শোনার জন্য বিল্লাহ্‌র প্রশ্নের পিঠেই সে উত্তর দিয়ে দেয়।
– না না দেখি নাই। কী দেখলি?
বিল্লাহ গল্প শুরু করে। ও’র বড় ভাইয়া টাইটানিক সিনেমার সিডি ভাড়া এনেছে। একদিন – বড় ভাইয়া যখন বাসায় ছিল না- ও একা একা সেই সিডি দেখেছে। বিল্লাহ্‌র কণ্ঠ আরো নীচু হয়ে যায়। এসব গল্প মেয়েদের শুনতে দেওয়া যায় না।
– বুঝলি! নায়িকার সব দেখায়!
– সব মানে! ইয়ে ও?
কেউ মুখ ফুটে আর বলে না। ‘ইয়ে’ ‘ইয়ে’ই থেকে যায়। বিল্লাহ হঠাৎ করে ব্যাগ থেকে বের করে আনে সিডি। টাইটানিকের সিডি। আমরা অবাক হয়ে সেই সিডির দিকে তাকাই। এর ভেতর লুকিয়ে আছে একটা অদ্ভূত কিছু। বিল্লাহ দাঁত বের করে বলে…
– কে নিবি? হাত তোল।
– তোর বড় ভাইয়া কিছু বলবে না?
– চুরি করছি। কিভাবে বুঝবে?
কেউ হাত বাড়ায় না। কারো বাসায় সিডি প্লেয়ার নেই। কারো আব্বু আম্মু দেখে ফেলবে। আর কারো হাত বাড়াতে লজ্জা হয়। বাস ছুটে যায়। পাহাড়ের পাশের রাস্তা বেয়ে। হঠাৎ পাহাড়টাও যেন হারিয়ে যায়। আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছুটতে থাকা একটা মাইক্রোবাসে বিল্লাহ্‌র ব্যাগের সিডিটায় আমাদের মন আটকে যায়।

প্রতিদিন স্কুল বাসে- টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের মাঠে বিল্লাহ্‌র সে গল্প বারবার শোনা হয়। আড়াল করে সেই সিডির কাভারও দেখা হয়। মাঝে মাঝে বিল্লাহ্‌র গল্প বিশ্বাস করতে পারি না। যা! সেটা কী সম্ভব! লজ্জা নেই বুঝি! তবুও বিল্লাহ যখন টাইটানিকের গল্প শুরু করে আমরা কান পেতে দিই। রহস্য আরো গাঢ় হয়।

এবং একদিন রহস্যের সমাপ্তি হয়। অথবা রহস্যের শুরুও বলা যায়।

সেদিন ছিল কম্পিউটার ক্লাস। এক গ্রুপে তেরো চৌদ্দ জন। চারজন মেয়ে। বাকীরা ছেলে। কম্পিউটার রুমে আমরা বসে আছি। স্যার আসে না। ইমরান একসময় বিল্লাহ্‌র দিকে তাকায়। বিল্লাহ বুঝে যায়। ব্যাগ খুলে সে সিডি বের করে।
– দেখবি নাকি?
আমরা হ্যাঁ না কিছু বলি না। যার অর্থ- হুঁ দেখব। বিল্লাহ আড়চোখে মেয়েদের দিকে ইশারা করে। ওরা থাকলে দেখবি কীভাবে? কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা হয়। কিন্তু মেয়েদের কম্পিউটার রুম থেকে বের করে নেয়ার কোন উপায় কারো মাথায় আসে না। এবং – অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- মেয়েরা থাকুক- কম্পিউটারের মনিটরটা একটু এদিকে ঘুরিয়ে নেয়া হবে।
বিল্লাহ সিডিটা চালু করে। আমরা কাঁপা কাঁপা বুকে অপেক্ষা করি। বার বার দরজার দিকে চোখ চলে যায়। যদি স্যার চলে আসে। স্যার যদি দেখে ফেলে। আব্বু আম্মু জেনে যাবে। তবুও এ টান তুমি অগ্রাহ্য করতে পারবে না। সিনেমা শুরু হয়ে যায়। নীল ছবি।

– দাঁড়া টেনে দিই। পুরা ছবি তো আর দেখা সম্ভব না!
এরই মধ্যে চারজন মেয়ের মধ্যে দুজন বিচ্ছু কথা বলে ওঠে। ধরা যাক। আফরিন আর নাবিলা। আফরিন বলে…
– কী কর তোমরা?
বিল্লাহ দাঁত বের করে দেয়।
– সেটা জেনে তোমরা কী করবা। আমরা সিনেমা দেখতেছি। তোমরা রান্না কর!
– ওমা! স্পীকার ছাড়া সিনেমা দেখবা কীভাবে?
– আমাদের ইচ্ছা।

কথার ফাঁকে বিল্লাহ ফরোয়ার্ড করে সেই অংশে চলে যায়। হঠাৎ একসাথে আমাদের চোখের সামনে সেই অদ্ভূত দৃশ্য এসে যায়। আমরা সেই দৃশ্যে চোখ স্থির করে রাখতে পারি না। কেমন যেন লাগে!
বুকের মধ্যে একটা শব্দ হয়! কার যেন আগমনের পদধ্বনি!
একটা মেয়ে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। সামনে বসে একটা ছেলে সেই মেয়েটার ছবি আঁকছে। আর কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে আসা সেই ছবি দেখে কয়েকটা ছেলে হা করে তাকিয়ে আছে। একবার শেষ হলে সেই দৃশ্য রিওয়াইন্ড করা হচ্ছে। আবার দেখা হচ্ছে।

……………………………………….

চট্টগ্রামে গেলে এখন প্রতি সন্ধ্যে বেলা জিইসি মোড়ে যাওয়া হয়। বাটা গলির উলটো দিকে টং’এর সামনে বসে আড্ডা চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেবার এরকম এক সন্ধায় বসে আছি। দেখি এক ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝারী ধরণের চুল। কাঁধে ব্যাগ। চোখে চশমা। সন্ধার অন্ধকারে সে চশমা’র পাওয়ার সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখটা কেমন চেনা চেনা মনে হয়। আমি এগিয়ে যাই। এবং তিন ফুট দূরে এসে হঠাৎ করে চিনে ফেলি ছেলেটাকে…
– বিল্লাহ না? কী খবর?
– তুই?
টং এ বসে অনেক কথা হয়ে যায় বিল্লাহ্‌র সাথে। আমি বিল্লাহ্‌র দিকে সিগারেট এগিয়ে দেই। বিল্লাহ নেয় না। সেই স্কুল বাসের গল্প হয়। সেই স্কুলের গল্প হয়। পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সেই স্কুলটা। বিল্লাহ অনেকের কথা বলে। আবার অনেকের কথা বলতে পারে না। নাবিলা’র বিয়ে হয়ে গেছে- ইমরান এইচএসসি’র পরই মালয়োশিয়া চলে গেছে। আমি সেই মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করি। নাবিলা’র বিয়ে হয়ে গেছে! ও না এতটুকুন ছিল!
একসময় টাইটানিকের গল্পটা মনে পড়ে। আমি বলি। বিল্লাহ লজ্জা পায় যেন। জিইসি মোড়ের টং এ বসে দশ বছর আগের সেই মুখটা মনে করার চেষ্টা করি।

হঠাৎ করে আমার আবার দশ বছর আগে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কম্পিউটার রুমে বসে ”টাইটানিক” নামের সেই ”অসভ্য” ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করে। সেই লজ্জায় ডুবে যাওয়া চোখ দুটি ফিরে পেতে ইচ্ছে করে!

৩৮,৮৫৭ বার দেখা হয়েছে

৬০ টি মন্তব্য : “নীল ছবি”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আহারে আগে কি সোন্দর দিন কাটাইতাম 🙁 🙁 🙁


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    কলেজ থেকে বের হবার কিছুদিন আগে মেজর ম্যাক্সের বদৌলতে "টাইটানিক" দেখছিলাম - ছবি আঁকার অংশ বাদে 🙁 😛 । এ্যাডজুট্যান্ট স্যারও আমাদের সাথে টাইটানিক দেখছিল।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. সিসিবিতে সবাই লেখা পুরোনো হয়ে গেলে তারপর দেয়। 🙁
    কি আর করা :((

    একদিন সব ক্যাডেটরা সিসিবিতেই সবার আগে লেখা দিবে, সেই দিন দেখার আশায় আছি।

    মহিব, তুমি খুব ভালো লিখো।

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    তোর লেখা তো বারবারই পড়া যায়। আবারও পড়লাম। অবশ্য নস্টালজিক হতে পারি নাই। কারণ আমার জীবনে এরকম কোন ঘটনা ঘটে নাই। তবে তোর নস্টালজিয়াটা ধরতে পেরে খুব ভাল লেগেছে।
    এখানে নতুন গল্প দেয়া শুরু কর।

    জবাব দিন
  5. সুইন্না আবারও ফিলিংস আহে
    মনে হয় হেই সময়ই ভালো সিল .......................
    গাড়ির পিসনের সীট..........নাবিলা ....আফরিন...বিল্লা..ও আরো একজন .
    আমি কখনই ছিলামনা .................
    যেমন এখনো নাই ..............................................................................

    জবাব দিন
  6. আপনার লেখাটা সত্যি পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়..জীবন টা কি ভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছে আমরা ভেবে দেখিনা কিন্তু যে বন্ধু ছাড়া দিন কাটত না তারা আজ কত পর..বেশির ভাগ কথায় আছে তার হদিস নেই ..আপনারা ছেলেদের তাও নিজস্বত্ত বদলায়না কিন্তু আমরা মেয়েদের কথা ভাবুন তো ....

    রবি ঠাকুর এর দুটো গান ই আমায় কাঁদায় ..
    এক - পুরানো সেই দিনের কথা , আরেক - দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলোনা

    জবাব দিন
  7. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    এমন একটা শিরোনাম দিছ মামা..... :grr:
    দৈনিক ১০/২০ জন দুষ্ট লোক গুগ্লিং কইরা আইসা তোমার লেখা পইড়া যায়.... 😉
    ভাবতেছি আমার নেক্সট পোস্ট এর শিরোনামও এই টাইপ কিছু দিমু :grr:

    জবাব দিন
    • রেজওয়ান (৯৯-০৫)

      Search Engine Terms

      These are terms people used to find your blog.
      Todayখোঁজ করুন Views
      মাল 10
      cadetcollegeblog 9
      নীল ছবি 3
      bns madhumati 3
      ছবি 3
      ক্যাডেট কলেজ ব্লগ 2
      জননিরাপত্তা 2
      রসময় গুপ্ত 1
      ধাধা 1
      abul kalam azad rajakar 1

      গতকালখোঁজ করুন Views
      মাল 30
      ছবি 30
      প্রেমের গল্প 11
      রসময় গুপ্ত 8
      cadet college blog 8
      বৌ 6
      বলে 4
      নীল ছবি 4

      :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz:
      মাইনষেরা এত্ত খারাপ ক্যান :pira:

      জবাব দিন
  8. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    যার যা খুশি ভাবুক, বলতে দ্বিধা নাই। সে সময়ে্র সেই দু্রদমনীয় শিহরনটাও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। 🙂
    লেখা অত্যন্ত সাবলীল ও পরিমিত,তবে শেষ করতে চাওয়ার তাড়াহুড়াটা না থাকলে আরো ভাল হত। সিরিজ লেখা পড়ার আশায় থাকলাম।

    জবাব দিন
  9. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমি আবারো নীল ছবি পড়লাম।
    আমি ও নীল ছবি শিরোনামে একটা লিখা লিখতে চাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।