ঋণ শোধের প্রহর

একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকে গল্প শুনতাম তৃষ্ণা ভরা বুক নিয়ে, পাঠ্য বইয়ের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পড়তাম জানার জন্য, অবজেক্টিভ প্রশ্ন উত্তর করার জন্য নয়।
জেনেছি, বুঝেছি, শুনেছি। মনে মনে কত ভেবেছি যদি আরেকবার এমন একটা অবস্থায় এসে বাংলাদেশ দাঁড়ায় তবে বুক চিতিয়ে লড়াই করবো।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়টা ছিল গৌরবের আর স্বাধীনতার অপেক্ষায় প্রহর গুনবার। সেই গৌরব আর স্বাধীনতা আমাদের মাটিতে এসেছে, আমরা ভোগ করেছি এবং করছি।
তবে সেই মুক্তিযুদ্ধের কান্না আর কষ্টের গল্পগুলো শুনতে ও অনুভব করতে আমাদের বরাবরই অস্বস্তি। আমরা নির্বিকার হয়ে পাঁচ বছর দেখেছি ধর্ষক আর খুনি রাজাকারেরা জাতীয় পতাকা খচিত গাড়ি নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে হুট করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে ভাষণ দিচ্ছে।
আমাদের গায়ে হয়ত লেগেছে, লেগেছে বলেই দাবী এসেছে যুদ্ধাপরাধী বিচারের। বিচার শুরুও হয়েছে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিলাম, দিন গুনছিলাম বাংলাদেশের রক্তের ঋণ শোধ করবার।

রাজাকার কাদের মোল্লার বিচারের রায় জাতির জন্য বড় একটি ধাক্কা। এই ধাক্কা কতজন সহ্য করতে পেরেছেন জানিনা। আমি পারিনি। আমি গিয়েছিলাম শাহবাগে প্রতিবাদ করতে। মনের কোন এক কোনে এখনও বিশ্বাস করি রাষ্ট্র আমাদের। আমারাই রাষ্ট্রের কাঁচামাল।
এই প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত, এই প্রতিবাদ আপনার আমার সকলের। আপনি যদি মনে করেন ফেসবুকে কাভার ফটো আপলোড করে, শাহবাগের ছবি শেয়ার করেই আপনার দায়িত্ব শেষ তবে আপনার প্রতি আমি শ্রদ্ধা হারাচ্ছি। অন্যায় সে সহে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যার জিহবা জড়, আমার কাছে সে জীবিত থেকেও মৃত। এই রাষ্ট্রের খেয়ে পরে যদি রাষ্ট্র নিয়ে আপনার মাথা ব্যথা না থাকে তবে আপনার উচিত বড় একটি সিরিঞ্জ কিনে আনা এবং নিজের শিরায় বিশাল একটি বায়ুর বুদবুদ ঢুকিয়ে মৃত্যুবরণ করা। কারণ আপনার মতো আকাঠ- অপ্রয়োজনীয় আগাছার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের কিছুই আসে যায় না।

জীবনে বাঁচতে শেখা একটি বড় শিক্ষা। এই বাঁচা যেন পরগাছা হয়ে বাঁচা না হয়। আপনি তরুন, পড়াশোনা করছেন, তাই বলে আপনার জগত পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ যদি হয়ে থাকে তবে আপনি কোন শিক্ষার্থীর মাঝেই পরছেন না। আপনার চেতনায় যদি রাষ্ট্র না থাকে, যদি আপনার ধ্যান ধারণার বারান্দায়ও আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবকে জায়গা না দিতে পারেন তবে বলা চলে আপনার শিক্ষা বৃথা। আপনার সনদ পত্রগুলো পুড়িয়ে শেখ সিগারেট ধরাতেও আমার আপত্তি থাকবে না।

মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি নয়, কোন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নয়। মুক্তিযুদ্ধ আপনার আমার সবার। খুঁজে দেখুন আপনার পরিবারেও হয়ত রয়েছে কোন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি রাজনীতি অথবা জানের পরোয়া না করেই যুদ্ধে গিয়েছেন। তারা যদি দেশকে স্বাধীন করে আনতে পারেন রনক্ষেত্রে যুদ্ধ করে আপনার পারা উচিত তাদের রক্তের মর্‍্যাদা আর চেতনা সমুন্নত রাখা।

আপনি প্রেমিক- প্রেমিকাময় আপনার জগত, প্রেমিকার আঁচল রিক্সার চাকায় আটকে গেল কিনা সেই চিন্তায় আপনার কপালের চামড়া কুচকেই থাকে সর্বক্ষন। প্রেমিকা মন খারাপ করে না খেলে আপনিও খেতে পারেন না।
অথচ কারো না কারো প্রেমিকা, স্ত্রী, বোনকে ধর্ষন করেছে পাকি সেনাবাহিনী, ধর্ষনের পর কেটে রেখেছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। রাজাকারেরা ধরে নিয়ে জমা দিয়েছে ক্যাম্পে, তারাও করেছে নির্বিচারে ধর্ষন। সেই ভারি আর্তনাদ আপনাকে কেন একবারও নাড়ায় না? কেন আপনি জাতির এই বীভৎস ইতিহাসকে ভালগার, হরর বলে না পড়ে গুটিয়ে রাখতে চান? কেমন প্রেমিক আপনি? কেমন সন্তান আপনি? কেমন ভাই আপনি?

আপনি কিভাবে পারেন স্টেডিয়ামে গালে কপালে পাকিস্তানের পতাকা একে উল্লাস করতে? আমি আপনার সামনে আপনার ধর্ষিতা বোনের অন্তর্বাস নিয়ে উল্লাস করলে আপনার কেমন লাগবে? একটুকুও খারাপ লাগবে না?
যদি না লাগে, তবে আপনার চামড়া আমার কাছে অর্থহীন। আপনার গালের চামড়ায় বানানো স্যান্ডেল পরে টয়লেটে যেতেও আমার আপত্তি আছে।

মানুষ হিসেবে আপনার মাথা উঁচু করে বাচার দরকার, নীচু করে নয়। আপনার কথা আপনি বলবেন, সবার সামনে বলবেন। আপনিও আসবেন সবার সাথে সবার মাঝে, সবাইকে নিয়ে, আপনাকে দেখে আমরা আন্দোলিত হব, আপনার উপস্থিতি আমাদের জাগাবে প্রেরণা।

আজকের শাহবাগের আন্দোলন একটি নতুন ইতিহাস, শাহবাগ কোন রাস্তার মোড় নয়, বরং শাহবাগ এখন জনগণের প্রতিরোধের মুক্তমঞ্চ।
মশাল হাতে আপনি যখন রাজপথে স্লোগান দিচ্ছেন, আপনি তখন কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন আপনার মন থেকে, আপনার চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে। আপনি সতীর্থ হচ্ছেন আপনার মতো আরও অনেকের সাথে।
আগুন হাতে আপনি আর ঘরের সোফায় বসে খবর দেখে হাই তোলা আপনির মধ্যে হাজার হাজার মাইল তফাৎ। মিছিলের আপনিই প্রতিবাদী আপনি, সেই আপনির কারনেই মুক্তিযোদ্ধারা কান্না ভেজা গলায় মাইকে বলে ফেলে ” এই তরুন সমাজের জন্য আরেকবার জীবন হাতে নিতে আপত্তি নেই”
তখন আপনার কি মনে হয় না সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কানাকড়ি হলেও আপনি শোধ করতে পারছেন?

৭৪২ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “ঋণ শোধের প্রহর”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শাহবাগের বিস্ফোরণ অবিশ্বাস্য ঠেকছে!
    ভেতরে ভেতরে সবাই কি পরিমাণ ঘৃণা লালন করছিলো সেটা আজ এক্কেবারে প্রকট।
    এ জায়গা থেকে নতুন নেতৃত্বের একটা শুরু হয়ে যেতে পারে, না কি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে!
    শাহবাগ নিয়ে সিসিবিতে একটা ছবিব্লগ পেলে ভালো হতো।
    খোলামেলা আলোচনাও হওয়াও দরকার।

    সিসিবি যেন বড্ড ঝিমিয়ে আছে এমন সময়ে।

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আলী রেজা ভাইয়ের কবিতা ফেসবুক থেকে:

    কবিতার শক্তি তুমি দেখনি কসাই
    এখন সমূদ্র গর্জে শাহাবাগ স্কোয়ারে
    শত শত বর্ণমালা উত্তাল ঢেউ তোলে
    কণ্ঠের কল্লোলে,
    বিলাপ করতে বসেনি অযুত সমূদ্র
    চাই না কোনো করুণা ভিক্ষা
    জিভ টেনে নেবো কেবলাবাদী কসাই
    ছিঁড়ে ফেলবো কণ্ঠনালী ম্যানিলা রোপের ফাঁসে
    কবি মেহেরুন নিসার কসম
    কবিতার শব্দের কসম
    প্রিয়তম পয়গম্বরের কসম
    আমরা আর ঘরে ফিরে যাব না
    আমাদের হাতে কবির চুলের ফিতা টুকটুকে লাল
    আমাদের হাতে কবির চুলের ক্লিপ বেয়নটের চেয়েও বেশি ধার
    আমরা প্রতিটি রাজাকারের গলায় ফাঁসির দড়ি পরাব
    তাদের হৃদপিন্ড খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নোংরা রক্ত ঝরাব
    আমার বোনের ইজ্জতের কসম
    শাহাবাগ মোড়ের কুচকুচে কালো ইস্পাত সড়কে
    আলবদর আর রাজাকারের ফাঁসির মঞ্চ বানাবো

    জোৎস্না মাখা রাত দেখিনা
    দেখিনা উপল চাঁদের ছেনালিপনা
    দেখি ফিঁকে নীল আকাশে অযুত কোটি নক্ষত্রের মাঝে
    আমাদের শহীদদের কাফেলা তাদের অগ্রভাগে
    মুক্তির কবিতা শব্দের পতাকা হাতে
    মা মাগো তাদের রক্তের সাথে বেইমানি করে
    আমারা কি ঘরে ফিরে যেতে পারি

    আমরা ফিরে যেতে পারি
    মোল্লা কাদেরের কাটা মুন্ডু নিয়ে
    গোলাম আযম আর তার রাজাকারদের
    কর্তিত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কপট কল্লা নিয়ে
    মা মাগো তোমায় কথা দিলাম
    পুঁতি গন্ধময় ভাগাড়ে তারা কুত্তার খাবার হবে।

    (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।