সুবর্নের কথাগুলো বরং বলেই ফেলি এবারে।
কবে স্কুলে এসেছে ও, ক্লাস টু, নাকি থ্রীতে, নাকি থ্রীর একদম শেষের দিকে?
কি জানি, মনে করতে পারি না। কিন্তু মনে পড়ে ওর পুরো নামটাই, “আবু ওবায়দা মোহাম্মদ জাফর সাদেক, সূবর্ন”। একবার জানতে চেয়েছিলাম এত বিশাল নামের রহস্য, লাজুক হেসে বলেছিল বাসায় ওর আদরের কথা। সবার আদর, প্রায় সবার কিছু কিছু নাম নিয়ে ওর এই বিরাট নাম।
স্কুলে আমাদের ছেলেদের গ্রুপ ছিল সাকুল্যে মাত্র একটিই। অত ছোট বেলায় আমাদের তো এত চাহিদা আর হিংসা ছিল না, খেলা আর মজা করাটাই ছিল মূল। নিজেদের সবকিছুতো বটেই, দূপুরের বাসা থেকে আনা টিফিনটাও ভাগ করে খেতাম লীচু তলায় বসে। তাই লাজুক লাজুক হাসি দিয়ে সুবর্ন যখন আমাদের একমাত্র ছেলেদের গ্রুপে চলে আসল, ওকে আপন করে নিতে আমাদের একদিন সময়ের পুরোটাও লাগেনি। যদিও আমরা পৌরুষে তখন মহা দীপ্যমান এক একজন, কারনে অকারনে পেশী ফুলিয়ে মেয়ে জাতিদের দেখাই, সেখানে পেশীহীন দুর্বল সুবর্নের এদিকে কোন নজরই ছিল না। তবে এই অমিল টুকুও সেই ছেলেবেলায় নির্মল আনন্দ জুটাতো বেশ, সুবর্নকে রাগাতাম আমরা, “দূর তুই একদম মেয়েলি, ছেলেদের মত না, তুই মেয়েদের দলে যা-গা, ছিঃবুড়ি খেল ওদের সাথে।“ সূবর্ন শুধু হাসত, কিংবা রেগে যেত, রেগে গেলে স্বাভাবিক কথা হারিয়ে ফেলত সে, তোতলানো শুরু করত। আমরা ওর তোতলামো দেখে অনাবিল আনন্দে ফেটে পড়তাম।
তবে ওর সবচেয়ে যেটা আমার অপছন্দের ছিল তা হল রাজকন্যার দিকে তার আড়চোখে তাকানো। পিটুনী দেয়ার প্ল্যানও মনে হয় করেছিলাম এজন্য, আরও কয়েকজন মিলে, কারন, রাজকন্যা মনে হয় একটু ঝুকে পড়েই ছিল ওর দিকে। পড়ার মত কারন ছিল অবশ্য অনেক। সুবর্ন স্কুলে আসার পরে, একমাত্র বৃত্তি টেস্ট ছাড়া বাকি সব পরীক্ষায় সে ছিল প্রথম। আমরা জানতাম, স্যারেরা জানতেন এবং জানতেন আমাদের অভিভাবকরাও, সূবর্ন প্রথম হবে পরীক্ষায়, এবং এরপরে বাকীরা। বৃত্তির টেস্টে ইংরেজী ছিল না বলে আমি প্রথম হয়েছিলাম, কিন্তু সব নম্বর যোগ করে গোটা পরীক্ষায় আবার সেই সুবর্নই। সংগে ছিল মুক্তদানার (কেমন যেন সেকেলে মনে হয় এই উপমাটা ওর সামনে) মতো হাতের লেখা। এরকম সুন্দর হাতের লেখা কি কারও হতে পারে! অবশ্য এটা আমাদের ততটা অবাক করেনি সেই সময়, কারন মনে হয় আমাদের সেটা বুঝার মত বয়সই হয়নি। তবে স্যারেরা তো আর অবুঝ নন, তাই যিনিই প্রথম তার হাতের লেখা দেখতেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন, যতটা না লেখার দিকে আর চেয়ে বেশি সুবর্নের দিকে। আর সুবর্ন, বরাবরের মত লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নামিয়ে নিত।
ঠিক কি অবস্থায় সুবর্ন পুলিশ লাইন ছেড়েছিল মনে নেই। তবে সে বৃত্তি পরীক্ষার কিছুদিন পরেই চলে গিয়েছিল জেলা স্কুলে। ক্লাস ফাইভ শেষ করে যখন আমিও সিক্সে সেখানে ভর্তি হলাম, তখন সূবর্নের প্রায় একবছর হয়ে গেছে ওখানে, এবং সেই অর্থে আমার যাকে বলে “গার্ডিয়ান””। আর গুরু যেহেতু, কিছু দায়িত্ব তো চলেই আসে আপনা থেকে। তখন, একটু বড় হয়েছি বলেই বোধহয়, দল হয়ে গেছে অনেক, আমি নতুন, এবং ঝগড়া বাধিয়ে দিলাম ওদের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপের একজনের সংগে। আচ্ছামত পিটালাম রাসেলকে একদিন, মেরে বেঞ্চের নীচে শুইয়ে দিলাম একেবারে। চোখের পানি মুছে হুমকি দিল রাসেল “দেখে নেব তোকে”। আমাকে ওদের হাত থেকে বাচালো সুবর্ন। খুব চুপচাপ শান্ত ছেলে ছিল একজন, ভালো ছাত্র, আমার ওকে খুব ভাল লেগে গেল। বললাম সুবর্নকে, “ঐ ছেলেটা কি ভালো রে, কি চুপচাপ, আর শান্ত””। “আরে দূর ওটাতো লিংকন, এই লিংকন এদিকে আয় তো, এই হচ্ছে রূপম, আর এইটা লিংকন” এই রকম আরও কত টুকিটাকি ব্যাপার। কোন স্যার মহা রাগী, বাসার কাজ করতেই হবে, আর কোন স্যারের ক্লাসে ফাকি দিয়ে গল্পের বই পড়া কোন ব্যাপার না, এইসব দরকারী টিপস পেয়ে গেলাম খুব সহজেই।
সুবর্নের বাবা যে স্বনাম খ্যাত চারন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন এটা জানলাম অনেক অদ্ভুত ভাবে, সাধারন জ্ঞানের ক্লাসে। স্যারের হাটার রাস্তাকে বেজ লাইন ধরে, ডান এবং বামে বসে থাকা ছেলেদের দুটো ভাগে ভাগ করা হয় সেই ক্লাস গুলোতে। এরপর এক গ্রুপ প্রশ্ন করে অন্য গ্রুপকে। সঠিক উত্তর দিতে পারা-না পারা নিয়ে নম্বর, এবং সবশেষে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে জয়-পরাজয়। একটা প্রশ্ন হল এমন, “রংপুরের কোন সাংবাদিক ফিলিপস পুরুস্কার পেয়েছেন”? যাদের উত্তর দিতে হবে সুবর্ন ছিল সেই গ্রুপে, অবাক হয়ে দেখলাম সবাই সুবর্নকে ইশারা করছে, কিন্তু সে সমানে দুইপাশে মাথা নাড়ছে। ক্লাস শেষে জানলাম, সবাই সুবর্নকে ইশারা করছে তার বাবার নামটা উত্তর হিসেবে বলার জন্য, কারন রংপুরের সাংবাদিক এই একটা নামই তারা জানে। কিন্তু সুবর্নের তাতে প্রবল আপত্তি, কারন সে নিশ্চিত নয় তার বাবা পুরুস্কার পেয়েছেন কিনা, কারন “ আরে আব্বু কি এইসব কখনো বাসায় বলেছে নাকি আমাদের? কিভাবে জানব?”
আমিও জানলাম তার বিখ্যাত বাবার কথা, সেই প্রথম। সুবর্নের সংগে প্রথম দেখা হবার প্রায় চার বছর পরে।
ওর সংগে আমার বন্ধুত্বে ছিল শুধু টক আর মিষ্টি। ঝাল কিছু ছিল না। কারন সুবর্ন ঝগড়া করতে পারত না, মারামারি তো নয়ই। ওই যে বললাম, ক্ষেপে গেলে তোতলাতো, আর বেশি ক্ষেপে গেলে মিশতই না আর তাদের সংগে। সোজা এড়িয়ে চলত।
আমি ক্যাডেটে চলে যাবার পর ওর সংগে দেখা হত বিচ্ছিন্ন ভাবে। ছুটিতে একদিন দেখি রেসিং সাইকেল চালাচ্ছে, ঈদে দেখা হল একবার, ওকে পৌর-বাজারে একদিন দেখলাম আঙ্গুর কিনতে, হেসে জানালো “আঙ্গুরে অনেক পুষ্টি আছেরে ব্যাটা”, বাসায় গিয়ে একদিন পেলাম না ওকে, শুনলাম কোচিং এ ক্লাস নিচ্ছে, ফার্মগেটে দেখা হয়েছিল একবার, ও তখন বুয়েটে, আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাবার অফিসে, আর শেষ দেখা হল রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে, কামাল-কাছনা ক্রীড়া সংস্থা আর শক্তি ক্রীড়া চক্র এর ফাইনাল খেলায়। খেলাটা শেষ হয়েছিল মারামারিতে। এর আগেই আমি ওকে আমার ঠিকানা লেখা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার লেখা দেখে হেসে দিল ও, “যা ব্যাটা, তোর হাতের লেখা দেখি সেই ক্লাস থ্রীর মতই, এতটুকুও বদলায়নি””। বলেই আবার সেই মুচকি হাসি।
সেমিস্টার ফাইনাল অথবা পিএল চলছিল তখন আমার। বরাবরের মত পড়াশুনায় বেশ পিছিয়ে আছি, যা টার্গেট করেছি তা থেকে। রাত জেগে পড়েছি বলেই ঘুমটা যাচ্ছি যাচ্ছি করেও যাচ্ছিল না। রিপন একটা পেপার এনে জোড়ে জোড়ে পড়ছিল, বুয়েটে ইলেক্ট্রিক্যালের একজন ছেলে আত্নহত্যা করেছে। নামটাও পড়ল জোড়ে জোড়ে। আশ্চর্য্য, এমনটাও হয় নাকি?
হল তো। অন্য অনেকে অনেক কথা বলল, কিংবা, কেউ হয়ত কোন কথাই বলেনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম এর-ওর কাছে, লিংকনের কাছেও, এক সাথেই পড়ত ওরা বুয়েটে। । দূ্র, কি হবে আর এত জেনে। শুনেছি ডঃ এম এ রশিদ হলের যে রুমে ও থাকত, সেই রুমে এখন কেউ আর থাকতে চায় না। খামোখাই ভয় পায় ওরা। সুবর্ন কাউকে ভয় দেখানোর মত ছেলেই নয়। আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমি তো জানি।
বরং আমি বুঝতে পেরেছি, ও হয়ত কারও খুব বিরক্তির কারন হয়েছিল, এবং সে কারনে খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিল নিজেই মনে মনে, আবার যে কারনে এই বিরক্তি আর বিব্রত হওয়া-হওয়ি, সেটাকে হয়ত এড়াতে পারছিল না সে কোন ভাবেই, তাই সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। এটাই হবে।
সুবর্ন ছোটকালে এমনি করত, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সরিয়ে নিত নিজেকে।
পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম খুব একটা মন খারাপ করা ফিনিশিং হবে। কেন যে মিলে গেল না মিললেই ভাল হত। খারাপ লাগছে খুব এখন।
আপনি একটা খুবি খারাপ লোক ফয়েজ ভাই। এতো সুন্দর শুরু দিলেন, মনে হলো সফল একজন মানুষের কথা জানবো। 🙁 🙁
আপনার লেখা এখন থেকে সাবধানে পড়তে হবে। এই সন্ধ্যাবেলাতে এম্নিতেই মন খারাপ থাকে, আপনি আরো খারাপ করে দিলেন।
দারুন লেখা বস।
ধুর ভাইয়া, মন টাই খারাপ হয়ে গেলো।
🙁
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
আমরা তখন বুয়েট এ পড়তাম... কি যে মন খারাপ হয়েছিলো... আজকে আবার সেটা মনে পড়লো
আচ্ছা ভালো ঘটনাগুলো মনে পড়লে সেইরকম মন ভালো হয়না কেন?
অসমভব চমৎকার একটা লেখা , কিন্তু মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।
বন্ধু হারানোর বেদনা এর মধ্যেই আমাকে বেশ কয়েকবার পেতে হয়েছে। আর ভাল লাগে না।
লেখা বরাবরের মত ৫ তারা :clap:
মোনাজাত ভাইয়ের ছেলে আত্মহত্যা করেছিল, জেনেছিলাম কিনা মনে নেই। তোমার অদ্ভূত আকর্ষনীয় লেখায় এমনভাবে তুলে আনলে? বাবা-ছেলে দুজনের অপমৃত্যু! কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
আমার খুব কষ্ট লাগে আন্টি আর চৈতী আপুর জন্য, আজও সাহস হয়নি জানার কেমন আছেন তারা।
তবে লালকুঠিতে তাদের বাসার সামনে যাই প্রায়ই, কারনে/অকারনে। বাসায় প্রাচীর তুলে দিয়েছেন আন্টি।
এই রকম মন খারাপ করা লেখা দিলে আপনার লেখায় আর কমেন্ট করুম না । আপাতত খালি ওয়ার্নিং দিয়া গেলাম ।
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
হুমমম, এই পোলার নাম হইল গিয়া কামরুল। ক্লিয়ার হইছে এইবার।
হায় মৃত্যু...............................................................
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।-
রেলওয়ে ফেরী দিয়ে যমুনা পার হয়ে রংপুর যেতাম। নদীর যে যায়গায় ফেরীর ছাদ থেকে পড়ে মোনাজাতউদ্দীন মৃত্যুবরন করেছেন, সেইখানে গেলেই কেমন গা ছমছম করতো সব সময়। আমার এক ব্যাচমেটের ফুফাতো ভাই ছিলেন তিনি। ওর বাবার কাছে শুনেছি মোনাজাতউদ্দীনের মৃত্যটা তিনি দূর্ঘটনা বা আত্মহত্যা মনে করেন না।
সূবর্ণ ভাইয়ের আত্মহত্যার কথা শুনেছিলাম, সেটাও কষ্টদায়ক ছিলো।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
সুবর্নের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আংকেলের ব্যাপারে, ও বলতে চায়নি।
কি ব্যাপার এই লেখায় কমেন্ট এত কম কেন? ফয়েজ ভাইর লেখায় এত কম কমেন্ট ... মনে হয় ১৭ তারিখ জিটিজি র কারণে সবাই ব্যস্ত।
এখন সারা দুনিয়ায় মন্দার ট্রেন্ড চালু হইছে, বুঝ না 🙂
ধুর! ফয়েজ ভাই মনটা খারাপ করে দিলেন। 🙁
লেখা বরাবরের মতই হৃদয়স্পর্শী। :boss: :boss:
চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো ...... আসলেই এমন হয়? ... অদ্ভুত ...
______
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
যারা লেখাটি পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন বা করেননি, অনুরোধ করব আমার এই বন্ধুটির জন্য মঙ্গল কামনা করতে।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
🙁 🙁
আর কিছু বলতে পারছিনা।
মনটা খারাপ করে দিলেন ভাই 🙁 🙁 🙁 । ধুর
ফয়েজ ভাই, সুন্দরভাবে মানুষের মন খারাপ করানোর জন্য আপনার ব্যান চাই।
সুবর্ণ ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি উনি মাগফিরাত লাভ করুন।